চা-সিগারেট

সকালের নাস্তা সেরে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম মোজাম্মেল মামার দোকানের উদ্দেশ্যে। ভার্সিটির ক্লাস ক্যানসেলড হওয়ায় সকালের চা সিগারেট দুপুরের চা সিগারেটে রুপ নিয়েছে। সাড়ে এগারোটায় ঘুম থেকে উঠেছি, এখন বাজে বারোটা দশ। মিরপুর ১৪ নম্বর মোড়ে, ডেন্টাল কলেজের সামনে মামার দোকান।

মোজাম্মেল মামাকে আমার প্রায়ই ফিলসফার পর্যায়ের লোক বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে মামার কথা শুনে আমার আফসোস হয়। লোকটা পৃথিবীতে আসতে মিসটাইমিং করে ফেলেছে। সক্রেটিস, এ্যারিস্টটলদের যুগে আসলে চা পিপাসা না মিটিয়ে মামা হয়ত জ্ঞান পিপাসা মেটাত! ফুটপাথের চায়ের দোকানের বদলে গাছতলায় স্কুল! ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দেয়া সিগারেট বাক্সের আড়ালে না বসে হয়ত সবুজ ঘাসের বিছানায় আসন হত তার! পরনের নীল স্যান্ডগেঞ্জি আর লুঙ্গির বদলে থাকত সক্রেটিস, এ্যারিস্টটলদের স্টাইলে জড়ানো শ্বেত শুভ্র কাপড়!

দূর থেকে মামাকে দেখে আজও এই কথাগুলোই মাথায় একবার ঘুরপাক খেল। চা বানাতে ব্যস্ত মামা আড়চোখে আমাকে দেখে হাসল।

‘আরে স্যার এই ঠাণ্ডার মধ্যে কোত্থেকে আসলেন?’

উত্তরে আমি কপালের ঘাম মুছলাম। মামা যে কেন আমাকে ‘স্যার’ বলে এইটা একটা রহস্য। ‘আর বইলেন না। ঠাণ্ডায় সারা শরীরের পানি বরফ হয়ে যাইতেছে!’

‘কেবিনে আইসা বসেন স্যার। এসির ব্যবস্থা আছে।’

কেবিন বলতে মামার মাঝারি আকারের সিগারেট বাক্সের আড়ালে পাতা বেঞ্চি। আর এসি বলতে বাক্সের দ্বিতীয় তাকে রাখা ছোট্ট একটা টেবিল ফ্যান। যে গরম পড়েছে তাতে আমাকে আর দ্বিতীয় বার বলতে হল না।

‘আছেন কেমন মামা?’

‘না মরে বেঁচে আছি স্যার। জুস হবে নাকি?’

‘একটু পরে দেন। জামিল আসতেছে।’

রাস্তার দিকে ইশারা করে চা বানাতে লেগে গেল মামা।

‘ঐ যে আইসা পড়ছে।’

গাড়ি, রিক্সা আর এলোপাথাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড় পার হয়ে জামিল আমার পাশে এসে বসল। চোখ থেকে চশমা খুলে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকাল। ‘কিরে কখন আসলি?’

‘এইতো মিনিটখানেক হইছে।’

শার্টের কোনা দিয়ে চশমাটা মুছে আবার চোখে লাগিয়ে শরীরটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে আরেকটু আরাম করে বসল জামিল। চেহারায় একটা শান্তি শান্তি ভাব।

‘কি যে আরাম করে ঘুমাইলাম আজকে! কত দিন পর সবগুলো ক্লাশ ক্যানসেলড হইল!’

সায় জানালাম আমিও। ‘আসলেই দোস্ত। অনেক দিন পর ১১টা পর্যন্ত ঘুমাইলাম।’

মোজাম্মেল মামা পাশ থেকে দুই কাপ চা এগিয়ে দিল। ‘স্যার নেন। জুস খান গরম গরম!’

আমার অন্য পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল জামিল। ‘কি মামা, কেমন চলে?’

