ম্যাজিক বয় – শেষপর্ব

ম্যাজিক বয় – ০১০২০৩০৪০৫০৬০৭০৮০৯
আজ রতনকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মেনে নেবে সবাই এবং আজ রতন মারাও যাবে।
এক বছর আগে এক রাতে রতন একটা স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নে এক অশরীরী এবং অদৃশ্য শক্তির কেউ একজন রতনের কাছে জানতে চেয়েছিল রতন তার কাছে যে কোনো একটা কিছু চাইতে পারে। তার সেই চাওয়াটা সে পুরণ করে দেবে। একেবারে যা চাবে তাই। রতন দুষ্টুমি ভেবে বলল, সে বিশ্বের সেরা ফুটবলার হতে চায়। সেই অদৃশ্য শক্তি তাকে বলল, এটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু শর্ত আছে একটা। সে বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে, কিন্তু হওয়ার পরই সে মারা যাবে। এই শর্তে রতন রাজি কিনা! রতন একটু ভাবল। ভেবে সে রাজি হল। তাকে স্কুলের ইতিহাস স্যার প্রায়ই মারধর করেন, কাকা বলেন ভাত বন্ধ করে দাও, তার কোনো বন্ধু নেই, কেউ তাকে গুরুত্ব দেয় না, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হলে নিশ্চয়ই সবাই তাকে গুরুত্ব দেবে। ইতিহাস স্যার মারতে পারবেন না। বিশ্বের সেরা ফুটবলারকে তো বেত দিয়ে পেটানো যায় না। তার ভাতও বন্ধ করে দেয়া যায় না। ঘুম ভেঙ্গে রতনের হাসি পেয়েছিল। কী অদ্ভুত স্বপ্ন। তবু কী ভেবে সে তার পুরনো বলটা হাতে নিল এবং নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খেয়াল করল তার পায়ে এক অদ্ভুত শক্তি এসে যাচ্ছে। বল পায়ে এলেই সে আর রতন থাকছে না। সে যেমনটা চাইছে অন্য কেউ একজন সেই খেলাটা খেলে দিচ্ছে। সে সেই শক্তিকে চেনে না, দেখতে পায় না, তার সঙ্গে ফুটবলগত যোগাযোগ ছাড়া আর সম্পর্কই নেই কোনো।

এটাও শর্ত ছিল যে রতন স্বপ্নের কথাটা কাউকে বলতে পারবে না। বললে, ভয়ংকর ক্ষতি হবে। সে মারা যাবে বলার সঙ্গে সঙ্গেই। কাজেই রতন কাউকে বলেনি। অনেকে রহস্যভেদের চেষ্টা করেছে, রফিক কাকা তো রহস্যভেদের নেশায় তার ঘুমের রাজ্য ছেড়ে পেশাদার ফুটবল এজেন্ট হয়ে গেলেন।

কিন্তু আর পারেনি রতন। সে এই বিদেশ-বিভুইয়ে মারা পড়বে এবং তার মা জানবেন না এটা তো হয় না। রতন মাকে বলে দিয়েছে। মুখে বলতে পারেনি। দেশ ছাড়ার আগেই একটা চিঠি লিখে এসেছিল। আর আজ ফোনে মাকে বলেছে তার টেবিলের ড্রয়ারে রাখা সেই চিঠিটা বের করে পড়তে। মাত্র দুই মিনিট লেগেছে পড়তে, কিন্তু এটা তার জীবনের দীর্ঘতম দুই মিনিট। সে লাইন না কেটে ফোনেই ছিল। মার গলার স্বরটা কতোটা বদলাবে! সন্তানের নিশ্চিত মৃত্যুর আগে একজন মা কতোটা কষ্ট পান! আর তিনি রতনের মা, যিনি মনে করেন তার ছেলের কোনো দোষ নেই, থাকতে পারে না। দুনিয়ার যা কিছু তার সবকিছুই তার ছেলের ভেতর আছে। অন্যদের দেখার চোখ নেই, তাই দেখতে পায় না।

