ব্যাকআপ।

– বুঝলি! আমাদের সময় ফেসবুক ছিল না। আমরা ফটো দেখতাম পাতা উলটে। একটা ছবি তুলতে গেলেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হতো। সে জন্যই বোধহয় একেকটা ছবি অমূল্য ছিল। এরকম পাতা উলটোতে গিয়েই তো তোর মাকে আমার খুঁজে পাওয়া। গল্পটা শুনবি নাকি?

– বলো না! কিন্তু একটা শর্ত আছে! ফেসবুককে খোঁচা দিতে পারবে না কিন্তু।

– হা হা হা। ধূর পাগলী, আমি ফেসবুককে খোঁচা দিলাম কই? সব যুগের শৈশব কৈশোর এক হয়? আমি তোর মাকে খুঁজে পেয়েছি সাদা কালো এলবামে। তুই হয়ত তোর মনের মানুষকে খুঁজে পাবি ফেসবুকে! হা হা হা।

– বাবা। যাও!

– আচ্ছা শোন্‌। আমার ছোট চাচা বিয়ের সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না। শহরের কলেজে পড়াশোনা করতে এসেছি। চিঠিতেই সব খবর আসত। তখন তো আর তোদের মত ফোনও ছিল না। মোবাইলও ছিল না!

– আ…বার!

– আবার কী?

– মোবাইল নিয়ে খোঁচা দিলে।

– আহা। খোঁচা দিলাম কোথায়? আমি নিজেই তো মোবাইল ছাড়া একটা দিন চলতে পারব না। হ্যাঁ রে। সেদিন রাতে আমার মোবাইলে একটা ছেলে ফোন দিল। বলল তোর মোবাইল নাকি বন্ধ। কে রে ছেলেটা?

– যাহ! জানি না! এত কথা বলো কেন? তোমার গল্প শোনাও।

– আচ্ছা। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে শুনি, ছোট চাচার বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের খবর জানিয়ে আমাকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন জানি হাতে পাইনি। তাছাড়া ছোটকুর বিয়েটা হুট করেই হয়ে গিয়েছিল। মনটা অবশ্য খারাপ হলো। আমরা বন্ধুর মত ছিলাম। তুই তো তোর এই দাদুটাকে দেখিস নাই। তোর জন্মের দুই বছর আগেই তো বোধহয় মারা গেল। তাই না?

– হুঁ। নাইনটিন্‌ এইটটি ফোরে।

– একদিন ছোট চাচার বিয়ের এলবাম দেখছিলাম। একটার পর একটা পাতা উল্টোচ্ছি। হঠাৎ একটা ছবিতে এসে আমার চোখ স্থির হয়ে গেল। বিয়ের স্টেজে বর কনের ছবি। মুখে রুমাল চেপে বসে থাকা ছোট চাচা, পাশে বিয়ের শাড়ি পরা চাচী। স্টেজের পাশে চোখ বড় বড় করে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পরা। সাদা কালো ছবি। তবুও ঠিক বোঝা হয়ে যায়- ওটা লাল টুকটুকে ফ্রক। কতক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানিস? পাশে ফুলে ফুলে সাজানো বিয়ের স্টেজ। ফুলের বাগানে বর কনে বসে আছে। কিন্তু সমস্ত ফুলের বাগান সেই লাল টুকটুকে ফ্রক পরে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার কাছে কী তুচ্ছ! কী অসহায়!

– তারপর তো তুমি ছবিটা চুরি করলে। তাই না?

– হ্যাঁ! পুরো এলবাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর পেলাম না। শুধু ঐ একটা ছবিতেই তোর মা আছে। পরে জানাজানি হয়ে গেলে লজ্জায় পড়তে হবে জেনেও ছবিটা যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিই। একটা কথা কী জানিস? সেদিন আমি রেণুর ছবি চুরি করেছিলাম ঠিকই- কিন্তু সেই দুপুরবেলা ছবিটা যখন দেখছিলাম ও তো সমস্ত আমাকেই চুরি করে নিল! তারপরের কয়েকদিনে আমার অসহায়ত্ব আমার সমগ্র জীবনের অসহায়ত্বকে হার মানাবে। প্রথমে ভাবলাম নিজের মধ্যেই চেপে রাখি। শুধু ছবিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু তুই তো জানিস। এমন হয় না।

– আমি জানি মানে?

– ঐ যে! ঐ ছেলেটা! কী নাম যেন? ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতিস।

– বা…বা। তোমার গল্প বলো! নইলে আমি উঠে যাচ্ছি কিন্তু!

– হা হা। আচ্ছা বোস। তারপর ছোটকুকে জানালাম। ছোটকুর শ্বশুড় বাড়িতেই রেণুদের বাড়ি। ছোটকুর হাত দিয়ে চিঠি দিলাম। তোদের মত তো আর চাইলেই ফোন নাম্বার যোগাড় করে এসএমএস পাঠিয়ে দিতে পারতাম না। তখন ভালোবাসা মানেই ছিল বুড়ো চিঠি। হা হা হা।

– আবার!

