লোকটা আমার দিকে ভাঙাচোরা একটা হাসি নিয়ে তাকাল।
আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। দুপুর একটা থেকে আড়াইটা- এই দুই ঘণ্টা- আমার একার। এই সময় আমি আমার অফিসের পাশে ছোট্ট রুমটায় কাটাই। রুমে একটা ডিভাইন খাটে- আধশোয়া হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকি। সবাই জানে- অতিরিক্ত জরুরী কোন কাজেও এই সময় আমাকে বিরক্ত করা যাবে না।
কিন্তু আমার কোম্পানীতে একদল গাধা কাজ করে। গাধাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গাধা হলো- আমার সেক্রেটারী নিশাত। সে বেছে বেছে এই দেড় ঘণ্টায় আমার সাথে বিভিন্ন জনের এপয়ন্টমেন্ট ঠিক করে। আমি কিছু একটা বলতে গেলে মাথা নীচু করে বলে…
– স্যার- আপনিই তো বলেছেন জরুরী কোন কাজের কথা – এই সময়ে আপনাকে না বলতে। কিন্তু…
এতটুকু বলে নিশাত চুপ করে থাকে আর মাথা নীচু করে মিটি মিটি হাসে। কড়া একটা ধমক দিতে গিয়েও আমি কিছু বলি না। এর ফল হিসেবে- এই মুহুর্তে ফিকে হয়ে আসা ছাই রঙের একটা পাঞ্জাবী পরে- ছাই হয়ে আসা একটা হাসি নিয়ে একটা লোক আমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
– সাজ্জাদ, চিনতে পারছিস?
লোকটার মুখে নিজের নাম শুনে কিছুটা অবাকই হলাম আমি। অনেকদিন কারো মুখে নিজের নাম কিংবা ‘তুই’ ডাক শোনা হয় না। আশেপাশের প্রায় সব মানুষ আমাকে স্যার বলে ডাকে। আমার স্ত্রী আমাকে ‘রাজুর বাবা’ বলে ডাকে।
আমি লোকটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালাম এবং একটা সিগারেট ধরালাম। কিছুক্ষণ পর পর সিগারেট ধরানো আমার বহুদিনের অভ্যাস। সিগারেট ধরিয়ে দুই আঙুলের মাঝখানে রেখে দেওয়া।
লোকটা ছাইরাঙা হেসে বলল…
– কীরে! এভাবে হা করে তাকায় আছিস কেন?
সাথে সাথেই লোকটার এখানে আসার কারণ আমি বুঝতে পারলাম। স্কুল কলেজের কোন বন্ধু টাকা পয়সার জন্য এসেছে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।
আমি মানুষটা কৃপণ না। কিন্তু বন্ধু কিংবা দূরসম্পর্কের আত্নীয়ের পরিচয়ে কারো টাকা চাইতে আসা’র ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ না।
আমি বললাম…
– আপনার নামটা?
ছাই রঙের পাঞ্জাবী পরা লোকটা হেসে উঠল…
– কী আশ্চর্য! আমাকে তুই চিনতে পারছিস না? আমি নীল… চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলের নীল।
আমার ভাসা ভাসা পড়ল। দেবপাহাড়ের নীচের সেই রাস্তা। আমি আর নীল। একই সঙ্গে একটা মেয়ের প্রেমে পড়লাম। দেবপাহাড়ের গলির মুখে বিকেল বেলা দুইজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মেয়েটার নাম কী যেন? শামা কী? মনে পড়ছে না।
– কী ভাবছিস? বসতে বলবি না?
লোকটার কথা শুনে আমি স্মৃতি গুলোকে ছুঁড়ে ফেললাম। স্মৃতি ভারাক্রান্ত হওয়ার মানুষ আমি নই। আমি বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসি। নইলে আমার এতদূর আসা হত না।
আমি লোকটাকে বসতে বললাম না। এই রুমটাতে ডিভাইন খাটটা বাদে আর কোন ফার্নিচার নেই। অতীত থেকে ফিরে আসা নীলের কোন মূল্য- আমার কাছে বর্তমানে নেই। আমি বললাম…
– তুমি আমার অফিসে বস। আমি আসছি।
লোকটা কিছুটা হকচকিয়ে গেল। এসব আমি গায়ে মাখি না। বসে বসে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করার সময় আমার নেই। কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে- নিশাত মেয়েটাতে কড়া করে একটা ধমক দিতে হবে।
অফিসে একটা মেয়েকে দেখতে পেলাম। নীল ভাঙা হাসি হেসে বলল…
– এটা আমার মেয়ে- আসমা।
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম।
– কোন ক্লাসে পড়- তুমি?
মেয়েটা কেমন জড় জড় কণ্ঠে বলল…
– ক্লাস ফাইভে।
নীল আমার সামনের চেয়ার বসল। আমি বললাম…
– তা খবর কী তোমার?
নীল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে বলল…
– চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি ঢাকায়। ঢাকায় তো আমার কেউ নেই। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই।
আমি কথা বাড়ালাম না। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে পাঁচশ টাকার দুইটা নোট বের করলাম। নীলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম…
– চলবে?