ফোনে মায়ের পরের কথাটা হলো, সব ছেড়েছুড়ে তুই চলে আয়। দেখব আমার ছেলেকে কে ছিনিয়ে নেয়। কার এত বড় সাহস! মার গর্জনটা এত জোরে যে রতনের মনে হয় সত্যিই মা তাকে রক্ষা করে ফেলবেন। সত্যিই।
রতন কিছু বলে না। তার ঠিক কান্নাও পায় না। যে শক্তিধর লোক ইতিহাস স্যারের মার খাওয়া ছেলেটিকে এক নিমিষে বিশ্বের সেরা ফুটবলার বানিয়ে দেয় তার শক্তির সামনে দাঁড়ানোর সামর্থ্য কি মায়ের এই ছোট্ট হাত দুটোর আছে।
মা বললেন, তুই আজকে খারাপ খেল। হেরে যা।
কেন মা?
তাহলে তো তুই দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় হতে পারছিস না!
তাই তো! ওর তো এটা মাথায় আসেনি। এই না-হলে তার মা!
আজ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। মৌসুমের শেষ ম্যাচ। এই ম্যাচ না জিতলে তার শ্রেষ্ঠত্ব তো প্রমাণিত হয় না।
আচ্ছা আজ না জিতলে তো তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে। তাহলে তো এখানেই শেষ হচ্ছে না। তাহলে কি সে ইচ্ছা করে আজ খারাপ খেলে দলকে হারিয়ে দেবে!
মা বলেই যান, আজ তুই খারাপ খেলে হেরে যা। তাহলে তো হয়েই যাবে। তারপর সোজা পরের ফ্লাইটে দেশে। বাকিটা আমি দেখবো।
রতন আজ খারাপ খেলবে। আর সে খারাপ খেললে বার্সেলোনা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে এবং মেসি হবে সেরা খেলোয়াড়। রতন যেমন ইংলিশ লিগের সেরা খেলোয়াড়, মেসি তেমনি স্প্যানিশ লিগের সেরা খেলোয়াড়। সে-ও তার দলকে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছে। এখন এখানে যদি বার্সেলোনা জিতে যায় তাহলে তো মেসিই মৌসুমের সেরা খেলোয়াড়। ঠিক যে মেসি রতনের মতো আধিপত্য দেখাতে পারেনি, রতনের ৩৫ গোলের বিপরীতে তার গোলসংখ্যা ২১। চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও ফাইনালের আগ পর্যন্ত রতনের গোল যেখানে ১১, সেখানে তার ৬টি। গোলসংখ্যাই সব নয়, মেসির চেয়ে স্প্যানিশ লিগে বেশি গোল আছে নিস্টলরয়ের, কিন্তু তার অবিশ্বাস্য ড্রিবলিং, চিতা বাঘের গতি, ডিফেন্সচেরা যাদুকরী সব পাস মিলিয়ে সেই রতনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

রতনের তাকে দেখার একটা ইচ্ছা ছিল। এজন্য যে সে যে খেলাটা খেলছে অদৃশ্য শক্তির জোরে, এই ছেলেটি সেই খেলাটা খেলে স্রেফ মানবীয় ক্ষমতা দিয়ে। মেসি নিশ্চয়ই কোনো স্বপ্ন দেখেনি, তার হয়ে নিশ্চয়ই অন্য কেউ খেলে দেয় না।
ম্যাচের শুরুতে অবশ্য মনে হল মেসির হয়েও অন্য কেউ খেলে। বলটা ধরে যে ভঙ্গিতে ভীড়ের মধ্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলো তা কি কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব! ম্যাচ শেষে জিজ্ঞেস করতে হবে। সে স্প্যানিশ জানে না, কিন্তু তেভেজকে দোভাষী হিসেবে নিলে হবে।

ঐ বলটা শেষ মুহূর্তে ক্লিয়ার করে দিল ফার্দিনান্দ। কিন্তু কয়টা বল সে ক্লিয়ার করবে! বল পেলেই কেমন করে যেন বেরিয়ে যাচ্ছে। রতন লক্ষ্য করল, ওর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো বলটা যেন ওর পায়ে আটার মতো লেগে থাকে এবং তার সঙ্গে অবিশ্বাস্য গতি। সবসময় মনে হয় বলটা নাগালের বাইরে চলে যাবে, কিংবা ডিফেন্ডার পেয়ে যাবে, কিন্তু পায় না। রোনালদোর ড্রিবলিং সে খুব কাছ থেকে দেখেছে, রোনালদো নানান কৌশল করে কাটায়, পায়ের প্রায় সব অংশ সে কাজে লাগায় কিন্তু মেসি তার নিয়ন্ত্রণ আর গতি দিয়েই সবাইকে দিব্যি ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। একটাই দুর্বলতা বোধহয়। খুব জোরালো শট নেই পায়ে। সে বরং চিপ বা স্কুপ করার চেষ্টা করে। মানে গোলরক্ষককে কায়দা করে বোকা বানানোর চেষ্টা করা। আর সেজন্যই প্রথম ৩০ মিনিট অন্তত তিনবার গোলের সুযোগ পেয়ে কাজের কাজটা করতে পারেনি।

