ভারতবধের প্রতিক্রিয়াঃ একজন আমৃত্যু টাইগার ফ্যানের স্বীকারোক্তি

একজন ডাক্তার তার জীবনে শত শত রোগীর জীবন বাঁচায়। একজন মিলিটারি অফিসার দেশমাতৃকার জন্যে বুকে গুলি বিঁধে লুটিয়ে পড়ে- সন্ত্রাসীর ছোঁড়া বোমায় ছিন্নভিন্ন মস্তিষ্ক নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে পুলিশ বাহিনীর কোন সাহসী সদস্য। এরা নিঃশেষে প্রাণ দেয়, প্রাণ বাঁচায়।সমাজের স্তরে স্তরে এদের অবদান অনেকটা বাতাসের মত, প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, “বায়ু সমুদ্রে বসবাস করিয়া আমরা ভুলিয়া যাই যে আমরা বায়ূ সমুদ্রে বসবাস করিতেছি”।

তবুও, বাংলাদেশে একজন ক্রিকেটার যে সম্মান পান- রাজার সম্মানও তার কাছে তুচ্ছ। অল্প ক’বছরের খেলা, চল্লিশের আগেই অবসর- কিন্তু যতদিন আপনি মাঠে আছেন এবং পারফর্ম করছেন- গোটা পৃথিবীটা আপনার।

সাদা চোখে এ বিষয়টা খানিকটা আনফেয়ার বলে মনে হতে পারে।ক্রিকেটাররা তো আমাদের জীবন বাঁচায়না, দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গ করার শর্ত নিয়ে চাকুরিতে যোগও দেয়না।কেন তাহলে তাদের নিয়ে এত উন্মাদনা? কেন একেকটা সিরিজ জয়ের পরেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান তাদের অভিনন্দন জানাতে? হোয়াই????

এ প্রশ্নের উত্তরটা বিচিত্র একটা জায়গায় পেয়েছিলাম , সেই গল্প বলতে যাচ্ছি আজ। লেঃ কর্নেল আহসান হাবীব- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডো, আমার পরম শ্রদ্ধেয় ক্যাডেটীয় বড়ভাই। কোন একটা বড় টুর্নামেন্টের আগে মনে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট টীম কমান্ডো ট্রেনিং করেছিলো? আহসান ভাই ছিলেন এই ট্রেনিং এর চীফ ইন্সট্রাকটর।

ছয় তলা বিল্ডিং থেকে দড়ি বেঁধে নামবার একটা ট্রেনিং আছে- র‍্যাপেলিং বলে এটাকে।সে সময়ে দলে সাকিব, মুশফিক , সৈয়দ রাসেলরা ছিল। এত উঁচু থেকে নামতে স্বভাবতই রাসেল ভয় পাচ্ছিলো একটু ( খুবই স্বাভাবিক, এটা করতে গেলে নিয়মিত ট্রেনিং নেবার পরেও প্রতিবারই আমার বুক কাঁপে)। আহসান ভাই তখন রাসেলকে বলেছিলেন- “রাসেল, আমি আজকে যুদ্ধ করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরে থাকলে শুধু আমার আত্মীয় স্বজনেরা কাঁদবে। আমার কোন সাফল্যে খুশি হবে আমার কাছের মানুষেরা। আর তুমি একটা উইকেট পেলে সারা বাংলাদেশের মানুষ পারলে খুশিতে টিভি ভেঙ্গে ফেলে- তোমাদের হাতে এই যাদু আছে। যারা সারা দেশের মানুষকে এইভাবে এক সূতোয় বাঁধতে পারে, তাদের কি ভয় পেলে মানায়??”

এই এক কথাতে রাসেল শুধু না, মুশফিক, আশরাফুল সবাই মনের ভেতর থেকে ভয় ছুঁড়ে ফেলেছিল।
আসুন, ব্যাপারটা একটু গভীরভাবে চিন্তা করি।প্রিয় পাঠক, প্রথম ম্যাচে আমাদের মুস্তাফিজুরকে যখন ধোনী কনুই দিয়ে গুঁতো মারল, সেই ব্যাথা কি আপনার মর্মমূলে আঘাত হানেনি? পরের বলে সাকিব যখন ধোনীকে ফিরিয়ে দিলো, পৈশাচিক উল্লাসে আপনিও কি ফেটে পড়েন নি?

