উপন্যাস: সবুজ বুড়ি ০১

আমাদের বয়স যখন তেরো থেকে বেশি, চৌদ্দ ছুঁই ছুঁই করছে- তখন একদিন, এক শীতের দিন- দাদীজানের সবুজ রঙের শাড়ীটা চুরি হয়ে গ্যালো।

শীতের ভোরে বেশ আয়েশ করে ঘুমোচ্ছিলাম। লেপমুড়ি দিয়ে, কান ঢেকে, তখনকার ছোট্ট ছোট্ট চুল শুধু লেপের বাইরে রেখে, হয়তোবা জানালার কাছে একেকটা শীতের পাখি এসে ডাকাডাকি করছিল, ঘুম ভাঙানোর জন্য। সে ঘুম ভাঙলো শান্তাতে। লেপ সরিয়ে শান্তা হৈ হৈ করে উঠলো, “এই বাদলা, ওঠ ওঠ। দাদীজান পাড়া মাথায় তুলেছে!”

ক্লাস ফোর থেকে বড়দের নভেল পড়ে শান্তাটা এসব বলতো। নইলে “পাড়া মাথায় তুলেছে” আবার কী? আমি ঝাপটে শান্তার হাত থেকে লেপ ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। শান্তার হৈ হৈ থামলো না, “দাদীজানের সবুজ রঙের শাড়ীটা ছিল না, লাল আঁচল করা? ওটা চুরি হয়ে গেছে কাল রাতে। দাদীজান সেই ফজরের নামায পড়ে চেঁচামেচি শুরু করেছে। আমেনার মাকে একটা চড়ও মেরেছে।”

শান্তা এতটুকু বলতেই আমি উঠে বসে দুই হাত দিয়ে চোখ ঘষি। নইলে শান্তা থামতো না। শান্তার কথা বলা ছিল নদীর পাড়ের মতো। বাঁধ না দিলে ভাঙতেই থাকতো। নদীর পানিতে যখন ভাসতে ইচ্ছে হতো, ডুবতে ইচ্ছে হতো তখন বাঁধ দিতাম না। কিন্তু এই ভোরবেলা, শীতের ঘুম ঘুমান্তের ভোরবেলা শান্তাকে না থামিয়ে পারা যায় না। “তাতে কী হয়েছে? দাদীজান তো রঙিন শাড়ী কখনো পরবে না!”

নদীর বাঁধ আবারো ভাঙবো ভাঙবো করে, “ধূর গাধা, চল্ দাদীজানের কাছে। জানিস না ঐ শাড়ীটা দাদীজানের কী পছন্দের!”

আমরা আদতে জানি। সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখতাম দাদীজানকে এবং তাঁর প্রিয় শাড়ীটাকে।

সবুজ রঙের শাড়ীটাকে দেখতাম দাদীজান কখন কোলছাড়া করতো না। এক আধদিন যখন খুব ভোরে ঘুম ভাঙতো, বাসি মুখে উঠোনে এসে দাঁড়ালে আকাশের শৈশব দেখতাম, ঘুম ভাঙা পাখি দেখতাম, উঠোনের সাথে লাগোয়া বকুল গাছের সাথে শিশির বিন্দু দেখতাম, আর দেখতাম- উঠোনের এক পাশে জায়নামাযের উপর সে সবুজ রঙের শাড়ীটা বিছিয়ে দাদীজান সেজদাহ দিচ্ছে। নামায পড়ছে। দুই হাত তুলে মোনাজাত করছে।
কখনো আমি, কখনো শান্তা, কখনো আমরা দুজন দাদীজানের কাছে গিয়ে বসতাম। অপেক্ষা করতাম , কখন মোনাজাত শেষ হয়। মাঝে মধ্যে অপেক্ষার পালা হয় না,

“দাদু, কী এত মোনাজাত করো?”

