“বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, বরিশাল-৮২১৬”


**********01
বাবা আজ অনেক খুশি। বাবার অনেক দিনের স্বপ্ন আজ পূরন হয়েছে, ছেলে ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েছে। আমিও খুশি, অনেক খুশি। ছোটবেলা থেকেই বাসার বাইরে থাকাই আমার অভ্যাস। সকাল ৭ টায় গন্তব্য জিলা স্কুল; স্কুল , কোচিং সবকিছু শেষ করে আমি ফিরতাম একেবারে সন্ধ্যায়। বাবা মা দুজনেই চাকরিজীবী, তাই সন্ধ্যায় সবাই একত্রে বাসায় ফিরতাম। আবার পরদিন সকাল হলেই গন্তব্য: জিলা স্কুল…। ক্যাডেট কলেজ ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার পরে কি করব বুঝতে পারছিলাম না… অর্থাৎ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিব, নাকি চলতে থাকবে, বুঝতে পারছি না। ঐ সময়ে আমার সবচেয়ে আপনজন ছিলো জিলা স্কুলের সেই বন্ধুগুলো, ওদের ফেলে বাসায় বসে বসে ক্যাডেট কলেজের জন্যে দিন গুণবো- এটা সম্ভব ছিলো না; তাই ঠিকানা আবার জিলা স্কুল। যার সাথেই দেখা হয় একই কথা, কিরে ক্যাডেটে চান্স পাইয়া গেলি… যাবি কবে? আমি কেবল মনে মনে ভাবি, কিছুতেই যেতে মন চাইছে না; এই স্কুল, এই মাঠ, এই ক্রিকেট, দলবেধে কীর্তনখোলায় গোছল… এসব ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। বেশ কয়েকবার ভেবেছিলাম, আব্বু-আম্মুকে আমার অনিচ্ছার কথাটা বলব, কিন্তু সাহস হয় নি। আমার খুব কাছের কিছু বন্ধু ছিলো সরোজ, পাভেল, অপু, মাহামুদ, রায়হানসহ আরও অনেকে। আমরা ছিলাম “সাইকেল গ্রুপ,” যারা স্কুল ছুটির পরে সাইকেলে টো টো করতাম। খুব বেশি ভালবাসতাম ঐ লাল সাইকেলটাকে; ক্লাস ফাইভে ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার পরে বাবা ঐ সাইকেলটা কিনে দিয়েছিলেন। আমি সবাইকে ছেড়ে চলে যাব- এটা মেনে নিতে পারছিল না বন্ধুরা অনেকেই। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে। সুতরং বিদায় বন্ধু… কান্নায় চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল … শেষ যেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম, সেদিন কাউকে বলিনি যে আগামীকাল আমি চলে যাব, স্কুল থেকে ফেরার সময় সাইকেল চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল… মনে হচ্ছিল যেন কেউ পেছন থেকে ডাকছে আমায়… “মিঠু, যেও না…” ইস্ সেই খেলার মাঠ,সেই বেলস পার্ক কিংবা পরেরসাগর মাঠের ক্রিকেট, সেই কীর্তনখোলা আজও হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়…

১২মে, ২০০১, আমি, বাবা-মা, ছোট বোন আর আমার কাকা, আমরা রওনা হলাম বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে, গন্তব্য: বরিশাল ক্যাডেট কলেজ । বাসা থেকে বের হবার সময় লাল সাইকেলটার দিকে বারবার তাকচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল, আর কোনদিন বুঝি আমি সাইকেল চালাতে পারব না। আমি অনেক বেশি উৎফুল্ল ছিলাম , শুধু একটা বিষয় ছাড়া, সেটা হচ্ছে প্রিয় জিলা স্কুল আর প্রিয় বন্দুরা… ওদের আজও অনেক ভালবাসি। এসব ভাবতে ভাবতে আমরা কখন যে নতুন বাজার টেম্পুস্ট্যান্ডে চলে এলাম! দাদুর মুখটা খুব মনে পড়ছিলো, বাসা থেকে যখন রিকসায় উঠি, দাদু কেমন যেন হা করে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে, মুখে কোন কথা বলেন নি।

টেম্পু ছুটছে রহমতপুরের দিকে… ধীরে ধীরে পিছনে ফেলে যাচ্ছি আমার প্রিয় শহর বরিশাল… বাবা-মা দেখছে আমি বেশ উৎসাহি, এতে তারা বেশ খুশি, কারন আমি মন খারাপ করলে সমস্যা। নতুন পরিবেশ, সেখানে হাঁসিখুশি থাকতে পারলেই ভাল। আর একজনের জন্যে খুব খুব কষ্ট লাগছিল… সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন… “আশা”…