নিজের লুঙ্গিতে হাত মুছতে মুছতে আবার আগের জায়গায় বসল মামা। ‘চলে ভাই একরকম।’ এরপর অভ্যাসমত আমার দিকে একটা বেনসন বাড়িয়ে ধরল। ‘লন স্যার। এই দুনিয়াতে আপন বলতে এই একটা জিনিসই আছে!’

আমি বিজ্ঞের মত মাথা নাড়তে নাড়তে সিগারেটটা নিলাম। ‘খাঁটি কথা মামা!’

জামিলের দিকে ইশারা করে হতাশার একটা ভাব করল মামা। ‘জামিল ভাই বুঝল না………আফসোস!’

জামিল আর আমি দুজনেই হেসে উঠলাম। জামিল বলল, ‘থাক থাক! অত আফসোস করা লাগবে না আমার জন্য।’

ফায়ার বক্সের বাক্সটা আমার দিকে এগিয়ে দিল মামা। ‘বুঝবেন বুঝবেন। পরে বুঝবেন। আফায় যে দিন দিলে চোট দিবো ঐ দিন বুঝবেন! কি কন আরিফ ভাই?’

একগাল সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই! তবে কি……আমি কিন্তু আফা ছাড়াই বেশ বুঝতে পারি!’

এইবার জামিল আর মামা মিলে হেসে উঠল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ফোঁড়ন কাটে জামিল। ‘আরিফ, বয়সতো কম হল না। কি করলি এই জীবনে!’

চোখ বড় বড় করে জামিলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ‘তুই বুঝি বিশ বছরের খোকা?’

‘বিশ না হোক, তোর চেয়েতো এক বছর কম! আমার হাতে সব সময়ই তোর চেয়ে এক বছর বেশি সময় থাকবে!’

আমি আর কিছু বলার আগেই মোজাম্মেল মামা বাধা দিলো।

‘বয়স কিন্ত খুব দামী জিনিস। মুখে রুচি থাকলে দুই প্লেটের জায়গায় চাইর প্লেটও খাওয়া যায়! আর রুচি চইলা গেলে এক প্লেটও পারবেন না!’

তর্ক ভুলে আমি আর জামিল ‘মারহাবা! মারহাবা’ করে উঠলাম। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে মামা আবার চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আমি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। ঢাকা ডেন্টাল কলেজের দেয়াল ঘেঁষে ফুটপাথ। সেই ফুটপাথের উপর মামার দোকানটা হওয়ায় ১৪ নম্বর মোড়টা এই খান থেকে খুব ভালভাবে দেখা যায়। পাশেই ‘ক্যাফে লবঙ্গ’। লবঙ্গের ভেতরে ঢুকলে অবশ্য ‘ওয়েটাররা’ যেভাবে তোতা পাখির মত ‘সাদা ভাত, হরেক রকম ভর্তা, রুই মাছের’ তালিকা শোনায় তাতে ‘ক্যাফে’ শব্দের সার্থকতা বিচার করতে গেলে মনে খানিকটা খটকা লাগে বৈকি! একটা বাস স্ট্যান্ডের রেগুলার কাস্টমারদের কথা ভাবলে ‘ভাই ভাই হোটেল’ টাইপ বাংলা নামই জুতসই হতে পারত বলে আমার ধারণা। জামিল আমার এইসব কথা শুনে একদিন দুলে দুলে হেসেছে। ‘কি ফালতু একটা নাম রাখছে লোকটা। অথচ দেখ তোর মাথায় এত বুদ্ধি কিন্তু তোর একটা হোটেল হল না। হইল কার? ঐ বোকা লোকটার!’ আমি কিছু না বলে ছোট ছোট চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

