গন টু ডগ

“আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।”

কবি সুকান্ত আঠারো বছর বয়সীদের নিয়ে এই কবিতা লিখলেও ক্যাডেট কলেজ পার্সপেক্টিভ থেকে চিন্তা করলে বলতে হবে “ক্যাণ্ডিডেট টাইমেই অহরহ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি”। সবচেয়ে ভদ্র সভ্য ক্যাডেটদের মনেও গড়ে ওঠে ডিসিপ্লিন ভঙ্গের নানারকম নীলনকশা।

আমার কলেজ FGCC’র কথায় আসি। জুনিয়র কলেজ। আমরা আবার ফার্স্ট ইনটেক। জুনিয়ররা স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি ডিসিপ্লিনড হয়, আর আমাদের যেহেতু সিনিয়রদের পাঙ্গা খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই তাই খুব একটা ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করার প্রয়োজন পড়ত না। তাছাড়া চোখের সামনে কোন সিনিয়রকে অথরিটির পিছে লাগতে দেখি নাই। অভিজ্ঞতার খাতাটাও শূন্য। কিন্তু গার্লস কলেজ আর প্রথম ব্যাচ হওয়ার কারনে অন্য কলেজের ক্লাসমেটদের ছিল আমাদের ব্যাপারে অগাধ কৌতূহল। একটা করে প্রশ্ন করত আর তারপর উত্তর শুনে নিজের কলেজে অমুক হয়, তমুক হয়, তারা অমুক করে এইসব বলে ভাব নিত। আমরা বিরস ভাবে শুনতাম। কিন্তু সেসব করার মতন পরিবেশ বা প্রয়োজন কখনো হয় নি। কলেজে ঘাসের পরিমাণই তখন লিমিটেড ছিল সেখানে ডাবচুরি-আমচুরি চিন্তা তো building castle in the air.
তবে যেহেতু সিনিয়র ব্যাচ হিসেবে তখনও আমরা কিছুই করতে পারিনি, তাই অথোরিটি থেকে বিশেষ চাপ ছিল না। উল্টো কলেজে এমন কিছু ফ্যাসিলিটি ছিল যা শুনে বাকিরা সবসময় বলত, “………… আমরা কতো কাহিনী করে সেলে চার্জ দেই আর তোদের ছোট ডর্মেই ৪টা পয়েন্ট!!!!!” নীরবে শুনতাম এসব আর ভাবতাম একদিন না একদিন তো কেউ এইসব করবেই। হোয়াই নট আস???

ক্যান্ডি টাইমে স্যাররা ডর্ম প্ল্যানিং খুব বুঝে শুনে করেছিলেন যেন সব ডর্মেই খুব বেশি পড়ুয়া একজন ভালো স্টুডেন্ট থাকে। আমাদের ডর্মেও একজন তেমন ছিল আর বাকি তিনজনের কাজ ছিল ঘুমানো আর উঠেই ক্যান্টিন ফুড খাওয়া। তো আমাদের সিরিয়াস ডর্মমেট ঠিক করলো একদিন যে আমাদের কেনা সব ক্যান্টিনফুড তার কাছে থাকবে। যদি আমরা রাত ১২টা পর্যন্ত জেগে পড়তে পারি তো প্রথম সিরিজ খাদ্য বিতরণ হবে, নেক্সট সিরিজ রাত ২টায়। এই “পড়ার বিনিময়ে খাদ্য” নিয়মটা মানতে কেউ রাজি না হলেও কিছু করার ছিল না। সে মোটামুটি রুমে ডিকটেটরশিপ চালু করেছিল। আমরা খাওয়ার জন্য কোনোমতে ১২টা পর্যন্ত জেগে থাকতাম কিন্তু সেই বেচারির পড়তে পড়তে এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল যে নরমাল কথার মধ্যেও ২-৩টা অবজেক্টিভ জুড়ে দিত। যেমন, একদিন বাংলা সেকেন্ড পেপারের MCQ নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম আমরা। তো আমাদের সিরিয়াস ডর্মমেট ঘোষণা করলো; আমরা মোটেও এক্সাম নিয়ে মাথা ঘামাই না, আমরা সবগুলা ‘gone to dog’.