নীল সঙ্কোচ নিয়ে টাকার দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে বলল…
– না সাজ্জাদ। টাকা লাগবে না।
আমি একটা ধাক্কা খেলাম। নীল তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেল।
একসময় ধাক্কার ঘোর কেটে গেল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। প্রায় তিনটা বাজে। কয়েকটা জরুরী কাজ বাকী পড়ে আছে…
এরপর নীলের কথা- নীলের মেয়ের কথা আমার মনে রইল না। হঠাৎ একদিন নিশাত এসে আমাকে একটা চিঠি দিল…
– স্যার। আপনার একটা চিঠি আছে।
আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। মেয়েটাকে কতবার বলেছি… আমার চিঠি টিঠি সব তাকে পড়ে দিতে।
– তোমাকে না বলেছি… চিঠিপত্র সব দেখতে।
নিশাত মাথা নীচু করে হেসে বলল…
– এটা অফিসিয়াল চিঠি না স্যার। প্রেরকের নাম লেখা নীল। ভাবলাম আপনার পার্সোনাল কোন চিঠি হবে…
নীল নামটা শুনে আমার আগ্রহ হল। নিশাতের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে খুললাম আমি…
প্রিয় সাজ্জাদ,
আমি মানুষটা মনে হয় পুরনো রয়ে গেছি। নইলে সেদিন তোমার কাছে গেলাম কেন? নইলে প্রায় বিশ বছর পরে তোমাকে তুই করে ডাকলাম কেন?
কয়েকদিন আগে হসপাতালেই আমার স্ত্রী মারা গেছে। আসমা খুব কেঁদেছিল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মেয়েটার মাথায় হাত রাখার শক্তিও আমার ছিল না।
অবাক হয়ে কী দেখছি জানো? এই বিশাল ঢাকা শহরে আমার কাঁধে হাত রাখার কেউ নেই। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে- আমি তোমাকেও আমার মত পুরনো ভেবেছিলাম। সেদিন তোমার অফিসে গিয়েছিলাম- ভেবেছিলাম তুমি আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে সান্ত্বনা দিবে- অনেক আগে দেবপাহাড়ের চূড়ায় বসে যেভাবে কাঁধে হাত রাখতে সেভাবে। আমি ভেবেছিলাম- তুমি আসমাকে কাছে টেনে নিয়ে তার কপালে একটা আদর দিবে…
নীলের চিঠি আমি পুরো পড়তে পারলাম না। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম- পুরনো দিনের মত আমার চোখদুটি ভিজে উঠেছে… অনেক আগে দেবপাহাড়ের চূড়ায় যেভাবে ভিজে উঠত… ঠিক সেভাবে…
(গল্পটি অনেক আগে সচলায়তনে প্রকাশিত)
১.
দারুন। হৃদয় ছোঁয়া।
২.
এই অংশটুকু আমার কাছে একটু দুর্বল লেগেছে শুধু।
আর শেষটা আরেকটু গুছানো হলে গল্পটা দুর্দান্ত।
৩.
এখানে লেখা কমিয়ে দিলে কেনো?
আপনার শুধু একটা অংশ দুর্বল লাগছে? নিজের পুরানা লেখা পড়লে পুরাটাই আমার কাছে হাস্যকর লাগে প্রায়সময়। কিন্তু কোন একটা কারণে আর বদলাইতে ইচ্ছে করে না।
তবুও দিয়ে দিছি লেখাটা। কোন কারণ থাকতে পারে। 🙂
কারণ থাকতে পারে মানে, খুইলা ক? 🙁
মহিবের লেখাতো সমসময়ই সুখপাঠ্য :boss:
ওর 'পূজা' লেখাটা পইড়া এখনো হাসতে হাসতে উল্টায়া পড়ি
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
ভালো লিখছো। আরো লিখো। নিশ্চয়ই পড়বো।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
সানাউল্লাহ ভাই, অনেকদিন লিখছেননা। আপনার লেখাগুলো মিস করছি খুব।
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
সচলায়তনেই গল্পটা পড়ছিলাম। খুব ভাল্লাগছিলো। সে সময় আমাদের শর্ট ফিল্ম বা মিনি নাটক বানানোর খুব ইচ্ছা ছিল। এইরকম কাহিনী আসলেই মহিবরে বলতাম, চিত্রনাট্য শুরু করে দে। এখন অবশ্য জোশ কমে গেছে।
ক্যাডেট কলেজ ব্লগে আবার লেখা শুরু করার জন্য পরিবর্তনশীলরে কোটি কোটি ধন্যবাদ।
তোমার গল্প বলার ষ্টাইলটা পছন্দ হল।
দুপুর একটা থেকে আড়াইটা ,দেড় ঘন্টা
গল্প বলার স্টাইলটা পছন্দ হল।
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
তোর তো দেখি শকুনের চোখ... :grr: :grr:
:shy: 😀
দোস্ত, ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকা সম্পাদনা করতাম তো.....এসে যায় (ইংরেজীর এনায়েত স্যারের মত)
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
বুঝছি। যে ক্যালকুটার দিয়া হিসাব করছিলাম ঐটাতে গণ্ডগোল আছিল। আইজকাল ক্যালকুটারেও ভেজাল। 😀
:))ব্যাপার না
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
ভালো লেগেছে...।
পূজা লেখাটা তাইলে আমাদের সাথেও শেয়ার করো... আমরা ও উল্টাইয়া পড়তাম চাই... 🙂
বস্, সিসিবিতেই আছে, প্রথম দিকে।
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
ওকে...।
ভালো লেগেছে। আরো পড়তে চাই।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"