রতন ঐ ৩০ মিনিট দর্শকই। একবার রোনালদো দারুণভাবে দুজনকে কাটিয়ে তাকে পাস দিয়েছিল, সে ইচ্ছা করে বাইরে মেরেছে। আর শুনেছে ম্যানচেস্টার গ্যালারির হৃদয় ছুয়ে আসা একটা সম্মিলিত ‘আহ’ শব্দ। সত্যিই এই বল চোখ বন্ধ করে গোল করার। তার ওপর বার্সেলোনা এবং মেসি যে চাপ সৃষ্টি করেছে তাতে তাদের জিততে হলে এমন ফাকতালে পাওয়া এক-আধটা সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
নিজের ভাগ্য সহায় নয় দেখে মেসি এবার মন দিয়েছে অন্যদের দিয়ে গোল করানোর দিকে। ডানদিক থেকে একবার দুর্দান্ত প্রিসিশনে একটা বল দিয়েছিল অঁরিকে, কিন্তু এত নিখুত মাপের বল যে গোল করবে কী অঁরি নিজেই চমকে গেল! ঊাইরে মারল অবিশ্বাস্যভাবে। কিন্তু ইনিয়েস্তা আর সুযোগটা নষ্ট করল না। জ্যাভির ক্রসটা বুকে নিয়ে মেসির সঙ্গে ওয়াল খেলে বেরিয়ে গেল একেবারে ফাঁকায়, ফন ডার সার এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু সে বলটা তার শরীরের ওপর দিয়ে এমনভাবে ঠেলে দিল যে বেচারা গোলরক্ষকের কিছু করার ছিল না।

এতক্ষণ তবু ম্যানচেস্টার গ্যালারিতে কিছু জনমানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিল। এবার সবাই চুপ। ফার্গুসনকে চুইংগাম ফেলে দিতে দেখল সে। ৪৪ মিনিটের এই গোলটা শোধ দেয়া যাবে না ওরা যেন একেবারে নিশ্চিত। রতনের কোনো ঝলক নেই, কী করবে জিতবে! রোনালদো-তেভেজ-রুনিরা আছে বটে, কিন্তু এই মৌসুমের ম্যানচেস্টার তো ম্যাজিক বয় রতনের দল। সে এমন নি®প্রভ। মেসির সঙ্গে লড়াইয়ে তাদের তারকা হারছে শোচনীয়ভাবে। ম্যান ইউ সমর্থকদের আর শান্ত্বনার জায়গা থাকে কোথায়!

ড্রেসিং রুমে ফেরার সময় একবার ম্যানচেস্টার গ্যালারির দিকে তাকাল সে। দূর থেকে সেভাবে দেখা যায় না, তবু যেন হৃদয়বিদীর্ন চেহারাগুলো দেখল সে!
ফার্গুসনকে সবসময় সে দেখেছে স্থিরচিত্ত। হাফ টাইমে বরং যারা ভালো করেছে তাদের প্রশংসা করেন এবং তারপর জোরালো গলায় শোনান আশাবাদ, এখন দ্বিতীয়ার্ধে আশা করি বাকিরা দেখিয়ে দেবে যে তারা কারো চেয়ে কম নয়। আজ দেখল অন্যরকম। তিনি দোষ ধরতে শুরু করলেন। তুমি ওটা ওভাবে করলে না। লেফট ব্যাক ইভরাকে বকাঝকা করলেন খুব, মেসিকে অরক্ষিত রেখে সে আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করছে কেন?
ইভরা বলল, আর করব না।
হু। দরকার নেই। কোনো দরকার নেই।
তারপর যেন রতনকে শুনিয়ে বললেন, অবশ্য না করবে কী! আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা তো মনে হচ্ছে বাড়ি যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর।
রতনের কান্না চাপল কোনোরকমে। স্যার যদি জানতেন, রতন কেন এমন নিষ্ক্রিয় তাহলে কি…
দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর সময় মেসির সঙ্গে একবার চোখাচোখি হলো তার। মেসি যেন পাত্তাই দিল না। ভাবটা এমন যে তুমি ইংলিশ লিগে ওসব ফালতু খেলোয়াড়দের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পার, কিন্তু আমার সঙ্গে নয়। দেখলে তো!
রতন আঘাতটা সামলাল। এর জবাব তো চাইলেই সে দিতে পারে। দেবে নাকি!
ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে রোনালদো বলল, রতন এই ৪৫ মিনিটই তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪৫ মিনিট। মনে রাখবে তুমি বলটা ভালো করে খেলতে পারো বলেই এই দর্শকদের চেয়ে তুমি এগিয়ে। না পারলে তোমাকেও ওদের মতো পয়সা খরচ করে লাইন ধরে মাঠে ঢুকতে হত। আজ খেলা দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না ওদের সঙ্গে কোনো পার্থক্য আছে তোমার!

