গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-৫

গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-১
গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-২
গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-৩
গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-৪

রাজিব
ইরফান বলল, বাচ্চারা তোমাদের খুবই দুর্ভাগ্য যে তোমাদের বাবা-মারা তোমাদের নিতে আসতে রাজি নন। এখন তোমাদের বিদেশে বিক্রি করা ছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় আপাতত নেই।
ভুঁড়িওয়ালা হাসে। ভুঁড়ি দোলে। সে বলে, বিদেশে বিক্রির আগে ছেলেগুলোকে ভালো করে একটু রসগোল্লা খাইয়ে দিয়ো। বিদেশে গিয়ে তো আর এই জিনিস পাবে না।
লক্ষ করেছি ভুঁড়িওয়ালা যে কোনো আলোচনাই রসগোল্লার দিকে টেনে নিয়ে আসে। এবং তার প্রধান খাদ্যই সম্ভবত রসগোল্লা। কারণ সকাল-সন্ধ্যা সবসময়ই ওই জিনিস তার হাতে দেখা যায়।
আনন্দের খবরে মানুষ মিষ্টি খায়, এর বাইরে এর কোনো উপযোগিতা আছে বলে আমাদের জানা ছিল না। ক্ন্তিু ভুঁড়িওয়ালার ক্ষেত্রে বিষয়টা একটুও সেরকম নয়। সে যখন-তখন মিষ্টি খেয়ে মিষ্টিমুখ জিনিসটার অর্থই বদলে ফেলছে। আর তার মিষ্টি খাওয়ার দৃশ্যটা এমন অশালীন যে এরপর মিষ্টিমুখের সত্যিই মানে থাকে না। কেউ এই দৃশ্য দেখলে আনন্দের খবরেও মিষ্টি খাওয়ার বদলে সেটা পরিহারই করবে সম্ভবত। মুখে দেয়, দিয়ে হাপুস করে শব্দ করে, এই ফাঁকে কিছু রস গড়িয়ে শরীর ভিজিয়ে দেয়, সে ভ্রুক্ষেপ করে না, কিন্তু পিঁপড়ারা করে। এই ঘরে মাঝে-মধ্যেই যে পিঁপড়ার সমাবেশ তার কারণ তার এই যত্রতত্র মিষ্টি আহার।
সে এখন আরেকটা মিষ্টি মুখে দেয়। আরেকবার রস গড়ায়। আরেকবার পিঁপড়াদের জন্য উপকারি কাজ হয়।
ইরফান বলে, তোমাদের চিঠিটা লিখতে বলেছিল কে ? চিঠি না লিখলে…
এতক্ষণ চিঠি লেখার জন্য আফসোস হচ্ছিল। শফিকের চিঠিজনিত গালাগালি খেতে খেতে খানিক অপমান। এখন মনে হয় একটু সুবিধার কাজও হয়েছে। কারণ ইরফানকে ভাবনায় ফেলা গেছে। তার মানে অচিরেই আমাদের কোনো গতি সে করতে পারছে না। সময় থাকছে হাতে। এই সময়েই কিছু একটা করতে হবে।
সকালে খানিকটা পরিকল্পনা হয়েছে। শফিক বলেছিল, বাবা-মা আমাদের দায়িত্ব নিতে চায়নি, এখন আমাদেরও ওদের বোঝাতে হবে যে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরা কুলাঙ্গার। তখন তার হাতে সুযোগ থাকবে একটাই। আমাদের বাইরে পাচার করা। তাহলে অন্তত এই বাসা থেকে একবার বেরোনো যাবে। সেই ফাঁকেই…
