কাঞ্চনদার গপ্পো: সাইবার ক্যাফে রহস্য।

“বোঝ্। পুরা দুইতলা জুড়ে সাইবার ক্যাফে, অথচ কোন কেবিনে কম্পিউটার নাই।”

কথাটা বলে কাঞ্চনদা হুস হুস করে কয়েকটা দম নেয়। জিহবার একপ্রান্ত হুসহুস করে নেয়া সে দমের ঠ্যালায় ঠোঁট ছেদ করে কিছুটা বেরিয়ে এসেছিল। জিহবা যথাস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে কাঞ্চনদা আমাদের দিকে চোখ বড় করে তাকায়। আমরা কাঞ্চনদাকে দম নেয়া এবং জিহবা ঠিক করার সময় দিই কয়েক মুহুর্ত। তারপর একসাথে চেঁচিয়ে উঠি।

“সাইবার ক্যাফেতে কম্পিউটার নেই মানে? তাহলি কী আছে?”

আমাদের আগ্রহভরা প্রশ্ন দেখে কাঞ্চনদা নিজেকে একটু বাগে আনে। শামসু ভাইয়ের চায়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসতে বসতে চায়ের অর্ডার দেয়। আমাদের দিকে তাকিয়ে ভুরু এক পাশে একটু তুলে নাটকীয় একটা হাসি ছাড়তে ছাড়তে বলে, “চা খাবি তোরা কেউ?”

এটা কাঞ্চনদার স্বভাব। শামসু ভাইয়ের চায়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসে কাঞ্চনদা যখন কোন গল্প বলে, আর আমরা যখন সে গল্পে আগ্রহ ঢেলে দিই, তখন কাঞ্চনদা – সোজা বাংলায় যাকে বলে- নাটক করে। এ না হলে নাকি গল্প ঠিক জমে না। “জীবনটা হলো এ পিওর ড্রামা, বুঝলি। ড্রামার গল্প ড্রামার মত করে না বললে…..”

“সাইবার ক্যাফেতে কম্পিউটার না থাকলে আছে টা কী?” অয়ন চা খাওয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায় না। কাঞ্চনদাও অয়নের প্রশ্নের প্রতি কোন আগ্রহ না দেখিয়ে শব্দ করে চায়ে একটা চুমুক লাগায়।

“কাকা, ডালপুরি দ্যান এদিকে।” ডালপুরির অর্ডার দিয়ে কাঞ্চনদা একটা বেনসন সিগারেট ধরায়। এক কামড় ডালপুরি, এক চুমুক চা আর কয়েক টান সিগারেট- এই আমাদের কাঞ্চনদা। সিগারেটে আয়েশ করে একটা টান দিয়ে, ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অনেকটা আনমনেই কাঞ্চনদা বলে ওঠে, “লাইফ ইজ এ স্ট্রেঞ্জ এনিম্যাল বুঝলি। ভেরি স্ট্রেঞ্জ। ভেবে দ্যাখ্। একটা সাইবার ক্যাফে। দশ বারোটা কেবিন। অথচ কোনটাতেই কম্পিউটার নেই! নট এ সিংগল ওয়ান!”

এতটুক বলে , ডানহাতের সিগারেট বামহাতে রেখে ডানহাতে আরেকটা ডালপুরি নিয়ে মুখে সেঁধে দেয়। ডালপুরির প্লেট আমাদের দিকে ঠেলে দিতে দিতে বলে, “খুব টেস্টি হয়েছে ডালপুরি। চেখে দ্যাখ্।” আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে প্লেটে রাখা ডালপুরি গপগপ করে মুখে পুরে দিই।

“গতরাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোদের ভাবীর সাথে একটু ভালোবাসা করছি, হঠাৎ ফস করে বেঁকে বসলো। ফেসবুকে নাকি একাউন্ট খুলবে। বলে, চিন্তা করো আমাদের দুজনের একটাই একাউন্ট। সবাই দেখছে। আমি ভালোবাসায় ছেদ পড়াতে কিছুটা বিরক্ত হই। বলি, আহা ফেসবুক টেসবুক এগুলো বাচ্চা কাচ্চাদের জিনিস। আমরা যদি ওখানে একাউন্ট খুলে বসি, লোকে কী বলবে?” কাঞ্চনদার গল্প বলা শুরু হয়। আমরা ডালপুরি পেটে চালান করে দিয়ে এ সুযোগে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। বলি, “তারপর?”