রতনের মনে পড়ল ম্যানচেস্টারের হয়ে প্রথম ম্যাচটাতে খারাপ খেলার পর তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। সেই রাতটা সে পেট ব্যথা বলে ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল ব্যর্থতার লজ্জায়। সে এক ভয়ংকর দিন গেছে। জেনে-শুনে এরকম একটা ভয়ংকর দিনের দিকে নিজেকে আবার ঠেলে দিচ্ছে সে।
না। হারা যাবে না। মরতে তো হবেই একদিন। কিন্তু যতক্ষন বাঁচবে ততক্ষণ বাঁচবে রাজার মতো। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী লোককে তো আমরা মনে রাখিনি, মনে রেখেছি তাকে যে বেঁচেছিল রাজার মতো। রতন যতক্ষণ বাঁচবে রাজার মতোই বাঁচবে।

কেন একটা ম্যাচে সে পারেনি সেই প্রশ্ন অনেকদিন তার মাথায় ঘুরেছে, সে উত্তর পায়নি, এখন পেয়ে গেলো। সেই শক্তি তাকে বোঝাতে চেয়েছিল শীর্ষে ওঠার পর ব্যর্থতার বেদনা কত তীব্র। রতন যেন পথচ্যুত না হয় কখনো সেজন্যই একটা শিক্ষা দিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে।

রতন গর্জে উঠল। ওকে কেউ বল দিতে চাচ্ছিল না তেমন, মিডফিল্ডারদের লক্ষ্য আজ রোনালদোর পায়ে বল পৌঁছানো, পজিশন নেয়া সত্বেও এন্ডারসন তাই জটিল পাস দিতে গেলো রোনালদোকে, কিন্তু বলটা বিপক্ষেও একজনের পায়ে লেগে ফিরে এল রতনের কাছে। ব্যস। তারপর দ্ইু মিনিট যা ঘটল পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন সম্ভবত সেটা দেখেনি। চোখের নিমিষে মার্কারকে ছিটকে ফেলে গতি বাড়াল রতন, বিপদ আঁচ করে নেমে এল বার্সেলোনার ডিফেন্স, ইয়ার তোরেকে সম্ভবত নির্দেশ দেয়াই ছিল বিপদ দেখলে পা চালিয়ে নিতে, সে চালালও, কিন্তু রতন সেই বাধা ডিঙ্গিয়ে গেল একটা কার্যকর স্পটজাম্প দিয়ে। পুয়োলের বয়স বেশি, কাজেই গতি বাড়াতেই কাজ হয়ে গেল। রোনালদো চমৎকার পজিশন নিয়েছিল,তাকে পাস দিলেও গোল হয়, কিন্তু মেসিকে দেখাতে হবে না! সে গোলরক্ষক ভালদেসকেও কাটাল ডান পায়ের একটা টোকায় এবং তারপর বল নিয়ে জালে ঢুকে সেই বলটা আবার হাতে করে এনে জায়গামতো বসিয়ে দিল। সময় বেশি নেই, দ্বিতীয় গোলটাও যে পেতে হবে।

এতক্ষণ শ্মশান হয়ে থাকা ম্যানচেস্টার গ্যালারি এখন আবার নাচছে। রতন জেগে গেছে, আর ভয়ের কিছু নেই, ওরা জানে। কিন্তু মেসি তো অত সহজে সেটা মানতে পারে না।