স্যারদের বিস্তর শায়েস্তা করেছি। কিন্তু আমাদের স্যাররা এসব সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে অপেশাদার এবং সেই সূত্রে অসহায়। কিন্তু ইরফান তো পাকা জিনিস। কত ছেলেকে এমন ধরে এনেছে। এমন বিদেশে পাঠিয়েছে। সবরকম প্রতিরোধই নিশ্চয়ই তার আছে।
আমার এই যুক্তিটা শুনে শফিক রেগে গেল। তাহলে এখানে বসে বসে চলো আল্লাকে ডাকি। আল্লাহ নেমে এসে আমাদের কোলে করে বাড়ি পৌছে দেবেন।
শফিক প্রত্যেক কথাতেই প্রথমে রেগে যায়। রাগ দিয়ে প্রথম জানিয়ে দেয়, আমাদের কথাবার্তায় কোনো বুদ্ধির ছাপ নেই। আইডিয়া নেই। সব তার মাথায়। কিন্তু আসলে তার মাথায় কিছুই নেই। আমাদের বুদ্ধি দিয়েই সে কাজ করে। তবে যে কোনো কাজে সাত-পাঁচ না ভেবে নেমে পড়ার একটা ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার জোরেই স্কুলে সে আমাদের নেতা।
শফিক একটু পর বলল, ঠিক বলেছিস। এসব করে যখন ও খায় তখন এত সহজে ওকে দমানো যাবে না। তার মানে ইরফানকে আমাদের বাদ দিতে হবে। আমাদের যা করার করতে হবে ইরফান না থাকা অবস্থায়।
কথাটা মনে ধরে। শত্র“ হিসেবে ইরফান ঠাণ্ডা মাথার এবং ভয়ংকর, কিন্তু ভুঁড়িওয়ালা এবং মিষ্টিমুখী লোকটা তেমন কিছু নয়। আমাদের স্যারদের চেয়েও সহজ প্রতিপক্ষ হওয়ারই কথা।
এমনিতে যাদের ভুঁড়ি বেশি থাকে তাদের মগজ কম থাকে বলে আমরা জানি। তাছাড়া অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া লোকদের খুব চালাক হওয়ার কথা নয়।
কাজেই সে-ই আমাদের টার্গেট। স্যারদের অপ্রস্তুত করার বিদ্যাই আমাদের ভরসা।
কিন্তু কীভাবে করা যায় ! করার কাজটাতে শফিক নেতৃত্ব দেবে যদিও, কিন্তু সূত্রটা ওকে ধরিয়ে দিতে হবে। যে কোনো পরিকল্পনা সফলভাবে রূপায়ণের ক্ষমতা তার আছে, কিন্তু প্রাথমিক পরিকল্পনাটা ওর মাথা থেকে বেরোয় না। সেটার দায়িত্ব সম্ভবত আমারই।
কিন্তু এখন দেখছি জহিরের মাথাও খুব ভালো কাজ করছে।
জহির হঠাৎ বলল, আচ্ছা তোদের মনে আছে আমাদের আব্বাস দারোয়ান একবার স্কুলে এসে উল্টা-পাল্টা কাণ্ড করছিল !
সেটা ভোলার ঘটনা নয়। সেদিন স্কুলে এসে সে উল্টা-পাল্টা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করেছিল। স্কুল শুরু হয় ৯ টায়, সোয়া নয়টাতেই প্রথম পিরিয়ড শেষের বেল, ইংরেজি স্যার ভাবলেন তার ঘড়িতেই বোধহয় সমস্যা, তিনি ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু সব স্যারের ঘড়িতে তো আর সমস্যা হতে পারে না, তাছাড়া আমাদের হেড স্যার সময়ের ব্যাপারে খুব নিখুঁত। তিনি আব্বাসকে ডাকলেন, এই আব্বাস ১৫ মিনিটেই তুই যে ঘণ্টা বাজিয়ে দিলি !
শোনা যায় তখন নাকি আব্বাস হেড স্যারকে ধমকে ওঠে বলে, ঘণ্টা বাজানোর কাজ আমার, এই কাজে হস্তক্ষেপ করা আমি মানব না।
কিন্তু ৪০ মিনিটের ক্লাস তুই ১৫ মিনিটে শেষ করে দিবি ?