ফুটপাথের উপর আরও কয়েকটা চা সিগারেটের দোকান আছে। লবঙ্গের সামনে থেকে শুরু করে ডেন্টাল কলেজের গেট পার হয়ে গেছে ব্যাটারি চালিত ‘টমটম’ গুলোর সারিবদ্ধ লাইনে। ‘টমটম’ নামের শানে নুযূল আমার জানা নাই। তবে রাতারাতি এলাকায় যে জনপ্রিয়তা ‘টমটম’ কামিয়েছে সেটা বেশ জানা আছে। পাবে নাই বা কেন? ১৪ নম্বর থেকে  ১০ নম্বর গেলে রিকশা ভাড়া নেয় কমপক্ষে বিশ টাকা। আর মাঝারি আকারের যে ভাঙ্গা চোরা টিনের বাক্সগুলো আছে ওইগুলোতে নেয় জনপ্রতি পাঁচ টাকা। কিন্তু ঐ টিনের গাড়ি ভরতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট। ঘাড় বাঁকা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরে পথ পাড়ি দেবার বিশেষ বিদ্যা সুনিপুণভাবে এই এলাকার মানুষ রপ্ত করে ফেলায় নিঃশ্বাস নেবার যে কষ্ট এতদিন এলাকাবাসীকে করতে হয়েছে এই গাড়িগুলো সেই কষ্ট লাঘব করেছে। বিনিময়ে ভাড়া নেয় জনপ্রতি মাত্র দশ টাকা। চার জন লোক উঠাতে পারলেই গাড়ি চালু। লাইনের একেবারে সামনে যার গাড়ি সে ঐ চার জনের কোটা পূরণ করতেই গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে। ‘এই ভাষানটেক, ভাষানটেক! আর দুইজন লাগে। এই মামা যাবেন নাকি? ভাষানটেক, ভাষানটেক!’

রাস্তার অন্যপাশে ‘মিরপুর ১৪ টু কাকলী’ লেখা নীল রঙের বাসগুলোও লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা করে বাস ছেড়ে যাচ্ছে আর পরেরটা এগিয়ে এসে শূন্যস্থান পূরণ করছে।

‘কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি?’

সিগারেটটা নিচে ফেলে স্যান্ডেল দিয়ে নেভালাম। ‘না, কিছু না। দেখি আশেপাশের অবস্থা।’

আমার দিকে খানিকটা ঝুকে এসে গলার স্বর এক স্কেল নামিয়ে ফেলল জামিল।

‘আ-শে-পা-শে না দেখে আপাতত শুধু পাশেই দেখ!’

আড়চোখে পাশে তাকালাম। সাদা এ্যাপ্রন পরা দুইটা মেয়ে দোকানের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ডেন্টাল কলেজের স্টুডেন্ট হবে নিশ্চয়ই।

‘ডাইনেরটা সুন্দর আছে রে!’

মাথা নাড়ালাম। ‘হুম। তাইতো মনে হচ্ছে।’

বিস্ময়ে জামিলের গলা আরেক স্কেল নেমে গেল। ‘মনে হয় কিভাবে? স্পষ্ট দেখা যাইতেছে!’

এহেন যুক্তির সাথে তর্ক চলে না। মোজাম্মেল মামা দুই কাপ চা মেয়ে দু’জনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এল। মুখে রহস্যের হাসি।

‘কি স্যার, ভাও করায় দিমু নাকি?’

আমি হাসলাম। ‘জামিলের সাথে করায় দিতে পারেন!’

সাথে সাথে জামিলের তীব্র প্রতিবাদ। ‘আমার ভাও আমি নিজেই করে নিতে পারব। দরকার তোর জন্য।’

আমি হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলাম। ‘ ছয় মাস ধরে খালি ফেসবুকে চ্যাট করেছিস। এখন পর্যন্ত একবার ফোনে কথা পর্যন্ত বলিসনি। আর তুই করবি নিজের ভাও!’

জামিল কঠিন একটা চেহারা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মোজাম্মেল মামা আমার আরও কাছাকাছি এগিয়ে আসল। ‘আপনার জন্যই দেখি স্যার!’

আমি পুরো ব্যাপারটাকে ‘ধুর মিয়া’ বলে উড়িয়ে দিলাম। মেয়ে দুটো যথাসময়ে কাপ ফেরত দিয়ে চলে যেতেই জামিল বলল, ‘মোজাম্মেল মামা, দেইখেন……আরিফের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে নিজেই আবার ফাইসা যাইয়েন না!’