মধ্যমাঠে বল ক্লিয়ারেন্সে একটু ভুল হয়েছিল, সেই সুযোগটা নিয়ে জ্যাভি বলটা ঠেলে দিল রাইট উইংয়ে, রতনের ম্যাজিক দেখে ইভরা প্রতিশ্র“তি সত্বেও ঠিক মার্কিং করেনি, তাকে চোখের নিমিষে কাটিয়ে কোনাকোনি ভেতরে ঢুকে একটা কোনাকুনি শট নিল মেসি। দ্বিতীয় বারে এমন মাপা শট যে গোলরক্ষক ফন ডার সার পুরো শরীর ফেলে, পুরো হাত বাড়িয়েও নাগালটা পেলো না।

পরের মিনিটেই রোনালদো তার ড্রিবলিংয়ের যাদু দেখিয়ে সমতা প্রায় নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তার শট ফিরে এল বারে লেগে। ফিরতি বলটা রুনি পেয়েও দেরি করাতে হাতছাড়া হয়ে গেলো সুযোগ। আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি। একটা নয়, দু-দুটো গোল লাগবে। রতন আবার চেষ্টা করল, কিন্তু এবার তোরের ফাউলটা কাজে লাগল। ডি বক্সের বাইরে ফ্রি কিক। রোনালদো এসেছিল ফ্রি কিক নিতে, কিন্তু তার আগেই রতন বলটা বসিয়ে ফেলেছে দেখে সে গিয়ে দাঁড়াল গোলমুখে। এবং দাঁড়ানো থেকে সময়মতো একটা লাফও দিল। এমন বাকানো ফ্রি কিক নিয়েছিল রতন যে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে গিয়ে পড়ল রোনালদোর মাথায়। এবার আর তার ভুল হয়নি।
ফাইনাল যেহেতু কাজেই খেলায় সমতা থাকলে ম্যাচ গড়াবে অতিরিক্ত সময়ে। তারপর টাইব্রেকার। না। অতদূর যেতে দেয়া যায় না। কিন্তু বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা যেন জীবন দিয়ে দিচ্ছে। চার ডিফেন্ডারের সঙ্গে তোরে এবং জ্যাভি মিলে ওদের ডিফেন্স একেবারে লখিন্দরের লৌহবাসর। রতন দুবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। একবার পুয়োল চমৎকারভাবে বল কেড়ে নিল। আরেকবার মিলিতোর কড়া ট্যাকলে সে ছিটকে পড়ল। আর মাত্র ২ মিনিট বাকি!

সেই স্বপ্নের পর অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে তার আর কোনো যোগাযোগ নেই, ওর কোনো সাহায্যও চায়নি রতন, কিন্তু আজ চাইল। বলল, আজই আমি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হতে চাই, তারপর আমি হাসিমুখে মৃত্যু মেনে নেবো। তুমি সাহায্য করো। সাহায্য করো।
না। সাহায্য আসে না। শর্ত ভাঙ্গায় সে বোধহয় রাগ করেছে। রতন একটা ডিফেন্সভাঙ্গা পাস দেয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেটা ভীড়ে আটকে গেল। আর হলো না বোধহয়।
চতুর্থ রেফারি দেখাচ্ছে এক মিনিট সময় যোগ হবে মাত্র। এই ১ মিনিটেই যা করার করতে হবে। করতে হবে।

রেফারি ঘড়ি দেখছেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে রতন বল নিয়ে একটা দৌড় দেয়ার চেষ্টা করে। এবং লক্ষ্য করে সে একা নয়, তার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে অন্য কেউও। হ্যাঁ হচ্ছে। বার্সেলোনার তখন প্রায় সবাই ডিফেন্সে, এমনকি মেসিও। তাকে বাঁ পায়ের ডগা দিয়ে এমন চমকাল যে টাল সামলাতে সে ছিটকে পড়ে গেলো এবং মাটিতে শুয়েই দেখল রতন বল নিয়ে বীরদর্পে গোলে ঢুকল। ও, হ্যা পেছন থেকে গোলরক্ষক ভালদেস ফাউল করার চেষ্টা করেছিল। পুয়োল শার্ট টেনেছিল। তোরে পা চালিয়েছিল। তবু বল জালে। ম্যানচেস্টার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চ্যাম্পিয়ন। এবং রতন বিশ্বের সেরা ফুটবলার।

