ক্রিকেট, লোডশেডিং এবং এইচ এস সি- ২য় পর্ব- লোডশেডিং

ক্যাডেট রা রুটিন এর মধ্যে থাকতে ভালবাসে 🙂

এইচ এস সি পরীক্ষার আগের এবং মাঝের ফাকা দিনগুলোর সকাল আমাদের কাটত ক্রিকেট খেলে. ক্লান্ত আমরা দুপুর টা ঘুমিয়ে সন্ধ্যা থেকে পড়া শুরু করতাম. পড়ার মাঝে মাঝে কখনো কারেন্ট চলে যেত, কিন্তু আমাদের চার্জার লাইট সেটা সামাল দিতে যথেষ্ট ছিল. পড়তে পড়তে রাত বার্ত . রাত গভীর হবার সাথে সাথে শফিক এর নেতৃত্বে একদল নিশাচর প্রাণী গাজা, সিগারেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, বাকিরা হয়ত ম্যাগি নুডলস, কফি :teacup: , অথবা ঝালমুড়ি নিয়েই থাকত. সবমিলিয়ে একটা অনুকুল রুটিন এর মধ্যে আমরা ছিলাম. কলেজ জীবনের শেষ দিন গুলি টক-মিষ্টি আনন্দের মধ্যে দিয়েই কেটে যাচ্ছিল. :tuski:

কিন্তু হায়, পল্লী বিদ্যুত কর্তৃপক্ষের সে সুখ সইলনা. এইচ এস সি শুরু হবার ১ সপ্তাহ পর ই ইলেকট্রিসিটি মাঝে মাঝে যাওয়া ছেড়ে মাঝে মাঝে আসা শুরু করলো 😐 আমাদের চার্জার লাইট ভরপেট ইলেকট্রিসিটি খেতে না পেয়ে আলো দেয়া কমিয়ে দিল 🙁 একইসাথে মে মাসের কাঠ ফাটা গরম আমাদের মগজ ভাজি করা শুরু করলো. এমন ই সময়ে আমাদের সামনে এসে সাক্ষাত যমদূত এর মত উপস্থিত হলো কেমিস্ট্রি ২য পত্র পরীক্ষা… ~x(

আপনারা যারা এই পরিস্থিতিতে পড়েননি, তাদের জন্য বলে রাখি, কেমিস্ট্রি ২য পত্র, গরম, লোডশেডিং এবং বদ্ধ ঘর- অত্যন্ত বাজে একটি রেসিপি- বদহজম MUST . আমাদের করুণ পরিস্থিতি দেখে ইসরাইল হক স্যার এর মন গলে গেল ( অথবা হয়ত অতিরিক্ত গরমেই গলে গেল ) উনি হাউস বেয়ারা জয়নাল ভাই কে দেকে বললেন সারারাত হাউস এর পোর্চ( দোতলা বারান্দা) খোলা রাখতে. আমরা ওখানে মৃদুমন্দ হাওয়ার মাঝে জ্ঞান আহরণ করব. আমরা তো মহাখুশি. যারা ঘুমিয়ে পরছিল তারাও বই পত্র নিয়ে পোর্চ এ হাজির. প্রবল উত্সাহে পড়া শুরু হলো. আমাদের হাউস এর ৩ তালা তেই এন.ডি.এম. থাকতেন. নাইট ডিউটি মাস্টার আব্দুল জলিল স্যার আমাদের মনোযোগ দেখে মুগ্ধ হয়ে চুপচাপ উপরে চলে গেলেন, আমরাও পড়তে থাকলাম. কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আমাদের উত্সাহে ভাটা পড়া শুরু হলো যখন দেখলাম চার্জার লাইট একটা একটা করে নেভা শুরু করেছে ( বলাই বাহুল্য, সে রাতে এক বারের জন্য ও ইলেকট্রিসিটি আসে নি). শেষ চার্জার লাইট টি যখন টিম টিম করে জলছিল তখন বুঝতে পারলাম চার্জার এর আলোর অভাব আজ আমাদের জ্ঞান এর আলো থেকেও বঞ্চিত করতে যাচ্ছে. আর তাছাড়া তখন তো আর ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল না, তাই আমরা সাথে মোমবাত্তি ও রাখতাম না. যাই হোক, সেদিন এর মত পড়া শেষ করে বই খাতা বন্ধ করে হাউস এ ঢুকতে গিয়ে টের পেলাম , সম্ভব না !!!! সোহরাওয়ার্দী হাউস এর ছেলেদের মাথা একটু গরম, কে জানে সেই গরম মাথার কারণেই কিনা, হাউস এর ভিতর তখন আগুন গরম, ৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রা 😐 . গরমে আমাদের ৪ ফুট মোজাম্মেল প্রসারিত হয়ে ৬ ফুট হয়ে গেল!! মোজাম্মেল বলল,” ধুর @%!$! :gulli: , এর চেয়ে তো পোর্চ এ থাকাই ভালো.” লক্ষ্য করলাম কেউ প্রস্তাব টা হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে না. বরং রুম এ গিয়ে ঘুমাতে হতে পারে এই চিন্তায় কারো কারো চোখে পানি ও শরীরে ঘাম চলে আসছে. ফলাফল আমরা ঘরের ছেলে ঘরে গেলাম, এবং বালিশ চাদর নিয়ে পোর্চ এ ফিরে এলাম 🙂

