শুভ জন্মদিন, ইনটেক-১৯৯৭ !!!

দেখতে দেখতে ১১ বছর পার হয়ে গেল। ১৯৯৭ সালের এই দিন আমি প্রবল উত্তেজনায় সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি-আগামিকাল আমার জীবনে শুরু হতে যাওয়া নতুন এক অধ্যায়ের জন্যে। আজ রাজশাহী থেকে বন্ধু হাফিজ ফোন করল একটু আগে…… “দোস্ত এবার ঢাকায় আসতে পারছিনা পরীক্ষার কারনে…”। আমি অবাক হয়ে বললাম, কি ব্যাপার?? হাফিজ বলে-“ভুলে গিয়েছিস?? আগামীকাল ৩ জুলাই! ”সাথে সাথে এক ছুটে আমার মন চলে গেল ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে- এগারো বছর আগের সেই দিনে-

মনে পড়ে গেল সে সময়টা যখন লকার পার্টনার ইব্রাহিম ভাই আমার শার্ট এ নবীনদের ব্যাজ পড়িয়ে দিয়ে নিয়ে গেলেন অডিটরিয়ামের দিকে। খাকি পোশাকের ক্যাডেটদের দেখে কি পুলকিতই না হয়েছিলাম! আমাদের বরণ করে নেবার অনুষ্ঠানের নাম ছিল “এসো নীপবনে”। ২৯ তম ইনটেকের আলী ভাই এর কন্ঠে গাওয়া “মনে পড়ে যায় আমার কৈশোর” শুনে মনে হয়েছিল তিনি নিঃসন্দেহে কোনো পেশাদার ব্যান্ডের শিল্পী। সেদিন প্রিন্সিপাল লেঃ কঃ আবুল কাশেম স্যারের সুগম্ভীর ভাষণ-“A Cadet shall lead a life of honor and integrity” যে কতবার আমাকে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেবার হাত থেকে রক্ষা করেছে সেটা গুনতে চেস্টা করাটাও বোধহয় অবান্তর।

বাবা মাকে বিদায় দিয়ে কান্নাভেজা মুখে হুনাইন হাউসের বক্স ডর্মের সামনে দিয়ে যাবার পথে ৩১ ইনটেকের সাকিব ভাই বলেছিলেন, “এত চিন্তা কিসের, দেখবা ৬ বছর কিভাবে কেটে যাবে টেরই পাবেনা- আর মন খারাপ হলে ডর্মে চলে আসবে, কেমন?” সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন সাকিব ভাই আজ রংপুরে অফিসার্স মেসে বসে কি মনে করতে পারেন, কতটা সাহস সেদিন তিনি আমায় দিয়েছিলেন?

মনে পড়ে ডর্ম ১১ এর ডর্মর্লীডার সুকান্ত ভাই এর কণ্ঠ- “রাতের বেলা ভয় পেলে অথবা পানি খেতে বাইরে যেতে চাইলে আমাকে ডাক দেবে, কোনো চিন্তা নেই। এখানে বাবা মা না থাকলেও আমরা বড় ভাইরা রয়েছি”। আজ সুদূর লন্ডনে বসবাসরত সুকান্ত ভাই কি জানেন, তাঁদের স্নেহ আমার মত সেইদিনের ১২ বছরের কিশোররা আজ কতটা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে?

হাউস প্রিফেক্ট প্রতীক ভাই সবাইকে হাউসের সামনে নিয়ে রাস্তায় আঁকা কার্টুনগুলো দেখিয়ে বলেছিলেন- “হুনাইন হাইস চ্যাম্পিয়ন হাউস, নভিসেস ড্রিলে তা প্রমান করার দায় কিন্তু তোমাদের উপর”। হাউসপ্রেমের সাথে সাথে দেশপ্রেমের শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি যে তাঁর কথাতেই পোক্তভাবে প্রোথিত হয়েছিল কতগুলো কিশোরের মনের গভীরে, আজ বিল গেটসের মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের তুখোড় ইঞ্জিনিয়ার প্রতীক ভাইএর মনে তা এক আধটু দোলা দেয় কি?

২০০৩ সালে কলেজ থেকে বের হবার পর প্রতি বছর এই দিনটি আমরা ৯৭ ব্যাচ দশ কলেজ মিলে উদযাপন করি। ২০০৪ সালে গুলশান বিএফসি, ২০০৫ সালে ধানমন্ডি লেকের ডিঙ্গি রেস্তোঁরা, ২০০৬ সালে ইস্টার্ন প্লাজার কাছের ফাস্টফুডের দোকান, ২০০৭ সালে আবার ধানমন্ডি লেক পেরিয়ে ২০০৮ এর ১১ জুলাই দেশ বিদেশ থেকে সবাই একত্রিত হব রমনা চায়নিজ রেস্তোরায়। পুরনো দিনের মত মেতে উঠব হাসি ঠাট্টা আর উল্লাসে। বুয়েটের নাসিরকে ক্ষেপাব সেদিন আমার পাশের বেড থেকে সান্তনা দিতে গিয়ে নিজেই কেঁদে দেবার কথা মনে করিয়ে দিয়ে। আর্মির বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করব, “কি রে হাঁটু পার্টি, মইন মামু প্রেসিডেন্ট হবেন কবে? মামু শুনলাম ক্যাডেট কলেজের বংশ বৃদ্ধি করতে চান?” সাথে সাথে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হবে-“লম্বু ভাল হয়া যা,পরসস তো মাস্তির যায়গায় আশে পাশে খালি সুইট সুইট পাখিরা- নিয়া আইলি না কেন লগে? আবার কথা কস!” এরপর আমার চরিত্র নিয়ে কাল্পনিক মন্তব্য ছুটে আসবে কে কবে আমাকে কোথায় কোন “পাখি”র সাথে “আপত্তিকর” অবস্থায় দেখেছে…আর প্রবল প্রতিবাদী আমি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হব তাদের মুখ বন্ধ করতে……

