স্মৃতির রোমন্থন

আমি আসলে ভালো লেখক না, তাই গল্পের মান খুব ভালো হবে না সেটা আগেই বলে রাখছি। এটাকে ঠিক গল্প বলা ঠিক হবে না, আপনারা এটাকে গল্পগুচ্ছ বলতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের ভক্তরা রাগ করবেন না এই ভেবে যে, ব্যাটা গুরুদেবের বইয়ের টাইটেল নকল করছে। হ্যাঁ, নকলই করছি, সেজন্যে আগেই ক্ষমা চাচ্ছি। :boss:

১. অর্থনীতির আব্দুস সামাদ স্যার, আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম কখন তার ক্লাশ করব। তো তিনি যখন পরীক্ষার হলে গার্ড দিতে আসতেন, তখন যা যা করতেন। আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল কখন কি কি করবেন। সামাদ স্যারের পরীক্ষার হলের রুটিন, তিনি খাতা নিয়ে ঢুকলেন, একটা কান ফাটানো চিৎকার দিয়ে বলবেন, “Boys, don’t sound” আমরা যারা ফাজিল ছিলাম তারা দিতাম হেসে। খাতা-প্রশ্ন দেয়া শেষ হলে তিনি একটা চেয়ার নিয়ে সামনে লেকচার ষ্ট্যান্ডের উঁচু জায়গায় বসবেন এবং অবধারিতভাবে ঝিমুবেন। আমরাও তার ঝিমুনির সুযোগটা নিতাম। আর ফাঁকে ফাঁকে তিনি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলবেন,” হুম, হুম, হুম, দেখছি। সবই দেখছি। আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখ কি করি।” এবং আবারো ঝিম।

২. বোটানির আব্দুর রফিক স্যার। জীববিজ্ঞান যদিও আমার পাঠ্য না, তারপরেও স্যারের সাথে আমার ভালই খাতির ছিল। ধরুন আপনি পরীক্ষার হলে পাশের জনের খাতা দেখে একটু সুবিধা লুটের চেষ্টা করছেন, হঠাৎ দেখলেন আপনার খাতা নেই 😮 অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়? আসলেই অবাক হবার মতনই ঘটনা। রফিক স্যার হাঁটতেন খুব জোরে। আর তার খাতা নিয়ে নেয়ার ভঙ্গিটা আমরা হাজার চেষ্টা করেও আয়ত্ত করতে পারিনি। তারপরে যদি তার কাছে খাতা নেয়ার জন্যে যাওয়া হত তাহলে, ছোটোমানুষদের হাত থেকে কোন জিনিস কেড়ে নিতে চাইলে তারা যেরকম ভঙ্গি করে ঠিক সেরকম ভঙ্গি করে খাতাটা আড়াল করতেন। এই দৃশ্য দেখে হাসব না খাতা ফেরানোর চেষ্টা করব, আপনারাই বলুন।

৩. তখন আমরা এস.এস.সি. পরীক্ষার্থীর এ্যাপুলেট পরেছি মাত্র। ভাবই আলাদা। তখন আমাদের মডেল টেষ্ট হচ্ছিল। একটা স্যারকে আমরা পেয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্যে। ইংরেজির নূর-ই-আলম স্যার। তার একটু বর্ণনার প্রয়োজন আছে। তিনি একদিন হাউস ডিউটি মাষ্টার ছিলেন, এবং কোন কারণে খুব কথা বলছিলেন। তো আমাদের জনৈক ক্যাডেট, তার মুখের লাগাম একটু বেশীই ঢিলা। সে স্যারকে শুনিয়ে শুনিয়ে হাউস অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে বলছে, “শহীদ ভাই, (হাউস বেয়ারার) হাউস অফিসে কোন ম্যাডাম? এতো চিল্লায় ক্যান?” ব্যাস, সব চুপ। ক্যাডেটদের কাছ থেকে ম্যাডাম উপাধি পাওয়ার চেয়ে বোধহয় চুপ করে থাকাটাই ভাল মনে করেছিলেন তিনি। তো সেই নূর স্যার পরীক্ষার হলের গার্ড। মডেল টেষ্ট বলে গা ছাড়া ভাবে দিচ্ছি। লিখছি, লিখছি না এরকম একটা অবস্থা। তো আমি হঠাৎ আমার পাশের একজনের সাথে সিরিয়াসভাবে উত্তর মেলানো শুরু করলাম। ভাবটা এমন যেন এটার উপরেই আমার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। হঠাৎ দেখি নূর স্যার আমার খাতা নিয়ে চলে গেলেম। আমিও স্যারের পিছনে পিছনে, স্যার স্যার স্যার স্যার করতে করতে যাওয়া শুরু করলাম। যদিও পরীক্ষটা আমার জন্যে এমন কিছু গুরুত্তপূর্ণ ছিল না। আসল উদ্দেশ্য ছিলো স্যারকে বিরক্ত করা। স্যার বিরক্ত হয়ে মোটামুটি চিৎকার করেই বলে উঠলেন, “Please, give us relief by your immediate departure.” তারপরেই অডিটোরিয়ামের এক কোনা থেকে কে যেন বলে উঠল, “Madam, please don’t shout.” এর পরে আর খাতার জন্যে অপেক্ষা করে যায় না।