“তারপর আর কী। যা হবার তাই হলো। আমার কথা শুনে তোদের ভাবী বলে, কেন পাশের বাসার ভাবীর ফেসবুকে একাউন্ট আছে। আমি কিছু না বুঝেই, গাধার মতো বলে বসি, পাশের বাসার ভাবী তো আর দুই দিন পর পর সাতদিনের জন্য বাপের বাড়ী চলে যায় না। বোঝ্ অবস্থা। তোদের ভাবীকে তো চিনিস, আমার এ কথা শুনে ছ্যাঁৎ করে উঠল। রয়েল বেংগল টাইগ্রেসের চেয়ে জোরে হুংকার দিয়ে ফুঁসফুঁস করতে থাকে। বলে, এক্ষুণি বিছানা থেকে দূর হও।” কাঞ্চনদা ফট করে মুখটা উদাস উদাস বানিয়ে ফ্যালে। দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। “এরপর পায়ে ধরাও বাকী রাখি না। বলি, সরি আর হবে না। বাসায় ইন্টারনেট কানেকশানটা নিয়েই আমরা দুজন ফেসবুকে একাউন্ট খুলব। অবশ্য এতে কোন লাভ হয় না। বরং রয়েল বেংগল টাইগ্রেস চতুর্গুণ জোরে হুংকার দিয়ে ওঠে- তোমার সাথে এক বিছানায় আমি শুতে পারব না”

সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ কাঞ্চনদা রাস্তার এক কোণায় ছুঁড়ে দেয়। এর সাথে বৃহদাকার এক দীর্ঘশ্বাস, “চিন্তা কর। বউকে বিছানায় রেখে ড্রয়িংরুমের সোফায় রাত কাটাতে হলো। গ্রেট ট্র্যাজেডি।”

এরপর কাঞ্চনদা আলুর চপ নিয়ে বসে। আমরা অপেক্ষা করি, গোটা দুয়েক আলুর চপ খেয়ে কাঞ্চনদা সাইবার ক্যাফের কাহিনী বলবে। কিন্তু গোটা দু প্লেট আলুর চপ খেয়ে নেয়ার পরও কাঞ্চনদার কথা বলার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। সুতরাং আমরা বলি, “তারপর?”

“হুঁমমমমম। তারপর আজ সকালে সাইবার ক্যাফেতে যাই, দেখি, বুঝলি এত বড় সাইবার ক্যাফে অথচ একটা কম্পিউটার নাই। শুধু ইয়েতে ভরতি।”

“ইয়ে মানে?” আমাদের চিৎকার শুনে শামসু কাকা ফিরে তাকায়। ফোঁকলা দাঁতে হাসি দেয় একটা।

“নারে আজ আর বলতে ইচ্ছে করছে না। মনটা দমে গেছে। তোদের ভাবী ইতিমধ্যেই বাড়ী ত্যাগ করেছে। ”

“প্লীজ। বলো না কাঞ্চনদা। সেদিনের গল্পটাও পুরো শেষ করো নাই। এভাবে ঝুলিয়ে রাখা ঠিক না।” কাঞ্চনদার মনের মত আমরাও দমে যাই কিছুটা। অয়ন দমে যাওয়া মন নিয়ে সিগারেট টানতে গিয়ে খুক খুক করে কেশে ওঠে।

“ধৈর্য্য ধর্। এত উতলা হলে চলে না। বলব। সব বলব” এ কথা বলে কাঞ্চনদা শামসু কাকার দিয়ে তাকিয়ে হাঁক পাড়ে “কাকা, দুই প্লেট মুড়ি দ্যান”