এই একবছর তাকে নিয়ে এমন উচ্ছাস হয়েছে অনেক। কিন্তু সেই উচ্ছাসের মধ্যেও সে হারিয়ে গেছে, তার চোখের কোনায় চিকচিক করেছে জল কিংবা গোপন কান্নায় শ্বাস ভারী হয়েছে, কিন্তু আজ সেরকম কিছু হচ্ছে না। তার মন বলছে, যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন রাজার মতো বেঁচে থাকাতেই জীবনের সার্থকতা। মনে পড়ল শুধু, এরকম একটা কথা ইতিহাস স্যার প্রায়ই বলতেন। খুব মারেন বলে স্যারকে তার বিশেষ পছন্দ হতো না, কিন্তু আজ স্যারের চেহারা ভেসে উঠল খুব মায়াবী রূপ নিয়ে। ক্ষমা করে দিল। মৃত্যুর আগে সবাইকে ক্ষমা করে দেবে। আর বাকিটা সময় যথাসাধ্য উপভোগ করবে।
মা নিশ্চয়ই খুব কাঁদবেন। মায়ের কথা সে রাখেনি। কিন্তু একটু কি গর্বও হবে না। তার ছেলে হারেনি। কারো কাছে হারেনি।
ড্রেসিং রুমেই উৎসব চলল দীর্ঘক্ষণ। বাইরে সমর্থকরা তবু অপেক্ষায়। তারা রতনকে যেতে দেখবে, তাকে শুনিয়ে হাততালি দেবে, তবেই না তাদের উৎসব রঙ্গীন হবে। এরা আনন্দের কিছুতে মাতাল হয়ে যেতে অপেক্ষায় রাজি হয় না। আজ হলো।
ড্রেসিং রুমেই শেষদিকেই মাথায় একটা ব্যথা সে টের পাচ্ছিল। পাত্তা দিল না। শুধু রফিক কাকাকে দেখে তার একটু কষ্ট হলো। বেচারা একা দেশে ফিরতে পারবে তো! এখন যেমন তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় কোন্,ো কিন্তু শোকের চোটে যদি আগের চেহারায় ফিরে যায় তাহলে ঝামেলা হবে। দেখা গেলো বাংলাদেশের জায়গায় বৎসোয়ানো চলে গেলো।
কী ভেবে সে রোনালদোকে বলে ফেলল, আমার কাকাকে একটু দেখে রেখো!
রোনালদো অবাক হয়ে বলল, দেখে রাখব মানে!
মানেটা কী সেটা তো আর বলা যায় না।
আচ্ছা কাকার রহস্যভেদের চেষ্টাটা কোন পর্যায়ে আছে। তিনি যে মনস্তত্ব বিশ্লেষণের জন্য খাতা করেছিলেন সেটা কি সঙ্গে আছে নাকি টাকার হিসেবের খাতার ভীড়ে হারিয়ে গেছে।
খালি প্রশ্ন আসছে মাথায়। অনেক জিজ্ঞাসা যে বাকি রয়ে গেল! মৃত্যুর আগে কি সব মানুষের মাথায় এমন হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। এবং তার সিংহভাগ না জেনেই মানুষ মারা যায়।
মৃত্যুন্মুখ মানুষের এসব সমস্যার কথা জানিয়ে যেতে পারলে ভাল হত! কিন্তু সুযোগটা তো আর নেই।
হোটেলের রুমে ফিরে মাথায় চাপ দিয়ে সে বসে রইল। ব্যথাটা বাড়ছে। মাথায় যেন অনেকগুলো সাপ ঢুকে কিলবিল করছে।
রফিক কাকা বললেন, কীরে মাথা ধরেছে নাকি! অবশ্য যা হয়েছে তাতে মাথা ধরবে না! তুই তবু পারলি। আমি হলে মরেই যেতাম।
রতন কিছু বলে না।
কাকা বলে যান, হাপিয়ে উঠেছি। আমি কথা বলেছি। কাল রাতেই আমাদের ফ্লাইট। পরশু সকালেই বাংলাদেশ। মাই সুইট বাংলাদেশ। হা। হা। হা।
কাকার এই হাসির ফাঁকেই রতন মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
কাকা গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন, পুরো শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা। তিনি চিৎকার করে উঠেন, রতন। রতন!
দূর-সুদূর থেকে ভেসে আসা আবছা ধ্বনির মতো ডাকটা রতনের কানে আসে। কিন্তু উত্তর দেয়ার সামর্থ্য আর তার নেই।
আহ! কাকাকে রহস্যটা জানিয়ে যাওয়া গেলো না! তার রহস্যভেদের খাতাটা রহস্যভরপুরই থাকল।