শেষ করে দেব। বেশ করব।
হেড স্যার তাকে এরপর উঠে গিয়ে কষে একটা চড় মারেন এবং চড় খেয়ে স্কুলের মাঠে এসে সে যা-তা বলতে শুরু করে। তার এই ঔদ্ধত্যের কারণ বের করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং তারা তিন দিন অনুসন্ধান চালিয়ে যে রিপোর্ট দেয় তার সারাংশ ছিল সেদিন বাংলা মদ খেয়ে আব্বাস মাতাল ছিল। এমনিতে সে রাতে খেত, সেদিন রাতে না পাওয়াতে সে সকাল বেলাই খেয়ে স্কুলে আসে।
মদের ঘোর কেটে গেলে আব্বাস সব স্বীকার করেছিল। তার কাছ থেকেই জানা যায় টাকা না থাকায় সে ভাত পচিয়ে মদ বানিয়ে খেয়েছিল। নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি মদ, ফলে এর কতটা খেলে কী প্রতিক্রিয়া সেই হিসেবে ভুল করাতেই মাতলামিটা স্কুল এবং স্কুলের ঘণ্টা পর্যন্ত।
সব মনে পড়ে যায় এবং মনে পড়ে এটা একটা কাজের কাজ হতে পারে।
এই জায়গাতে ভাত ছাড়া আমাদের আর কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল পচা ভাত সে খেতে যাবে কেন ?
শফিকের মাথা এখন খুলে গেছে। সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, মিষ্টির লোভে।
মিষ্টি !
হু।
কিন্তু আমরা মিষ্টি পাব কোথায় ?
সেটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই ব্যবস্থাটা কী !
শফিক বলল হাতুড়ে পদ্ধতি।
কী রকম ?
শোন দুপুরে আর রাতে আমাদের দেয়া হয় ভাত, সকালবেলা রুটি। ঠিক !
আজ রাতে আমরা আমাদের খাবার থেকে কিছু ভাত সরিয়ে রেখে দেব। এখন গরমের দিন। সকাল হতে হতেই ভাতগুলো পচে যাবে।
কিন্তু মিষ্টি।
কাল ভুঁড়িওয়ালার কাছ থেকে রুটি বানানোর দায়িত্বটা আমি নিয়ে নেব।
তাতে কী হবে ? আমার মাথায় কিছুটা ঢুকতে শুরু করলেও জহিরের মাথায় ঠিক ঢোকেনি এখনো।
আমাদের মেলায় এক টাকায় তিনটা মিষ্টি বিক্রি হয় খেয়াল করেছিস ?
হু।
টাকায় তিনটা মিষ্টি বিক্রি হয় কারণ ওগুলো আটার তৈরি মিষ্টি। খেয়েছিস কখনো ?
না।
আমি খেয়েছি। খেতে গিয়ে দেখি ভেতরটা হচ্ছে আমাদের রুটির জন্য যে কাই তৈরি হয় সেটাই শুধু। মানে রুটি যেভাবে বানায় সেভাবে না বানিয়ে গোল একটা জিনিস তৈরি করে তার সঙ্গে একটা চিনির ঝোল মিশিয়ে দেয়। কাজেই…
তুই বানিয়েছিস কখনো ?
একবার। আমি বানাইনি। আমি টাকায় তিন মিষ্টির খুব প্রশংসা করাতে সে আমাকে একদিন সকালে রুটি বানানোর সময় বানিয়ে দেখিয়েছিল কীভাবে আটা দিয়ে মিষ্টি তৈরি হয়।
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম হয়ে যাবে। কারণ আমাদের এই রান্নাঘরে চিনি এবং গুড় আছে
ইরফান চা খায়। সে এলেই ভুঁড়িওয়ালা গজগজ করতে গিয়ে তার জন্য চা বানায় আর বলে, চা খেয়ে যে মানুষ কী মজা পায় ! আজ বিকালে চা বানানোর পরও অল্প একটু চিনি বাকি আছে। রাতে ইরফান একবার আসে, সে-ই চায়ে চিনি শেষ হয়ে যেতে পারে। কাজেই এখনই কিছু চিনি লুকিয়ে ফেলতে হবে।
চিনিতেই আমাদের সমাধান জানার পর জহির দৌড়ে গিয়ে চিনির বোতলটা খাটের তলায় লুকিয়ে ফেলল।
