ক্যাডেট জীবনে ঘটনার ঘনঘটা

ঘটনা :

আমার ক্যাডেট কলেজের ১ম দিনটা নিয়ে বলতে গেলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের সাহায্য নিয়ে বলতে হবে…… শেষ হইয়াও হইবে না শেষ১টা ব্লগ লিখে ফেললাম অথচ এখনও সব কাহিনী শেষ হয়নি। আরও ১টা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ঘটনাটা ঘটেছিল আমাদের ক্যাডেট লাইফের ১ম ডিনারের পর, যখন আমরা হাউজে আসলাম। হাউজে এসে জানলাম ক্যাডেটদের নাকি রাতে ঘুমানোর সময় শয়ন পোশাক পরিধান করতে হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই বাসা থেকে সেই শয়ন পোশাক বানিয়ে এনেছিলাম। বাসা থেকে আনার কারনেই একেক জনেরটা একেক রকম আলাদা ডিজাইন আর কালারের ছিল। যাই হোক আমি আমার ড্রেস নিয়ে বাথরুমে গেলাম। আমাদের কলেজের বাথরুম গুলো অন্য কলেজ গুলোর মতোই। দুই সারিতে পাশাপাশি ৩টা করে। আমি আমার কাজ শেষ করে যেই না বের হলাম ওমনি আমার সামনের সারির বাথরুম থেকেও ১টা মেয়ে বের হল এবং অদ্ভুত ব্যাপার সে আমাকে দেখে ১টা চিৎকার দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে দরজা দ্রাম করে লাগিয়ে দিল।
ক্যাডেট কলেজ যাওয়া উপলক্ষে আমার মা আমার চুল ‘boy cut’ করে দিয়েছিলেন আর আমার চেহারা এমনিতেই আমার বাবার কার্বন কপি। সব মিলিয়ে আমার ওই ক্লাসমেট আমাকে দেখে ভেবেছিলো হয়তো বা ভুল করে কোনো ক্যাডেটের ছোটো ভাই কলেজেই রয়ে গেছে। হাহ এই ছিল আমার কপালে….!!!

ঘটনা :

ক্লাস নাইন। মনে হয় কলেজের সব চেয়ে অদ্ভুত ক্যাডেটরা ছিল আমার ডর্মমেট। ১ জনের উদাহরন দিলেই সবাই বুঝতে পারবেন।
গেমস গ্রাউণ্ডের পাশে জলাশয় মতো ১টা জায়গায় বড় বড় শামুক দেখে আমার সেই ডর্মমেটের মনে নতুন ভাবনার উদয় হল। সে শামুক পুষবে। তার সাধ রক্ষার্থে বিশাল বড় ১টা বালতি যোগাড় করা হল, তাতে গোটা কতক ইয়া ইয়া সাইজের শামুক আর মাটি দিয়ে আমাদের বারান্দায় রাখা হল। শামুক প্রজাতির খাবার সম্পর্কে আমাদের কোনো বিশদ জ্ঞান না থাকায় আমরা মাঝে মাঝে মাটি আর শ্যাওলা দিতাম। তবে অবাধ্য দুষ্টু শামুকেরা কখনো কখনো বালতি ছেড়ে বেরিয়ে পরতে চাইতো। তাই আমরা বালতির মুখ ১টা পাতলা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলাম। অতঃপর ভালই চলছিল আমাদের জীবন শামুক প্রজাতির সাথে। কিন্তু সেই সুখ নিন্দুক প্রজাতির আর সহ্য হল না।
কেউ ১ জন হাউজ মাস্টার কে কমপ্লেইন দিল। আর স্যার তৎক্ষণাৎ হাউজে ডিউটিরত ম্যাডামকে আমাদের ডর্মে পাঠালেন। এবং ম্যাডাম আমাদের কোনো কিছু না বলেই নিন্দুকের সুনির্দিষ্ট তথ্য মোতাবেক সোজা বারান্দায় প্রবেশ করলেন। বালতিটা আমাদের রুমে এনে উপরের কাপড়টা খুলে ফেললেন। এরপর যা ঘটলো তা হলো, এতো গুলো ঢাউস সাইজের শামুক দেখে বেচারি ম্যাডাম………
আমরা তাড়াতাড়ি ম্যাডামের মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে তাঁর সৎবিত ফেরালাম। মজার ব্যাপার হল হাউজ মাস্টার স্যার আমাদের কোনো বকাই দেন নি। শুধু হাউজ বেয়ারা দিদিকে বললেন ওগুলো ফেলে দিতে আর ম্যাডামকে বললেন “ওইটুকু শামুক দেখে এতো চিৎকার করার কি আছে?? আপনি এতো বড় মানুষ!!”  ম্যাডাম বোকার মতো হাসার চেষ্টা করে বললেন “সরি স্যার।”

