সিয়াটলের শীত – ৩

গত সপ্তাহে সিসিবিতে ঢোকার সুযোগ হয়েছে খুব কমই। নানা ব্যাস্ততার মাঝেও চোখ বোলানোর চেষ্টা করেছি কি কি হচ্ছে সিসিবিতে। একটা জিনিস মানতেই হবে, সিসিবিতে প্রানচাঞ্চল্য আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বেড়েছে নতুন সদস্যের সংখা (সংখ্যা বানানটা ভুলে গেছি। কোনটা ঠিক বুঝতে পারছি না। মাফ চাই, বাংলা চর্চার অভাবের ফল। একই সাথে ধন্যবাদ সিসিবিকে, চর্চার সুযোগটা করে দেবার জন্য)। আমি যখন সদস্য হই তখন খুব সম্ভবত আড়াইশর মত সদস্য ছিল, মাথা পিছু পোস্টের সংখা ছিল দুইয়ের কম। গত মাসে সদস্য বেড়ে দাড়িয়েছে তিনশর ওপরে, পোস্টের সংখাও অনেক বেড়েছে। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করার মত তা হোল লেখার বিষয়ে ভিন্নতা। আমাদের মাঝে যে এত ভালো কিছু লেখক আছেন দেখে হীনমন্যতায় ভুগি। ভাবি “কি করলাম জীবনে, একটা কোবতে, গপ্পোও লিখতার্তাম না”।

সিয়াটলের শীত – ১
সিয়াটলের শীত – ২

সিয়াটলের শীত নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। এর মাঝে ব্যাস্ততার কারনে আর লেখা হয়নি। ফলে আমার ধারনা পাঠকদের অনেকেই ভুলে গিয়েছেন আমার লেখার মুল সুত্র। (কামরুল বাদে, তোমার ধৈর্য দেখে সত্যি অবাক হই)। তাই খুব বেশি টানাহ্যাঁচরা নয়, সিয়াটলের শীতের আজকেই শেষ দেখে ছাড়ব।

আজ থেকে তিন বছর তিন মাস আগে সবাইকে ছেড়ে এসেছিলাম স্বপ্নের দেশে স্বপ্ন পূরনের বাসনায়। সাফল্যের চূড়াটাকে ধরার জন্য এতই ব্যাকুল ছিলাম যে আমার পার্বতীকে ফেলেই আসতে হয়েছিল। আশা ছিল খুব বেশি দেরী হবে না, মাস খানেকের মধ্যেই নিয়ে আসতে পারব। বিধি বাম, কপাল খোলেনি। ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়াতে পি এইচ ডি শুরু করেছিলাম ২০০৫ এ। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ। যারা আমেরিকার পুর্ব উপকুলে আছেন বা কোনকালে ছিলেন, তারা জানবেন ভার্জিনিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কতটা। কিন্তু আমাকে ওসব কিছুই টানতো না। অসহ্য যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে ক্লাস করে যেতে লাগলাম। পয়সা গুনে গুনে দিন চালাতাম আর পয়সা জমাতাম দেশে যাবার জন্য। সেদিন হিসেব করে দেখলাম গত তিন বছরে দেশে যাওয়া উপলক্ষ্যে ১৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করেছি। প্রত্যেক সেমিস্টার শেষে সেই জমানো পয়সা দিয়ে টিকেট কিনে দেশে যেতাম আর ফেরার সময় সেই একই অসহ্য ছেড়ে আসার যন্ত্রনা। ফলাফল হোল গবেষনার নামে বারোটা। কাজ কিছুই আগালো না। এর মধ্যে ২০০৬ এর জানুয়ারীতে ইন্টার্নিশীপ করার জন্য চলে গেলাম সিলিকন ভ্যালিতে। ব্রডকমে কাজ শুরু করলাম। । রুম ভাড়া করলাম স্যান হোজেতে, সিলিকন ভ্যালির রাজধানীতে। কি বুঝে ইন্টার্নশীপ্টা নিয়েছিলাম জানিনা, ফলাফল হোল আরো খারাপ। রিসার্চের কাজের বারোটা থেকে তেরটা বেজে গেল। আমি ভাবলাম, অনেক হয়েছে আর না, এবার ক্ষ্যান্ত দেবার পালা। এইভাবে অসহ্য যন্ত্রনায় দিন কাটানোর চাইতে নামের আগে ডক্টর শব্দটা না লাগানো অনেক ভাল। সাফল্যের চুড়ার কাছাকাছি এসেই থামার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার এডভাইজরকে বললাম আমার সিদ্ধান্তের কথা। মাস্টার্স করেই বিদায় নেবার সিদ্ধান্ত।

