প্রবাসের ডায়েরি থেকে…(প্রথম খন্ড) – শেষ

প্রবাসের ডায়েরি থেকে…(প্রথম খন্ড) – ১
প্রবাসের ডায়েরি থেকে…(প্রথম খন্ড) – ২

৭। মাঝে মাঝে উদ্দ্যেশহীন ভাবে সারারাত ঘুরে বেড়াতে আমার ভালোই লাগত। এখানে দিন আর রাতের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কর্মব্যস্ত দিনের কোলাহল আর চঞ্চলতার পর ক্রমেই শান্ত হতে থাকে শহরটি। শপিং মলগুলো সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে থাকে রাস্তাঘাট। নিরবতা নেমে আসে। নাইট বাসগুলো চলতে শুরু করে। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত মানুষগুলো বার আর ক্লাবগুলোতে ভীড় জমায়। রাস্তাঘাট, বাস, বাস স্টপ, টিউব স্টেশন আর পার্কগুলো নিশিকন্যাদের আগমনে পূর্ণতা পায়। নাইট বাসগুলোর কল্যানে বেশ মজার মজার ঘটনা চোখে পড়ে। সভ্যতার মাপকাঠিতে প্রায় নিঁখুত এই শহরে ছিনতাই বলে যে কোন শব্দ থাকতে পারে তা আমার ধারনার বাইরে ছিল। সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে মাঝ বয়সী একটা ছেলেকে কয়েকজন নিগ্রো যেভাবে নির্যাতন করল, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। লন্ডনে আসার পর থেকেই শুনেছি, যে কোন জরুরী প্রয়োজনে ৯৯৯ এ ফোন করতে হয়। একবার মনে করেছিলাম একটা ফোন করি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস হয়নি।

ছুটির রাত গুলোতে (শুক্রবার আর শনিবার রাত) জমে ওঠে মায়াবি এই শহর। মনে হয় অন্য একটা জগৎ। নাইট ক্লাব, বার, কল গার্ল, মাতলামি, গান, নাচ……… কি নেই সেখানে? নিশাচরী অপ্সরীরা মর্ত্যের মানবদেরকে স্বর্গীয় শান্তি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সভ্য দেশের মানুষের এই উন্মত্ত্ব অসভ্যপনার মধ্যেই যেন সৃষ্টির সকল সুখ নিহিত।

৮। আর মাত্র ২ ঘন্টা পর ২০০৩ হয়ে যাবে অতীত। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত লন্ডন। বিল্লাহ ভাইয়ের রুমে বসে বিদায়ী বছরকে উৎসর্গ করে জীবনে প্রথমবারের মতো শ্যাম্পেইন পান করলাম। বেশ অনেকখানি খেয়ে ফেললাম। ভেবেছিলাম ঘোর লাগা একটা অনুভুতি হবে। তেমন কিছুই হলো না। বাংলাদেশ সেন্টার থেকে ৮ জনের একটা গ্রুপ নতুন বছরের আগমন মূহুর্তকে স্বরণীয় করে রাখতে বের হলাম রাস্তায়। থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত টিউবে করে চলে আসলাম পার্লামেন্ট হাউজ “বিগ ব্যান” এর কাছাকাছি। কোথাও তিল পরিমান জায়গাও নেই। মানুষ আর মানুষ। এ যেন বিশাল জনসমুদ্র। সবার দৃষ্টি বিগ ব্যানের বিশালাকৃতির ঘড়িটির দিকে। ১১ টা ৫৯ মিনিট। চারিদিকে এতো মানুষ, তবুও পিন পতন নিরবতা। সেকেন্ডের কাটার টিক টিক শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সহস্র কন্ঠের গগন বিদির্ণ চিৎকারে আকস্মিক নিরবতা ভঙ্গ হলঃ দশ… নয়… আট… সাত… ছয়… পাঁচ… চার… তিন… দুই… এক… এন্ড হ্যাপি নিউ ইয়ার…………

মূহুর্তের মধ্যে বর্ণিল আতশবাজির স্বপ্নিল খেলা আর হৃদয় কাপানো সঙ্গীতে অপূর্ব স্বর্গপুরীতে পরিনত হল এই নগরী। বর্ষবরণে অজস্র মানুষের মাতলামি আর পাগলামির সাথে মিশে গিয়ে ভোরের দিকে নিজেকে আবিস্কার করলাম টেমস নদীর পাড়ে একটি বেঞ্চের উপর। আমাদের গ্রুপের আর কাউকেই আশেপাশে দেখতে পেলাম না।