প্রতিবার এ দিনটি আসে নানান রঙের পসরা সাজিয়ে, আমাকে উজ্জীবিত করে তোলে কর্মে চিরদীপ্ত, কর্তব্যে কঠোর ব্রত আর সাধনায় একনিষ্ঠ হতে। ছাত্রজীবন শেষে একে একে সবাই ছড়িয়ে পড়ছি একেক কোনায়, প্রতি বছর কমে আসছে একত্রিত হতে আসা প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের সংখ্যা। আগামী বছর আরও দূরপ্রান্তে চলে যাবে অনেকেই……

তার পরেও, এ দিনের কথা কি সত্যি সত্যি উপেক্ষা করা সম্ভব? তাই কি হয় কখনও??

একেবারেই না।

শুভ জন্মদিন, ইনটেক-১৯৯৭!!!!!

২,৪০৪ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “শুভ জন্মদিন, ইনটেক-১৯৯৭ !!!”

  1. তোমরা তো দেহি বহুত পরে গেছ...
    আমাদের('৯৫-২০০১) 'গৃহ প্রবেশ' দিবস ৩০শে এপ্রিল...
    তোমাদের চাইতে আমরা অনেক বেশি দিন কলেজে কাটাইছি!!!

    যাহোক, তোমাদের সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

    জবাব দিন
  2. শাহেদ_৯৭-০৩

    খুব শুন্দর হইসে মাস্রুফ...দেশের সব বন্ধুকে জন্মদিনের সুভেচ্ছা...দেশের বাইরে থেকে সবাইকে খুব মিস করছি...হাতের কাছে ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের পাবার মর্ম দেশের বাইরে থাকলে উপলব্ধি করা যায়..so earnest request to everyone....go to the get together...

    জবাব দিন
  3. এই লেখার সুবাদে ৯৭ ব্যাচতো আসল জন্মদিনের আগেই সব শুভেচ্ছা পেয়ে গেল। তাই আমিও আগেভাগেই দিয়ে দিচ্ছি- শুভ জন্মদিন।

    আর ৯৭ ব্যাচের কাছে আমার প্রশ্ন- বছরের এত দেরীতে কলেজে জয়েন করা কি ভাল/আনন্দের ছিল না খারাপ/কষ্টের?

    জবাব দিন
  4. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    একটু দেরীতে হলেও শুভ জন্মদিন ৯৭ ব্যাচের ছোট ভাই বোনেরা। এই দিনটা আমার অনেকগুলা কারণে অসম্ভব রকম ভালোভাবে মনে আছে। সেটা নিয়ে একটা পোস্ট দিব দিব করেও দেওয়া হচ্ছে না।

    জবাব দিন
  5. আলম (৯৭--০৩)

    বড় বেশি দেরি করে ফেললাম নাকি?
    ১৩ দিন ধরে রুমের নেট কানেকশন ছিলোনা। দিল তড়পাচ্ছিলো সিসিবির জন্য। বেশি খারাপ লাগছিলো এই জন্য যে, ৩রা জুলাই 'আমাদের বার্থডে' উপলক্ষ্যে আগেই লিখে রেখে দিছিলাম, কিন্তু পাবলিশ করার আগেই নেট ডিসকানেক্ট... যাহোক, লেখাটা জমা রইলো, পরের বছর বার্থডেতে পাবলিশ করে দিব।
    মাসরুফ দোস্ত, প্রচন্ড ভাল লিখছিস। আমারও জিহাদের মতোই ফিল হইতেসিল!! 😀

    জবাব দিন
  6. আশিক (১৯৯৬-২০০২)

    মনে পড়ে ডর্ম ১১ এর ডর্মর্লীডার সুকান্ত ভাই এর কণ্ঠ- “পানি খেতে বাইরে যেতে চাইলে আমাকে ডাক দেবে, কোনো চিন্তা নেই। ”।

    আরে খাইসে! 😀 আমাদেরতো পারলে বলতো...'যাওয়ার সময় ফ্রন্টরোল দিতে দিতে যাবা, আসার সময় ফ্রন্টরোল দিতে দিতে আসবা! 😀 '। নেহায়েত প্রথম দিন দেখে হয়তো বলে নাই, নাইলে সিওর বলতো! :))

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।