– না আমি এসএমএসকে দোষ দিই না। তবে চিঠি অনেক মহান একটা ব্যাপার। তোর মা যেদিন প্রথম আমাকে চিঠি লিখল সেদিনটা এখনো যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। তখন ও কোন ক্লাসে পড়ত? ক্লাস সিক্সে। কী অদ্ভুত সেই চিঠি! আর কয়েকদিন বাদে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি’র রেজাল্ট বের হবে। বৃত্তি না পেলে ও মারা যাবে! আমি যেন অনেক অনেক দোয়া করি। এক জায়গায় ”আমি তোমাকে ভালোবাসি” লিখে লাইনটা অনেক যত্ন করে কেটে দিয়েছে। এই একটা লাইন লিখে আবার কেটে দেয়া! কী মায়াময় সেই কাটাকুটি খেলা, তুই জানিস? তোদের এসএমএসে তো মনে হয় এই ঝামেলা নেই!

– কী আশ্চর্য! আমাদের এসএমএস বলছ কেন? আচ্ছা বাবা! মা অনেক সাহসী ছিল, তাই না? ফার্স্ট চিঠিতে ঐ কথাটা লিখে দিল?

– হা হা। আমি চালাকি করে আমার নিজের নায়ক মার্কা একটা ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম চিঠির সাথে। কিন্তু প্রথম চিঠিতেই ঐ কথা লিখেছে কে বলল রে গাধা? লিখে আবার কেটে দিয়েছিল না?

– ঐত্ত! একই কথা।

– বুঝলিরে মামণি আজ মনটা এলোমেলো হয়ে আছে। খুব খুব। একত্রিশ বছর ধরে যে ছবিটা যত্ন করে আগলে রাখছিলাম- সেটা আজ চলে গেল!

– কী আশ্চর্য, বাবা! মা’র ছবিটা চলে গেল মানে? আমাকে তো কিচ্ছু বলোনি! কিভাবে?

– মানিব্যাগেই তো ছবিটা ছিল। এখন কী করি বল্‌ তো! পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব, যে মানিব্যাগটা নিয়েছে সে যেন ছবিটা ফেরত দিয়ে যায়।

– এতে কী আর লাভ হবে? তোমাকে কতবার বললাম, মায়ের ছবিগুলো সব কম্পিউটারে স্ক্যান করে রাখি। তুমিই তো দাও না। ব্যাকআপ থেকে যেত। তোমার মন খুব খারাপ, তাই না বাবা! গান শুনবে? ঐ গানটা! আমি গাই?

– বুঝলি রে মামণি। তোদের কম্পিউটারই ভালো। সবকিছুর ব্যাকআপ রেখে দিতে পারিস। মাঝে মধ্যে কী মনে হয় জানিস? যদি কম্পিউটারের সব প্রোগ্রামের মত মানুষের সব স্মৃতির- মানুষের শৈশব কৈশোরের ব্যাকআপ রেখে দেওয়া যেত! মূল কপি হারিয়ে গেলেও অসুবিধা হতো না! আবার মাঝে মধ্যে মনে হয় প্রকৃতিই সবকিছুর ব্যাকআপ তৈরি করে দেয়। নইলে কী আর তোর দিকে তাকালে আমি তোর মাকে খুঁজে পেতাম!

– হুঁ। বুঝছি- আচ্ছা, এবার ওঠো! ওঠো তো! রাত করে ঘুমোলে শরীর আবার খারাপ করবে! আর শোন‌। এখন থেকে প্রতিদিন ভোরে আমি তোমাকে চিঠি লিখব। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে যেন জবাব পেয়ে যাই!

———————————————————–

২২/০১/২০০৯

৪,৫২৭ বার দেখা হয়েছে

৪৪ টি মন্তব্য : “ব্যাকআপ।”

  1. রকিব (০১-০৭)

    আগে একবার সচলে পড়ে নিশ্চল হয়ে গেছিলাম মুগ্ধতায়,
    আবারো মুগ্ধ করলেন।
    মুহিব ভাই বেশি বসসসসসসসসসসসসসসসসসসসস :boss: :boss: :boss:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. ইউসুফ (১৯৮৩-৮৯)
    যদি কম্পিউটারের সব প্রোগ্রামের মত মানুষের সব স্মৃতির- মানুষের শৈশব কৈশোরের ব্যাকআপ রেখে দেওয়া যেত! মূল কপি হারিয়ে গেলেও অসুবিধা হতো না!

    :thumbup: :boss: :dreamy:

    জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    মহিব রে,আমার "ইয়ে"র কথা মনে করতে গিয়া তোর গল্পডার প্রশংসা করা হয়নাই।এক্কেবারে কলিজায় চাক্কু মারা গল্প লিখছস,দিল পুরা গার্ডেন গার্ডেন হো গিয়া...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুবায়ের (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।