আমরা নামলাম ক্যাডেট কলেজের অপজিটে, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের “সাতমাইল” নামের জায়গাটিতে…
বেশ রঙিন সাজে সেজেছে আজ বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, ঠিক যেন বিয়েবাড়ি! “বরিশাল ক্যাডেট কলেজ” লেখা গেট দিয়ে আমরা ঠুকলাম সেই বহু প্রতিক্ষীত গৃহে… তারপর অনেক কথা… সব কি একবারে বলা যায়… সেদিনের “মিঠু” পরবর্তীতে কি করে “তারিক” হয়ে গেল, সে এক বিস্তর কাহিনী…

*****02
ছোট্ট সরু একটা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি আমরা… হাতের বাম পাশে খুব সুন্দর একটা মসজিদ, ডানপাশে একটা দোতলা লম্বা বিল্ডিং। আমরা গিয়ে পৌছলাম রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের সামনে, সেখানে লাগানো বিশাল তিনটি ফলক:
শরীয়তউল্লাহ হাউজ, শেরেবাংলা হাউজ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাউজ।

বরিশাল ক্যাডেট কলেজের খ্যাতনামা শিক্ষক মোল্লা স্যারের ছেলে ইমন ভাই ছিলেন আমার গাইড। তিনি নিয়ে গেলেন আমার নতুন ঠিকানায়: রুম নং ১২৭, শরীয়তউল্লাহ হাউজ… গিয়ে দেখি আমার রুমমেট আমার অতি পরিচিত বন্ধু রাজিব, দুজন একত্রে কোচিং করতাম জিলা স্কুলের এনামুল হক স্যারের কাছে । দুই গ্রুপের বাবা-মাই বেশ খুশি, মিলেমিশে থাকবা তোমরা, ভালই হইছে দুজন একই রুমে পরেছ। ভর্তি পরীক্ষায় আমার ইনডেক্স নম্বর ছিলো ১২০৮৫, রাজিবের ১২০৮৪। এখানে এসে আমার ক্যাডেট নম্বর হল ১১৮২, ওর ১১৮১। ইমন ভাই আমার বিভিন্ন জিনিসপত্র আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, তারপর আমার সাদা শার্টটার ডানপাশে লাগিয়ে দিলেন কালো একটা নেমপ্লেট, যেখানে লেখা রয়েছে “তারিক”; আমার অতি প্রিয় “মিঠু” নামটা যে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে সেটা তখনো বুঝতে পারিনি, সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আরও প্রায় ১৫/২০ দিন পরে। এরপর নাস্তা, শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব ইত্যাদির পরে বাবা মায়ের বিদায়ের পালা।
আমার কেন যেন সেদিন বাবা-মায়ের জন্যে ততটা কষ্ট লাগেনি, কিন্তু শুধু ছোটবোনটার জন্যে… আম্মুর জন্যে একটু কষ্ট লাগছিল, কারন আমামু অনেক সখ করে নিয়ে আসা কাথাটা আমাকে দিয়ে যেতে পারেননি, তবে কষ্টটা আম্মুর জন্যে লেগেছিল নাকি কাথাটার জন্যে- সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, কারন আমি আবার কাথা ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না। তবে আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে যখন হাউজের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম, সে এক করুন দৃশ্য… আমার অধিকাংশ হবু বন্ধুই কাঁদছে, কাঁদছেন স্নেহময়ী মায়েরা… আড়ালে চোখের পানি মুছছেন বাবারা… সৌরভের ছয় বোনের সে কি কান্না… কারন ও ছিল ছয় বোনের আদরের ছোট ভাই…
সবার কান্নাকাটি দেখে আমি একবার পিছন ফিরে তাকালাম আমার বাবা-মায়ের অবস্থা দেখার জন্যে। মায়ের মুখটা মলিন, চোখে পানি আছে কিনা সেটা দূর থেকে বুঝতে পারিনি… তবে বাবা যে হাত দিয়ে চোখের কোণাটা মুছছেন- সেটা দেখতে পেলাম স্পষ্ট। বাবার সেই কান্নার অর্থ সেদিন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারি… ওটা কষ্টের কান্না ছিলো না, ওটা ছিলো আনন্দের… কিসের আনন্দ? চলুন ঘুরে আসি ১৯৭১… যখন বাবা ছিলেন সদ্য ক্লাস সেভেন…