৯। দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন পার করে দিলাম। ছুটি প্রায় শেষ হয়ে এল। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার উপলক্ষ্য খুঁজে বেড়াচ্ছি। এক বছর বি এম এ ট্রেনিং এর পর এমন একটা ছুটি কাটানোর সৌভাগ্য কত জন পায়? আর আমার তো আজ বি এম এ’র ড্রিল গ্রাউন্ডে শরীরের রক্ত পানি করে স্টাফের সাথে ইঁদুর-বিড়াল খেলার কথা ছিল। এগুলো চিন্তা করে এখন কিছুটা হলেও স্বস্তি অনুভব করছি।

০৪ জানুয়ারী ২০০৪, রবিবার। “ওয়াটার লু” স্টেশনে আমি আর তৌহিদ কেম্বার্লি গামী ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছি। ঈস!! কত্ত মজাই না করলাম ছুটিতে। মাত্র তিন সপ্তাহ ছিলাম এখানে কিন্তু মনে হচ্ছে এই শহর, শহরের রাস্তাঘাট, মানুষজন সবকিছুই হাজার বছরের পরিচিত। একেবারে আপন করে নিয়েছিলাম শহরটিকে। বিগত কিছুদিনের আনন্দময় স্মৃতিগুলো চিন্তা করতে করতে কখন যে আনমনা হয়ে গিয়েছি টেরও পাইনি। তৌহিদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, “চল, ট্রেনে উঠতে হবে”। ব্যাগগুলো সামলে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। মনে পড়ে গেল বি এম এ তে প্রথম যোগদানের জন্য যখন ঢাকা থেকে বাসে উঠেছিলাম সেই দিনের কথা। সেদিন স্বজ্ঞানে মর্ত্যের জাহান্নামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। আজ রয়্যাল মিলিটারী একাডেমি, স্যান্ডহার্স্টে আমার প্রথমদিন। জানি না ওখানে কি অপেক্ষা করছে।

২,৩২৫ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “প্রবাসের ডায়েরি থেকে…(প্রথম খন্ড) – শেষ”

  1. রকিব (০১-০৭)
    সহস্র কন্ঠের গগন বিদির্ণ চিৎকারে আকস্মিক নিরবতা ভঙ্গ হলঃ দশ… নয়… আট… সাত… ছয়… পাঁচ… চার… তিন… দুই… এক… এন্ড হ্যাপি নিউ ইয়ার…………

    এইবছর আমিও গেছিলাম কাউন্ট ডাউনে। কিছু সুখস্মৃতি আছে, কওন যাইবো না।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    আগের পর্বগুলা পড়িনাই তাই মাফ চাই।

    আমার ধারণা ছিল আপনি আর্মি। লেখা পড়তে যেয়ে একটু কনফিউজড হয়ে গেলাম। যাই হোক, পরে খোলাসা হইছে।

    ভোরের দিকে নিজেকে আবিস্কার করলাম টেমস নদীর পাড়ে একটি বেঞ্চের উপর

    😀 😀 😀

    জবাব দিন
  3. সামি হক (৯০-৯৬)

    খুব ভালো করসিলা মিয়া ৯৯৯ এ ফোন দাও নাই, ফোন দিলে পুলিস এসে তোমারে একগাদা প্রশ্ন করতো, তারপর দেখা যাইতো যারে মারসে সে বলতেসে তারে কেউ মারে নাই।

    তোমার লেখাটা পড়ে বুঝতে পারলাম লন্ডন শহরটাকে আমি অনেক বেশি মিস করি। এতো জম জমাট একটা শহর...

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটি ছিল তো, তাই।

    ছুটিতে ছুটিতে তো প্যাচ লাগায় ফেললাম। কোন ছুটির কথা কও, এখনকার, নাকি তখনকার?


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ওহ, আসল কথাই তো বলতে ভুলে গেছিলাম... আর্সেনালের জার্সিতে তোরে জব্বর লাগতেছে... :thumbup: :thumbup: :thumbup:

    আর্সেনাল :thumbup: :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।