ঘটনা :


“পিয়া পিয়া ক্যায়া কিয়া ক্যায়া কিয়ারে সানাম” বলিউডের এই গানটা যখন খুব পপুলার, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তখন CCC থেকে আমাদের কলেজে এলেন ভূগোলের জাকিয়া ম্যাডাম। আমাদের কলেজে আরেকজন জাকিয়া ম্যাডাম থাকায় উনার নাম হলো বড় জাকিয়া ম্যাডাম।
একদা প্রেপ টাইমে একঘেয়েমি কাটাতে আমরা কয়েকজন আমাদের C ফর্মে (ওয়াশরুমে) গেলাম। কথায় কথায় এই গানটার কথা চলে এল। কখন যে ম্যাডামও চলে এসেছেন বাইরে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমরা মনের সুখে গান আর ডান্স একসাথে শুরু করলাম
“পিয়া পিয়া ক্যায়া কিয়া……”
ম্যাডাম বাইরে থেকে কি যে শুনলেন জানি না তবে আমাদের প্রত্যেকের পিঠের উপর দ্রিম দ্রিম আওয়াজ শুনলাম একটু পর।

ঘটনা :

আমাদের ৭ দিনের এক্সকারসনে তখন আমরা। ১দিন সন্ধ্যায় সবাই বীচ মার্কেটে শপিং করছি। স্বাভাবিক ভাবেই রাস্তায় কোন মেয়ে থাকলেই সবার চোখ সেদিকে থাকে। আর সেখানে আমরা ৫২টা মেয়ে (আমরা ৫০+ফর্ম মাস্টার ম্যাডাম+এডু স্যারের ওয়াইফ) একসাথে, সবার মধ্যে ড্যাম কেয়ার ভাব। সবাই ইচ্ছামতো জোরে জোরে আরেকজন কে ডাকছে……হাসছে……কথা বলছে। তাই মার্কেটের সবার চোখ আমাদের দিকে। এমনকি ফিল্ম স্টার আমিন খান কেও কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। বেচারার অহমে গিয়ে লাগলো ব্যাপারটা। এরি মধ্যে আমাদের ১ ক্লাসমেট তার কাঁটা ঘায়ে লঙ্কা যোগ করলো।
আমিন খান ছোটো ঘুপচি টাইপ ১টা দোকানের বাইরের দিকে দাঁড়িয়ে বেডকাভার দেখছিল। আমরা কয়েকজন ওই দোকানে ঢোকায় ছোটো দোকানটায় ভিড়
জমে গেলো। আমাদের সেই ক্লাসমেট ভিড়ের মধ্যে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে “দেখি ভাই দেখি। আরে আপনি কি? সরেন না কেনো? সাইড দেন।”
বেচারার চেহারা ছিল দেখার মতো!!!

ঘটনা
:

