স্মৃতির শোকেস

২য় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমার পাশে একটা সিট সবসময় খালি থাকতো। পরীক্ষার্থীর নাম ছিল নীলিমা আচার্য।

মনে পড়ল সেই পরীক্ষারই মাত্র দু’বছর আগে প্রথম যখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্লাসে ঢুকছিলাম তখন খুব হতাশ হয়েছিলাম, কারণ ক্লাসে ঢুকেই দেখি মাত্র ৪ জন মেয়ে। চামড়ার রঙ দেখে মনে হলো এর মাঝে দু’জন ইউরোপীয়,একজন আফ্রিকান আর একজন আমাদের উপমহাদেশের। স্বল্পবসনা দুই ইউরোপীয় ললনার মাঝে একটা সীট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও গিয়ে বসলাম পিছনে। অ্যারোডাইনামিক্সের বোরিং ক্লাস হচ্ছিল। শিক্ষক সবার নাম আর দেশ জিজ্ঞাসা করল। পাশের মেয়েটা তার নাম বলল নীলিমা আচার্য, আর অবাক করে দিয়ে বলল তার দেশ বাংলাদেশ। আমিও যখন বললাম যে আমার দেশ বাংলাদেশ, তখন আড়চোখে ও আমাকে একটু দেখল, আর আমিও এক্সট্রা ফ্রি হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন আছো?’

আমাদের পুরো ক্লাসে শুধু আমি আর নীলিমাই ছিলাম এশিয়ান। তাই আমাদের বন্ধুত্বটাও খুব তাড়াতাড়ি গড়ে উঠল। নীলিমা দেখতে ছিল মায়াবী, তাই স্বভাবতই অন্য ডিপার্টমেন্টর দু’একটা ইন্ডিয়ান ছেলে ওর পিছনে ঘুরাঘুরি করত কিন্তু ও এমনিতে ছেলেদের সাথে খুব একটা মিশত না, কিন্তু যেহেতু আমাদের ধর্ম ছিল ভিন্ন, তাই আমাদের সম্পর্কটা খুব শংকামুক্তভাবে গড়ে উঠছিল। ও ছিল কট্টর ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে, এখানে এসেও প্রতিদিন পূজা না করে ক্লাসে আসতো না। আর আমি যদিও প্রতিদিন ফজর নামাজ পড়ে ক্লাসে আসতাম না, তবু অন্তত ধর্মের প্রতি বিশ্বাসটা অটুট ছিল। স্বভাবতই তাই, আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে অন্যদিকে টার্ন নেয়ার কোনো অবকাশই ছিলনা, এটা ভেবেই হয়তো ও আমার সাথে খুব সহজভাবে মিশত।

ও আসলে ছিল পুরাই আমার উল্টা। আমি সকালে ক্লাস মিস করে ঘুমিয়ে থাকতাম, আর ও প্রতিটা ক্লাস করতো।আমি সারারাত পার্টি করে বেড়াতাম, আর ও পড়ত। আমি সবসময় মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতাম, আর ও পারতপক্ষে ছেলেদের সাথে কথাই বলতো না। তবু আমাদের বন্ধুত্বটা গভীরতর হচ্ছিল। আমি যত ক্লাস মিস করতাম, ও আমার জন্য সব নোট জোগাড় করে রাখতো। এস্যাইনমেন্ট জমা দেয়ার আগের রাতে, ওর রুমে এসে আমি হাজির। ওরটাই কপি করে শুধু নাম বদলে দিয়ে দিতাম। ও খুব রাগ করত। বলতো, এভাবে চলতে থাকলে নাকি আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, কোনো কোম্পানি নাকি আমাকে চাকরী দিবেনা। ও বকতো, আমি হাসতাম, আর ও আরো রাগ করতো।

সময় উড়ে চলে গেলো। ১ম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা। সারা বছর ফাঁকি দিয়ে কিছুই বুঝছিলাম না। পরীক্ষার আগের রাতে নীলিমার রুমে গিয়ে বসে থাকতাম, আর ও ওর পড়া বাদ দিয়ে আমাকে propulsion র কঠিন সব বিদ্যা বোঝানোর চেষ্টা করত। মাঝে মাঝে লাইব্রেরী থেকে নিজে বই এনে আমাকে বাংলায় অনুবাদ করে দিত। পরীক্ষার মাঝে একদিন আমাকে বলল, ও সামার এর ছুটিতে বাংলাদেশ যাওয়ার টিকেট বুকিং দিয়েছে।
বললাম, ‘তাই নাকি? কবে যাচ্ছো?’
‘এইতো পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে তার তিনদিন পর।’
‘ভালো, ঘুরে এসো।আমি এখানেই থাকবো। দেখি জব করে সামারে কিছু টাকা জমানো যায় কিনা।’