এক কাস্টমারকে পাঁচটা শেখ সিগারেট দিয়ে মামা জামিলের দিকে ঘুর বসল। ‘জামিল ভাই, সব ফুল বাগানে ফোটে না। বাগানের ফুল মন চাইলেই তুইলা নেয়া যায়! কিছু আছে শাপলা ফুল। পানির মধ্যে হয়। ছিঁড়তে হইলে সাঁতরাইয়া যাইতে হবে! আমার কি আর সাঁতরানোর বয়েস আছে?’

আমি আর জামিল আবারও ‘মারহাবা মারহাবা’ করে উঠলাম।

‘এ্যাই মোজাম্মেল দুই কাপ চা দেতো তিন কাপে। আর গোল্ডলিফ ল দুইটা।’

পরিচিতি অন্যান্য কাস্টমারদের ভিড়ে মামা আবার হারিয়ে গেল। এইখানে বেশিরভাগ কাস্টমারই হয় রিকশাওয়ালা আর না হয় ড্রাইভার। ডেন্টাল কলেজের স্টাফরাও আসে হরদম। দুপুরবেলা বলে তাও রাস্তা-ঘাট একটু ফাঁকা। অন্যান্য সময় গাড়ির হর্ন, রিকশার টুংটাং, আর মানুষের গালাগালিতে বেশ জমজমাট থাকে জায়গাটা।

‘শোন, নতুন একটা বিজনেসের আইডিয়া এসেছে মাথায়।’

জামিলের গলায় সিরিয়াস সিরিয়াস একটা ভাব টের পেয়ে কপাল কুঁচকে গেল আমার। ‘কি আইডিয়া?’

সামনের ব্যাটারি চালিত গাড়িগুলোর দিকে ইশারা করল জামিল। ‘রাস্তায় এই রকম দুইটা গাড়ি নামাতে পারলে বেশ লাভ।’

‘এই ব্যাটারি গাড়ি?’

‘হ্যাঁ। দামও বেশি না।’

‘বেশি না? এই বেশি না বলতে ঠিক কি মিন করলি?’

‘দেড় লাখ করে পড়বে একটা গাড়ির দাম।’

আমি হাসলাম। ‘দেড় লাখ টাকা কি আকাশ থেকে পড়বে? দেড় লাখ! দেড়শ টাকা নাই পকেটে!’

লুঙ্গিতে ভেজা হাত মুছতে মুছতে মোজাম্মেল মামা বলল, ‘গাড়ির ব্যবসা করবেন?’

‘জামিলের বুদ্ধি!’ খানিকটা টিটকারির সুরে বললাম। মামা জামিলের দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকাল।

‘গাড়ির ব্যবসা করতে হইলে আগে খানকি পাড়া থেকে মুখ বাঁধাই করে আসতে হবে জামিল ভাই! এই লাইনে মুখ ঠিক তো ব্যবসা বেঠিক!’

আমি আর জামিল সশব্দে হেসে উঠলাম।

‘কথা কইলেই হাসেন! শোনেন, এই ড্রাইভাররা ডেইলি মালিকের ভাড়াতো দেয়ই……আবার সার্জেন্টের চান্দা, স্ট্যান্ডের চান্দা এই গুলানতো ফ্রি!’

জামিলের আগ্রহ না কমে আরও মনে হয় বেড়ে গেল। ‘স্ট্যান্ডের চান্দা কেন দিতে হয়? স্ট্যান্ডে গাড়ি দেখে শুনে রাখে বলে?’

‘মামা, টাকাটা রাখ। একটা কেক, একটা চা, আর বেনসন একটা।’

আমাদের বয়সী এক ছেলের হাত থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিয়ে ক্যাশ বাক্সে রাখতে রাখতে মোজাম্মেল মামা হতাশায় মাথা নাড়ে। ‘কি যে কন জামিল ভাই! স্ট্যান্ডের চান্দা বোঝেন না? আপনাগো দিয়া এই ব্যবসা হইব না।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কাছে চান্দা দিতে হয়? এলাকার গুণ্ডা পাণ্ডা?’

