ভালোবাসি……জনম জনম

কি আশ্চর্য!! বাসে উঠেই আমি ভিমড়ী খেয়ে গেলাম। আজ সিট খালি দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, সাত-পাঁচ না ভেবে বসে পড়লাম মাঝামাঝি একটা সিটে। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে ব্যস্ত শহর দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কিন্তু কি অদ্ভুত, কোথাও ব্যস্ততার লক্ষন মাত্র নেই। খেয়াল করে দেখলাম, রাজলক্ষ্মী থেকে বনানী পর্যন্ত চলে এসেছি কিন্তু কোথাও যানজট এ বাস আটকা পড়েনি!! যোগাযোগ মন্ত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হওয়াকে মনে মনে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। মিষ্টি একটা রোদ খেলা করছে বাইরে। শহরটাকে বেশ ছিমছাম পরিপাটি লাগছে। রাস্তায় রাজ্যের ধুলো নেই, গাড়ির সেই পুরনো বীভৎস ক্রমাগত হর্ন নেই। রাস্তার মাঝখান দিয়ে উসাইন বোল্ট হবার স্বপ্ন নিয়ে দু একজন উজবুক পথচারীর ১০০ মিঃ স্প্রিন্টও দেখা যাচ্ছেনা। শরতের ভেজা ভেজা বাতাস চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। জানালা দিয়ে মাথাটা হালকা বের করে দিলাম। বাস এখন মহাখালী, কি অদ্ভুত!! রাস্তার খানা-খন্দ গুলো কোথায় যেন গায়েব। পুরাই ঝকঝকা ফকফকা রাস্তা। মনে মনে সিটি কর্পোরেশন এর বিস্তর গুণগান গাইলাম। দূরে দেখছি এক বৃদ্ধাকে ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা পার করে দিচ্ছে।

ফার্মগেট চলে এসেছি, মহুয়াকে দেখা যাচ্ছে বাসস্ট্যান্ড এ। বুকের কাছটায় কি যেন একটা পাক খেয়ে গেলো মনে হচ্ছে।
– ওই মহুয়া, উঠে আয়।
– তুই এই বাসে? দাড়া আসছি।

আমার পাশের সিটটা খালিই ছিল। কিছুক্ষনের মাঝেই মহুয়ার দখলে চলে এল সেটি।

– হেডফোনটা খোল কান থেকে।
– কেন?
– আহা, খোল না। তোর সাথে আমার জরুরী কিছু কথা আছে।

ওকে আজ এতো সুন্দর লাগছে কেন? এই ভয়ানক দজ্জাল মেয়েটিকে আমি যে এতো ভালোবাসি সেটা যদি ও বুঝত! হালকা সবুজ রঙের সালওয়ার এর সাথে ম্যাচ করে সবুজ ব্রেসলেট। রোদে দাঁড়িয়েছিলো বলে বাম পাশের ফর্সা গালটা লাল হয়ে আছে। কে বলবে এই মায়া মায়া চেহারার মেয়েটি মার্শাল আর্ট জানে, ভার্সিটির গুন্ডা পান্ডা গুলাও ওকে সমীহ করে। একবার থার্ড ইয়ারের শাহেদ ভাই মহুয়া কে প্রেমের প্রস্তাবও দিয়েছিল। ভাইয়া পলিটিক্স করতো, অন্যরকম ক্ষমতা ছিল তার। মহুয়া তাকে এমন সাইজ করল…এরপর আর কেউ এমন কিছু করার দুঃসাহস করেনা।

কিন্তু আজ ওর চেহারায় কাঠিন্যের লেশমাত্রও নেই। অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা, চোখে-মুখে রাজ্যের রহস্য। রহস্যের আধার এই মুখটা আমার কতইনা পরিচিত। মহুয়ার জরুরী কথাটা আমি জানি। তার এই অসম্ভব জরুরী কথা দিনে আমাকে হাজার বার শুনতে হয়। মহুয়াকে যে আমি অসম্ভব ভালবাসি।

* * * * * * * * * * * * * * * * * * *

দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে।

– ভাই যাইবেন কই? ও ভাই…

এক ঝটকায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমি চারপাশে হতবাক হয়ে তাকাচ্ছি। বাস এ মনে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। পারলে আমার কোলেও বসে পড়ে। বাইরে তাকালাম, নাহ- বাস চলছেনা, পুরাই স্থির। বোঝার চেষ্টা করলাম কোন জায়গা- হ্যাঁ, মহাখালী। তবে সামনে যেই জ্যাম, ২ ঘণ্টার আগে কিছু ভাবা যাবেনা। স্বপ্নের সাথে বাস্তবের যোজন যোজন পার্থক্য। মোবাইলটা একটানা বেজেই চলেছে। মহুয়ার কল-

– ওই হারামজাদা, তুই কই?
– মহাখালী, জ্যাম নামক প্রেশার কুকার এ আটকা পড়ে আছি।
– তোর জ্যাম এর গুষ্টি কিলাই। আয় তুই আজকে…