৪. পৌরনীতির শরীফুজ্জামান স্যার(রাজশাহীতে বাড়ি, তাই স্যারের ‘স’ উচ্চারণ্টা ঠিকভাবে আসে না), তার অভ্যাস হল ফাইনাল বেল এর অন্তত আধা ঘন্টা আগে থেকে শুরু করবেন, “এই নিয়ে এছো, নিয়ে এছো বলছি। কি বুল্লাম ছুনতে পারছোনা? নিয়ে এছো বললাম।” এর মধ্যে পরীক্ষা দেয়া যায়? তার মধ্যে সেটা শেষ ৩০ মিনিট, সবচেয়ে মূল্যবান সময়। তো একদিন তিনি গার্ড, আমরা তখন সবেমাত্র ক্লাস এইটে উঠেছি, জুনিয়র তখনো আসেনি। তাই শরীফুজ্জামান স্যারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন সাহস নেই। কিন্তু আমাদের সাথে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন রাব্বি ভাই, বিশাল দেহের অধিকারী। তার দশাসই দেহই ভয়ের জন্যে যথেষ্ট, আমরা তখন তার তুলনায় পিঁপড়া। রাব্বি ভাইয়ের সম্ভবত কোন কঠিন পরীক্ষা ছিলো, স্যার তখন তার স্বভাবমত বুলি আওড়ানো শুরু করেছেন। শেষে রাব্বি ভাই বিরক্ত হয়ে মেঘস্বরে বলেই উঠলেন, “স্যার, এতো কথা বলেন ক্যান? একটু চুপ থাকেন।” স্যার পুরো পরীক্ষার সময়ে আর কোন কথা বলেন নি।

৫. এটা ক্লাস সেভেনের কাহিনী। সেকেন্ড টার্মের কাহিনী। টেবিল লীডার রুমেল ভাই(ক্যাঃ নঃ ১৯৯৪) আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন যে, এই পোলা পাগল নাকি? ভাইয়ের ক্যাডেট নাম্বার লেখে ক্যান? স্মৃতির রোমন্থন তো, তাই মেমোরি একটু ঝালাই করছিলাম। যাই হোক, সেকালে স্যান্ডউইচ নামে একটা অখাদ্য দিত মিল্ক ব্রেক এ। আপনারা এও ভাবতে পারেন যে, পোলা নো ডাউট একটা খ্যাত। স্যান্ডউইচ আবার অখাদ্য হয় ক্যামনে? না না, আমি স্মার্ট না হলেও ঠিক খ্যাত না। সেই স্যান্ডউইচ একবার খেলে আর জীবনে আসল স্যান্ডউইচ খেতে ইচ্ছা করবে না(স্যান্ডউইচ দেখলে এখনো আমার গা শিরশির করে) যা বলছিলাম, সেই স্যান্ডউইচ দিতো দুইটা করে। গোদের উপর বিষফোঁড়া বলতে পারেন। সে জিনিস একটা খেতেই হিমশিম খেতে হয় সেই জিনিস দু’টা কিভাবে খাব সেটা চিন্তা করতেই শনিবারের প্রথম চারটা ক্লাস কেটে যেতো। একদিন অতিষ্ট হয়ে অনেক সাহস সঞ্চয় করে রুমেল ভাইকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “ভাই, স্যান্ডউইচ খেতে পারছি না।” ভাই দেখলাম একটু হাসলেন, যার অর্থ ঠিক আছে খেতে হবে না। আমি খুশীমনে পানি খাওয়া শুরু করলাম। ৩০ সেকেন্ড পরে দেখি আমার সামনে দুই ডিশ ভর্তি স্যান্ডউইচ। রুমেল ভাই বললেন, “মাজহার, ওইগুলা না খেতে পারলে, এইগুলা তো খেতে পারবা।”