টাকা ফেরত দিয়ে মামা এখন সুস্থির। ‘ঐ রকমই স্যার। রাজনীতি! সবখানে রাজনীতি! যে যখন ক্ষমতায় সে তখন খায়। ডেইলি সব ড্রাইভারকে দুইশ বিশ টাকা করে দিতে হয়।’

জামিলের চোখ দুটো একটু বড় হয়ে গেল। ‘দুইশ বিশ? তাও খালি খালি? যে চান্দা উঠায় তাকে চেনেন?’

হাসল মামা। ‘এই চোদনার মোড়ে আমার দুইখান সার্কিট ক্যামেরা চব্বিশ ঘণ্টা চালু থাকে! সব রেকর্ড করা আছে।’ এইটুকু বলে একটা চোখ টিপ মারল মামা। এত কিছু শোনার পরে জামিলকে একটা খোঁচা না মেরে পারলাম না।

‘কি জামিল! ব্যবসা করবা?’

খোঁচায় খুব একটা কাজ হোল না। যেন কিছুই শুনতে পায়নি এমন একটা ভাব করে জামিল বলল, ‘চিন্তা করতে পারিস, তুই কিছুই করিস না। অথচ মানুষ এমনি এমনি তোকে ডেইলি দুইশ বিশ টাকা করে দিয়ে যায়!’

খুব সমঝদার একটা ভাব করলাম। ‘এমনি এমনি না। ইউ আর মিসিং দ্য হোল পয়েন্ট। এই যে আমি কিছু করছি না, এই জন্যেইতো মানুষ টাকা দিয়ে যায়! তাওতো মাত্র দুইশ বিশ টাকা!’

আমার বলার ধরনে জামিল হেসে ফেলল। ঠিক এই সময় ব্যাটারি গাড়ীগুলো যেইখানে দাঁড়ায় ঐখানে বিশাল হইচই শুরু হয়ে গেল। মোজাম্মেল মামা সহ আমরা সবাই ঠায় দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘাড় উঁচিয়ে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে আর সবার মত বোঝার চেষ্টা করছি- কাহিনীটা কি! সেকেন্ডের মাঝে আশপাশ থেকে মানুষ গিয়ে জটলা পাকিয়ে ফেলল। আমরা কিছু বোঝার আগেই জটলার মাঝখানে কাকে যেন পেটানো শুরু হয়ে গেল। ভিড়ের মধ্যে জনতার তোড়জোড় দেখে মনে হল মাঝখানে যে বেচারা পড়েছে তার আজ আর সব হাড্ডি গুড্ডি আস্ত নিয়ে ঘরে ফেরার সম্ভাবনা নেই। আদৌ ফিরবে কিনা এইটা অবশ্য আরও বড় চিন্তার বিষয়। আমার দিকে না তাকিয়েই জামিল বলল, ‘পকেটমার মনে হয়।’

আমি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ালাম। ‘তাইতো মনে হচ্ছে। মেরেই না ফেলে বেচারাকে।’

মোজাম্মেল মামা কিছু না বলে গম্ভীর মুখে জটলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর হঠাৎ করে মামাও ঐদিকে এগিয়ে গেল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আমি আবার আগের জায়গায় বসে পড়লাম। নিজেই মামার বাক্স খুলে একটা বেনসন বের করে ধরালাম। মারামারি আমার কেন যেন সয় না। ধরা যখন পড়েছে তখন পুলিশে দিয়ে দে। ঝামেলা চুকে বুকে যাক। না, পেটাতে হবে। মানুষ পেটাতে মানুষের জুড়ি নাই। রাস্তায় গো বেচারার মত দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাও এক মুহূর্তে কেমন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমূল পরিবর্তন করে ফেলল নিজেকে! যেভাবেই হোক ভিড় ঠেলে ঐ মাঝখানে থাকা হতভাগাকে দু ঘা না বসালে যেন মানব জনমই বৃথা। গালাগালি, হই হুল্লোড় যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমন হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল। জামিল আমার পাশে বসে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘কিছুইতো বুঝলাম না দোস্ত।’

‘তুই বুঝস নাই ক্ষতি নাই। যারা পিটাইল তারা বুঝছে কিনা এইটা দেখার বিষয়!’