ফোন কেটে দিলো মহুয়া। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে এলো। এই আমার পরিচিত মহুয়া, ভার্সিটির সহপাঠী। এই মহুয়াকেই আমি ভালোবাসি যে কিনা আমার হাড্ডি গুড্ডি প্রতি মিনিটে মিনিটে ভেঙ্গে দিতে চায়। যার চোখে ভালোবাসা নয়, খেলা করে এক অদম্য হিংস্রতা। শাহবাগ এর মোড় এ চলে এসেছে বাস। ভীড় ঠেলে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে এক নিঃশ্বাসে ছিটকে বের হয়ে এলাম। সারা শরীরে হাযারও মানুষের + আমার ঘামের চ্যাটচ্যাটা গন্ধ। লাইব্রেরীর সামনে আসতেই মহুয়াকে দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে তলোয়ার উচিয়ে ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই গটগট করে এগিয়ে আসছে। এক কোপে এখন আমার কল্লা উড়িয়ে দিবে। নাহ, সেরকম কিছুই হয়নি। মহুয়া বিধ্বস্ত, আগুনভরা নয়নে কে যেন আজ জল ঢেলে দিয়েছে। থমথমে মহুয়ার মুখের দিকে ছেয়ে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল ভিতরটা।

– ওই, কি হইসে?

মহুয়া নিঃশব্দে আমার দিকে ডায়রিটা বাড়িয়ে দিলো। আরে, এতো আমারি ডায়রি। নীল রং এর চামড়ায় বাঁধানো, আমার মা শখ করে কিনে দিয়েছিল। ১১০০ ভোল্ট এর ইলেকট্রিক শক খেলাম, এই ডায়রী ওর কাছে কেন? তৌহিদ দূরে দাঁড়িয়ে আর পাঁচটা ছেলের সাথে হাসাহাসি করছে। হারামজাদা এক নম্বর এর হারামী। ডায়রি চুরি করে মহুয়া কে দিয়েছে আমাকে সাইজ করার জন্য। হায় তৌহিদ, এ তুই কি করলি? অলস হাতে ডায়রিটা নিয়ে নিলাম। কি আশ্চর্য, কেমন অদ্ভুত নিরবতা চারপাশে। উল্টো ঘুরে এলোমেলো পায়ে হেঁটে চলেছি।

– ওই গাধা, আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছিস?

মহুয়ার দিকে চকিত ফিরে তাকালাম। ওর চোখে পাওয়ার ব্যকুলতা গিজগিজ করছে। ধীর পায়ে কাছে এসে আমার হাতটা ধরলো ও। ভেজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-

– আমি আরও অনেক আগে থেকেই তোকে ভালোবেসে বসে আছি। মনে করতাম তুই আমাকে ওভাবে দেখিস না। তাই বলার সাহস করিনি।
– মহুয়া, আমি অসুস্থ…
– হ্যাঁ, আমি জানি। ডায়রিটা আমি পুরো পড়েছি।

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি ঠায়। অনেকক্ষণ পর মহুয়া মুখ খুলল।

– হয়তো লিউকোমিয়ার চিকিৎসা নেই, ডক্টর তোর আয়ু বেধে দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে তুই তোর ভালবাসাকেও মেরে ফেলতে চাইছিস?

কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। সূর্যের প্রখর আলোয় চোখে জ্বালা ধরে যাচ্ছে। নির্লিপ্ততা এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। কোনও সৃষ্টির শেষটা জানা হয়ে গেলে হয়তো এমনি মনে হয়। মৃত্যুর সাথে ভালোবাসার কি গভীর সম্পর্ক। শেষটা যখন নির্ধারিত ভালোবাসাও তখন হৃদয়ের গহীনে সমাধিস্থ। মহুয়ার দিকে চেয়ে ভিতরটা কুঁকড়ে উঠলো। যারে সারাজীবন খুঁজে খুঁজে দিশেহারা, আজ সে আমার কত কাছে। মহুয়া আমাকে ভালোবাসে– এই সত্যিটা আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে। নাহ, আজ আমি ওর দিকে তাকাবো না। ওর চোখে এখন ভালোবাসার আধার। আমি তাকালে যদি তা নষ্ট হয়ে যায়।

মহুয়ার হাত ধরে হেঁটে চলেছি আমি। শরীরে এখনো ঘামের চ্যাটচ্যাটা গন্ধ, প্রখর রোদ আর ধুলো, হর্নের কর্কশ শব্দে অসুস্থ রাজপথ; এরপরও আশ্চর্য নিরবতা অনুভব করছি। অনুভব করছি নরম আলোর মিষ্টি তেজটুকু। শরতের ভেজা ভেজা বাতাস আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে হয়তো। হয়তো এগুলো সব নিছকই কল্পনা, এর কোনও কিছুই হচ্ছেনা। তারপরও সত্যি তো একটাই……ভালোবাসি……জনম জনম।।

১,৫৭২ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “ভালোবাসি……জনম জনম”

    • মেহেদী (১৯৯৮-২০০৪)

      রেযা...অনেক ধন্যবাদ। ব্লগ এ আমি তোমার লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। মনে মনে ভাবি, ইশশসশ...এই ছেলেটার মতো যদি লিখতে পারতাম। তোমার ভিতরে এই জিনিস আছে। তুমি এটাকে leave করোনা। তুমি অনেক বড় লেখক হবা দোয়া করি। এখন কুইক ৫ টা পলটি লাগাও দেখি। :frontroll: :frontroll: :-B

      জবাব দিন
  1. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    উরিইইইইইইইইইইইইইইইই সেই পিচ্চি পোলাটা আজকে প্রেমের গল্প লেখে ! তাও আবার বড়ই সৌন্দর্য গল্প ।


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।