ক্লাস ১২।  HSC পরীক্ষার শেষ দিন। ব্রেকফাস্টের পর সবাই বাসে উঠছে আস্তে আস্তে। আমি আর আমার ডর্মমেট ৪ তলায় থাকতাম বলে রোজই সবার শেষে বাসে উঠতাম। ওই দিনও মনের সুখে হেলতে দুলতে নামছি, শেষ এক্সাম বলে কথা। কিন্তু বিধি বাম। দেখলাম আমাদের CP দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে আমাদের ২জনের দিকে। সে আমাদের যা জানালো তা শুনে আমাদের আত্মা শুকিয়ে গেলো।
আমাদের রেড হাউজের কোনো ১ জুনিয়র অথোরিটির কাছে ফাঁস করে দিয়েছে আমাদের সেলফোন লুকিয়ে রাখার গোপন জায়গার কথা। আর ওই হাউজের ৬-৬টা সেল ইতিমদ্ধে ধরা পরে গিয়েছে। আমরা সেলফোন রাখতাম টিউব লাইটের পেছনে যে ১টা বক্সমতো structure আছে তার ভেতর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ৪ তলায় উঠে এলাম। তাড়াহুড়ো করে সেল দুটো টয়লেটের ফ্লাশবক্সের ভেতরে রাখলাম চার্জার সহ। MP3 নিলাম জুতার ভেতর আর সিম নিলাম কলেজ ব্যাচের ভেতর। কিন্তু হেডফোন কোথাও রাখতে ভুলে গেলাম। মাঝ সিঁড়িতে এসে মনে পড়ায় আবার দৌড়ে গেলাম উপরে। ততক্ষণে বাস বারবার হর্ন বাজাচ্ছে আমাদের ২জনের জন্যে। জলদি করে হেডফোনটা পকেটে নিলাম।
কিন্তু আমাদের A ফর্মের ফর্ম মাস্টার ছিলেন নাজনীন ম্যাডাম :gulli2: তাই বাসে ওঠার পর থেকে মনে হচ্ছিল উনি যদি নামার আগে আমাদের সবাইকে চেক করেও নামান তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। অগত্যা হেডফোনটা বিসর্জন দেবো বলে মনস্থির করলাম। আমি ছিলাম বাসের একদম পেছনের সিটে। হাতটা বাইরে বের করে ফেলে দিলাম ওই অলক্ষনে জিনিস। কিন্তু আসলেই অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়।

কলেজ বাসের ঠিক পেছনে ছিল ১টা বাইক আর তাতে ছিল দুইজন বাইকওয়ালা। আরোহী দুই জনই ছিল চেংরা টাইপ পোলাপান। তারা হেডফোনটা উঠিয়ে বাসের পেছন পেছন আসতে লাগলো আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলো “ওই ক্যাডেট বাস…………থামেন………আরে বাস থামান।”
আমি তো শুধু যত রকম দোয়া দরুদ পারি সব পড়েই যাচ্ছি। যাক অবশেষে চিরসহায় এই অসহায়কে সহায় দিলেন। বাস ‘ফেনী সরকারি কলেজ’ পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমি আর আমাদের CP সবার আগে আগে নেমে পড়লাম। জীবনে প্রথম বার ভদ্র মেয়ের মতোন ম্যাডামের পা ছুঁয়ে দোয়া নিতে নিতে দেখলাম, ওই দুই আরোহীকে বাসের কাছাকাছিও আসতে দিচ্ছে না আমাদের কলেজের স্টাফজী আর গার্ডরা। এমনকি স্টাফজীর বকায় তো ওদের কথাও শোনা যাচ্ছিল না। অবশেষে স্বেচ্ছাসেবী আরোহীরা বিমর্ষ বদনে প্রস্থান করলেন।
মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম, যাক গার্লস ক্যাডেট বলেই আজ রেহাই পেলাম।

৪১ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট জীবনে ঘটনার ঘনঘটা”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    :khekz: :khekz: :khekz:
    দূর্দান্ত হয়েছে, ঝুলিতে আরো যত ঘনঘটা আছে একে একে ছাড়তে থাক :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. পিয়া(০৩-০৯)

    ব্যাপক মজা পাইলাম...ফোন লুকানোর ঘটনায় অনেক কিছু মনে পরে গেল...কত বিচিত্র জায়গায় যে ফোন রাখতাম...একটা বলি...আমাদের একজন ফোন রাখত প্রিঙ্গেলসের কৌটায়...আর সেইটা রাখত খুল্লাম খুল্লা,ডেস্কের উপরে...আমরা একচুয়ালি লুকানোর সময় টিচারদের সাইকোলজি এনালাইজ করতাম,এমন জায়গা সিলেক্ট করতাম,যেখানে তারা খুজেও দেখতে যাবে না...আর আমি সবসময় সাথে রাখতাম...একদিন ডিনারে বসে আমার ফোন ভাইব্রেট করা শুরু করসে,পাশে দাঁড়ানো ওয়াইসি...জুনিওররা সবাই তাকায়ে আছে,কিসের শব্দ!!!ভয়ে সেদিন আমি শেষ...

