গল্পঃ অবলম্বন

“চোখে পানি আসলে কী দিয়ে মুছেন?”

এ প্রশ্ন শুনলে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাতে হয়। প্রায় বৃদ্ধ একজন মানুষ। পরনে আধ ছেঁড়া পাঞ্জাবী, ঢোলা পায়জামা। শীত নেই তবুও কানে মাফলারের মতন করে একটা গামছা জড়ানো। গায়ে এলোমেলো ভাবে নেতিয়ে যাওয়া একটা চাদর বিছানো রয়েছে। কাঁধে বাজারের থলির মতন একটা ব্যাগ। বৃদ্ধ রয়ে যাওয়া কয়েকটা দাঁত সম্বল করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন। যাবো যাবো বিকেলের আলোয়, হালদা নদীর মাঝখানে বয়ে চলা ইঞ্জিন নৌকায় বসে বৃদ্ধের শেষ কটা দাঁত কখনো সাদা ছিল কিনা বোঝা যায় না। আমি একটু হাসার চেষ্টা করি, “আমাকে বলছেন?”

“জ্বী। কইতেছিলাম, চোখে পানি আসলে কী দিয়ে মুছেন?”

কী অদ্ভূত প্রশ্ন!
বৃদ্ধের হাবভাবে অবশ্য সেটা ফুটে ওঠে না। বরং আগ্রহ নিয়েই তিনি আমার দিকে তাকান। আগ্রহ ভরা দু চোখে নাটকের কোন আভাস নেই। আমি আবার হাসার চেষ্টা করি।

“জ্বী, এই তো মাঝে মধ্যে হাতের তালু দিয়ে। আবার কখনো কখনো তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে। কেন? এই প্রশ্ন হঠাৎ!”

“ক্যান। আর কেউ নাই?” বৃদ্ধের যেন হাসি রোগ আছে আমার বোন শান্তার মতো। অথবা মুখটাই অমন, চির হাসির ছাপ পড়া কোন মুখ! আমি বৃদ্ধের শেষোক্ত কথা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করি। খানিকটা কৌতুহলই দেখি যেন সে প্রশ্নে।

“বুঝলাম না।”

“আরে বাবা! কইলাম যে, চোখের পানি মুছে দেওনের কেউ নাই?” বৃদ্ধের এ কথা আমাকে বিস্মিত করে তোলে। বেশ কাব্যিক প্রশ্ন। ‌অথবা কাব্য নয়, পৃথিবীতে হয়তো স্বাভাবিক ভাবে এই প্রশ্নটা মানুষের কাছে মানুষের জানতে চাওয়ার থাকতে পারে। একজন মানুষ সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষকে তার চোখের জলের কথা বলতে পারে!

“কী বাবা। লজ্জা পাইলেন নাকি? এমনি কইলাম। আমার অবশ্য চোখের পানি মুইছা দেওনের কেউ নাই। সুফিয়ার মা আছিল। হে তো সেই কবেই মাটির তলায় ঘর বানাইছে।”

এরপর নীরবতার পালা চলে। এখানে বসে নদীর পাড় স্পষ্ট দেখা যায়। কয়েকটা শিশুর জল ছোঁড়াছুড়ি- পাশে একজন কিশোরীর একা বসে থাকা। আমার শান্তার মুখ মনে আসে। সম্পূর্ণ অকারণে মনে হয়, সুফিয়াও বুঝি কোন ঝিমিয়ে পড়া বিকেলে নদীর জলে পা ডুবিয়ে এভাবে বসেছিল। বৃদ্ধের দিকে তাকাই।

“চাচাজী। সুফিয়ার গল্প বলেন তো।”