৬. এটা ক্লাস টেনের কাহিনী। তখন কি জানি একটা পরীক্ষা চলছিলো, পরীক্ষার হলের গার্ড ছিলো আমাদের রেফাউদ্দৌলা স্যার। একটা জুনিয়র টয়লেটে গেছে। সে যাবার পরে দেখা গেলো যে, যাবার সময় পকেটে করে প্রশ্নটা নিয়ে গেছে। তো রেফাউদ্দৌলা স্যার গেলেন ক্ষেপে। সেই জুনিয়র আসলো। স্যার তার পকেট চেক করা শুরু করলেন। কি আর বের হবে? বের হল প্রশ্ন, তার উল্টাপিঠে কিছু সূত্র লেখা। স্যার বললেন, এসব কি? স্যার, কিছু সূত্র। দাঁড়া তোর টয়লেটে যাওয়া বের করছি। বলে কিছু চড়-থাপ্পড় দিলেন। তারপরে যা বললেন, “সূত্র নিয়ে মূত্র করতে যাওয়া হচ্ছিল তাই না? সূত্র নিয়ে মূত্র করতে যাওয়া?”

৭. এটা ক্লাস এইটের কাহিনী। আমরা যথারীতি হাউস ডিউটি ক্যাডেট, ভাইরা প্রদীপে ঘষা দিলে মানে “ডি কে” বলে জোরেসোরে চিৎকার দিলে আলাদীনের জিনির মত দৌড়ে হাজির হই। আমাদের জনৈক ক্যাডেট এক ভাইকে ঘুম থেকে ডাকতে গেছে। সে নিয়মমতো ডাকছে, ভাই 5 minutes হইছে। তো সেই ভাই ঘুম থেকে হঠাৎ বলে উঠলেন, “ভালো হইছে।”

৮. এটা ক্লাস টেনের কাহিনী। গ্রাউন্ডে পিটি টাইমে ফল ইন করে দাঁড়িয়ে আছি। হাউস স্টাফ হল ল্যান্স কর্পোরাল মোতাচ্ছেম স্টাফ। স্টাফ ক্লাস টুয়েলভের ভাইদের কাউন্টিং করছেন।

১ ২ ৩ ………১৩, ১৩ আর ৩ এ ১৪।

আর দুইজন কই গেলো? গ্রাউন্ডে আরো দুই ক্লাস সিনিয়র ছিলো, তাই হাসিটা পেটের মধ্যেই রেখে দিয়েছিলাম।

৯. এইবারে আমি হাউস ডিউটি ক্যাডেট। ডাকতে গেছি জজ ভাইকে, ভাইয়ের ঘুম একটু গাঢ়। প্রতিদিনই অনেক্ষণ ধরে ডাকতে হয়। তার উপর ভাই আমাদের বলে দিয়েছিলেন যে তাকে যেনো একটু জোরেসোরে ডাকা হয়। তো সেদিন প্রথমেই গিয়ে বেডে দিলাম একটা রাম বাড়ি। “জজ ভাই,ফাইভ মিনিটস হইছে।” এর উত্তরে জজ ভাই লাফিয়ে উঠে, ওই, ফাজলামি কর :chup: :chup: ? লাঞ্চের পরে দেখা করবা। :brick: :brick: :brick: :frontroll: :frontroll: :frontroll:

১,৩০২ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “স্মৃতির রোমন্থন”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    কলেজের ঘটনাগুলো পড়তে খুব মজা লাগে... 😀

    মাজহার, যতদূর মনে পড়ে সিসিবি নীতিমালায় স্যার/ম্যাডাম কিংবা ক্যাডেটদের নাম উহ্য রাখার জন্য উৎসাহীত করা হয়েছে (কেউ যেন কোনভাবে হার্ট না হয় এ উদ্দ্যেশ্যেই এই নিয়ম করা হয়েছে)। এরপর থেকে আশা করি ব্যাপারটা মাথায় রাখবি...

    লেখালেখি চলুক... :thumbup:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আউয়াল (২০০৩-২০০৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।