শুভ জন্মদিন, ‘৮৯ ইনটেক

২২ বছর আগের এই রাতে, সারা রাত বৃষ্টি ছিল। ঢাকা থেকে সন্ধ্যা সাতটায় ছেড়ে যাওয়া বিআরটিসি’র লাল রঙের বাসে চড়ে, ভোর ৫ টায় রাজশাহীর সাহেব বাজার। জীবনে প্রথমবারের মতো রাজশাহী আসা। অজানা এক আশংকা, কিংবা উৎকণ্ঠায় নির্ঘুম সারা রাত। সাহেব বাজারের এক হোটেলে উঠে, ফজরের নামাজ শেষে ক্লান্তির ঘুম।

লোকাল বাসে করে বানেশ্বর হয়ে সারদা যেতে যেতে প্রায় বিকাল ৫টা। প্রথমবারের মতো এতো কাছ থেকে পদ্মা নদী দেখা। এর আগ পর্যন্ত পদ্মা নদী বলতে আমি শুধু আরিচা-দৌলতদিয়া বুঝতাম। কলেজ গেটে তড়িঘড়ি রেজিস্ট্রেশন, লাগেজ নিয়ে অনেকদুর হেটে তারিক হাউজের দোতলায় ৯ নম্বর রুম। টাই বাঁধতে জানতাম না। সিনিয়রের সহায়তায় টাই বেধে নিয়ে, ডাইনিং হলে দৌড়।

কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কি থেকে কি হচ্ছিল, কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘন্টার শব্দ, অনেক মানুষের কোলাহল, কেউ যেনো চিৎকার করে কি বলে উঠলো, পাশ থেকে কে যেনো বিস্কুট খেতে দিলো, চা খাওয়ার অভ্যাস ছিলো না। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা- একটু পর আব্বা চলে গেলেই আমি একা।

ডাইনিং হল থেকে আবার রুমে। আব্বা এসে দেখে নিলো, পরের ৬টি বছর আমি কোথায় থাকবো। দুইজন সিনিয়র আমার ট্রাংক খুলে সব বের করে, কেমন জানি হিসেব মিলিয়ে আলমারি গুছিয়ে দিলো। ট্রাংকের অর্ধেক ছিলো গল্পের বইয়ে ভর্তি। গল্পের বই যে আনা যাবে না, সেটা কোথাও লেখা ছিল না। সাহাবুদ্দিন স্যার (পরে নাম জেনেছি), সব বই বের করে আব্বার হাতে দিয়ে দিলেন। সব মিলিয়ে, ঘন্টা খানেক। আব্বা আমাকে কেমন একটা সান্তনা দিয়ে চলে গেলো।

কোনো কিছু ভাবনার সময় পাচ্ছিলাম না। অন্য কারো দিকে তাকানোরও সময় হচ্ছিল না। সিনিয়রদের কথা মতো রোবটের ভুমিকা। ঘন্টায় ঘন্টায় ড্রেস চেন্জ, বেলুন ছিড়ে ফেলায় বেল্টের বাড়ি, চামচ আর কাটা চামচের তালে-গোলে প্র্রায় না খেয়ে থাকা, সিনিয়রকে নাম ধরে ডাকায় বিভিন্ন জনের কাছে দফায় দফায় পানিশমেন্ট, অনেক অনুরোধেও শখের চুল বাঁচাতে না পেরে, প্রায় ন্যাড়া মাথা। জটিল কায়দার মশারি টানানো, রাত এগারটায় লাইটস অফের পর, দাড়িয়ে দাড়িয়ে রুম লিডারের ক্লান্তিহীন লেকচার। তারপরও সেলুন কেনো বারবার সপ, আর লন্ড্রি কেনো ধুপি সপ, তা বুঝে উঠতে পারিনি।

দেখতে দেখতে দুই মাস দশদিন শেষ। এসএসসি পরীক্ষা শেষ। দুই-দুই বার কলেজ পালিয়ে কলেজ আউট। দেখতে দেখতে ২২ বছর শেষ।

অথচও, আজও ১৪ মে আসলে মনের ক্যানভাসে হাজার স্মৃতির আনাগোনা। বিছানার চাদর মুড়ি দিয়ে- নাইটগার্ডদের অগোচরে, টিডি বিল্ডিং এর পিছনের দেয়াল টপকে মাঝরাতে হারেছের দোকান, আম বাগান অথবা ডাব চুরি। দিনে দুপুরে প্রিন্সিপাল বাংলোর সামনে থেকে পেয়ারা চুরি অথবা ডাইনিং হলের পিছনে জাম গাছে জ্যামিং। রাত জেগে রেডিওতে নিশুতি প্রোগ্রাম অথবা রেডিও নেপালে হিন্দি গান। কলেজ পালিয়ে চারঘাট যেয়ে বাংলা ছবি ‘গরম হাওয়া’। কার্ড খেলার সময় এনামুল হক স্যারের হাতে ধরা পড়া। রুমের মধ্যে সক্স আর ক্লিয়ার শ্যাম্পুর হেড দিয়ে বানানো বল দিয়ে ক্রিকেট খেলার সময় টিউব লাইট ভেঙ্গে, মাঝরাতে ডাইনিং হলের সামনে থেকে লাইট চুরি।

