গল্প: পদার্পণ

কাগজে বানানো খাম থেকে আমি মালতীদি’র বুকের গন্ধ নিতাম। অথচ মালতীদি আমার প্রেমিকা ছিলো না। যে নারীর জন্য প্রেমভাব থাকে- তার শরীরের ঘ্রাণ নেয়া হয়তো অপরাধ নয়। প্রত্যক্ষভাবে কিংবা অন্য কোনখান থেকে সে ঘ্রাণ নিলে হয়তো আর পাপ হয় না।

হিন্দুপাড়ার মালতীদি’র জন্য আমার মাঝে কোন প্রেমভাব ছিলো না।

“এই ট্যাপা, এদিকে শুনে যা তো একটু।” নিখিল স্যারের ঘর থেকে বের হয়ে যখন আমরা বাড়ির পথের দিকে তাকাই, হিন্দুপাড়া মুসলমান পাড়ার মাঝামাঝি বিল- যেটা আমাদের খেলার মাঠ যখন চোখের সামনে উঁকি দেয়, তখন মালতীদি’র ফিসফিস করা কন্ঠস্বর শোনা যেত। রতন- আলমরা এগিয়ে যায়, আমি ঠিক বুঝে যেতাম আমাকে আশিষবাবুদের বাড়ির পেছনের দিকে যেতে হবে- যেখানে কলেজ পড়ুয়া মালতীদি দাঁড়িয়ে থাকে- যে মালতীদির চুলের সারি গত বর্ষায় পিঠ পেরিয়ে হাঁটুর সমান্তরালে এসে পৌঁছেছে প্রায়।

আমার পরনে ছিলো তখনো হাফপ্যান্ট। কাঁধে প্রায় মৃত হয়ে যাওয়া ব্যাগ সামলে নিতে নিতে মালতীদি’র দিকে তাকাতাম- দেখতাম কখনো হাওয়ায় মালতীদি’র খোলা চুল হাওয়া যাচ্ছে উড়ে উড়ে- কখনোবা সে চুলেরা পরাধীনতার শিকলে বন্দিনী হয়ে আছে। দেখতাম- আর বলতাম, “বলো।”

মালতীদি’র হাতে একগাদা চুড়ি ছিলো। লাল নীল সবুজ। কলেজ পড়ুয়া মালতীদি যখন বুকের মধ্যখান থেকে চিঠি বের করে আনতো- চুড়িগুলো শব্দ করতো। ঝনঝন। রিনঝিন। আমি কী এক ব্যকুলতা নিয়ে দৃশ্যটা দেখতাম- বুকের মধ্যখান থেকে চিঠি বের করে আনা। মালতীদি হাসতো, “রাশেদ ভাইকে দিবি এটা।”

যখন সে খাম আমার হাতে তুলে দেয়া হতো। আমি অবাক হয়ে শুনতাম চুড়িগুলো তখনো বাজে- রিনঝিন- ঝনঝন। মালতীদির হাতের চিঠি নিয়ে বলতাম, “জানি, বলতে হবে না রোজ রোজ।”

মালতীদি হাসতো আবারও। কিংবা আগে বেজে ওঠা হাসিটাই থামতো না মুহুর্তের জন্য। চলতো- চলতো। “পড়বি না। পড়লে কিন্তু মার খাবি। ”

“আমি অত খারাপ না। কিন্তু আবার যদি ট্যাপা ডাকো তাইলে কিন্তু সবাইকে বলে দিব।” এবার আমার হাসার পালা। কলেজ পড়ুয়া মালতীদি- যার চুলগুলো গত বর্ষায় পিঠ পেরিয়েছে, তার ভীত মুখ দেখে আমার হাসি পেত। মালতীদি আমাকে কাছে টেনে নিতো- আমার চুলের সিঁথি ঠিক করে দিয়ে মালতীদি’র বলা, “আচ্ছা যা। আর ট্যাপা বলবো না। লক্ষী ছেলে।”

আমি কী “লক্ষী” ছেলে ছিলাম?