শফিক ধমক দিয়ে বলল, এভাবে না। একটা কাগজে চিনি ভরে পকেটে রাখ। পুরো বোতলটা হাপিশ হয়ে গেলে তো রাতেই ধরা পড়ে যাব।
সকালে আমাদের দায়িত্ব হল ভুঁড়িওয়ালা রুটি বানাতে আসলে মিষ্টির গল্প জুড়ে দিয়ে তার কাছ থেকে রান্নার দায়িত্বটা কেড়ে নেয়া। আমার কাজ হল তাকে গল্পে মাতিয়ে রাখা। জহিরের দায়িত্ব হল ভাত পচানো, সে বেচারা এমন আন্তরিকভাবে কাজটা করেছে যে রাতে বোধহয় তার ঘুমই হয়নি, সকালে উঠে সে মুখ ভার করে বলল, হল না মনে হয়।
শফিক গিয়ে দেখল, ভাতটা যথেষ্ট পচেনি। কিন্তু কাজের সূত্র পেয়ে গেলে শফিকের কাছে কোনোকিছুই আর খুব বড়ো সমস্যা নয়। বলল, ঠিকই আছে। বেশি পচলে গন্ধ বেরিয়ে যেত, তাতে ধরা পড়ার ভয়। এই ভাতটার সঙ্গে পানি মেশালে যে পানিটা হবে তাই নাকি যথেষ্ট হবে।
ভুঁড়িওয়ালাকে আমি বললাম, আপনাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।
ভুঁড়িওয়ালা হাসে। আমার কাউকে পছন্দ হয় না। আমার পছন্দ শুধু মিষ্টি।
আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে বলে আজ আমরা আপনাকে মিষ্টি খাওয়াব।
মিষ্টি খাওয়াবে !
হু। আপনি এখানে বসে থাকুন। আমাদের এই যে শফিক তার বাবা আমাদের অঞ্চলের একজন বিখ্যাত ময়রা। তার কাছ থেকে শফিকও মিষ্টি বানানো শিখেছে।
কিন্তু কীভাবে ? আমি দেখি !
দেখলে আপনার খেতে ভালো লাগবে না ! মিষ্টি বানানোর কায়দাটা খুব ভালো না।
ভুঁড়িওয়ালা হাসে। তা যা-ই হোক আমার মিষ্টি পেলেই হয়।
বানাবে কী দিয়ে !
এই যে আপনি আটা এনেছেন এতেই হবে। রুটিও হবে। মিষ্টিও হবে।
হবে !
হু।
সত্যি বলছ। সত্যি যদি হয় তাহলে তো হয়ে গেল। টাকার জন্য সবসময় খেতে পারি না। ইরফানটা আমাকে খুব ঠকায়।
আমরা আপনাকে মিষ্টির একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়ে যাব।
আশু মিষ্টি খাওয়ার সম্ভাবনায় তার ভুঁড়ি দোলে। সে চোখ বন্ধ করে বলে, আহ !
তার চোখ বন্ধ হয়ে গেলে আমি রান্নাঘরে আসি। সেখানে যজ্ঞ চলছে ব্যাপক। একটা বাক্সে পচা ভাতের সঙ্গে মেশানো ্পানি এবং সেই পানির গন্ধ এমন যে আমার বমি আসার যোগাড়।
শফিক-জহিরের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এই মিষ্টি বানানোর সাফল্যের ওপরই নির্ভর করছে মুক্তি, এখন বমির চিন্তা করার সময় আছে নাকি !
শফিক ইতিমধ্যে মিষ্টির মতো একটা জিনিস বানিয়ে ফেলেছে। এখন তার সঙ্গে পানি মেশানোর অপেক্ষা।
শফিক বলল, কাজটা দুভাবে করতে হবে। মিষ্টির সঙ্গে এর কিছু অংশ, বাকিটা রেখে দিয়ে শুধু পানি হিসেবে সরবরাহ করা হবে। মিষ্টির সঙ্গে এই পানি এবং চিনি মেশানোর পর যা তৈরি হবে তাতেই কাজ হয়ে যাওয়ার কথা। তবু যদি কাজ না হয় তাহলে তখন পানি হিসেবে ঐ জিনিসটা খাওয়ানো হবে। এরপর লোকটির মাথা না ঘুরে যায় না।
জহির বলল, লোকটি ওটা খেয়ে মাতলামি শুরুর পরই কি আমরা পালিয়ে যাব ! ইরফান যদি আমাদের খুঁজে বের করে ফেলে।
শফিক বলল, রাজিব তুই ছোট্ট আরেকটা কাজ কর।
কী কাজ ?
