মাথার-ব্যামো-১

ব্যাপারটার শুরু হয় একদিন বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ভেজার পর।ঘাড়ের পিছন থেকে হালকা একটা চিনচিনে ব্যথা মাথার তালু পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।আমি ফার্মগেট থাকি,কোচিং করি।মনে অনেক স্বপ্ন।মাত্র ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হলাম।এইসব ব্যাথাকে পাত্তা দেয়ার সময় কখন?তাই বাড়ি ছেড়ে ফার্মগেটে চলে এলাম।ব্যাথা টাও আমার সাথে এল।প্রতিদিন আমাকে জ্বালাতে লাগল।ব্যাথাকে থোরাই কেয়ার করে দিন কাটল।এদিকে ISSB র কল চলে আসছে।কেনাকাটা করে বাসায় গেলাম আগেরদিন।ব্যাথা নিয়েই গেলাম এবং যথারীতি স্ক্রীন্ড আউট হয়ে চলে আসলাম।এরপরই ঘটনা ঘটা শুরু হল।চিনচিনে ব্যাথা শেষ হয়ে দপদপ ব্যাথা শুরু হল।কিন্তু ঢাকার মায়া ছাড়তে পারলামনা।ফিরে গেলাম বন্ধুদের সাথে।একদিন ইফতারির পর মাথাব্যাথার জ্বালায় আর উঠতে পারলাম না।আমার চাচাত ভাই ইসলাম বাসায় ফোন করে সব আব্বুকে বলল।বাবার নির্দেশে পরদিন বাসায় চলে আসতে হল।ডাক্তার দেখালাম।ঘুমের ওষুধ দিল।দিন পাচেক পড়ে পড়ে ঘুমালাম।কিন্তু ব্যাথা আরও বাড়ল।ডাক্তার পালটালাম,কিন্তু লাভ হল না।আমার অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল।অবশেষে ঈদ এল।আমার জীবনে কাটানো সবচেয়ে খারাপ ঈদ।ঈদের পর অবস্থা আরও খারাপ হল।অবস্থা খুব খারাপ দেখে ডাক্তার   CT SCAN করাইতে বলল।করাইলাম এবং রিপোর্ট আসল।আব্বু রিপোর্ট নিয়া নিওরো-সার্জনের কাছে গেলো।তবে ডাক্তার কী বললেন তা কাঊকে খুলে বলল না।শুধু বলল ছোট একটা অপারেশন করাইতে হবে।আমার তখন এইসব শোনার বা জানার মতো অবস্থা নাই।সারাদিন সেন্সলেসের মত বিছানায় পড়ে থাকি।শুধু এই ব্যথা থেকে পরিত্রাণ চাই।দুই দিন পর সন্ধ্যায় একবার বমি করে সেন্সলেস হয়ে গেলাম।তখন আব্বু-আম্মূ ডিসিশন নিল আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।সাথে সাথে এম্বুলেন্স ডাকা হল।আসা মাত্রই আমাকে গাড়িতে তোলা হল।সঙ্গে আব্বু,আম্মূ,ইসলাম এবং ইসলামের বাবা-মা অর্থাৎ আমার চাচা-চাচী।গাড়ী ছাড়ল টিকাটুলির সালাঊদীন হাসপাতালের উদ্দেশশে যেখানে ঐ ডাক্তারের চেম্বার।পথে এমন প্রাকৃতিক ডাক আসল যে মাথাব্যথা কমে গেল।অবশেষে রাত সাড়ে নয়টার দিকে হাসপাতালে পৌছালাম।আগেই কেবিন বুক করা ছিল,নয় তালায়।কেবিন নং ৩০২।কোনমতে কেবিনে ঢুকে আগে টয়লেট সারলাম।বের হয়েই দেখি নার্স হাজির।স্যালাইন লাগিয়ে দিল আর একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেল।ব্যাস, রাত কাবার হয়ে গেল।পরদিন সকালে দেখলাম ঐ এলাকার আত্মীয়রা এবং আমাদের সাকিব এসে হাজির।তখনও আমি জানিনা আমার ট্রিটমেন্ট কি হবে। হঠাৎ শুনি নার্স এসে বলল পেশেন্ট রাত ১১টার সময় ওটি তে যাবে।আমি মাকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম'”আমার কি অপারেশন হবে?” মা-বাবা বলল মাথার সামনে নাকি পানি জমেছে,সেটা মেশিন দিয়ে বের করা হবে। কোন ব্যাপার না।একটু পরেই ওয়ার্ডবয় এসে মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে গেল।