গল্প: কালকান্দি গ্রামের মেয়েরা।

( পুরনো লেখা। কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। দিতে কেমন যেন লাগে! তবুও দিলাম। সানাউল্লাহ ভাইয়ের “নারী দিবস” বিষয়ক পোস্ট পড়ে ভাবলাম এই লেখাটা পোস্ট করা যায়। আর পুরনো লেখা দিব না। আর ফাঁকিবাজি না। এই শেষ। 😀 )

কালকান্দি গ্রামের মেয়েরা চৌদ্দ বছর বয়েসে নারী হতো।

শেফু নামের মেয়েটা-
তেরো’র শেষ দিনেও রান্নাবাটি খেলায় ডালে লবণ কম দিয়েছিল বলে
আমরা যার কোঁকড়ানো চুলকে কাকের বাসা বলতাম।
মুন্নি- অলকা- শাহেদা-
যাদের পুতুলের ঘর ধ্বংস করে দিয়ে হাসানুল নদীতে ঝাঁপ দিত- বলতো-
পারলে আমারে ধর দিখি নি।
চৌদ্দ বছরের প্রথম দিন তারা আর এলো না।

আমরা তখনো পুরুষ হইনি-
তাই ঠিক ঠিক দলবেঁধে চলে যেতাম শেফুর জানালায়।
দেখতাম শেফু সেই আগের মতোই আছে।
যৌবনপ্রাপ্তি হয়েছে কিনা- সেটা দেখতে পেতাম না।
চোখের পাতার দুষ্টুমি- এখনো লজ্জাহীন।
হাতদুটোতে এখনো দশটি আঙুল- আলো এখনো সমগ্রতায়।
শুধু দেখা যেতো- সেই কোঁকড়ানো চুল- যাকে আমরা কাকের বাসা বলতাম
যাকে এলোমেলো করতে করতে এত আনন্দ পেতাম যে, কখন তা ভালোবাসা হয়ে যেতো বুঝতে পারতাম না-
তাকে একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

মুন্নি-অলকা- শাহেদারাও আর আসতো না রান্নাবাটি খেলায়।
পাপের শাস্তি হিসেবে হাসানুলের তৈরি করা পুতুলের ঘর তাই-
অক্ষতই থেকে যায়।
ক্রমে ক্রমে আমরা বুঝে যাই-
চৌদ্দ বছরের পরে মেয়েরা ঘরের বাহির হতে পারে না।
এতে কালকান্দি গ্রামের অসুখ হয়।

যদিও-
এতে নদীর জল থেমে থাকে না।
যদিও-এতে আমাদের খেলা ভংগ হয়না একটুও।
যদিও-কালকান্দি গ্রামের পুরনো বটগাছটা এতে
ছায়া বর্ষণ থামিয়ে দেয় না।
সুতরাং-
চৌদ্দ বছর বয়েসে মেয়েরা নারী হলে এমন কিছু আসে যায় না।

বয়েসের সাথে সাথে আমরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাওয়ার অধিকার পেলাম-
বয়েসের সাথে সাথে শেফু-অলকা- মুন্নি- শাহেদা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ঘরে বন্দিনী হলো।

চৌদ্দ বছর বয়সেই শাহেদার বিয়ে হলো।
পনেরোতে শেফুর জানা হয়ে গেলো- ডালে লবণ কম দেয়া নারীর অপরাধ।
ষোলতে মরা বাচ্চা জন্ম দিয়ে অলকা হতভাগিনী।
আর-

স্বামীর ঘর টিকেনি বলে সতেরো বছরে
মুন্নি আজ পরিত্যক্ত।

৫,৪৯৫ বার দেখা হয়েছে

৫৯ টি মন্তব্য : “গল্প: কালকান্দি গ্রামের মেয়েরা।”

  1. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    মহিব, দুর্দান্ত...
    এইটা নারীদের নিয়ে লেখার মধ্যে আমার পড়া অন্যতম টাচিং একটা লেখা... :boss:

    রীতিমত খারাপ লাগতেসে মুন্নি- অলকা- শাহেদা-শেফু'র জন্য...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ধুর ! এই পোলাডারে হিংসা হয় এর মতো লিখতে পারিনা বইলা।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    চৌদ্দ বছর বয়সেই শাহেদার বিয়ে হলো।
    পনেরোতে শেফুর জানা হয়ে গেলো- ডালে লবণ কম দেয়া নারীর অপরাধ।
    ষোলতে মরা বাচ্চা জন্ম দিয়ে অলকা হতভাগিনী।
    আর-

    স্বামীর ঘর টিকেনি বলে সতেরো বছরে
    মুন্নি আজ পরিত্যক্ত।

    অদ্ভুত সুন্দর :hatsoff: :hatsoff: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  4. এহসান (৮৯-৯৫)

    সিসিবি তে আমার প্রিয় লেখক মহিব। আর সচলায়তনে প্রিয় লেখক 'পরিবর্তনশীল'। অবশ্য সিলেট ক্যাডেট কলেজের আমার ব্যাচের অনেকেরই প্রিয় লেখক 'পরিবর্তনশীল'। কিন্তু এই পোলা আমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট এইটা আমি গতমাসে আবিস্কার করেছি।

    যাই হোক ভূতদর্শন গল্পটায় এই মন্তব্য করবো ভেবেছিলাম। ভাই তোমার গল্প বলার ঢং ইউনিক। তোমার কবিতা থেকে অবশ্য আমার গল্পই ভালো লাগে।

    সিসিবি তে আজকাল নিয়মিত লিখছো তাই ধন্যবাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।