আমাদের কথায় আকাশের দিকে জড়ো করে পেতে রাখা দুই হাত দাদীজান নামিয়ে আনতো, আমাদের চুলে রাখতো, “আল্লাহর কাছে চাইরে দাদুমণি!”

“কী এত চাও? বলোনা!”

বুড়িয়ে যাওয়া বুড়ি আঙুলে দাদীজান আমাদের নাক টিপে দেয়, চুলে বিলি কাটে, সর্বোপরি মমতার মহাআল্পনা অংকিত হতো বুঝি বা, “তোদের চাই দাদুমণিরা, আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে কী চাই জানস? বাদল আর শান্তারে!”

আমরা খুব করে হেসে নিতাম। আমরা তো এই কাছেই আছি দাদীজানের। আমাদের আবার চাওয়ার কী আছে? এ কথা জিজ্ঞেস করলেই বুড়ির বুড়ি চোখ দুটি ভিজে উঠতো। ঠিক তখনই জায়নামায থেকে সবুজ রঙের শাড়ীটা নিয়ে দাদীজান চোখ ঢাকতো্।

সে শাড়ীটা, সবুজ রঙের শাড়ীটা, দাদীজানের কত কত চোখের জল শুষে নিয়েছে! আমরা দেখেছি।

ইশকুল থেকে বাড়ি ফিরে আমরা দেখেছি, খাবারের পাতের সামনে দাদীজান সে শাড়ী নিয়ে বসে আছে।

আমরা দেখেছি বর্ষণ মুখর সন্ধ্যা। আমরা শুনেছি দাদীজানের মুখে হাজারো গল্প। দাদীজানের কোলে যখন মাথা রেখেছি বিবিধ বর্ষার রাতে, দাওয়ায় বসে, গল্প শুনবার আশে, তখন দেখেছি, সেই সবুজ রঙের শাড়ীটা দাদীজান চাদরের মতো জড়িয়ে রয়েছে। অথবা অনুভব করেছি, কোলে মাথা রাখা আমাদের নীচে শাড়ীটার অস্তিত্ব। কোন কোনদিন দাদীজানকে জিজ্ঞেস করেছি, “দাদু, তোমার শাড়ীর গল্প বলো।”

কোন কোনদিন শান্তা তার নিজস্ব অধিকার মাখানো কন্ঠস্বর নিয়ে বলেছে, “দাদু, তুমি সারাক্ষণ এই শাড়ীটা সাথে রাখো কেন?”

দাদীজান কক্ষণো বলতো না। “শাড়ীর গল্প কী শুনবা? শাড়ীর কুন গল্প নাই!”

এরপর হয়তো আমরা মা’র কাছে হাজির হতাম। মাকে জিজ্ঞেস করতাম শাড়ীর রহস্য কী? সমগ্র দিবস রজনী- দাদীজান তাঁর সবুজ রঙের শাড়ীটা আগলে রাখে কেন? কোলছাড়া করে না কেন?
কিংবা বাবাকে। তবু আমাদের জানা হয় না।

শাড়ীটার , সবুজ রঙের শাড়ীটার রহস্যময়্তা তাই আমাদের দূরেই রয়ে যেতো।

২,০৩০ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “উপন্যাস: সবুজ বুড়ি ০১”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    কী ঝরঝরে গদ্য!

    কিন্তু এই ছোকড়ার লেখার প্রশংসা করে লাভ নেই, প্রচন্ড ফাঁকিবাজ ।
    তাই একে লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করি সব সময়। 😀


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    মহিব, এইটা উপন্যাসের প্রথম কিস্তি? এইরকম আকারে ধারাবাহিক শুরু করলে ৩/৪ বছরেও উপন্যাস শেষ হইবো না! যাউগ্যা, অপেক্ষায় আছি।

    লেখাটা ভালো হয়েছে। ভাষা একেবারে ঝরঝরে, সাবলীল। লেখার এই ধরণটাই আমার পছন্দের। নিজেও তাই চেষ্টা করি। দ্রুত আগাও............


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কামরুল হাসান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।