তারপর গেলাম বুকের এক্স-রে করাতে।উদ্বেগে কাটল বিকেলটুকু।আশেপাশের সব আত্মীয়রা এসে দেখা করে গেল।অনেকে রয়ে গেল।অনেকে প্রশ্ন করল ভয় হচ্ছে কিনা।উত্তরে আমার বাবা বললেন ‘আমাদের মেহেদী এসবকে ভয় পায়না।’আমার মনোবল বেড়ে গেল। বাড়াতেই হবে কারন হল প্রথম অপারেশন সফল হলে কয়েকদিন পর আরও একটি অপারেশন চালানো হবে-মানে বাবা বলেছিল অপারেশনটা ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।আস্তে আস্তে সময় ঘনিয়ে আসল।আমাকে ওটি তে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হল।সবার কাছে দোয়া চাইলাম।শেষ মুহূর্তে বাবা-মার সাথে কিছু সময় কাটিয়ে নিলাম।তারা আল্লাহর নাম নিতে বলল।অবশেষে আমায় ওটি তে নিয়ে যাওয়া হল।আমি ভেবেছিলাম  Nothing so serious. কিন্তু যেই ঢুকলাম,দেখলাম একদিকে সার্জারির যন্ত্রপাতি র-নার্স এবং অপরদিকে একটি টিভিতে ডিপজলের ছবি চলছে।কিন্তু মেইন ডাক্তার,আব্দুল্লাহ আল আলমগির প্রবেশের পর সব চুপচাপ হয়ে গেল।আঙ্কেল আমার সাথে কথা বলে আমাকে হালকা করার চেষ্টা করলেন।বললেন সে আমার বাবার বড়ভাই। তারা একই স্কুলে পরেছেন,একসাথে ফুটবল খেলেছেন ইত্যাদি।হাতে একটা হারটবিট মাপার যন্ত্র ও স্যালাইন লাগান হল।আমি মনে মনে তাওবা, আয়াতুল কুরসি,কালেমা ইত্যাদি যত দোয়া জানি পড়তে লাগলাম।একটা অক্সিজেন মাস্ক পরান হল।বলা হল শ্বাস নাও।দুই-তিনবার নিলাম।তারপর শুন্যতা…………………………………………………………………………………………………  -মেহেদী…মেহেদী……                                                                                                                                                                                                                       -ও…                                                                                                                                                                                                                                                       -চোখ খোল।আমি খুললাম।বলা হল জিহ্বা দেখাতে।আমি দেখালাম  এবং দেখতে পেলাম আমার শরীরটা উচু করে ধরে ট্রলি বেডে শোয়ানো হচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পেলাম এবং আবারো ঘুমের কোলে হারালাম।যখন আবার ঘুম ভাঙল দেখলাম মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগান। তখন প্রচুর কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল তখনি মারা যাব। দোয়া পরছিলাম মনে যেটা আসছিল। একজন নার্স বোধহয় ব্যাপারটা খেয়াল করল। জিজ্ঞেস করল ‘কি? কষ্ট হচ্ছে? মাস্ক খুলে দিব?’ আমি মাথা নাড়ালাম। সে মাস্ক খুলে দিল। তখন প্রায় রাত দুইটা- আড়াইটা হবে।আমি বুঝতে পারলাম আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখানে কেবল রোগী এবং নার্সরাই আছে। অর্থাৎ আমি আই সি ইউ তে। সেখানে অনেক সদ্য জন্ম নেয়া শিশু এবং মা-রা রয়েছে।আমি অপেক্ষায় রইলাম কখন কেউ আমাকে দেখতে আসবে। অনেকক্ষণ কেটে গেল, কেউ এলনা।