বৃদ্ধ সুফিয়ার গল্প বলেন। সুফিয়ার বিয়ের গল্প বলেন। শেষ গ্রীষ্মে যে সুফিয়ার একটা মেয়ে হলো, আদর করে যে সে মেয়েকে বৈশাখী ডাকা হতো, সুফিয়া নাইওর আসলে উঠোনে শীতলপাটি, শীতলপাটির সদর দুয়ার চাঁদের আলোয় ভেসে যেতো, কোলে বৈশাখীর অবুঝ ক্রন্দন, আনাড়ী গলায় সুফিয়ার গান এবং সেইসব মায়াময় রাতের উপসংহারে অন্য মায়াময় দিন- অন্য মায়াময়ী রাত- আমি শুনি। চাচাজীর চোখের এক প্রান্ত ভিজে যায় কি? মানুষ পুরনো হয়- তার সুখ তার কষ্ট কী পুরনো হয়ে যায়- চোখের এক কোণায়? অথবা ফিকে হয়ে আসা পাঞ্জাবীর হাতে?

এরপর পুনরাবৃত্তি হয় নীরবতার। হালদা নদীর এক পাশে পাখিরা ঘরে ফেরার আয়োজন করে। তাদের বাড়ি নদীর অন্যপাশে। একটা পাখি হয়তো শত পাখির ভীড়ে তার সংগীকে খোঁজে। গাছের ডালের বাড়িটায় হয়তো গভীর রাতে খুনসুটি হয়। বাড়ি ফেরার সময় হলো। একলা এ পথ চলা বাড়ি ফেরা মানুষদের বড় বোঝার মতন?
চাচাজী তাঁর মাটির তলায় ঘর বানানো স্ত্রীকে খুঁজে পান বাড়ি ফিরে? অথবা কোন এক বিকেলে নদীর জলে পা ডুবিয়ে একা বসে থাকা সেই উদাসী কিশোরী। সেই সুফিয়া!

নৌকায় যাত্রী বলতে পাঁচ জন। সাথে নৌকার মাঝি, একজন সহকারী। সহকারীকেই মাঝি বলতে হয় সঠিক বলতে হলে। মাঝি সেই ঘন্টা খানেক আগে নৌকার একপাশে শুয়ে পড়েছে। সহকারী ছেলেটা- যে কিনা আসলে মাঝি- সে গান ধরে, “প্রেমের মরা জলে ডোবে না।” কোথায় যেন কষ্টের শব্দ পাই। কোথায় যেন মায়ার জাল রচিত হয়। বৃদ্ধের দিকে চোখ যায় আমার। তাঁর ঐ চাদরের মতনই নেতিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে সেই জাল ধরা দেয়। হালকা স্বরে বলি, ” কী চাচা, চুপ হয়ে গেলেন যে!”

চাচা হাসেন। এবার শব্দ করে হাসা সে হাসি। বিদায়ী বিকেলে সে হাসি আমায় ধরা দেয় না। “হাসেন কেন চাচা?”

চাচা চুপ করে থাকেন। মাঝির গান থেমে আসে। চাচাজী এবার কথা বলেন। হাসি ছুটে যায়না- সে হাসি বড় অকৃত্রিম- ছুটতে জানে না, “বাবাজী যুদ্ধের গপ্পো শুনবেন?”

“আপনি যুদ্ধ করেছেন? আপনি মুক্তিযোদ্ধা?” আমার অনুভূতি যেন অবাক হতে পারে না পুরোপুরি। আমার অনুভূতির মুগ্ধতাটুকু যেন বৃদ্ধ মুখে লেপটে থাকা সে হাসির কাছে বড় শিশুতোষ।

“এই যে দেখছেন না।” চাচাজী তার পাঞ্জাবীর ডান হাতা তুলে ধরেন। নদীর পাড়ে কোন মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান শোনা যায়। পাখির ডাক। বড় সংগীতময়তা এ নদীতে। এ পৃথিবীতে। আমার চোখে কখন জল জমা হয়।

এ পৃথিবীটা জলের।

চাচাজীর অবলম্বনহীন পাঞ্জাবীর ডান হাতাটা আমি ছুঁয়ে দেখি। বলি, “চাচা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন আমাকে!”