*** *** ***
ইতিহাস স্যার বেত হাতে এগিয়ে এসে বললেন, রতন বল দেখি মাহাত্মা গান্ধীকে কে খুন করেছিল?
রতন কিছু বলে না।
স্যার হুংকার দেন, কালকের মতো বাঁদরামি করলে কিন্তু..। আজ এই বেত আমি তোর পিঠে ভাঙ্গবোই। স্যার বেতটা খুব কায়দা করে ঘোরান।
রতন কী ভেবে বলে, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।
ইতিহাস স্যার ইতিহাস জানেন শুধু, বর্তমান নয়। কাজেই ফার্গুসনকে তিনি চিনতে পারেন না।
বেত উঁচিয়ে গর্জন করেন, এই ফার্গুসন আবার কোন শালারে! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।
তারপর কী যেন ভেবে থেমে বলেন, তবু আজ ভুল হোক শুদ্ধ হোক একটা নাম বলেছিস। তাই আর বেত মারছি না। যা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইতিহাস ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রতনের মনে পড়ে কাল রাতের স্বপ্নের কথা। একটা নয় দু-দটো স্বপ্ন। স্বপ্নের ভেতর আরেকটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে কেউ একজন বলেছিল চাইলে সে রতনকে বিশ্বের সেরা ফুটবলার বানিয়ে দেবে, কিন্তু তারপরই তাকে মরতে হবে।

রতন সেরা ফুটবলার হয়েছিল। তারপর মরেওছিল!

২,১০৪ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “ম্যাজিক বয় – শেষপর্ব”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    পুরো টান-টান উত্তেজনা ছিলো শেষ পর্বে।
    মনে হচ্ছিলো যেন ম্যাচটা সরাসরি স্টেডিয়ামে বসে দেখছি।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    আমি ভাবছিলাম এই উপন্যাস এখানে পড়ব না। দেশে গিয়ে বইটাই পড়ব। কিন্তু একটা পর্ব ও বাদ দিতে পারলাম না। প্রতিবার ভাবছি পরের পর্ব পারব না। খুবই ভাল লাগল। তবে একটা দুঃসাহস করে ভাইয়ার লেখা সম্বন্ধে একটা জিনিস বলি। পুরোটাই আমার ব্যাক্তিগত মতামত।
    লেখার শেষে এসে পুরো ঘটনাকে স্বপ্ন বানিয়ে দেওয়াটা আমার ভাল লাগেনি। ফ্যান্টাসি কে ফ্যান্টাসি রাখা হলে ভাল লাগত। অন্য কোন ভাবে ফিনিশিং দিলে ভাল লাগত। পুরো ঘটনা স্বপ্ন বানাতে মনে হয় এই দুর্দান্ত উপন্যাস টা একটু হলেও হালকা হয়ে গেল। আগের পর্ব গুলো পরার সময় আমার কিন্তু একবার ও মনে হয় নি লেখক কেন এইরকম গাঁজাখুরি গল্প বানাচ্ছে। তাই স্বপ্ন বানানোতে কষ্ট পেয়েছি।
    অনেক বেশি সাহস দেখায়া ফেললাম। :frontroll: :frontroll: দিয়া দিলাম

    জবাব দিন
    • মোস্তফা মামুন (৮৭-৯৩)

      কামরুল তোমার মন্তব্যটার সঙ্গে অংশত একমত।

      প্রথমে স্বপ্ন বানানোর পরিকল্পনা ছিল না। ঈদসংখ্যা ছাপার কারণে একটু তাড়াহুড়া ছিল, ভাবলাম এখন শেষ করে দেই এভাবে, বই করার সময় শেষটা বদলাবো।

      বদলানো গেল না। কারণ বেশির ভাগ লোক বলল শেষটা দারুণ হয়েছে।

      শুধু দুই কামরুল ছাড়া!

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফাহিম (৯০-৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।