সেখানে ঘড়িও ছিলনা যে দেখব কয়তা বাজে। একসময় অসহ্য হয়ে বললাম ‘কেউ কি আছেন আমারে আমার কেবিনে দিয়ে আসেন।’একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল ‘এখন তো যাওয়া যাবে না।আগে স্যার আসুক তারপর।’ বললাম ‘স্যার কখন আসবে?’উত্তর হল বিকেলে।আমার মন আবারো ভেঙ্গে পরল।এদিকে ব্যাথা আবার ফিরে আসতে লাগল। আস্তে আস্তে বাড়তেও লাগল।মনে হচ্ছিলো মা-বাবা কেউ আমার কথা চিন্তা করছে না। জীবনে আরও একবার প্রিয়জনদের দেখার আকুল মিনতি আমাকে পেয়ে বসল। প্রচণ্ড রাগ হল,কান্না আসল, ব্যাথা আরও বেড়ে গেল। বুঝতে পারছিলামনা অপারেশনের পরেও কেন ব্যাথা এতটুকু কমছেনা।এমন সময় চেনা মুখ দেখতে পেলাম।আমার চার জিগ্রি দোস্ত- মিতুল(ইসলাম),নাহিদ,হুসাইন ও সবুজ। প্রচণ্ড ভালো লাগল। ওরা কাছে আসল, জিজ্ঞেস করল ‘কি অবস্থা?’ বললাম ‘ভালই, তবে ব্যাথা যায় নাই।অপারেশন কি আনসাকসেফুল?’ ওরা বলল ‘না,ব্যাথা এখন থাকবেই, সেকেন্ড অপারেশনের পর ঠিক হয়া যাবে।’ নার্স পাশ থেকে বলল বেশি কথা বলবেন না। আমি ওদের বললাম আব্বু-আম্মুকে পাঠিয়ে দিতে। ওরা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই তারা আসলেন। আমি আব্বুকে বললাম আঙ্কেল্ কে ফোন করে তারাতারি কেবিনে নিয়ে যেতে। আব্বু বলল বিকেলের আগে পারা যাবেনা। তাছাড়া এখানে আমাকে ভালর জন্যই রাখা হয়েছে।আম্মু স্যুপ নিয়ে এসেছিল,সেটা খাওয়াল। ব্যাথা কমেনা কেন জিজ্ঞেস করার পর আম্মুর চোখে ভয় দেখতে পেলাম।মনে হল কিছু একটা আম্মু জানে যেটা আমি জানিনা। নার্সকে বলা হলে সে ডাক্তারকে ফোন করে দুইটা ইঞ্জেকশন দিল। বলল চলে যাবে। এরপর বড় চাচী এল,তাকে আমার ছোট মাও বলা যেতে পারে। কেন এই বিষয়ে পরে বলব। আমাকে সবুর করার পরামর্শ দিয়ে গেল। তারা আরও কয়েকবার আসা-যাওয়া করল। ফজরের আজানের কিছু আগে ব্যাথা প্রচণ্ড বেড়ে গেল। নার্সকে আবারও বললাম। তিনি ডাক্তারকে ফোন করে বললেন। আমাকে ইনজেকশন অমিট করে সাপজিটর =(( =(( =((  দেওয়া হল। এবার ব্যাথা একটু কমল। সারাদিন বিভিন্ন আত্মীয়রা আসলেন, আসলেন না আমার আশার মানুষটি – ডাক্তার আঙ্কেল। বিকেলে হঠাৎ  দেখি রাজভি ভাই এসে হাজির। সাথে ঐ হাসপাতালের এক ইয়ং ডাক্তার। এক্সক্যাডেট বরভাই দেখে বিরাট ভরসা পাইলাম।আমার খবর জিজ্ঞাসা করলেন, কোন আসুবিধা হচ্ছে কিনা।বললাম রাতে একটুও ঘুম হয়নাই আর আমারে তারাতারি কেবিনে পাঠানর ব্যাবস্থা করেন।ভাই তার সাথের ডাক্তারের সাথে কথা বললেন। আমাকে বললেন চিন্তা না করতে- ঘুমের ওষুধ দেওয়া হবে এবং সময়মত কেবিনে পাঠিয়ে দেয়া হবে।সন্ধ্যার পর ডাক্তার আসলেন। আমার সাথে কথা বললেন এবং কেবিনে নিয়ে যেতে বললেন। বিরাট শান্তি পাইলাম। একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে আমাকে কেবিনে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কেবিনে যাওয়ার পর সবার চেহারা দেখে ঘুমের কোলে ঢলে পরলাম।(চলবে)

৩,৩৬৭ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “মাথার-ব্যামো-১”

মওন্তব্য করুন : arsabuj

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।