“আরে মিয়া, কান্দেন নাকি আপনে? ব্যাটা মানুষের চোখে কান্দন মানায়? বুঝলেন বাবাজী, কান্দি নাই কুনদিন। চোখের সামনে কতজনরে মরতে দেখছি। কান্দি নাই কুনদিন।” একজন পিতার মমতাময় চোখের পানে আমি তাকাই- একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমি চেয়ে দেখি।

এরপর চাচাজী যুদ্ধের গল্প বলেন। নোয়াপাড়ার সে যুদ্ধ। যে যুদ্ধে শমসের শহীদ হলো। সেই শমসের, স্বাধীন বাংলার পতাকা যে মাথায় বেঁধে রেখেছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। স্বাধীন বাংলার পতাকার স্পর্শে যে শমসের তাঁর শেষ কথাটা বলেছিল, “জয় বাংলা।”
মিয়া বাড়ীর কাজের ছাওয়াল রফিকের গল্প হয়। তের চৌদ্দ’র রফিক। “আমিও যুদ্ধে যামু।” আটত্রিশ বছর আগে কিশোর রফিকের বলা সে কথাটা যেন সন্ধ্যায় হালদা নদীর গভীর থেকে উঠে উঠে আসে।
বিনাজুরিতে শেষ যুদ্ধটা। যে যুদ্ধে চাচা আহত হলেন। দেড় মাস পরে সুস্থ হয়ে স্বাধীন দেশের সূর্য দেখলেন। স্বাধীন দেশে জ্যোৎস্নাদের আগমন দেখলেন। যেখানে চাঁদের আলোর মাঝে একদিন কিছু বিষধরেরা ঘর পেতে রেখেছিল।

আর সুফিয়া?

নৌকা থেকে নেমে মেঠো পথ। এদিক ওদিক লোকজনের আনাগোনা। এদিক ওদিক চাঁদও তার প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করেছে। আমি আর চাচা হাঁটি। কাদামাখা মেঠোপথ- আমার ঠিক পাশে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে হাঁটা পথ নীরবতায় পেরিয়ে যায়। একসময় অদূরে আলো দেখা যায়, বাজার। চাচাজী থেমে দাঁড়ান। মেঠোপথ- তার পাশে বেড়া দিয়ে ঢেকে রাখা সারি সারি কবর।

এর মাঝে-

ওখানে সুফিয়া শুয়ে আছে। কিশোরী সুফিয়া।

————————————————————–
২৫-০৬-২০০৯ (গল্পের নাম পরিবর্তিত)

২,৬৩৬ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “গল্পঃ অবলম্বন”

  1. আশহাব (২০০২-০৮)
    একজন পিতার মমতাময় চোখের পানে আমি তাকাই- একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমি চেয়ে দেখি।

    :salute: :salute: :salute: 😐


    "Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
    - A Concerto Is a Conversation

    জবাব দিন
  2. নদীর পাড়ে কোন মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান শোনা যায়। পাখির ডাক। বড় সংগীতময়তা এ নদীতে। এ পৃথিবীতে। আমার চোখে কখন জল জমা হয়।
    এ পৃথিবীটা জলের।


    এ পৃথিবীটা জলের

    এই জায়গাটায় বুকটা কেমন যেন করে উঠল......

    জবাব দিন
  3. রকিব (০১-০৭)

    ভাইয়া…
    আপনার লেখা সবসময়েই দারুণ লাগে……
    :boss: :boss: :boss: :boss:

    অফ টপিকঃ এইটা কি সচলে পড়ছিলাম নাকি?


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    মুহিব, তোমার গল্পগুলো সবসময়ই দারুণ। পড়ি, তৃপ্তি পাই, মন্তব্যও করি। :hatsoff:

    কিন্তু একমাত্র তোমারেই দেখতাছি একটা লেখাতেও ফৌজদারহাট ট্যাগ দাও না। ঘটনা কি? সব কলেজের পোলাপাইন সাম্প্রদায়িকতা কইরা কলেজের পোস্ট বাড়াইয়া নেয়, আর তুমি কিনা নিজের কলেজটারেই ভালোবাসো না!! পরের গেট-টুগেদারে খবর আছে কইলাম!! x-( x-( x-(


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।