পাকিদেরকে সিলেবাস থেকেই বাদ দিলাম- এদের নিয়ে কথা বলার রূচিটুকু আজ হচ্ছে না।আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরম বন্ধু, আমাদের মিত্র। সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতেও ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। রাজনীতির মারপ্যাঁচে না গিয়েও সাদা চোখে এটা বলা যায়, ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটা খানিকটা অম্লমধুর।ভারত বিশাল দেশ, সুবিশাল তার অর্থনীতি- উন্নত তার সভ্যতা- পরাশক্তি হবার অন্যতম দাবীদার তারা। অপরদিকে আমরা সবেমাত্র নিজেদের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বিশাল এই দেশটি কি অবলীলায় জোচ্চুরি করে বাংলাদেশের মত একটি উদীয়মান দলের সাথে- ন্যূনতম চক্ষুলজ্জা না রেখে। এদের অর্থনৈতিক পেশীর জোরে উঠে বসে আইসিসি, অপমানিত হতে হয় আমার দেশের নাগরিক এক প্রেসিডেন্টকে। পশ্চিমবঙ্গের যারা একাত্তরে এক কোটি শরনার্থীদের খাইয়ে পরিয়ে রাখার মত উদারতা দেখিয়েছে, সুনীল সমরেশ শীর্ষেন্দুর পূন্যস্নাত যে পশ্চিমবঙ্গ-সেই এলাকার লোকেরাই দেখি সবচাইতে কুৎসিত মন্তব্যগুলো ছুঁড়ে দেন আমাদের দিকে।আমরা বাঙাল আর এনারা জমিদারের জাত- এই মিথ্যা অভিমানের কত না বড়াই এঁদের।

এই অপমানগুলো ভীষণ গায়ে লাগে, জানেন? গায়ে লাগে বলেই আমরা প্রসেনজিতের পেজ-এ তেড়েফুঁড়ে যুদ্ধ করি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে- আমাদের ক্রিকেটদলকে বাঘের বদলে বেড়াল ডাকায়।

আমাদের ক্রিকেট দলের পাঁচফুট-সাড়ে পাঁচফুট সদস্যরা যখন সাড়ে ছয় ফুটিয়া অস্ট্রেলিয়ানদের হারিয়ে দেয়-মনে হয় আমার মাথাটাই আকাশ স্পর্শ করেছে। গতকালকে তাসকিনের কাঁধে করে মুস্তাফিজুর যখন ফিরছিলো, মনে হচ্ছিলো ওটা আসলে আমি- আমিই বহন করে নিয়ে যাচ্ছি দলের হিরোকে।

চুরিচোট্টামি আর ছলচাতুরি করে সারাবিশ্বের আর সব জায়গায় দাবিয়ে রাখা যায় আমাদের- শুধু মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ওই বাইশ গজ জায়গাটুকু ছাড়া। এই একটা জায়গা- যেখানে বছরের পর বছর পুঞ্জীভূত বঞ্চনার জবাব আমরা চোখে চোখ রেখে দিই। আউট হবার পরেও বিরাট কোহলী যখন দাঁড়িয়ে থাকে, মাশরাফির উদ্ধত চাহনির সাথে যেন এই মাসরুফও সুদূর টোকিও থেকে বলে ওঠে-“ কেয়া হুয়া রে? চল ভাগ!!!”

নাসির যখন উড়ন্ত কোন ক্যাচ ধরে, সাকিব যখন ঘূর্ণিজাদুতে বোকা বানায় ধোনীকে, তাসকিনের বাউন্সারে কাট করতে গিয়ে ডাবল সেঞ্চুরিয়ান রোহিত শর্মা যখন ধরা খায় উইকেটের পেছনে- বিশ্বাস করুন, এদের প্রত্যেকের ভেতরে আমি আমাকে দেখতে পাই।বাজী ধরে বলতে পারি- বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতিটি ফ্যান এই একই অনুভব করেন বুকের ভেতরে। মুস্তাফিজুরের বোলিং বিশ্লেষণে যখন লেখা থাকে মুস্তাফিজুর ৬/৪০, ওই জায়গাটাতে আমি মাসরুফ পড়ি।মাহমুদুল্লাহের নামের পাশের সেঞ্চুরিটার সময়ও তাই।

অতিমাত্রায় নার্সিসিস্টিক বলে গালি খাবার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই সাহস করে মনের ভেতরে লুকানো অনুভূতিটা বলে ফেললাম। আমি জানি, মুখে না বললেও- বাংলাদেশ ক্রিকেটদলের প্রতিটা সাফল্য কিংবা ব্যর্থতাকে আপনারাও হুবহু একইভাবে একেবারে ব্যক্তিগত অর্জন বা পরাজয় হিসেবে দেখেন।

এই জায়গাটাতেই একজন ক্রিকেটার এগিয়ে থাকেন একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পুলিশ অফিসারের চাইতে।এ্যান্ড রাইটলি সো।