তালাটা এনে হাতের কাছে রাখ। ও পাগলামি শুরু করলেই আমরা বেরিয়ে যাব। যাওয়ার সময় তালাটা মেরে যাব। ইরফান এলেও সে ভাববে ভুঁড়িওয়ালা আমাদের তালা মেরে বাইরে গেছে। বাড়তি কিছু সময় পাওয়া যাবে।
না ! আজ শফিকের মাথা কাজ করছে। মগজ খুলে গেছে। কিন্তু এখনই তালা নিয়ে আসা যাবে না। কারণ তাহলে সন্দেহ করবে।
বললাম, এখন আনতে গেলে তো সমস্যা হবে।
জহির বলল, ইরফানের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কী হয় ! মনে কর, এ মাতাল হয়ে গেল তখন্ ইরফান এসেই ব্যস্ত হয়ে যাবে ওর দিকে। এই ফাঁকে…
কিন্তু ইরফান !
হঠাৎ মনে পড়ল, ট্রেনে ইরফান বলেছিল চশমা ছাড়া সে কিছু দেখে না।
হাততালি দিয়ে বললাম, বেশি কিছু না। শুধু ইরফানের চশমাটা কেড়ে নিতে হবে। তাহলেই তো হয় !
শফিক বলল, ঠিক। ঠিক।
পরিকল্পনার সাফল্যে জহির লাফ দিয়ে উঠেছিল প্রায়। কিন্তু শফিক এখন নেতা। তার অনেক দায়িত্ব। সে তার মুখ চেপে ধরল।
আমরা তবু আনন্দে হাসলাম। এখানে আসার পর তিনজনের একসঙ্গে হাসার ঘটনা এই প্রথম।

জহির

রাজিবকে মাস্তান বলা হত অকারণে। আমি সবসময়ই সেটা বিশ্বাস করে এসেছি। অন্য সবাই যে দুষ্টুমিটা করে রাজিব সেটা করলেই তার সঙ্গে বাবা না থাকাটা এক সুতায় গেঁথে সবাই গল্প বানিয়ে বসত। ফলে রাজিব হল মাস্তান রাজিব।
সবাইকে জব্দ করার দিকে তার অদ্ভুত একটা মনোযোগ ছিল, কখনো কখনো আমার কাছে মনে হত কী দরকার এসবের, কিন্তু আজ মনে হল এরও একটা মানে আছে। ওর উদ্যোগে শামিল হয়ে হয়ে আমাদের মস্তিষ্কও সচল হয়ে গিয়েছিল। সেজন্যই না আজ কাজের সময় আমার গাধা মাথাটাও কেমন কাজ করল। আর শফিক তো গোলমালে কিছু বাস্তবায়নে বরাবরই সিদ্ধহস্ত।
আমাদের পাহারাদারটা ছিল ভুঁড়িওয়ালা, মিষ্টিখেকো এবং বোধবুদ্ধিহীন। এখন মানুষটি পুরোপুরি আমাদের কব্জায়। এখন সে হেরে গলায় গান গাইছে। গাইতে গাইতে এমন সব তথ্য দিচ্ছে যা শুনে আমাদের পিলে চমকে যাচ্ছে।
ভুঁড়িওয়ালাকে ভূপতিত করার যে বুদ্ধিটা এঁটেছিলাম সেটা কাজে লাগবে এমন বিশ্বাস এমনকি আমারও পুরোপুরি ছিল না। তবু সাগরে যখন তখন খড়-কুটোও ধরে চেষ্টা করতে হয়। আর সেই খড়-কুটো প্রায় বটগাছ। মনে হচ্ছে সেই ছায়ার নিচে হেঁটে হেঁটে আমরা বাড়ি পৌঁছে যেতে পারব।
ভুঁড়িওয়ালাকে প্রথমে মিষ্টি খেতে দেয়া হয়। জটিল মিষ্টি। পচা ভাতের পানি মেশানো ঝোল সঙ্গে। পুরো প্লেট ভরতি মিষ্টি দেখে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খেতেও পারে ব্যাটা। গোটা দশেক ছিল। নিমিষে শেষ করে বলল, আরো।
শফিক আরো আনতে গিয়ে এসে দেখে সে কেমন যেন টলমল চোখে তাকাচ্ছে। শফিক বীরপুরুষের মতো তাকে মিষ্টিগুলো খাওয়াল। তারপর খাওয়ার পর পানি খাওয়ার নিয়মের কথা জানিয়ে পুরো এক গ্লাস বিশেষ তরলও সেবন করিয়ে দিল।
লোকটির মিষ্টিতেই কাজ হচ্ছিল, তার সঙ্গে তরল মিলে এমন অবস্থা যে একবার তো মনে হল মরে-টরে যায় নাকি !