এর মধ্যে মোজাম্মেল মামা ফিরে আসল।

‘কি মামা, কাহিনী কি?’

বিরক্ত একটা ভাব ফুটে আছে মামার চেহারায়।

‘ধুর! আর কাহিনী! ১০ নম্বর থেকে এক গাড়িতে করে আসছে। নামার সময় নাকি মহিলার গায়ে হাত দিছে ঐ লোক!’

আমি আর জামিল মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। অপরাধ গুরুতর সন্দেহ নাই। মামা আর কিছু বলার আগে দেখলাম দুই জন লোক মিলে অন্য একজনকে প্রায় তুলে এনে জামিলের পাশে বসিয়ে দিল। যাকে বসানো হোল তার চেহারা ছবি দেখেই বেশ বোঝা গেল যে এই সেই ভয়ংকর অপরাধী। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। কপাল আর গাল ফুলে গিয়ে চেহারাটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। আমার মায়ের ধারনা আমার মন নাকি অনেক নরম। কে জানে, সেই নরম মনের প্রভাবেই কিনা এক দেখায় লোকটাকে আমার যথেষ্ট নিরীহ বলে মনে হল। হঠাৎ কোথা থেকে এক শ্যামলা বর্ণের মহিলা আর লুঙ্গি পরা আরেক লোকও হাউকাউ করতে করতে উপস্থিত। মেয়ে মানুষের গলা বলে কথা। সবার মাঝে তার গলাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

‘ব্যাটারে বললাম, ভাই পরে নামেন। না সে ধাক্কাধাক্কি করেই নামবে! বুঝি না নাকি আমরা কিছু!’

কেউ কিছু বোঝার আগেই মহিলার সাথে থাকা লোকটা অপরাধির দিকে তেড়ে এল। ‘খানকির পোলা! ম্যাইয়া দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, না?’

যে দুইজন লোকটাকে ধরে এনেছে তাদের মাঝে একজনকে নেতা গোছের মনে হল। সে বাঁধা দিল। ‘এ্যাই শমশের মিয়া, হইছেতো অনেক। শিক্ষা পাইছে।’

অপরাধি নিজের ফুলে ওঠা কপালে হাত বুলিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলল, ‘আমিতো ইচ্ছা করে ওনারে ধাক্কা দেই নাই।’

মহিলাটা এই কথার জবাবে একটা মুখ ভেঙচি দিল আর উত্তেজিত শমশের মিয়া আবারও তেড়ে এল। ‘আবার কথা কস খানকির পোলা!’

এইবারেও নেতা গোছের লোকটা বাঁধা দিল। ‘যা হবার হইছে। বউ লইয়া বাড়িত যা।’

শমশের নামক লোকটা বাড়ি যাবার কোন লক্ষন না দেখানোয় এক প্রকার ঠেলাঠেলি করেই তাকে তার স্ত্রীর সাথে পাঠিয়ে দেয়া হল। যাবার আগে অবশ্য শমশের মিয়া এই ১৪ নম্বর মোড়ে ঐ তথাকথিত ‘খানকির পোলারে’ আবার পেলে কিভাবে তার টেংরি ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গেল। এলাকা ঠাণ্ডা হলে আমি আর জামিল অপরাধির দিকে মনোযোগ দিলাম। লোকটা এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চেহারায় লজ্জা ও অপমানের ছাপ স্পষ্ট। আবারও আমার মনে হল এই লোক আর যাই হোক যেচে পরে ঐ মহিলার গায়ে হাত দেবার মত লোক নয়। নেতা গোছের লোকটার হাতে একটা কলম আর সাদা কাগজ। সে বলল, ‘এ্যাই মোজাম্মেল, চা দে দুইটা। সিগারেটের খালি প্যাকেট আছে?’