ও চলে গেলো দেশে। আমিও ব্যস্ত রইলাম আমার জব নিয়ে। মাঝে মাঝে ফেইসবুক এ কথা হতো ওর সাথে। ভালই মজা করছে ছুটিতে। এর মাঝে আমাদের রেজাল্ট দিল। আমি কিভাবে যেনো পাস করে গেলাম আর নীলিমা ডিস্টিংশন নিয়ে পাস করলো। ও ২য় বর্ষের ক্লাস করার জন্য চলে আসলো। একদিন রাতে গেলাম ওর রুমে গল্প করতে। দরজা নক করতেই বলল, ‘কাম ইন প্লিজ’, আমাকে দেখে বলল, ‘আরে তুমি, পরীক্ষা আর এস্যাইনমেন্ট না হলে তো আমার কথা তোমার মনেই থাকে না।’ বললাম, ‘আর লজ্জা দিয়ো না, আজ শুধু তোমার সাথে গল্প করতে আসছি’
‘ভালো, শুনে ধন্য হলাম’
‘কেমন মজা করলা ছুটিতে বাংলাদেশে?’
‘হমম অনেক মজা করছি কাজিনদের সাথে। আমি সামনে ক্রিস্টমাস ছুটিতেও আবার যাব’
‘আবার! মাত্র তো আসলা। তিন মাস পর আবার! তোমার বাবার তো অনেক টাকা! হাহাহা’
‘না যেতে হবে, এই সামনের ছুটিতে আমার বিয়ে। সামারেই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ছেলে অষ্ট্রেলিয়ায় থাকে তো, ছুটি পায়নি।’

সত্যি কোনোদিন নীলিমাকে নিয়ে কিছু ভাবিনি, কিন্তু ও যখন হাসিমুখে ওর বিয়ের কথাটা আমাকে শোনাচ্ছিল তখন কেনো যেনো মনে হচ্ছিল আমার শ্বাস নেয়ার জন্য কোনো অক্সিজেন নেই। অদ্ভুত এক ঘোরে চলে গেলাম সে রাতে। নির্ঘুম রাত। অদ্ভুত চিন্তারাশি। পরদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি আজ সদা পরিপাটি নীলিমাকে ও খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। বললাম, ‘কি কাল রাতে ঘুম হয়নি?’ উত্তর দিল, ‘কই না তো।খুব ভালো ঘুম হয়েছে। বরং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যে তোমার ঘুম হয়নি।’ আমি বললাম, ‘না তো, আমারও খুব ভালো ঘুম হইছে।’ এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো, প্রতিদিনই নীলিমাকে দেখতাম আরো বেশী বিধ্বস্ত হচ্ছে। একদিন সন্ধ্যায় ওর রুমে গেলাম, বললাম, ‘নীল, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’ ও অবাক করে দিয়ে বলল, ‘আমার পরিবার এটা কিছুতেই মেনে নিবে না।’ আমি বললাম, ‘আমার পরিবারও মেনে নেবে না কোনোদিন।’ ও আমার দিকে এক দিশেহারা দৃষ্টিতে তাকালো যে, আমি কিছু না ভেবেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, আর আমরা দু’জন আরেকটি নির্ঘুম রাত কাটালাম। সেই রাতেই হয়ত আমরা প্রমিস করেছিলাম যে দু’জন কেউ কোনোদিন কাউকে ছেড়ে যাবো না।

আবার ব্যস্ততা শুরু হল। ক্লাস, জব, এস্যাইনমেন্ট, তবু এসবের মাঝে পৃথিবীটা একটু বেশীই সুন্দর মনে হচ্ছিল আমার কাছে। প্রতিদিনই নীলিমার সাথে দেখা হতো। আর হত অনেক কথা। আমাদের ভবিষ্যতের কথা, অতীতের কথা।এখন আর ও আমাকে কোনো ক্লাস ফাঁকি দিতে দেয়না, রাত জেগে পার্টিও করতে দেয়না। মাঝে মাঝে কোনো এক উইকেন্ড এ হয়তো আমরা চলে যেতাম ম্যানচেস্টার বা বার্মিংহাম এ। রাতের ট্রেন এ যেতাম, সারাদিন ঘুরে ওইদিন আবার রাতের ট্রেন এ ফিরে আসতাম।সেবার খুব তুষার পড়ছিল কার্ডিফ এ, একদিন আমি আমার ফ্রন্ট ইয়ার্ড এ বরফ কেটে ওর নাম লিখছিলাম, ও কত খুশি হয়েছিল!