মরেনি। চোখ বন্ধ করেছিল মাত্র।
চোখ খোলার পর দেখলাম কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। মদ খেয়ে সিনেমার ভিলেনরা যে গলায় কথা বলে, সেরকম গলা।
শফিক আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। মিশন আংশিক সফল।
আমি উচ্ছ্বাসবশত লাফ দিতে যাচ্ছিলাম, শফিক হাতটা চেপে ধরে বলল, হাফ দ্য ব্যাটল ইজ ওন অনলি। এক মুহূর্তের জন্য ইংরেজি স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। শফিকের মুখে এই প্রাসঙ্গিক ইংরেজি বাক্যটি শুনলে স্যার একদিন ক্লাস ছুটি দিয়ে দিতেন নির্ঘাত।
ভুঁড়িওয়ালার অবশ্য ওসব দেখার সময় নেই। চোখ খুলে সে বলল, তোমরা কারা ?
রাজিব বলল, আমাদের চিনতে পারছ না। আমরা সেই যে…
ও তোমরা সেই….
হ্যাঁ। আমরা সেই…
ও। তোমরা আসলেই সে…ই। না হলে এই আমার কাছে এলে কী করে !
শফিক জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা এই ইরফান লোকটা কেমন ? তোমার বন্ধু যখন তখন ভালো লোকই হওয়ার কথা !
সত্যি বলব ? না বললে তোমরা আবার কাউকে বলে দেবে।
রাজিব বলে, আরে আমরা বলব কেন ? আমরা না তোমার সে……..ই।
কাউকে বলবে না তো সত্যি ! তাহলে বলি শোনো। সে একটা বজ্জাতের হাড়ি। শয়তানের ঢেঁকি। হারামির ডিম।
হারামির ডিম !
হ্যাঁ। আমাকে ঠকায় শুধু। জানো একটা ছেলে বিদেশে পাঠালে পায় এক লাখ টাকা, আমাকে কিনা দেয় মাত্র এক হাজার টাকা।
আচ্ছা ওর সঙ্গে আর কে আছে ?
আরো বহু লোক আছে। তারপর সে গলা নামিয়ে বলে, পুলিশও আছে। মাস্তানও আছে। নেতারাও আছেন।
তাই !
এরা থাকেন কোথায় ?
বাসায়।
কার বাসায় ? শফিক উত্তেজনায় একটু বোকার মতো প্রশ্নটা করে ফেলে।
নিজেদের বাসায়।
এখানে আসেন না।
রাতে আসেন।
কই আমরা তো দেখলাম না।
আসেন রাত গভীর হলে। যখন সবাই ঘুমিয়ে যায়। এবার আমি ঘুমাব।
বলে সে সোফার মধ্যে শুয়ে পড়ে।
সে শোয়ার প্রস্তুতি নিলে রাজিব বলে, একে ভেতরের রুমে নিয়ে শুইয়ে রাখি। তারপর ইরফান এলে জহির বেরিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলবে, চাচা কেমন যেন করছে।
শফিক বলে, কিন্তু ভুঁড়িওয়ালাকে ভেতরে নেয়া তো সহজ হবে না। ভুঁড়ির সাইজ দেখেছিস ?