‘আছে ইকবাল ভাই।’

বেনসনের একটা খালি প্যাকেট ইকবাল নামক লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরল মামা। সে প্যাকেটটা নিয়ে কায়দা করে উপরের দিকের ঢাকনাটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। তারপর বাকিটা আড়াআড়ি ছিঁড়ে অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো বাদ দিয়ে শুধু মাঝখানের কাগজটুকু রাখল। কাগজের সাদা অংশটা পরে লেখার কাজে লাগবে তার। পুরো ব্যাপারটা আমাকে বেশ মুগ্ধ করল। কে জানত সিগারেটের প্যাকেটের এত ভাল উপযোগিতা আছে!

অপরাধি লোকটার কান্না থেমেছে। ‘ভাই……… বিশ্বাস করেন আমি ঐ মহিলার গায়ে হাত দেই নাই।’

ইকবাল ভাইয়ের সাথে আসা লোকটা এতক্ষণে কথা বলল। ‘বাদ দেন। আমারা না থাকলেতো আপনারে মাইরাই ফালাইত আজকে। শরীর ভালো লাগলে বাড়ি যান। পারলে ডাক্তারও দেখান।’

লোকটাকে শেষবারের মত নিজের চেহারায় একবার হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর খুব ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেল। আমার মনে হোল যে কোন সময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে লোকটা।

এর খানিকক্ষণ পরে ইকবাল ভাই ও তার সাথের লোকটা চা সিগারেট খেয়ে বিদায় নিলে জামিল মুখ খুলল, ‘কি বুঝলেন মামা?’

মোজাম্মেল মামা এখনও বিরক্ত। ‘স্ট্যান্ডের ড্রাইভারের বউ। ক্ষমতা আছে তাই দেখায় গেল!’

মামার কথায় মনে মনে বেশ শক্ত একটা ধাক্কা খেলাম। আসলেইতো! লোকটা হয়ত ইচ্ছা করে মহিলাটাকে ধাক্কা দেয় নাই। একসাথে নামতে গিয়ে একটু ছোঁয়াছুঁয়িই হয়েছে বোধহয়। আর তাতেই হুজুগে বাঙালি এত কাহিনী করে ফেলেছে। মোজাম্মেল মামা গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘মানুষরে কি বাল বলবেন। আমরা দেশের নেতা-মেতাগো গাইল দেই। ক্ষমতা পাইয়া দেশটা তারা নাকি লুটপাট কইরা খায়। আরে খানকির পোলা ক্ষমতা পাইলে তুই কি করতি!’

মামা আসলেই ভুল যুগে ভুল সময়ে চলে এসেছে। সক্রেটিস, এ্যারিস্টটলদের যুগে আসলে নির্ঘাত বিখ্যাত কেউ হয়ে যেত।

‘এই ইকবাল ভাই লোকটা কে মামা?’ প্রশ্নটা না করে পারলাম না।

‘আরে উনি না থাকলেতো কাহিনী আজকে আরও খারাপ হইত। উনি হইল গিয়া আপনাগো সেই চান্দা তোলনের পাবলিক।’

জামিল আর আমি একে অন্যের দিকে তাকালাম। দুই জনের চোখেই বিস্ময়। জামিল হঠাৎ বলল, ‘আমার মনে হয় ঐ লোকটা ভালো মানুষের অভিনয় করছিলো। হয়ত সত্যি সত্যিই সে ঐ মহিলার গায়ে সুযোগ পেয়ে হাত দিয়েছে!’