শুতে গিয়ে দেখলাম, বসে বসে অনেক বাতাস আমাদের ছুয়ে গেলেও , শোবার সাথে সাথে আমরা সেই বাতাসের নাগালের বাইরে চলে যাই. কি করা যায় ? পোর্চ এর পাশেই ছিল আমাদের হাউস থেকে নজরুল হাউস এ যাওয়ার শেড. শেড এর উপর টা দেখে আমাদের বড় লোভ হলো. আমরা “চল চল চল” মন্ত্রে অনুপ্রানিত হয়ে শেড এর উপরে ২ হাউস এর মাঝামাঝি একটা জায়গায় বেড শিট , বালিশ বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম. একদিকে নজরুল হাউস এর বাগান, অন্যদিকে কলেজের পুকুর. বাতাসের তোরে আমাদের মনে সুখ এর হাওয়া বইলো. এমতাবস্থায় আমাদের মধ্যে কেউ একজন , মনে হয় তানভির , অর মামার গল্প করা শুরু করলো.গল্প টা কি মনে নেই, তবে এটা মনে আছে যে গল্প টা আমাদের তেমন একটা পছন্দ হয়নি, যার ফলে আমরা মৃদ বাকবিতন্ডায়- মূলত তানভির কে টিজ করাতেই 😛 – মেতে উঠি . এক পর্যায় এ আরিফ এর কোনো কথার (টিজ) উত্তরে তানভির বলে উঠে ” তুই আরেকটা ফালতু কথা বললে কিন্তু তোকে নিচে ফেলে দিব”. ঠিক তখন নিচ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসে,” থাক বাবা, কাউকে ফেলতে হবে না, সবাই নেমে আস” 😐

আমরা সবাই চুপ. একটু উকি মেরে দেখলাম জলিল স্যার আর জয়নাল ভাই নিচে দাড়িয়ে. আমরা মনে বরই দু:খ পেলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম এই শোকে আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য নীরবতা পালন করব. কিন্তু জলিল স্যার এর মনে হয় ঘুম পাচ্ছিল, তাই তিনি ৩ মিনিট এর মাথায় নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, ” কে কে আছ বল, কিচ্ছু হবে না, কাউকে বলব না, ইত্যাদি”. কথা টা শুনে আমাদের একটু ফ্লাশব্যাক হয়ে গেল….. ক্লাস ১০ এ থাকতে একজন শিক্ষক মিত্থ্যা আশ্বাস দিয়ে কথা এবং একটি পাতলা বই ( 😛 ) আদায় করে আমাদের এক বন্ধুর জরিমানার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন. তাই আমরা পুনরায় নীরবতা পালনে ফিরে গেলাম. কিন্তু জলিল স্যার একটু পর পর আমাদের কে নানা ধরনের কথা বলতে থাকলেন . ওনার উপুর্যুপরি বাক্যবাণে কাবু হয়ে রিয়াদ এক সময় বলে ফেলল, ” স্যার, আমি রিয়াদ”…স্যার তো খুশি. স্যার এর খুশি দেখে মেহেদী আর আরিফ ও ওদের উপস্থিতি জানান দিল. কিন্তু আমি আর তানভির আবার একটু লাজুক স্বভাবের 😐 বড়দের সামনে গলা তুলতে আমরা একেবারেই পছন্দ করি না. তাই আমরা পুনরায় নীরবতায় ফিরে গিয়ে স্যার এর ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে শুরু করলাম. ভাবখানা এমন ছিল, আপনি তো আমাদের অনেক পরীক্ষা নিলেন এ কয় বছরে, এবার একটু পরীক্ষা দেন. দেখা গেল, স্যার অতি দ্রুত পরীক্ষায় ফেল করলেন এবং বললেন,” এতক্ষণ ভালো করে বললাম শুন্লানা, এবার দেখাচ্ছি মজা” এরপর দৌড়ে উপরে আসতে লাগলেন. ওনার দৌড় শুরু করার আগেই আমরা হপ স্টেপ এন্ড জাম্প এ উপরে উঠে আমাদের রুম এর সামনে পৌছে গেছি আর অন্ধকারে দাড়িয়ে দেখছি কি হয়. মুহূর্ত পরেই স্যার দৌড়ে উপরে উঠে পোর্চ এ ঢুকতে যাবেন….আর ধুম. আসলে আমাদের পোর্চ এর দরজা ছিল থাই এলুমিনিয়াম এর. দিনের বেলা দরজা গুলোর উপস্থিতি স্পষ্ট ভাবে বোঝা গেলেও রাতে আমাদের ই বুঝতে কষ্ট হত যে দরজা খোলা নাকি বন্ধ. আর ব্যাচারা স্যার তো বয়স্ক মানুষ, দৌড়ের উপরে ছিলেন, চোখে ঘুম. সব মিলিয়ে উনি বন্ধ দরজা কেই খোলা মনে করে ঢুকতে যান, এবং একটা বড়সর বাড়ি খান . :bash:

এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত, স্যার ওই রাতে ঘুমুতে যান, কিন্তু পরের দিন হাউস মাস্টার কে জানান. হাউস মাস্টার আমাদের ডেকে একটু অগ্নিদৃষ্টি বিতরণ করেন. আর আমি যেহেতু তখন দোতলার সিনিয়ার প্রিফেক্ট ছিলাম তাই আমাকে ডেকে বলেন সবাইকে একটু দেখে রাখতে. 😐
পরে একদিন জলিল স্যার কে একা পেয়ে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম, কিন্তু কথা শুরু করার আগেই উনি ওনার নাক এ হাত দিয়ে একটু ম্যাসাজ করে নেন. এটা দেখে মনে হলো থাক, আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা না দেই.

দু:খিত স্যার, আপনাকে ব্যথা দিতে চাইনি আমরা. :no: :salute:

২৬ টি মন্তব্য : “ক্রিকেট, লোডশেডিং এবং এইচ এস সি- ২য় পর্ব- লোডশেডিং”

মওন্তব্য করুন : ফখরুল (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।