আমাদের পাণ্ডুলিপি – ২

আগের পর্ব

……
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় সাদা পোষাক পড়া একজন মানুষ এলেন আমাদের রুমে।
– কেমন আছ সবাই?
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। হিমেলই প্রথমে কথা বলল।
– জ্বী স্যার। ভালো।
সাদা পোষাক পড়া মানুষটা হেসে দিল।
– আমি স্যার না। আমাকে স্টাফ ডাকবা।
আমি খুব মজা পেলাম। মানুষটা আবার বলল।
– আমি ল্যান্স নায়েক কবির। আমি তোমাদের হাউসের স্টাফ।
মোরশেদ হাসি হাসি মুখে বলল।
– স্টাফ। স্টাফ মানে কী?
আমরা সবাই হেসে দিলাম। কে বলেছে বাবা-মাকে ছাড়া থাকা কষ্টের?
আমার আরো ভালো লাগল যখন দেখলাম তানবীনও হাসছে। বেচারা গত কয়েক ঘণ্টা এত কেঁদেছে!
স্টাফ বললেন।
– তোমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না তো! সমস্যা হলে আমাকে বলবা।সাড়ে সাতটায় ডিনারে যেতে হবে। আমি বেশ অবাক হলাম। বাসায় কখনো দশটার আগে ডিনার করেছি বলে মনে পড়ল না। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম। আজ থেকে আমার জীবন নতুন ভাবে শুরু হবে।
আমার। মোরশেদ-হিমেল-দিদার-তানবীন-নিয়ামুল-আখতার সবার।

ডিনারে আমাদের একেবারে একপাশের টেবিলে বসানো হলো। পাশে উঁচু একটা টেবিল। আমরা অবাক হয়ে আশেপাশের সবকিছু দেখতে লাগলাম। হঠাৎ দেখলাম টেবিলে একজন ভাইয়া আসল। তিনি বললেন।
– আমার নাম ইমতিয়াজ। আমি তোমাদের টেবিল গাইড।
ইমতিয়াজ ভাই আমাদের চামচ দিয়ে কিভাবে খেতে হয় শেখাতে লাগলেন। চামচ দিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটায় আমি মোটেই অবাক হলাম না। আমি আগেই শুনেছি- ক্যাডেট কলেজে চামচ দিয়ে খেতে হয়। আমার এক টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম। তাঁর ছেলে ক্যাডেট কলেজে পড়ত। সেই ভাইয়া বলেছে।
একটু পরে দুইজন মানুষ এলেন। ইমতিয়াজ ভাই বললেন-
– বয়েজ। স্ট্যান্ড আপ।
একজনকে দেখলাম- উঁচু টেবিলের মাঝখানে চেয়ারে বসলেন। স্যার হবেন বোধহয়। অন্যজন না বসে আমাদের টেবিলগুলোর সামনে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটার সময় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। হাঁটার সময় কারো জুতোয় এত শব্দ হতে পারে আমার জানা ছিল না।
হঠাৎ বলে উঠলেন…
– হ্যালো বয়েজ। I am major fidah nur. I am ur adjutant. So how are u?
আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলে উঠল ”ফাইন স্যার”। আর বেশিরভাগই চুপ করে থাকলাম। এডজুটেন্ট আবার বললেন…
– যখন কোন প্রশ্ন করব। সবাই একসাথে এনসার দিবা। আর গলায় যেন জোর থাকে। u r not girls…u r boys…ok?
সাথে সাথে অনেকগুলো কন্ঠ ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দের মত একসাথে বলে উঠল…
– ইয়েস স্যার।
– গুড। thats the spirit. from today u r not just anymore students. u r cadets. and cadet means spirit. ok?
– ইয়েস স্যার।
– গুড। now sit down..gentleman. and enjoy ur dinner.

রাতে রুমে অনেক সিনিয়র আসল। তারা আমাদের আমাদের সাথে বেশ হাসি মুখে গল্প করল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে মজা লাগল আশরাফ ভাইয়ের কথা।
– বুঝলি ভাইয়ারা। তোদের ওপর খুব হিংসা হচ্ছে। আমরা চলে যাব সাতদিন পর। আর তোরা আরো ছয় বছর থাকবি।
আমি প্রচণ্ড অবাক হলাম। ছয় বছর এখানে থাকার মধ্যে মজার কী আছে? আশরাফ ভাই বেশ ভাব নিয়ে সিগারেট টানছেন… আর মুখ ভর্তি করে ধোঁয়া ছাড়ছেন। আরো অনেক ভাই আসল। এক ভাইয়া হঠাৎ বলল।
– উপরের এই লাইটটা দেখছ না সবাই।
সবাই তাকালাম। উপর থেকে ঝুলানো একটা লাইট। লাইটটা ঘড়ির কাটার মত দুলছে। আরপর সে ভাইয়া ভয়ংকর একটা কাহিনী বললেন।
বহুবছর আগে কলেজের এডজুটেন্ট ছিলেন- ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। ক্যাপ্টের জাহাঙ্গীর কলেজের সাথে লাগানো রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্নহত্যা করেছিলেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের আত্না নাকি এখনো কলেজে ঘুরে বেড়ায়। নতুন ক্যাডেটরা আসলে ক্যাপ্টেন জাহাংগীর তাদের পেছনে লাগে। এখন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের আত্না আমাদের রুমে। তাই লাইটটা দুলছে।
আমি একটুও ভয় পেলাম না।
হঠাৎ রুমে একজন স্যার আসলেন। ওনাকে চিনতে পারলাম। বিকেলে আমাদের সাথে কথা বলেছিলেন। আমাদের হাউস মাস্টার সহিদুল ইসলাম। স্যার রুমে ঢোকার সাথে সাথে আশরাফ ভাই তার সিগারেটটা স্যান্ডেলের নীচে পিষে ফেলল। স্যার আশরাফ ভাইকে বললেন।
– আশরাফ। ভালো হয়ে যা।

রাত পৌনে এগারোটায় সব বাতি অফ করে দেওয়া হল। আমি বিছানায় একা একা শুয়ে আছি। আব্বু-আম্মু- ছোট ভাই সবার মুখটা চোখের সামনে আসতে চাচ্ছে। আমি জোর করে দূরে সরিয়ে রাখছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম- চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে। মনে মনে বললাম- আম্মু। আমি ভালো আছি। আমার জন্য একদম চিন্তা করো না। আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। ওরা খুব ভালো। আম্মু তুমি ঘুমিয়ে পড়। তাইলে আমি ঘুমিয়ে পড়ব। হঠাৎ পাশের বিছানা থেকে মোরশেদ বলে উঠল—
– কাঁদ কেন? ঘুম আসতেছে না?
আমার খুব লজ্জা লাগল। সত্যিই তো। কাঁদার কী আছে। আমি কী এখন ছোট আছি। চোখের জল শুকাতে শুকাতে – মায়ের মুখটা বুকে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

ক্যাডেট কলেজে আমার প্রথম ঘুম…

(চলবে…)

১,৫০২ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “আমাদের পাণ্ডুলিপি – ২”

  1. "ক্যাডেট কলেজে আমার প্রথম ঘুম…"

    তোর গল্পের পুরোটা সাচ্ছন্দে পড়ে ফেলা যায়। পড়ার সময় কোথাও আটকে যেতে হয় না। সেই সাথে একটা আশা থাকে যে শেষ লাইনটা চরম হবে। সেটা পড়ার গতি আরও বাড়িয়ে দেয়।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : samjhang

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।