আমি একমত হতে পারলাম না। ‘আমারতো মনে হচ্ছে ঐ মহিলাই বাড়াবাড়ি করেছে। হয়ত জাস্ট একটা আন ইনটেনশনাল ধাক্কা লেগেছিল আর তাতেই এত কাহিনী।’

জামিল একটু অদ্ভুতভাবে হাসল। ‘তোর মন বেশি নরম। ঐ মহিলা যদি একটু কাঁদ কাঁদ চেহারায় তোর সামনে দাঁড়িয়ে যেত তাহলেই দেখা যেত তোর চোখে ঐ লোকটাই অপরাধি হয়ে গেছে।’

বিরক্ত হয়ে গেলাম। ‘আচ্ছা মানলাম। এখন থাম। আমরা কেউই জানি না কে আসল কালপ্রিট। হয়ত লোকটারও দোষ নাই আবার ঐ মহিলাও ভাবে নাই সামান্য চিৎকারে এত বড় কাহিনী হয়ে যাবে।’

জামিল মাথা নাড়াল।‘হতে পারে।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু আমার গায়ে লাগে অন্য মানুষের আচরণ। যারা লোকটাকে পিটাইল তারা আগে পিছে কোন কিছু চিন্তা না করে, লোকটা আসলেই দোষী কিনা, এইসব না দেখেই একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল!’

জামিল খুব ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল, ‘এত বেশি যখন বুঝিস তখন নিজে গিয়ে লোকটাকে বাঁচালি না কেন?’

আমি কোন উত্তর খুজে না পেয়ে চুপ মেরে গেলাম। জামিল থামল না।

‘আমরা হইলাম দর্শক। তুই, আমি, আমরা, এই যুগের প্রায় সবাই হলাম শান্তি প্রিয় দর্শক। দূর থেকে দেখব। উত্তেজিত হব, চিল্লাব, গালিগালাজ করব, প্রয়োজনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস পর্যন্ত দেব। কিন্তু কাছে গিয়ে কিছু করবার সাহস আমাদের নাই।’

জামিলের কথার সত্যতা ও নির্মমতা দুইটাই মানতে হল। এক কাপ চা আর সিগারেট খেতে এসে অনেক উত্তেজনা গেল। এই উত্তেজনা ঠাণ্ডা করতে এখন আরেক কাপ চা না হলেই না। তর্কে না গিয়ে তাই মোজাম্মেল মামার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলাম। ‘আরেক কাপ চা দাও মামা। আর বেনসন লাগাও একটা।’

 

১,৪৯১ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “চা-সিগারেট”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    খুব ভাল লাগলো ভাই। আমরা খালি মুখ লুকায়া থাকতে জানি। প্রতিবাদের বেলায় আমরা বিড়াল হয়ে যাই... আর ফেসবুক, ব্লগে হই বাঘা...


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. your writing has got a pure simplicity which is rare in these days..
    Although the story itself is simple but the hidden lessons for the society depicts certain intelligence level. But truly speaking I was expecting a blow.. But stories, surely, are not for the entertainment of a singular entity rather it is for the self contentment..
    hope you will bask in the adulation of your fans..
    Nice writing.. good to see you back 🙂

    জবাব দিন
  3. ফারহান ( ২০০৪-২০১০ )
    ‘আমরা হইলাম দর্শক। তুই, আমি, আমরা, এই যুগের প্রায় সবাই হলাম শান্তি প্রিয় দর্শক। দূর থেকে দেখব। উত্তেজিত হব, চিল্লাব, গালিগালাজ করব, প্রয়োজনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস পর্যন্ত দেব। কিন্তু কাছে গিয়ে কিছু করবার সাহস আমাদের নাই।’

    :boss: :boss: :boss: (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  4. শাহরিয়ার (০৬-১২)

    খুব সুন্দর লিখছেন ভাইয়া...

    ‘আমরা হইলাম দর্শক। তুই, আমি, আমরা, এই যুগের প্রায় সবাই হলাম শান্তি প্রিয় দর্শক। দূর থেকে দেখব। উত্তেজিত হব, চিল্লাব, গালিগালাজ করব, প্রয়োজনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস পর্যন্ত দেব। কিন্তু কাছে গিয়ে কিছু করবার সাহস আমাদের নাই।’


    • জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব - শিখা (মুসলিম সাহিত্য সমাজ) •

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হামীম (২০০২-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।