কিন্তু ভেতরে নিতেই হবে। ইরফান ও ভেতরে আছে শুনলে দৌড়ে ভেতরে যেতে চাইবে। আর তার আগে আমরা এখানে তেল ছিটিয়ে রাখব। সে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে যাবে। ব্যস চশমাটা নাই।
কিন্তু চশমাটা যদি তবু না খুলে পড়ে। যারা এমন চশমানির্ভর তাদের চশমা শরীরের অংশ হয়ে যায়।
তুই থাকবি ভেতরে। ভুঁড়িওয়ালার পাশে মন খারাপ করে বসে। ইরফান ওর দিকে মনোযোগ দিতে গেলেই চশমাটা খুলে নিবি।
ভুঁড়িওয়ালা ততক্ষণে জেগে উঠেছে।
শফিক ধমক দিয়ে বলল, আপনার না ঘুমানোর কথা। ঘুমান।
না। আমি এখন কাঁদবো।
এবং সত্যিই সে কান্না শুরু করে দিল। এমন কান্না যে একেই বোধহয় মরা কান্না বলে। কিন্তু মরা কান্না থামাতে হয়। নইলে আমাদেরই মৃত্যু।
শফিক বলল, এভাবে হবে না।
রাজিব হঠাৎ দৌড়ে রান্নাঘর থেকে একটা আধভাঙা লাঠি নিয়ে এল। নিয়ে প্রচণ্ড জোরে কয়েকটা আঘাত। আঘাতে মানুষ কাঁদে, কিন্তু মদ খেলে বোধহয় উল্টা হয়। সে নেতিয়ে গেল।
তিনজনে মিলে মনে হল একটা ৪০ মণ ওজনের বস্তা নিয়ে বিছানায় রাখলাম।
সেই বিছানা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল না ইরফান। তেলেই কাজ হল। ও-মাগো বলে চিত হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চশমাটা এত দূর চলে গেল যে সেটা বের করতে রাজিবকে টেবিলের নিচে ঢুকতে হল। বের করেনি। ওটা ওখানেই ভেঙে রেখে এসেছে।
শফিক জিজ্ঞেস করলো, আমি কে ?
ইরফান বলল, জহির আমার চশমাটা দে। খুন করে ফেলব। এক ফোঁটা রক্তও কেউ দেখতে পাবে না।
রাজিব উঠে এসে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, বলো তো এটা আমার কোন আঙুল।
ইরফান হামাগুড়ি দিয়ে বলে, আমার চশমা।
শফিক বলে, ঐ যে টেবিলের নিচে।
ইরফান ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। টেবিলটা কোথায় ?
শফিক তাকে বাথরুমের পথ দেখিয়ে দেয়। আর ইরফান সত্যি সত্যি হাতড়ে সদিকে আগায়।
হঠাৎ আমার মনে হল একটা কিছু ভূমিকা না রাখলে কেমন দেখায় !
আমি দৌড়ে গিয়ে কষে একটা ফ্লাইং কিক মারলাম।
এমনিতে হাতড়ে এগোচ্ছে, তাছাড়া লাথিটা এই সময় প্রত্যাশিতও নয়, ইরফান হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। রাজিব করল বাকি কাজটা। তার পিঠে কয়েকটা লাঠি বসিয়ে দিল ঠাণ্ডা মাথায়।
শফিক বলল, চল। তালাটা আছে তো !
তালাটা রাজিবের হাতেই ছিল।
বেরোতে গিয়ে হঠাৎ রাজিব বলল, দাঁড়া।
দেখলাম রাজিব কী একটা যেন কুড়িয়ে ওঠাচ্ছে।
মোবাইল। ইরফান যখন ছিটকে পড়েছিল তখন চশমার সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে মোবাইলটাও ছিটকে পড়েছিল। কাছেই পড়েছিল, কিন্তু চোখে না দেখলে কাছে আর দূরের তফাত কী !
রাজিব জিজ্ঞেস করে, নেব !
