ম্যাজিক বয় – ০৯

ম্যাজিক বয় – ০১০২০৩০৪০৫০৬০৭০৮

রতন একদিনেই রীতিমতো হাপিয়ে উঠল। এ কী কাণ্ড!
প্র্যাকটিস তো নয় যেন, একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি। এবং সে যুদ্ধে না জিতলে মাথা যাবে। কোটি-কোটি টাকার কারবার দেখে সে ভেবেছিল এই দেশে বোধহয় টাকা উড়ে বেড়ায়, কিন্তু এখন দেখল এখানে প্রতিটি পাইয়ের জন্য আক্ষরিক অর্থেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।
ঢাকায় এক-আধটু দৌড় হয়, তারপর নিজেদের মতো প্র্যাকটিস। আর প্র্যাকটিসে তারকা-টারকা বলে কিছু নেই। কোচ একবার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ওপর রাগ করে তাকে কয়েকটা বাড়তি চক্কর দিতে বললেন। হ্যাঁ, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনই সম্রাট। কোনো ক্লাব কর্তা নেই, তাদের কোনো খবরদারি নেই। ঢাকায় সে দেখেছে কোচ একজন থাকলেও কর্তারাই ছড়ি ঘোরান। কিন্তু এখানে ছড়ি একজনেরই। তার যা ইচ্ছা তাই করাচ্ছেন।
শুরুর আগে তিনি রতনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই ম্যানচেস্টার দলে এমনকি প্রত্যন্ত আফ্রিকান দলের খেলোয়াড়রাও আছে, কিন্তু ইংল্যান্ডের ক্লাব যেহেতু তাই এখানে ইংরেজিই বলতে হয়। কারো কারো ইংরেজি রতনের চেয়েও খারাপ। তেভেজ যে ইংরেজি বলল, সেটা শুনলে তার স্কুলের ইংরেজির মদন স্যার তাকে বেঞ্চের ওপরে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন নির্ঘাত। তুলনায় আফ্রিকান খেলোয়াড়রা বরং ভালো বলে।
রফিক কাকা শুনে বললেন, এর কারণ হলো আমরা তো আমাদের স্কুলে ইংরেজি পড়ি। ওরা তো পড়ে না।
কেন? ওরা ইংরেজি পড়ে না কেন? ওরা তো আমাদের চেয়ে অনেক শিক্ষিত আর ধনী দেশ।
আরে আমরা ইংরেজি পড়ি কারণ ইংরেজিটাকে আমরা আন্তর্জাতিক ভাষা মনে করি। ওরা সেটা মনে করে না। এই তেভেজ ধর ইংরেজিটা শিখছে দুবছর আগে ইংল্যান্ডের ক্লাবে খেলতে আসার পর। ইউরোপে ইংল্যান্ডসহ বৃটেনের কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকিগুলোতে তো কেউ ইংরেজি বলে না।
কিন্তু আফ্রিকানরা যে পারে! ওরা তো…
আফ্রিকার সবাই নয়। যেসব দেশে ইংলিশরা রাজত্ব করেছিল সেসব দেশে ইংরেজির প্রসার আছে। আবার মনে কর সেনেগাল ছিল ফ্রান্সের কলোনি, ওদের দ্বিতীয় ভাষা তাই ফ্রান্স। এই যে তেভেজর দেশ আর্জেন্টিনা, সেটা ছিল স্পেনের রাজত্ব, তাই ওখানকার ভাষা হয়ে গেছে স্প্যানিশ। আবার ব্রাজিল পর্তুগালের কলোনি ছিল তাই তাদের ভাষা পর্তুগীজ। এখানেও তা-ও দেখছিস ওরা কিছু ইংরেজি বলতে পারে, কারণ ইংল্যান্ডে খেলছে। স্প্যানিশ লিগে তুই খেলতে গেলে দেখবি কেউ ইংরেজি জানে না।