ক্রিস্টমাস ছুটি তখন কাছাকাছি। আমি আর নীলিমা, একসাথে বসে ডিনার করছিলাম। হঠাৎ ওর বাবার ফোন। ওকে জিজ্ঞাসা করছে কবে আসবে বাংলাদেশে, টিকেট কেটেছে কিনা। ও আমতা আমতা করতে রেখে দিল ফোন। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বললাম, ‘যেও না’।
ও বলল, ‘যেতে তো হবেই, তুমিও চলো না আমার সাথে। একা যেতে এবার খুব ভয় করছে।’

দুজনে একি ফ্লাইট এর রিটার্ন টিকেট কাটলাম। বাংলাদেশে নেমে, বাবা-মা, ভাই-বোন কে পেয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হলো। নীলিমার বাসায়ই ও আগে বলল, ওর মা ঘোষণা দিলেন, নীলিমা যেদিন এই সম্পর্ক করবে আমার সাথে, সেদিনই তিনি আত্মহত্যা করবেন। আমিও একদিন অনেক সাহস করে বললাম আমার বাসায়, মা খুব রাগারাগি করলেন। আর বাবা কিছু বললেন না। আমার বাবা খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। তিনি পরদিন আমাকে তার রুমে ডেকে ১০ মিনিট কিছু কথা বললেন। তার জীবনের সংগ্রাম এবং আমাকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা। কি বলেছিলেন সেদিন সত্যি মনে নেই, শুধু মনে আছে যে সেই ১০ মিনিট তার হাত ধরে আমি অঝোরে কেঁদেছি। ভাবছিলাম, যাদের এত বেশী ভালোবাসি তাদের কিভাবে আমি এত দু:খ দিব! দুটা পরিবার এর স্বপ্ন আর সুখ আমরা নিজেদের জন্য চিরদিনের জন্য নষ্ট করছি। আবার নীলিমার কথাও মনে হলো, ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাই নিরর্থক। নিজের এমন জীবন কল্পনাও করতে পারছিলাম না যেখানে নীলিমা নেই। নীলিমার সাথে ফোন এ কথা হতো নিয়মিত, ও প্রায়ই কাঁদতো ফোনে, আর আমি কাঁদতাম নীরবে। আমরা দুজন শুধু আশা করতাম কোনো একটা মিরাকল এর।ছুটি শেষ হওয়ার দুদিন আগে ওকে একটা মেসেজ পাঠালাম, ‘পরশুদিন আমাদের ফ্লাইট, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব এয়ারপোর্ট এ’, সেই মেসেজের একটা উত্তর ও নীলিমা আমাকে পাঠেয়িছিলো।

এরপর বহুবছর কেটে গেছে, নীলিমার ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা করে দিয়ে কোনো একটা কোম্পানি আমাকে জবও দিয়েছিল। ক্যারিয়ারের প্রতিটা পদে সাফল্য পেয়ে আমি প্রতিষ্ঠিত। তবু এতদিন পর, কোনো কষ্ট নেই, কোনো অভিমানও নেই, শুধু হঠাৎ বেলকনিতে বসে কোনো এক অলস দুপুরে কেনো যেনো মনে হয়, ‘এই জীবনটা ঠিক এরকম হওয়ার কথা ছিল না।’

২,৭৫৫ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “স্মৃতির শোকেস”

  1. রেশাদ (১৯৯৩ -৯৯)

    নাম বলে এটা স্মৃতিচারণ, লেখকের বয়স আর কলেজে অবস্থানকাল এবং ঘটনার সময় বিন্যাস বলে এটা গল্প, ট্যাগিং এ আছে ব্লগর ব্লগর, 😮 , কনফিউজড হইয়া গেলাম।

    জবাব দিন
    • মামুন (২০০২-২০০৮)

      আসলে গল্প লেখার সময় ট্যাগ করতে মনে ছিল না। এটা একটা গল্পই, আরেকটু বলতে গেলে, জীবনের ভবিষ্যত কল্পনা করে স্মৃতিচারন। 😛

      দোয়াপ্রাথী যে সত্য ঘটনার সমাপ্তিটাও যেনো এইরকম না হয়।

      বি:দ্র: সবার কনফিউশন দূর করতে ট্যাগ বদলে দিছি। (সম্পাদিত)

      জবাব দিন
  2. কানিজ ফাতিমা সুমাইয়া (অতিথি)

    খুব ভাল লাগলো।খুব মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম শেষ অংশটার জন্য।পড়ে মন টা খারাপ হয়ে গেল ! 🙁
    ভবিষ্যতে আরও মজার মজার লেখার অপেক্ষায় রইলাম :clap:

    জবাব দিন
  3. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    :grr:

    সময় থাকতে রমিত ভাইয়ের কাছে টিপস টুপস নাও, ক্যাম্নে ফ্যামিলি ট্যাকেল করতে হয় শিখাই দিব। কিন্তু ভুলেও এহসান কে ফোন্দিও না কইলাম, ওর পরিনতি কিন্তুক বিয়োগান্তক।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মামুন (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।