আমার বাবার বয়স মাত্র ১২/১৩, সবে ক্লাস সিক্সে পড়েন। যতটুকু জানি, বেশ ভাল ছাত্র ছিলেন আমার বাবা। দাদার স্বপ্ন ছিল, ছেলে বড় অফিসার হবে। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, ৭১-এর শুরুতেই পাক দস্যুদের হাতে নিহত হলেন আমার দাদা… এরপর শুরু হল আমার বাবার জীবন যুদ্ধ… সৎ মায়ের সংসার, আমার দাদু একটু বোকাসোকা ছিলেন, তাই সংসার চালাতেন আমার ছোট দাদু। চাচা- চাচীদের অবহেলা, অত্যাচার এসবের মাঝে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সহযোগীতায় কোন রকমে HSC পাস করেন তিনি… দিনের বেলা চাকরি করেছেন, রাতে পড়েছেন নাইট কলেজে- এমনই কেটেছে সময়… দাদার সহায়সম্পত্তি মোটেই কম ছিল না, কিন্তু সেগুলো ভোগ করার সুযোগ হয়নি আমার বাবার শুধুমাত্র একজন বুদ্ধিমতি মায়ের অভাবে… অনেকদিনই পেটপুড়ে খেতে পারেননি… পড়াশুনাতো অনেক পরের কথা… সেই বাবার ছেলে আজ ক্যাডেট কলেজের মত একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাচ্ছে এটা ছিল তার কাছে স্বপ্নের মত… কল্পনারও অতীত… তাই হয়ত বাবা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি…
আসলে “সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত” – এই বাক্যটির এক স্বার্থক প্রমাণ আমার বাবা, ক্লাসের বই কিনে পড়তে পারতেন না… নতুন জামা-কাপড় হয়ত ছিল না, কিন্তু আমার বাবা ছিলেন জ্ঞান রাজ্যের এক নীরব প্রজা… বরিশাল পুরাতন পাবলিক লাইব্রেরি ছিল জ্ঞানের সেই রাজদরবার… বাবার অনেক লেখাও তখন প্রকাশিত হয়েছিল বিচিত্রাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়…

সেই বাবার ছেলে আমি যাচ্ছি এক নতুন জগতে… পিছনে বাবা-মা, আদরের ছোটবোন… সামনে ক্যাডেট কলেজ… মাঝখানে হাটছি আমি এক কিশোর… কি ছিলো আমার সেদিনের অনুভূতি- সেটা সঠিক করে বলতে পারব না… তবে এতটুকু জানি, সেদিন বাবা-মায়ের জন্যে ততটা কষ্ট লাগেনি যতটা লেগেছিল পরবর্তী ক্যাডেট লাইফে, যতটা লাগে এখন… [চলবে]

[লেখাগুলো সা.ইনে পূর্বপ্রকাশিত]
[গত ৪/৫ মাস ব্যাক্তিগত কারণন খুব ঝামেলায় ছিলাম … দীর্ঘ প্রায় ২ মাস পরে সিসিবিতে পোস্টালাম … তবে পরীক্ষা, তাই আরও একমাস … তারপর আবার নিয়মিত হব ইনশাল্লাহ …]

৪,৪৯৮ বার দেখা হয়েছে

৪৪ টি মন্তব্য : ““বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, বরিশাল-৮২১৬””

  1. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    মরতুজা ভাই, খেলুম না... :no:
    আপনি পোস্ট পড়ার আগেই কমেন্ট দিলেন কেন? :thumbdown:

    ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার আরেকটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    "মিঠু",
    স্মৃতিচারণ টুকু খুব সুন্দর হইসে...একটানে পড়ে ফেললাম...

    আংকেল কে সালাম... :salute:


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  3. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    হৃদয় ছুয়ে গেল......
    কতদিন পর সেই চেনা পথ....সেই চেনা ভবন......সেই প্রিয় শহর
    ছুটিতে আমি কিছুদিন বাড়ি যেতাম না.........ঘুরতাম বরিশালে....আত্মীয়দের বাড়ি থাকতাম আর অলিতে গলিতে ঘুরতাম
    সেই গোরস্থান রোড....সেই কাশীপুর........সেই বিকেল বেলা নদীর পাড়
    আহা......দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না

    ধন্যবাদ মিঠু :hatsoff:


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    আগে পড়ছিলাম। ভাল্লাগছিলো।
    এখনও পড়লাম, ভাল্লাগলো :clap: :clap:
    ঝামেলা সব কাটিয়ে সিসিবিতে আবার রেগুলার লিখবে এই আশায় :thumbup:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফৌজিয়ান (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।