খাওয়ার ফাকে ফাকে কথা বলছিল ওরা। সেই খাওয়াও ক্লাবের ডাক্তার, যাকে ওরা বলে ডায়েটেশিয়ান তিনি ঠিক করে দেন। এর বাইরে কিছু খেতে হলে ওর অনুমতি নিতে হবে। রতন একদিন মাছের ঝোল খেতে চেয়েছিল, ডাক্তার এমন ভাব করলেন যে এটা খেলে নরক নির্ঘাত। কাকা প্রথম কয়েকদিন ভাত রেধে খেয়েছিল, কিন্তু রতনের কষ্ট হয় দেখে কাকা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এখন রতনের খাবারই তিনি খান। কাকার কোনো কষ্ট হয় না। তিনি দারুণ মানিয়ে নিয়েছেন। রতন খেয়াল করেছে কাকার চুলের স্টাইলটা ক্রমে বদলে যাচ্ছে। সেদিন বিশ্রি ধরনের কয়েকটা প্যান্ট কিনে এনেছেন। এর একটায় ঠিক কতগুলো বোতাম সেটা রতন গুনে বের করতে পারেনি। যত গুনে তত গোপন গোপন জায়গা থেকে আরও পকেট উকি মারে।
খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। রতন উঠে ধরতে গিয়েছিল, কাকা বাধা দিলেন। তার ফোন ধরা নিষেধ। রতন সরাসরি কারো সঙ্গে কথা বলতে পারে না, কাকা আগে তাদের যাচাই-বাছাই করে নেবেন। পছন্দ হলে তবে সময় দেয়া হবে।
কাকা ফোনটা ধরে খুব স্মার্ট ইংরেজিতে বললেন, জ্বি বলুন।
আমি কি রতনের এজেন্ট মিস্টার রফিকের সঙ্গে কথা বলতে পারি।
বলছেন।
আপনি আমাদের আজ সন্ধ্যায় সময় দিয়েছিলেন। আমরা কি আজ একসঙ্গে ডিনার সারতে পারি।
না। ডিনারটা আমরা সেরে ফেলেছি।
তাহলে আমরা একসঙ্গে এক কাপ কফি খেতে পারি।
পারেন। পনের মিনিট পর যদি আপনারা আসেন, তাহলে আপনাদের ১০ মিনিট সময় দেয়া যেতে পারে।
তারা এল ঠিক ১৫ মিনিট পর। এবং ১০ মিনিটের মধ্যেই সব কাজের কথা সেরেও ফেলল। রতন তাদের কাজের ধরনে যারপরনাই মুগ্ধ। কিন্তু কাকা মুগ্ধ হলেন না। তিনি কথার মারপ্যাচে ফেলে প্রমাণ করতে চান ওরা তাকে ঠকাতে চাইছে। কাকা নিজের গুরুত্ব বোঝাতে এটাও উল্লেখ করলেন যে তার ভাই একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। বাংলাদেশের যে কোনো আইন তার অনুমোদন ছাড়া তৈরিই হয় না। বাড়িয়ে বলা, কিন্তু রতনের বাবার কথা মনে পড়ে গেল। শুনেছে তার খ্যাতির সূত্রে নাকি এখন বাবার চেম্বারে ভীষণ ভীড়। লোকজনকে তিনদিন আগে থেকে নাম লেখাতে হয়। রতনের আনন্দ হয়। মক্কেলের জন্য বাবাকে কী অপেক্ষা করতে হত! আচ্ছা আজিজ মিয়া কি বাবাকে এখনও আগের মতো ঠকায়?
তাহলে কি আমরা আশা করতে পারি যে গ্রহের সেরা ফুটবলার রতনকে আমরা অ্যাডিডাস পরিবারে পাচ্ছি। টেকো মাথার লোকটির কথায় রতনের ধ্যান ভাঙ্গল।
ও। এরা তাহলে অ্যাডিডাসের লোক। কাল নাইকির সঙ্গে মিটিং হয়েছে।
এরা সবাই রতনকে স্পনসর করতে চায়। সামান্য দাবি, ওদের কোনো একটা জামা গায়ে দিতে হবে কিংবা কোনো একটা জুতা পরতে হবে।
রতন প্রথম শুনে কাকাকে বলেছিল, ওরা ফ্রি আমাকে দেবে?