নব্বইয়ের দশকে চোরের মত খেলা দেখতাম- বাংলাদেশের খেলোয়াড়দেরকে টিভিতে দেখাচ্ছে এই আনন্দেই আটখানা হতাম আমরা। আজকে আমাদের বাংলাদেশ বলে কয়ে হারায় বিশ্বের সেরা সব দলগুলোকে- মিরপুর স্টেডিয়াম প্রতিপক্ষের জন্যে আজ আতঙ্কের অপর নাম।

পুরান ঢাকার এক বিহারী নাপিতের কাছে মাঝে মাঝে চুল কাটাতাম আমি। উর্দুভাষী বিহারী হলেও এই লোকটা কোন এক বিচিত্র কারণে অন্ধভাবে বাংলাদেশ দলকে সাপোর্ট করত। কেনিয়ার সাথে আইসিসি ট্রফির ঠিক পর পরই গো হারা হেরে মুখ চুন করে যখন চুল কাটতে গিয়েছি, সেই নাপিত মজার একটা কথা বলেছিলোঃ

“কিঁউ বেজার হো বাবুজি, মার খা খা কার হামারে বাংলাদেশ একদিন মার দেনা সিখেগা। হামারে বাত জানতা নেহি মাগার তুম দেখেগা- জরুর দেখেগা”।

সেই দিন তো দেখতেই পাচ্ছি,আমার দল আজ বলেকয়ে ধরাশায়ী করে মহাপরাক্রমশালী ভারতকে- বাংলাওয়াশের আতঙ্কে ঘুম হারাম করে দেয়।

ক্রিকেটে যেমন, জীবনেও তাই। মার খেতে খেতেই একদিন আমরা মার দেয়া শিখব।শুধু ক্রিকেটে নয়- প্রতিটি ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তাই আমাদের জন্যে অনুপ্রেরনার এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র- যার আলো অন্ধকারের ভেতরেও সর্বক্ষেত্রে আলো দেখাবে।

সবশেষে Dead Poets Society ছবির রবিন উইলিয়ামসের উক্তি দিয়ে শেষ করিঃ

We don’t read and write poetry because it’s cute. We read and write poetry because we are members of the human race. And the human race is filled with passion. And medicine, law, business, engineering, these are noble pursuits and necessary to sustain life. But poetry, beauty, romance, love, these are what we stay alive for.

কবিতার জায়গায় ক্রিকেট বসিয়ে নিন, আমি কি বুঝাতে চাইছি নিমেষেই বুঝে যাবেন।
জয় বাংলা!

২,২২২ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “ভারতবধের প্রতিক্রিয়াঃ একজন আমৃত্যু টাইগার ফ্যানের স্বীকারোক্তি”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    সুন্দর লিখেছো, মাশরুফ।
    মনের কথাগুলাই অবলিলায় বলে দিয়েছো।
    তোমার সব লিখাই আগ্রহ নিয়ে পড়ি।
    এটা শুধু পড়লামই না, অনুভবও করলাম...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন হয়েছে, মনের কথাগুলো সুন্দর করে বলে ফেলার জন্য :just: ধন্যবাদ 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    রাইটলি সো।
    এন্ড দ্যা কোট ফ্রম ডেড পোয়েটস সোসাইটি ওয়াজ এ পারফেক্ট মর্টার ইন দ্য লঞ্চার অব আ পিওরলি টারগেটেড অয়েনমেন্ট ফর ইমোশন।
    থাম্বস আপ ! (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  4. সাইদুল (৭৬-৮২)

    শিরোনাম খুব শক্তি শালি।পড়ে মজা পেয়েছি। তবে খেলাধুলোর সাথে রাজনীতি নিতে পারিনা। মনে হয় বয়স হচ্ছে।


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    কিছু কিছু লেখা পড়ে মনে হয় ছয়ফুট লম্বা এই শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরি, হুদাই কয়েকটা ফ্রন্টরোল লাগাই -- হলই বা পুলিশ!
    বেড়ে লিখেছ ভায়া!
    নাও এবার শুরু কর --- :frontroll:
    😀

    জবাব দিন
  6. নাফিস (২০০৪-১০)

    আলুভর্তা আর ডাল।
    খেলা আর রাজনীতি।
    না মেশালে ঠিক জমেনা। আসলে খেলার সাথে অনেক কিছুই মেশাতে হয়। আবেগ, অনুভূতি আরো অনেককিছু। এত কিছু মেশাই বলেই তো এত ভালোলাগা কাজ করে... ২০০৩/৪/৫ এর সময়কার কথা করি মাঝে মাঝে। সম্মানজনক পরাজয়ের আত্মতৃপ্তি থেকে বের হয়ে আমরা এখন কতই না বদলে গেছি ? হোয়াইট ওয়াশ করতে না পারলে আফসোস লাগে !

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।