কিন্তু তাতেও তো মুল সমস্যার কোন সুরাহা হয় না। কারন মাস্টার্স করার পরেও তো বউ আনতে পারব না, কারন তখনও আমি স্টুডেন্ট ভিসায়। আর ছাত্র থাকা অবস্থায় বউ আনতে গেলে যেই লাউ যেই কদু। আবার ভিসা রিফিউজ। আর দেশে চলে গেলে তো আবার সব গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। মহাখালির জ্যামে ঘন্টাখানেক আটকে থাকা। তাই শুরু করলাম চাকরি খোজা। কিন্তু চাকরি পেলেও বউ আনতে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে কারন চাকরির প্রথম এক বছর আমাকে স্টুডেন্ট ভিসাতেই থাকতে হবে। সুতরাং শুরু করলাম ব্যাকআপ প্ল্যান। কানাডার স্থায়ি বাসিন্দার এ্যাপ্লিকেশান করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারজন্য আবার চাই আইইএলটিএস। এখন সেটা কোথায় দেই? কপাল ভাল স্যান হোজে (San Jose) এর পাশেই স্যান ফ্রানসিসকোতে পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল একটা। কোন এক ছুটির দিনে চলে গেলাম সেখানে। নীলক্ষেত থেকে কেনা একপিস বই সম্বল করে পরীক্ষা দিতে গেলাম। ফলাফল খারাপ হয়নি। সব মিলিয়ে ৮ পেলেও স্পিকিংএ ৯ এ ৮ পেয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আশা ছিল ৯ পাব। কোই বাত নেহি, সব বিষয়ে আলাদা করে ৭ পেলেই যথেষ্ট ছিল।

এবার আসল প্ল্যান, চাকরি। সিলিকন ভ্যালির রাজধানীতে থাকার সুফল মিলল। বাড়ির পাশেই এনভিডিয়া তে চাকরি হয়ে গেল। এর মাঝে আবার মাইক্রোসফটে ইন্টাভিউ এর ডাক এল। যদিও এনভিডিয়ার অফারটা বেশ পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু তাও ভাব্লাম বিল গেটস মামুর পয়সায় সিয়াটল দেখার সুযোগটা ছাড়ি কেন। সেটাও দিলাম। কপাল মনে হয় ততদিনে বদলাতে শুরু করেছিল। সেটাও হোল। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম এনভিডিয়া কে না করে দেই। ততদিনে আমার ইন্টার্নশীপ শেষ। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভার্জিনিয়াতে ফিরে এলাম। মাস্টার্সের ডিফেন্স শেষ করে দেশে যাবার প্ল্যান করলাম। মাইক্রোসফটে জয়েন করার আগে শেষ দেশ দর্শন। আসার কয়েকদিন আগে গুগল থেকে ডাক এল জয়েন করার জন্য। ওহ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, চাকরি খোজার সময় ইয়াহু আর গুগলেও ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। শালাদের আবার ম্যালা ভাব। এক টেলিফোন ইন্টারভিউই নিল পাঁচবার। একবার এনভিডিয়া না করে মাইক্রোসফটে হ্যাঁ বলছি, আবার তাকে না করে গুগলকে হ্যাঁ বলতে ইচ্ছা করলো না। চলে গেলাম দেশে।

দেশ থেকে ফিরে এসে চাকরিতে জয়েন করলাম গত বছর নভেম্বরে। এসেই পড়লাম সিয়াটলের বিখ্যাত শীতের খপ্পরে। শীত গেল, বসন্ত এল, গ্রীস্ম এলো, আমার একা থাকা আর শেষ হয় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক পিস বিস্কুট মুখে দিয়ে অফিসে যাই, রাতে এসে ভাড়া করা ডিভিডিতে সিনেমা দেখি, সকালে উঠে আবার সেই একই রুটিন। তবে এতদিনে বোধহয় আমার অপেক্ষার ফল মিলল। অগাস্টে কানাডার স্থায়ী বাসিন্দার সনদ পেলাম। বউ চলে এলো কানাডাতে। কিন্তু তাতেও তো যেই লাউ সেই কদু। আমি তখনো থাকি তিন হাজার মাইল দূরে (সিয়াটল-টরন্টো)। অবশেষে আবার শীত এলো সিয়াটলের আকাশে, মন খারাপ করা মেঘলা দিন আর বৃস্টি প্রতিদিন। তবে আমি আর এখন ঘুমহীন সিয়াটলের রাতে নির্ঘুম রাত কাটাই না। গত সপ্তাহে আমার পার্বতী আমার দুয়ারে নোঙ্গর ফেলেছে। স্বপ্নটাকে কাটছাট করলেও বেশ উচুঁতেই দাঁড়িয়ে শ্বাস নেই এখন।