রাত ১১টার দিকে আমি আর আনিকা পুরা হাউজে একবার রাউণ্ড দিতাম। কোন ক্লাসমেট কি পড়ছে দেখার জন্য আর মেইনলি টিভি রুমে যেতাম 9xM দেখতে। হাউজের নিচ তলায় টিভি রুম, হাউজ অফিস আর NDM এর রুম ছিল ত্রিভুজাকারে। টিভি রুম আর হাউজ অফিসের মাঝে ছিল দোতলার সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নামলেই NDM এর রুমের দরজা।
কোনো বিশেষ একদিনের কথা (মানে রাতের কথা), আমি আর আনি টিভিরুম থেকে বের হয়ে দেখলাম হাউজ অফিসের দরজা খোলা। ভেতরে উঁকি দিলাম আমাদের থেকে সীজ করা খাবারগুলো উদ্ধারের আশা নিয়ে। কিন্তু প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল সেটা হল, হাউজের ল্যান্ডফোন। ২০০৮ থেকে ক্যাডেটদের বাসায় কথা বলার নিয়ম চালু হয়। সেজন্য হাউজগুলোতে ল্যান্ডফোন দেয়া হয়েছিলো। আমরা সবাই সপ্তাহে এক দিন বাসায় পাঁচ মিনিট কথা বলার সুযোগ পেতাম। কিন্তু ক্লাস সেভেনরা যারা বেশি কান্নাকাটি করতো স্যাররা তাদের ১৫-২০ মিনিটও কথা বলতে দিতেন। সেটা নিয়ে আমাদের সবসময়ই কমপ্লেইন ছিল। আর যারা জুলিয়েট পার্টি তাদের কথা তো আলাদা করে বলার কিছু নাই। যাই হোক মূল ঘটনায় ফিরে যাই। ল্যান্ডফোনটা সামনে পেয়ে খাবারের খোঁজ না করে, জাস্ট সব প্লাগগুলো খুলে সেটটা কার্ডিগানের ভেতরে লুকিয়ে ডর্মে নিয়ে আসা হল। ঢুকেই দরজা লক করে দিলাম আমরা। তারপর আমি আর আনি একসাথে বললাম আমরা আবারও “gone to dog”.
কিছুক্ষণ সবাই একভাবে তাকিয়ে থাকল জিনিসটার দিকে তারপর সবাই মিলে জিনিসটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। মজার ব্যাপার হল এই কাজে সব চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল আমাদের সিরিয়াস ডর্মমেটের। যাই হোক। ফোন নিয়ে আসার পরবর্তী স্টেপ কাউকে ফোন করা। তখন প্রায় রাত ২টা। বাসায় তো ফোন করার কথা কারো চিন্তাতেও আসবে না। আর আমাদের মধ্যে একজনেরই তখন রাত ২টায় কল করার মতো বিশেষ কেউ ছিল। আর সেই বিশেষ কেউ আবার আমাদের প্রতিবেশি কলেজের ক্যাডেট। সিসিসি তে আমাদের ব্যাচমেটদের ইনটেক নাম্বার অনুযায়ী সবাইকে ফোন দেয়া শুরু করা হল। সেই মুহূর্তে আমাদের ফিলিংসটা বোঝানো সম্ভব না। লাইট অফ করে, শীতের মধ্যে ফ্যান ছেড়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে আমরা চারটা আস্তে আস্তে কথা বলছি। একটা পেনলাইট জ্বালিয়ে রাখা জাস্ট। একেকটা নাম্বার ডায়াল করা হয় আর সেই “দুঃখিত আপনার ডায়ালক্রিতো নাম্বারটি…………” এই যান্ত্রিক কথাও আমরা রিসিভার পাস করে করে সবাই শুনি। কিন্তু কথায় বলে প্রেম করতে শুধু সাহস না কপালও লাগে। কোন নাম্বারই ওপেন পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেকগুলো নাম্বার ডায়াল করার পর একটা নাম্বারে রিং হওয়া শুরু করলো। আমরা সবাই রিসিভারে কান লাগিয়ে রাখলাম। কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করলো না। আবার ডায়াল করা হল। এইবার একজন ফোন রিসিভ করলো।

সেইদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এইকাজ করা হত। অনেক কাহিনী করে হাউজ বেয়ারা দিদির থেকে লুকিয়ে হাউজ অফিসের চাবির একটা ছাপ নিয়ে আসা হয় সাবানের উপর। “তিন গোয়েন্দা”র নলেজ এর রিয়েল লাইফ অ্যাপলিকেশন। প্যারেন্টস ডে’তে সেই ডর্মমেটের বাবা একটা চাবি বানিয়ে দেন আমাদের। এরপর তো আমাদের অবাধ এক্সেস হয়ে যায় হাউজ অফিসে। তিনজন তিন জায়গায় পজিশন নিতো আর একজন সেট নিয়ে আসতো। তারপর সারারাত “gone to dog” চলতো।