শফিক বলে, অবশ্যই।
শফিক নিয়ে একটু টেপাটেপি করে বলে, শালা বন্ধ দেখি। যাক নিয়ে চল। চার্জ নেই মনে হয়।
তালা মেরে বাইরে বেরিয়ে এসে সোজা একটা রিকশায়।
আমরা যাব রেল স্টেশন। কারণ ভেবে দেখেছি কাউকে থানা কোথায় জিজ্ঞেস করলে সমস্যা হতে পারে। কোনো রিকশাওয়ালাকে ১৩-১৪ বছরের তিনটা ছেলে থানায় নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলে সে তাদের আরেক দল পাচারকারীর কাছে নিয়ে যেতে পারে।
তার চেয়ে রেল স্টেশন অনেক ভালো। অনেক লোক। আমাদের বয়সীরাও থাকে। কেউ সন্দেহ করবে না। আর স্টেশনের পাশে সব জায়গায় একটা থানা থাকে। একটু হাঁটাহাঁটি করলেই খুঁজে বের করা যাবে।
আমার দায়িত্ব ছিল বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বাসার ঠিকানাটা মুখস্থ করে রাখা।
রাজিব-শফিক রিকশা খুঁজবে আর আমি ঠিকানাটা মুখস্থ রাখব।
গাধা হলেও এই কাজটা খুব ভালো মতোই করলাম।
যেতে যেতে গাধার মতো একটা প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা থানা যদি আমাদের কথা বিশ্বাস না করে ! তাছাড়া ওখানে নাকি টাকা দিতে হয়। আমাদের তো টাকা নেই।
শফিক বলল, আরে না। ঢাকার থানায় নিশ্চয়ই টাকা লাগবে না। ঢাকার পুলিশ কি আর আমাদের গাও-গেরামের পুলিশ নাকি !
কিন্তু আমরা বাড়ি যাব না !
শফিক অবাক হয়, আরে বাড়ি কী-রে ! আমাদের আসল কাজ-ই তো হয়নি। অধিকার আদায়।
কিন্তু সেটা কীভাবে হবে এখন ? রাজিব জানতে চায়।
শফিক বলে,তুই একটু ভাব। আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসি আসি করছে। তুই শুরু করে দিলে বাকিটা হয়ে যাবে !
রাজিব একটু ভেবে বলে, এরকম হতে পারে আমরা থানায় ওদের ধরিয়ে দেয়ার পর সাংবাদিকরা আসবে। পত্রিকায় আমাদের ছবি ছাপা হবে। তখন…
শফিক বলে, ইয়েস ! তারপর আমাদের নিয়ে পত্রিকার সাংবাদিকরা লিখবে। তখন ওদের কাছে আমরা বলব আমাদের দাবির কথা। পত্রিকা-টেলিভিশনে শুনে আমাদের বাবা আর মা আসবেন আমাদের নিতে। তখন রাজি না হলে আমরা যাব না।
আমার ঠিক ভরসা হয় না। তাছাড়া এখন বাড়ি যেতেও ইচ্ছে হচ্ছে। বাবার চেহারাটা মনে পড়ছে।
বাবা যা-ই করুন রাতে ঘুমানোর আগে একবার দেখে যান আমি ঘুমিয়েছি কিনা। গরমকাল হলে ফ্যান ঠিক মতো ঘুরছে কিনা ! শীতকাল হলে কাঁথা গায়ে আছে কিনা !

কিন্তু ওরা যখন বলছে এখনো দাবি পূরণের সুযোগ আছে তখন শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। আমি তো নিজে নিজে কিছু করতে পারি না। অন্যরা কিছু করলে তাতে মেলাতে পারি মাত্র।

১,৫১১ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-৫”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    মামুন ভাই, আপনার লেখা নিয়ে নতুন করে কি আর বলবো। যথারীতি দুর্দান্ত আরেকটা লেখা পড়ছি। আর বস্ একেকটা পর্ব পড়তে বেশিক্ষণতো লাগছেনা, তাই পরের পর্বের জন্য আমাদেরকে ঝুলায়ে রাইখেননা এইভাবে। একবার ভাবলাম পুরোটা পড়ে একেবারে কমেন্ট করবো। কিন্তু ৪ নম্বর পর্বের মোচড়ের পর এইটা পড়ে আর বসে থাকতে পারলামনা কিছু না লিখে :boss: :boss: :boss:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. গল্পটা জমে উঠেছে। গত দুই পর্বের পর এই পর্বে এসে একেবারে প্রথম দিকের মজাটা ফিরে এসেছে।

    জহির, রাজিবের পাশাপাশি শফিকও খুব গুরুত্বপর্ন চরিত্র হয়ে উঠেছে। তবে তাকে আমার মাঝে মাঝে ক্লাস সেভেনের চেয়ে একটু বেশি ম্যাচিউর্ড মনে হচ্ছে। এরকম থাকে অবশ্যই। আর গল্পের সাথে মানিয়েও যাচ্ছে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : samiur (1997-2003)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।