সিঁথি ঠিক করে দেবার বেলায় মালতীদি’র শরীরের খুব কাছাকাছি – বুকের খুব কাছাকাছি আসা হতো তখন আমার হাফপ্যাণ্ট পরা শরীরে শিহরণ, রাশেদ ভাইয়ের কাছে খাম পাচার করার আগে- বাড়ীর পেছনে গিয়ে সে খাম মুখে চেপে ধরে মালতীদির বুকের গন্ধ নেয়া, এলোমেলো চুম্বনে কাগজে বানানো খাম ভরিয়ে তোলা, মাঝেমধ্যে রাতের অন্ধকারে কিংবা ভোরে ঘুমভাঙ্গা বিছানায় আমাকে কেমন যেন করে দিত। আমি কাঁদতাম।

ছোটবেলা থেকে এই একটা ব্যাপারে আমি বেশ পটু ছিলাম। ক্রন্দন।

শৈশবে একটা অচেনা পাখির মৃত্যু দেখে আমি কেঁদেছিলাম। শীতের সকালে বড়দীঘির সে ঘটনার কথা আমার এখনো মনে পড়ে। সে বড়দঘির পাড়- সে শীতের সকালে আমাদের স্কুল বন্ধ থাকার আনন্দ- পুকুরে অকারণে ঝাঁপাঝাঁপি- আমি, রতন আলম আর অন্য কেউ। পাড় থেকে শিউলির চিৎকার, “আমিও পুকুরে নামবো।” এবং ও পাশের গাছটায় একটা পাখির উড়ে এসে বসা। রতন বলে, “আলম, ঐ পাখিটাকে মারতে পারবি?” এরপর আলমের ব্যর্থতা- আমার গুলতি হাতে তুলে নেয়া- নাম না জানা পাখিটার পতন- বারবার মনে পড়ে।

সে রাতে হঠাৎ আমার মনে হয়- পাখিটা বুঝি শিউলির মতন। পুকুরে আমাদের দাপাদাপি দেখে তারও সাঁতার কাটবার ইচ্ছে হচ্ছিল। আমি কাঁদলাম। বুবুর ঘুম ভেঙে যায় আমার কান্নার শব্দে। বুবু কোন তুচ্ছ কারণে ভয় পেতে জানতো- তাই আমার কান্নার কথা বুবুকে সে মধ্যরাতে ব্যাকুল করে- বুবু মার কাছে ছুটে যায়- মা ছুটে আসে, আমাকে জড়িয়ে ধরে মা বলে, “আনু, বাবা কী হয়েছে?”
বুবু বলে, “খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?”

আমি মায়ের আঁচল ভিজিয়ে দিয়ে বললাম, “মা, বাবা কোথায়? আমি বাবার কাছে যাবো।”

একসময় সকাল হয়। ভোরের পথে ধূলো উড়িয়ে অমলদা বাড়ি বাড়ি যায়। কাঁধে একটা লাঠির দুইপ্রান্তে দুধের ডেকচি। উঠোনে দাঁত মাজতে মাজতে অমলদাকে দেখি। দুধের ডেকচি একপাশে রেখে দাওয়ায় বসে অমলদা জিরোয়। লুঙ্গির গিট থেকে বিড়ি বের করে ধরায়। যেন নিজের মনেই বলে, “বুঝলা, অনু দাদা। এই বুড়া বয়সে এরম খাটনি করতে ভালা লাগে না। তবুও তোমাগো লাইগা করি, তোমরা মানুষ হইবা- দুধ খাইবা। নাইলে শক্তি হইবনা কইয়া দিলাম!”

মা আসে। ঘোমটা টেনে অমলদার দিকে বাটি বাড়িয়ে দেয়। “চারটা পানিভাত খেয়ে যান কাকা।” অমলদা পানিভাত খায় দাওয়ায় বসে। তারপর আবার বিড়ি ধরায়। রান্নাঘরে পাটি পেতে আমরা নাস্তা করি। নাস্তার পর দুধ খেতে হয়। স্টীলের গ্লাসে সে সাদা দুধের দিকে চেয়ে আমার মালতীদি’র কথা মনে পড়ে।

স্কুলের পথে খেজুর গাছে একটা পাখিকে দেখি। আমার সেদিনের মৃত পাখিটার কথা মনে হয়।

আমার শিউলির কথা মনে পড়ে।

স্কুল শেষে নিখিল স্যারের বাসায় পড়তে যাবার পালা আসে। আমার বুকের মাঝে কাঁপুনি বাড়ে। নিখিল স্যার বলেন, “বাবারা, হোমওয়ার্ক করেছ সবাই? আজ অংক পরীক্ষা নিব। পড়েছ তো? শোন মানুষ হতে হলে পড়াশোনা ছাড়া যেমন গতি নাই- পড়াশোনা করতে হলে তেমন অংক ছাড়া উপায় নাই!”