প্রতি উইকে কথা বলার পর সেটা একটা খাতায় রেজিস্টার করে রাখা হত। তাই ফোনের ব্যালেন্স আর খাতার রেকর্ডে গড়মিল ধরা পড়ল মাস শেষে। কিন্তু মজার ব্যাপার তারপরেও হাউজ মাস্টার স্যার কিছু বুঝতে পারেননি। সবার ধারনা হয় যে ক্যাডেটরা ৫ মিনিটের বেশি কথা বলেছে কিন্তু খাতায় ৫ মিনিটই এন্ট্রি করেছে। তাই এন্ট্রি করার আগে হাউজে ডিউটিরত স্যার অথবা ম্যাডামকে কল ডিউরেশন দেখিয়ে নেয়ার নিয়ম করা হয়। এতে আমাদের একটা সুবিধাই হয়। এই নিয়মের কারনে সবাই ৫ মিনিটের বেশি কথা বলা শুরু করে। আর সেই বেনিফিট নিয়ে, রাতে যখন সেট আনতে যাওয়া হত তখন রেজিস্ট্রি খাতায় জুনিয়রদের কল ডিউরেশন বাড়িয়ে দেয়া হত। এরপরেও ফোনের ব্যাল্যান্স আর খাতার হিসাবে গড়মিল হতো। কিন্তু সেটা খুব বেশি পরিমাণে না হওয়ায় আমাদের আর চিন্তা করতে হয়নি। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে ছুটিতে আসার আগ পর্যন্ত হাউজের জুলিয়েটরা চির-বসন্ত পালন করেছিলো।

৪,০৪৬ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “গন টু ডগ”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লিখেছো :thumbup: ছোট্ট একটা ক্যাডেটিও ডাউট দেই, ল্যান্ড ফোন জ্যাকসহ খুলে নিয়ে এসে ডর্মে ফোন লাইন কোথা থেকে পেলে :-/


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    এই যুগের ক্যাডেটদের কাহিনী গুলো আগের প্রেম কাহিনীর চেয়ে একদম আলাদা। তবে যাই হোক না ক্যান, একটা হলুদ রঙের খামের ভিতর চিঠি লেখার প্যাডের উপর লেখা কিছু শব্দের আবেগ নতুন যুগের ক্যাডেটরা পায় না বলেই আমার বিশ্বাস। আর সেই পাতায় মাঝে মাঝে ভেসে আসতো পারফিউম। আহা ! কি সেই যুগ!


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  3. রায়েদ (২০০২-২০০৮)

    আমরা কলেজে মোবাইলে কথা বলার সুবিধার আগে একবার ভূগোলের জাকিয়া ম্যাডামের মোবাইল থেকে কথা বলেছিলাম।

    আমরা মানবিকের ৬ জন তার রুমে যেয়ে ক্লাস করতাম। মাঝে মাঝে ম্যাডাম আমাদের রুমে রেখে বের হয়ে যেতেন কোন কাজে। একদিন মোবাইল রেখে গেলেন। অতঃপর ক্যাডেটীয় বুদ্ধি এবং কার্য সম্পাদন।

    ক্লাস শেষে বন্ধুদের কাছে যেয়ে সেই কি পার্ট। মানবিক কেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভাল তার পক্ষে অনেক বড় একটা যুক্তি পেয়ে গিয়েছিলাম।

    😀 😀

    জবাব দিন
  4. প্রতীক(২০০৫-২০১১)

    আমি আর আমার রুমমেট তো ইলেভেনে ওঠার পরে হাউজ অফিস থেকে কথাই বলতাম না।কেউ যেন সন্দেহ না করে তাই এমনিই ২/৩ মিনিট লিখে রেখে এসে রুম থেকেই কল করতাম। 😉


    যাহা বলিব,সত্য বলিব,সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    টুয়েলভে আমি আর হোসেন ছিলাম রুমমেট।
    সে সায়েন্স, বায়োলজি সহ।
    আমি আর্টস। সারাদিন-রাত বাদরামি করি আর নয়তো ঘুমাই।

    মাঝে মাঝে হোসেন আইসা আমার খাট ধইরা টানা হ্যাচড়া কইরা আমার ঘুম নষ্ত করার চেষ্টা করতো। আমি ওর কানে কিছু মধু ঢেলে আবার ঘুমাতাম।

    এখন ভাবলে হোসেনের জন্য মায়া হয়।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  6. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    একবার হাউজ অফিস এর তালা খুলে পাওয়া গেলো একগাদা সিজ করা পোষ্টার।
    তাও আবার বাংলা সিনেমার ঢাউস পোষ্টার।
    ভরপুর বিনোদন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।