প্লেট ভরতি মুড়ি সামনে এলে, আমরা ডানহাতের মুঠোয় মুড়ি নিয়ে পেটে পাচার করে দিই। এরপর শুকনো মুখে চিবোতে থাকি।

মুড়ি চিবোতে চিবোতে কাঞ্চনদা বলে ওঠে,

“ডালপুরি খাবি নাকি। ঝালমুড়ির সাথে ডালপুরি। জমবে ভালো।”

৪,৪০৬ বার দেখা হয়েছে

৫১ টি মন্তব্য : “কাঞ্চনদার গপ্পো: সাইবার ক্যাফে রহস্য।”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    মহিব, যে ভাবে ঝুলায়া রাখার অভ্যাস করছো, কোনদিন না জানি পাবলিক ধইরা মাইর লাগায় (হাতের কাছে যদি একবার পাইতাম x-( x-(


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রাশেদ (৯৯-০৫)

    মহিব ঠিক ধরতে পারছি না এইটা কি তোর অন্য কোন গল্পের নতুন ভার্সন????

    অফটপিকঃ আর কতকাল এইভাবে ঝুলায়ে রাখার অভ্যাস চালিয়ে যাবি x-(


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  3. হোসেন (৯৯-০৫)

    একজন লেখকের অন্যতম গুন পর্যবেক্ষনের নিখুত চিত্রায়ন। তাই এখানে কাঞ্চন্দার ভালোবাসাবাসিটা আরেকটু প্রেশাইস্লি ডিফাইন্ড হলে গল্পে কাঞ্চনের হারানোর পরিমান,সোফায় শোয়ার ট্র্যাজিডির গভীরতা আর শেষে রহস্যটার মুলসুত্র সম্পর্কে ভালো ধারনা করা যেত।

    দোস্ত আমিও দেখি আজিজ মার্কেটের কাকস্য কবিকুলের মত কথা কইতেছি 😀 😀 😀 😀

    মুলা ঝুলানির জইন্যে মহিবের ব্যান চাই।

    অফটপিকঃ তুই কি আরো খাট হইছস?


    ------------------------------------------------------------------
    কামলা খেটে যাই

    জবাব দিন
    • মহিব (৯৯-০৫)

      একজন লেখকের অন্যতম গুন পর্যবেক্ষনের নিখুত চিত্রায়ন। তাই এখানে কাঞ্চন্দার ভালোবাসাবাসিটা আরেকটু প্রেশাইস্লি ডিফাইন্ড হলে গল্পে কাঞ্চনের হারানোর পরিমান,সোফায় শোয়ার ট্র্যাজিডির গভীরতা আর শেষে রহস্যটার মুলসুত্র সম্পর্কে ভালো ধারনা করা যেত।

      আগের পার্ট পইড়া আয়। তাইলে বুঝতে সুবিধা হইবো। 😛

      জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ঐ মহিব, দোকানদার শামসু কি "কাকা" নাকি "ভাই"? নাকি কারও কাকা আর কারও ভাই?

    আমি বুঝবার পারছি, তুমি উপন্যাস লিখতেছ একটা, পার্ট পার্ট?

    কি ঠিক কইছি না? 😀

    মহিবিও হইছে, চালায় যাও, তবে তুমি খুব স্লো মুভ করতেছ, ফাস্ট ম্যান, বি ফাস্ট!


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. বরাবরের মতোই চমৎকার লেখা। খুবই প্রাণবন্ত। পড়তে ক্লান্তি লাগে না একদমই।

    যদি উপন্যাস হয়ে থাকে, তাহলে বলার কিছু নেই। শুভকামনা থাকল। চলুক।

    তবে যদি উপন্যাস না হয়, সেক্ষেত্রে পাঠককে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার প্রতিবাদ জানাই।

    জবাব দিন
  6. হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    বরং রয়েল বেংগল টাইগ্রেস চতুর্গুণ জোরে হুংকার দিয়ে ওঠে- তোমার সাথে এক বিছানায় আমি শুতে পারব না

    কাঞ্চনদা মনে হয় জানে না যে মেয়েরা জোর করা পছন্দ করে। (কপিরাইট: যায়যায়দিন) B-)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।