অংক পরীক্ষা হয়। বাড়ির পথে তাকিয়ে শুনি, “এই ট্যাপা শুনে যা!’ আলম- রতন এগিয়ে যায়, আমি আশিষবাবুদের বাড়ির পেছনটায় এসে দাঁড়ায়, যেখানে মালতীদি দাঁড়িয়ে থাকে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে- হাওয়ায় যেখানে বিগত বর্ষায় ছুটে যাওয়া চুল উড়ে উড়ে যায়।

যখন আমি কথাটা বলে ফেলি সেদিনও চুড়ির রিনঝিন ঝনঝন শব্দ হয়- বুকের মধ্যখান থেকে মালতীদি খাম বের করে আনে। সেদিন আমার চোখ থেকে পানি পড়ে টুপটাপ। বলি, “মালতীদি, তুমি আমাকে আর চিঠি নিয়ে যেতে দিওনা। আমি খুব খারাপ ছেলে।”

মালতীদি অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে। রিনঝিন শব্দ থেমে আসে বুঝি! “কী আশ্চর্য! ট্যাপা তুই কাঁদিস কেন?”

এবার আমার টুপটাপ বৃষ্টি বাঁধ ভেঙে দেয়। “আমি খুব খারাপ মালতীদি!”

“কেন কী করেছিস? চিঠি পড়ে ফেলেছিস নাকি?” আমি অবাক হয়ে দেখি মালতীদি হাসে- চোখের পানির মাঝ দিয়ে মালতীদিকে কেমন লাগে? “ধূর গাধা। এ জন্য কাঁদতে হয়। ” মালতীদি আমাকে কাছে টেনে নেয়। ওড়না দিয়ে আমার চোখ মুছে দেয়। মালতীদি’র ওড়না আমাকে মধ্যরাতের আঁচলের ছোঁয়া দেয় তবুও-

তবুও আমি সে খামের গন্ধ পাই। এবার আরো তীব্র। আমার মনে হয়- শিউলিদের বাগানে আমি যেন এই গন্ধ পেয়েছিলাম। মনে হয়- গত বর্ষায় মালতীদির কাছ থেকে রাশেদ ভাইয়ের জন্য খাম নিতে গিয়ে এই ঘ্রাণ পেয়েছিলাম।

অনেক দিন পর আমি এক দালান্দের বারান্দায় – সামনের দালানের ছাদে প্রেমেলিপ্ত দুটো পাখি এসে বসে। ওরা প্রেম করে পরস্পরের খুব কাছাকাছি যায়। পুরুষ পাখি নারী পাখিকে ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে দেয় ভালোবেসে।

আমি কী সেদিন মালতীদি’র খুব কাছাকাছি গিয়েছিলাম আশিষবাবুদের বাড়ীর পেছনটায়? যেদিন আমি বলেছিলাম, মালতীদির হাতের চুড়ির শব্দে রিনঝিন- ঝনঝন- লাল নীল সবুজ- বিগত বরষার মতন চুলের ওড়াউড়ি দেখে-

“তোমার গায়ের গন্ধ আমার এত ভালো লাগে কেন, মালতীদি!”

————————————————-
০৮/০৬/২০০৯

৪,৭৬২ বার দেখা হয়েছে

৫২ টি মন্তব্য : “গল্প: পদার্পণ”

  1. আন্দালিব (৯৬-০২)

    গল্পটা পড় আমি রীতিমত আরাম পেয়েছি। পাঠক হিসেবে, এমন দৃশ্যবহুল গল্প আমার ভালো লাগে। বর্ণনার যে ঢঙ, ছোট ছোট বাক্যে একটা সময়হীন সময় তুলে আনার ব্যাপারটা আমার কাছে দুর্দান্ত লাগলো।
    যে আড়াল, আর প্রচ্ছন্নবোধ ছিল গল্পে, সেটা শেষদিকে ব্যক্ত না করলেও হত কিন্তু। তাতে গল্পের অন্যরকম আমেজ পাওয়া যেত। না-পাওয়ার হাহাকার, বা এইটুকু প্রাপ্তির মাঝে আমরা দোদুল্যমান থাকতাম।
    এমন লেখার ফ্লো'টা ধরে রাখো! 🙂

