হজ্জ সম্পর্কিত একটি গল্প এবং আমার এক বড়ভাইঃ

হজ্জ সম্পর্কে খুব ছোটবেলায় একটি গল্প শুনেছিলাম।এক ব্যক্তির আপ্রাণ শখ হজ্জে যাবার। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে তা হয়ে ওঠেনি।প্রতিবছর তিনি তিল তিল করে টাকা জমান হজ্জে যাবার জন্যে।তার পাশেই থাকতেন এক দরবেশ যিনি প্রতিবার হজ্জে যেতেন।তো প্রতিবার যাবার সময় তিনি ওই ব্যক্তির খোঁজ নিতেন- এবার তিনি যাচ্ছেন কিনা, টাকা পয়সার কতদূর ব্যবস্থা হল ইত্যাদি।এরকম এক বছর ওই দরবেশ শুনলেন যে তাঁর প্রতিবেশী ওই ব্যক্তি অবশেষে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পেরেছেন।দরবেশ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং হজ্জের পথে রওয়ানা হলেন।হজ্জ শেষে তিনি যখন আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন,তখন তিনি গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেলেন যে  এবছর সবার আগে কবুল হয়েছে তাঁর সেই প্রতিবেশীর হজ্জ।দরবেশ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং এই সুসংবাদ দেবার জন্যে সাথে সাথে তাঁর প্রতিবেশীর বাসায় গেলেন।গিয়ে তিনি দেখলেন,তাঁর প্রতিবেশীর চোখে ভ্রমণজনিত কোন ক্লান্তি নেই,কি এক আভায় তার মুখ জাজ্জ্বল্যমান।দরবেশ তখন জানতে চাইলেন, কি ভাই তুমি হজ্জে গেলে অথচ আসার পথে আমার সাথে দেখা করলেনা,তুমি জান তোমার জন্যে কত বড় সুসংবাদ আছে আমার কাছে?

 

দরবেশের কথায় প্রতিবেশী খুব অবাক হয়ে গেলেন।তিনি বললেন, ভাই, আমি তো এবার হজ্জে যেতে পারিনি, একটা জরুরী কাজে সব টাকা খরচ করতে হয়েছে।এ কথা শুনে দরবেশ প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলেন।তিনি বুঝলেন, নিশ্চয়ই এতে স্রষ্টার কোন অপার মহিমা লুক্কায়িত রয়েছে।তিনি ঘটনা সবিস্তারে জানতে চাইলেন। ভদ্রলোক তখন বললেন,হজ্জে যাবার কিছুদিন আগে তার পাশের বাসায় মাংস রান্না হচ্ছিল।বাসার সবচেয়ে ছোট ছেলেটি খেলতে খেলতে সে বাসায় গিয়ে এক টুকরো মাংস চায়।কিন্তু প্রতিবেশী তাকে তাড়িয়ে দেয়।ছেলেটির কান্না দেখে তিনি তখন প্রতিবেশীকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেন-কি হত মাত্র এক টুকরো মাংস এই বাচ্চা ছেলেটিকে দিলে?সে নিশ্চয়ই পুরোটা খেয়ে ফেলত না!।প্রতিবেশী এ কথা শুনতে পেয়ে ভদ্রলোককে দূরে ডেকে নেন। ডেকে নিয়ে বলেন,-ভাই,আমার পরিবার আজ সাতদিন ধরে কিছু খেতে পারেনি।ক্ষুধার জ্বালায় অনন্যেপায় হয়ে তাই রাস্তায় ফেলে দেয়া একটা মরা গরুর মাংস আমরা রান্না করে খাচ্ছি।আমরা সবাই জানি যে আপনি অত্যন্ত ঈমানদার ব্যক্তি।হারাম মাংস কিভাবে আপনার ছেলেকে খেতে দেই!এ কারণে তাকে আমরা মাংস দেইনি।যদি আমার কখনো সামর্থ হত অবশ্যই নিজে না খেয়ে হলেও তাকে আমরা খেতে দিতাম।আশা করি আমার এ অপারগতা আপনারা ক্ষমা করে দেবেন।প্রতিবেশীর কথায় ভদ্রলোকের চোখে জল চলে আসে।সাথে সাথে তিনি হজ্জের জন্য জমানো সব টাকা সেই দরিদ্র লোকটির হাতে তুলে দেন।ইনশা-আল্লাহ যদি পরবর্তীতে সুযোগ হয় তাহলে হজ্জে যাব।আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার এবারের অপারগতাকে ক্ষমা করে দেবেন-সবশেষে ভদ্রলোক বলেন দরবেশকে।দরবেশ সে কথা শুনে অবাক হয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন।ইন্নামাল আমালু বিন নিয়্যাত-সকল কাজের ফলাফর তার নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল-মহানবী(স)এঁর এ কথাটি বেজে ওঠে তাঁর মনের গহীনে।

 

এবার বলি আমার এক বড় ভাইয়ের গল্প।তিনি যেখানে চাকরি করতেন,সেখানে একটা নিয়ম ছিল যে খুব কঠিন একটা প্রশিক্ষনে প্রথম স্থান অধিকারী ব্যক্তিকে হজ্জ করতে দেবার সুযোগ দেওয়া হবে সব ধরনের খরচ সহ।তাঁর এলাকার একজন সেই প্রশিক্ষণে প্রথম হয়ে হজ্জে যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন।সেই ভদ্রলোকের বাবা একদিন কথায় কথায় এটি আমার সেই ভাইয়ের আব্বাকে বলেন।ভাইয়া সেটা আড়াল থেকে শুনে ফেলেন এবং প্রতীজ্ঞা করেন যে তাঁর বাবাকেও তিনি এ কথা বলার সুযোগ করে দেবেন।অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ সে প্রশিক্ষনে(যেটিতে যোগদান করতেও অনেকে সাহস করেনা) আমার সে ভাই তাঁর অদম্য মনোবল নিয়ে প্রথম স্থান অধিকারও করে বসেন।কিন্তু আফসোস,ততদিনে হজ্জে যেতে দেবার সে নিয়মটি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে।যোগ্যতা থাকতেও তিনি তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি।সেদিন কথা হচ্ছিল আমার সেই ভাইয়ের সাথে।ভাই রে,জীবনে তো কোনদিন বাবা মা কে কিছু দিতে পারিনি।এই যে সুযোগ ছিল তাও তো হলনা-দুঃখ যেন ঝরে ঝরে পড়ছিল তাঁর কণ্ঠে।

 

ভাইয়ার এ কথায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।পেশাজীবনে অত্যন্ত সফল আমার এই ভাইটি, যাঁকে নিয়ে যে কোন পরিবার গর্ব করতে পারে,সেই তিনি যদি এ কথা বলেন, তাহলে যে আমি প্রায়ই বাবা মায়ের কথায় কর্ণপাত করিনা,সেই আমার অবস্থান কোথায়!নিজের অক্ষমতায় মাথা নীচু হয়ে এল আমার।সেই সাথে আমার সেই ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে গেল বুক।

 

ভাইয়া,দোয়া করি,আপনার সাধ পূর্ণ হোক!প্রিয় পাঠক,আপনারাও প্রার্থনা করুন আমার এই ভাইটির জন্যে…

 

 

 

১,৯৮২ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “হজ্জ সম্পর্কিত একটি গল্প এবং আমার এক বড়ভাইঃ”

  1. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    প্রার্থনা তো না করলেও চলব। কারণ, উনি তো অলরেডি একটা কবুল হজ্জের সওয়াব পায়া গেছেন। কাহিনী এইরকম না হইলে প্রার্থনার চিন্তা-ভাবনা করা যাইত। 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।