৪,০৩৬ বার দেখা হয়েছে

৪১ টি মন্তব্য : “সিয়াটলের শীত – ৩”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    🙁 আমিও সিয়াটলের শীত দেখুম :(( :(( :((


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    ও ভাই আরেকটা কথা কইতে ভুইলা গেছি 😀
    প্রাপ্তবয়ষ্ক সিরিজ কই??????? :grr: :grr: :grr:
    ওইটা ছারা আমার চলেই না 😀 😀 😀


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আয় হায় এইটা মিয়া কি কন? 🙁
    তারাতারি প্রাপ্তবয়ষ্ক সিরিজ ছারেন। x-( x-(
    নাইলে কিন্তু সুইসাইড খামু 🙁 🙁 🙁


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)
    ফলে আমার ধারনা পাঠকদের অনেকেই ভুলে গিয়েছেন আমার লেখার মুল সুত্র। (কামরুল বাদে

    বিজায় দুঃখ পাইলাম...পচুর আগ্রহ নিয়া পড়ছিলাম। মূলসুত্র মনে আছে।

    সিয়াটলের শীত শেষ?? আপনি না কি সব জ্ঞানী জ্ঞানী আলোচনা করবেন এই সিরিজে বলছিলেন, সেইটা কি আর হবেনা??

    সবশেষে এই দীর্ঘ একাকী জীবনে জন্য সমবেদনা। যদিও আপনার জায়গায় আমি থাকলে মনে হয় একা থাকতেই বেশী পছন্দ করতাম। 😛

    জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    মরতুজা, এ তো বিরাট প্রেম কাহিনী দেখি। যাক সফল পরিনতি দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।

    পার্বতীর আনন্দে আমাদের ভুলে যেও না আবার। অনেকদিন তোমাকে দেখিনি সিসিবি তে।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  6. আমি আর এখন ঘুমহীন সিয়াটলের রাতে নির্ঘুম রাত কাটাই না। গত সপ্তাহে আমার পার্বতী আমার দুয়ারে নোঙ্গর ফেলেছে। স্বপ্নটাকে কাটছাট করলেও বেশ উচুঁতেই দাঁড়িয়ে শ্বাস নেই এখন।

    বস্, সিয়াটল তাইলে আর স্লিপলেস নাই, আলহামদুলিল্লাহ 🙂
    বাকিদের মতই 'পচুর আগ্রহ নিয়া পড়ছিলাম। মূলসুত্রও মনে আছে'। আর মনে মনে আশাই করতেছিলাম যে শেষমেশ দেখা যাইবো শীতের চাদরে মিলনাত্মক সমাপ্তিই আইবো। নিরাশ করেননাই দেইখা থ্যান্কু। ভাবীসাবরে আমাগো সিসিবি বাসি পোলাপাইনের তরফ থেইকা সালাম।

    এইবার হয় 'সিয়াটলের শীতের মাঝেও উষ্ণতা' নাইলে কচিকাচার সিরিজটা যেকুনু একটা চালু করেন 😉

    জবাব দিন
  7. সিয়াটলের শীতের আজকেই শেষ দেখে ছাড়ব।

    এইটা কি করলেন!!!! 🙁 🙁
    এহেন অপকর্মের জন্যে মরতুজা ভাইয়ের চশমা, ঘড়ি, কালো টি-শার্ট,ক্ষুদ্র-নরম চাকরি, ielts রেজাল্ট, কানাডার পি.আর মোট কথা পার্বতী ভাবি ছাড়া বাকি সব শুদ্ধা ব্যান দাবি করছি। :grr: :grr: :grr:

    জবাব দিন
  8. তাইফুর (৯২-৯৮)
    স্বপ্নটাকে কাটছাট করলেও বেশ উচুঁতেই দাঁড়িয়ে শ্বাস নেই এখন

    দীর্ঘ নীরবতার পর স্বশব্দে ফিরে আসা ...
    বস তো বস'ই হয়, কি বলেন মরতুজা ভাই ??


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  9. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)
    গত সপ্তাহে আমার পার্বতী আমার দুয়ারে নোঙ্গর ফেলেছে

    এখন বোঝা যাচ্ছে মরতুজা কেন গত এক সপ্তাহ সিসিবিতে নাই। গুড বয়। ভালো থেকো, বউকে শুভেচ্ছা জানিও আমাদের। আর সিয়াটলের (আমি একবার এয়ারপোর্ট থেকে উঁকি মেরেছিলাম) শীত উপভোগ করো।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তাইফুর (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।