    জবাব দিন
  2. দারুণ লাগলো।
    মহিব, বন্ধু এইটা আগে কোথাও পড়েছি। কিন্তু তখন জানতাম না এইটা তোর। এখন জানলাম দেখে আরও বেশি ভালো লাগলো।

    ঘটনা যেভাবে বয়ে গেলো...... আমার হৃদয় ছুঁইয়ে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মূলত এই গল্পের প্রকাশভঙ্গিটাই এইটাকে আলাদা একটা মাত্রা দিয়েছে-- যা পাঠকদের মোহিত করে রাখবে শেষ এই বাক্যটি পর্যন্ত--

    “তোমার গায়ের গন্ধ আমার এত ভালো লাগে কেন, মালতীদি!”

    জবাব দিন
  3. এহসান (৮৯-৯৫)

    এই গল্প পড়ার পর সবাই এর পরে কি হবে নিয়ে কথা বলছিলো। আমি ভাবলাম পরের পার্ট আইসা পড়সে। এখন খেয়াল হইলো এইটা সিসিবিতে আসা একটা পুরান গল্প 🙁

    সচলে কমেন্টাই নাই। এখানে কই... ঝরঝরে গদ্য। :clap: এর গল্পটা এখানেই শেষ করলেই ভালো। রিটন সাহেব মনে হয় এই কথাই কমেন্টাইসিলো।

    জবাব দিন
    • মহিব (৯৯-০৫)

      এই শিরোনামে আরো কয়েকটা গল্প লিখব। এ জন্যই সচলে শিরোনামে এক দিছিলাম।
      পদার্পণ শিরোনামের গল্পগুলো একটা বিশেষ সময়ের কথা বলবে। কিংবা আন্দালিব ভাইয়ের ভাষায়- সময়হীন সময়।

      আর পুরান লেখা বললে কেমুন কেমুন জানি লাগে।
      একটা গল্পকে কয়েকদিন পরই পুরান বইলা দিতে ভাল্লাগেনা আর কি! 🙂

      জবাব দিন
  4. কঠিন লিখেছিস দোস্ত মুহিব!!!!!
    কলেজে এই ধরনের ২/১টা গল্প লিখেছিলাম,তবে কাব্যরস হিসাবে অন্তত এইটার ধারে কাছে নেই।আর সেগুলি এইখানে ছাপার জন্য ফিট নয়,কারন শুরু এভাবেই,মাঝপথে গিয়েই গুপ্ত আঙ্কেলের ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। 😀 😀 তোর গল্পটাকেও হালকা এডিট করে নীলক্ষেতে গুপ্ত আঙ্কেলের প্রকাশনীতে ছেপে দেয়া যায়।

    জবাব দিন
  5. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    লেখার ভঙ্গিটা কিংবা ট্যাপার বলার ভঙ্গিটাই এই ছোট গল্পটিকে বিশেষ করে তুলল। চমৎকার বললে কম বলা হয়। পড়ে ভালো লাগা আর মুগ্ধতা রেখে গেলাম। ( এইটা পিঠ চুলকানো প্রশংসা না। আমার কোন লেখা ভালো না লাগলে সাধারণত সেখানে মন্তব্য করি না। )

    জবাব দিন
  6. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    লেখাটা আগেই পড়েছি, তখনো ভাল লেগেছিল এখনো আবার ভাল লাগলো । তোমার পরবর্তী লেখা গুলো এখানে দেখার আশা করছি । একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যে গল্পটা লিখেছ দিয়ে ফেল । পোলাটা অনেক পাথরায় 😀

    জবাব দিন
  7. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    তুমি কোনদিনই কি আমাগো নতুন গল্পের স্বাদটা আগে পাইতে দিবা না বইলা কসম কাটছ ????
    x-( x-( x-( x-( x-( x-( x-(
    যাই হোক
    দাদা, খাসা লিকেচেন যে, এক্কেবারে জম্পেশ হয়েচে, বুজলেন নি ??

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদ ফয়সাল (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।