সবই মনে হচ্ছে, এই সেদিনের কাহিনি। শুধু বুঝতে পারছি, কাঁচা আম আর আমাকে টানে না। গাছ থেকে বেছে বেছে, আর কোনদিন পেয়ারা পেড়ে খাওয়া হবে না। কলেজ থেকে বের হয়ে, আর কোনো দিন রাত জেগে নিশুতি শোনা হয়নি। যে দিন গেছে, তার সকলি গেছে, সোনাঝরা বিকেলগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না।

২,১৭০ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “শুভ জন্মদিন, ‘৮৯ ইনটেক”

  1. তাহমিনুল (২০০২-২০০৮)
    জীবনে প্রথমবারের মতো রাজশাহী আসা
    প্রথমবারের মতো এতো কাছ থেকে পদ্মা নদী দেখা
    কলেজ থেকে বের হয়ে, আর কোনো দিন রাত জেগে নিশুতি শোনা হয়নি

    অনেকদিন পর আবার ফিরে গিয়েছিলাম সেই পদ্মাপাড়ে, সেই তারিক হাঊসে, সেই কলেজে ।
    মনজুর ভাইকে অনেক ধন্যবাদ ।

    জবাব দিন
  2. সামি হক (৯০-৯৬)

    মঞ্জুর ভাই :boss: :boss:

    আপনার লেখা পড়ে অনেকদিন পর বিআরটিসি বাসগুলার কথা খুব মনে পড়ল। লাল রং এর বাসে এক দিকে দুই সিট এক দিকে তিন সিট। মনে আছে একবার ঢাকা ফেরার পথে আমাদের বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এজাজ ওস্তাদ ছিল সেইবার বাসে। আমরা হেটে হেটে অনেকদূর যাবার পরে বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর বাস ঠিক করে নিয়ে আসছিল।

    লেখা সরাসরি প্রিয়তে ...

    জবাব দিন
    • মনজুর (৮৯-৯৫)

      অই মিয়া শরম দাও কেন 😛

      হমম.. বিআরটিসি বাসের অনেক ঘটনাই মনে আছে। আগে পাবনা বাইপাসের রাস্তাটা কাঁচা ইট বসানো ছিলো। ওই রাস্তা পার হওয়ার সময় প্রায়ই গাড়ী নষ্ট, না হয় টায়ার পাংচার কিছু একটা হইতোই।
      কলেজে আসা-যাওয়ার আরো অনেক মজার ঘটনাই মনে পড়ছে। ছুটির আগের দিন বাসে ভালো ছিট রাখার জন্য নানান ফন্দি-ফিকির, ফেরিতে টপফ্লোরে একসাথে আড্ডা-গান গাওয়া, কোরবানী ঈদের আগের ছুটিতে আমিন বাজারের জ্যাম--ম্যালা ঘটনা।

      কমেন্টানোর জন্য ধন্যবাদ 🙂

      জবাব দিন
  3. এহসান (৮৯-৯৫)

    দারুণ লেখা।

    নিজের জন্মদিনে মন খারাপ হয়না, কিন্তু এই ১৪ মে আসলে মনটা খারাপ হয়ে যায়… খালি মনে হয়, সব ফুরিয়ে যাচ্ছে.. সময় কমে আসছে.. সবই মনে হচ্ছে, এই সেদিনের কাহিনি। শুধু বুঝতে পারছি, কাঁচা আম আর আমাকে টানে না। গাছ থেকে বেছে বেছে, আর কোনদিন পেয়ারা পেড়ে খাওয়া হবে না। কলেজ থেকে বের হয়ে, আর কোনো দিন রাত জেগে নিশুতি শোনা হয়নি। যে দিন গেছে, তার সকলি গেছে, সোনাঝরা বিকেলগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না।

    একদম মনের কথা লিখেছো... ফেসবুক ছাড়া আর কখনো ব্যাচের সবাই একসাথে আড্ডা মারতে পারবো না... অনেক মন খারাপ হয়... অনেক কষ্ট... বড় হয়ে যাবার কষ্ট।

    জবাব দিন
    • মনজুর (৮৯-৯৫)

      বড় হয়ে যাবার কষ্ট। ছোট বেলায় এই কষ্টটা আন্দাজ করতে না পারার কষ্ট 🙁

      আসলে ক্যাডেটদের সকলের মনে অনেকটা একই ধরনের অনুভুতি উড়ে বেড়ায়, তাই একজন যাই লিখুক, তা অন্যদের মনে কিছুটা অনুরনন তুলে যায়। 🙂

      ধন্যবাদ। (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)

      জবাব দিন
  4. আসাদুজ্জামান (১৯৯৬-২০০২)

    ভাই এইভাবে মনটা খারাপ করে দেয়া কিন্তু ঠিক না......। আজকে দিনটা এমনিতেই gloomy. আর এইদিনগুলাতেই আমার কলেজের কথা বেশি মনে পড়ে। আর সারাদিন ধইরা সবার মন খারাপ করা ঘটনা শুনতেছিলাম। কেন যে আবার আপনার ব্লগটা পড়তে গেলাম????? 🙁

    জবাব দিন
  5. মনজুর (৮৯-৯৫)

    হমম.. পড়াটা একদম উচিত হয় নাই। আর পড়লেও কোনো রোদেলা দুপুরে বা পড়ন্ত বিকেলের সোনারঙ আলোয় ভিজে ভিজে পড়া উচিত ছিলো, যেনো মনটা বেশ ফুরফুরে থাকে..

    যাউগ্গা, পইড়া কমেন্টানোর জন্য একটা বৃষ্টি ভেজা সম্ধ্যাবেলার শুভেচ্ছা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মনজুর (৮৯-৯৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।