    জবাব দিন
  3. মুহিব (৯৬-০২)

    ** ভাইরে আমাগর সময় যমুনা নদীর ঐ পারে নেটোয়ার্ক ছিলো না। তবে বি এম এ তে গিয়া অর্ডার্লিদেরটা ব্যাবহার করতাম ৭ টাকা মিনিট।
    ** যে ম্যাডাম শামুক দেইখা ভয় পায় তারে খুব দেখতে মঞ্চাইতাছে। আমার মাথায়তো এখনই ক্যাডেটিয় বুদ্ধি গিজগিজ করতাছে ম্যাডাম আর শামুক নিয়া।
    ** নাজনীন ম্যাডাম কি ফিজিক্স এর না কি? সেই যে পিচ্চি ম্যাডামটা উনি না কি? আমরা শেষের দিকে পাইছিলাম। উনি কি খুব জ্বালায় না কি? আমগর লগে ত...... ( থাক বাচ্চা পুলাপান এইগুলা শুনতে চাইছ না)। তয় ম্যাডাম ত ভালুই আছিল।

    জবাব দিন
    • রিদওয়ান (২০০২-২০০৮)

      মীম ও খেয়া,
      তোমাদের অনুরোধের জন্যে নাজনীন ম্যাডামের কিছু ব্যাপার বলছি। মুহিবুল ভাই, দোষ হইলে জাহাঙ্গির ভাইকে বলে দিয়েন, বাসায় আসলে আমাকে লকার স্টিক ইস্যূ করবেন।
      আমাদের কলেজে রসায়নের একজন স্যার ছিলেন, শাহীন স্যার। টিজ নেম ছিল শাল্টু, :)) আমাদের মানে এ ফর্মের ফর্ম মাস্টার। উনি ছিলেন ম্যাডামের সমসাময়িক সিনিয়ার। ম্যাডাম আবার বি ফর্মের ফর্ম মাস্টার। স্যার ম্যাডামকে খুব পছন্দ করতেন 😡 । ম্যাডাম আর স্যারকে নিয়ে কলেজে অনেক কানাঘুষা ছিল। দুইজনকে একসাথে দেখা যেত সবসময়। ক্লাস সেভেনের এক্সকারশনের পর স্যার ম্যাডামকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আরেকজন স্যারের মাধ্যমে। কিন্তু বিধি বাম =(( , ম্যাডাম সাড়া তো দিলেনই না, উল্টো ভিপির কাছে কমপ্লেইন :gulli: 😮 । ম্যাডাম ভিপিকে জানান যে শাহীন স্যার নাকি তাকে বিরক্ত করছেন 😕 , যা ছিল পুরাই ভুয়া :thumbdown: । পরে ফর্ম থেকে শাহীন স্যার চেঞ্জ :chup: , ফর্ম মাস্টার হিসেবে নতুন যিনি আসলেন তিনি আবার হান্টু(টিজ নেম), শাল্টু গেল, হান্টু এল। এনিওয়ে, ম্যাডাম সিনিয়ারদের সাথে এবং তার ইনটেকের সাথে অনেক ফ্রেন্ডলি ছিলেন। ম্যাডাম কেন স্যারকে রিফিউজ করেন, তার কারন এখানে বলা যাবে না। ওটা তোমরা সাবরিনার(ঢাকা বিঃ) কাছেই শুনে নিও। একবার ওকে আমি জানিয়েছিলাম।

      জবাব দিন
  4. মীম (২০০৬-২০১১)

    আচ্ছা ভাইয়া আমরা সাব্বোর কাছ থেকে শুনে নিবো...
    তবে ভাইয়া আমরা তো ম্যাডামের সাথে ভূগোলের দেলোয়ার স্যার কে নিয়ে প্রথম দিকে 😡 ভাবতাম। তবে পরে অবশ্য দেখলাম স্যার বিবাহিত =(( =((

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুহিব্বুল (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।