কাকা বললেন, ফ্রি দেবে মানে! প্রশ্ন হলো ওরা কতো টাকা দেবে?
সঙ্গে টাকাও দেবে?
দেবে না! তুই এই জিনিসটা পরছিস মানে তুই এর বিজ্ঞাপন করছিস। এর মাধ্যমে ওদের বিক্রি কতো টাকা বেড়ে যাবে।
রতনের বিশ্বাস হতে চায়নি। সে জিনিসটা পরলে অন্যরাও পরতে শুরু করবে কেন? যারা কেনার তারা তো নিজেদের প্রয়োজন হলে তবেই কিনবে। কিন্তু ওর জানায় নিশ্চয়ই ভুল আছে, কারণ এডিডাস শুধু রতন সংবাদ সম্মেলন বা টিভিতে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তাদের ক্যাপ পরে যাবে এই শর্ত মানলে ১০ লাখ পাউন্ড দিতে তৈরি। তাও মাত্র এক বছরের জন্য। জানিয়েছে, রতন ভালো খেললে এক বছর পর অংকটা আরও বাড়ানো হবে।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো শুনে অবশ্য বলেছে, রাজি না হতে। ৫ মিলিয়ন চাইতে।
কাকা এদের কাছে ৫ মিলিয়নই চাইলেন। মানে ৫০ লাখ পাউন্ড। ওরা ৩০ লাখ পর্যন্ত দিতে রাজি। মানে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। শুধু ক্যাপ পরার বিনিময়ে ৪৫ কোটি টাকা! তাও কাকা রাজি হননি। বলেছেন দুদিন তিনি ভাববেন। তারাও ভাবুক। তারপর গিয়ে সিদ্ধান্ত।
ওরা এরপর আর কথা বাড়ায়নি। জানিয়ে দিল ৪৮ ঘণ্টা পেরোনোর পর আবার যোগাযোগ করবে, তবে এর মধ্যে অন্য কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে হলে তাদেরকে জানাতে হবে। কাকা যেন দয়া করে সেটা মেনে নিলেন। এটুকু দাবি পূরণ করে ওরা বিদায় নিল।
কাকা ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে যোগ-বিয়োগ করে দেখলেন আয়টা ঠিক কতো হচ্ছে। সত্যি টাকার হিসাব রাখা মুশকিল। টিভি সাক্ষাৎকারেও টাকা পাওয়া যায়। পত্রিকায় কথা বললেও টাকার থলি। বাংলাদেশে অল্পদিনের খেলার অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে খেলোয়াড়রা টিভি ক্যামেরায় নিজেদের দেখানোর জন্য সাংবাদিকদের কতো চা-সিগারেট খাওয়ায়। অথচ সে কাল একটা ইন্টারভিউ প্রত্যাখ্যান করেছে চাহিদামতো টাকা না দেয়ায়।
টাকা যেমন আসছে, তেমনি পরিশ্রমও যাচ্ছে। প্র্যাকটিসে তো কোনো কোনোদিন মনে হয় সব ছেড়ে-ছুড়ে দৌড় দেয়। এ যেন চাকরি, খেলা সপ্তাহে একদিন কিন্তু বাকি প্রতিটা দিন ঘড়ি ধরে অনুশীলন। কত কসরত।
রতন ম্যানচেস্টারের ২০ নাম্বার জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচ খেলল অ্যাস্টন ভিলার সঙ্গে। ওরা তুলনামুলক ছোট দল, বাংলাদেশের ওয়ারী-রহমতগঞ্জের মতো। ওসব দলের কোনো সমর্থক থাকার কথা নয়, কিন্তু রতন অবাক হয়ে দেখল ওদের জার্সি গায়ে লোকের সংখ্যা ম্যানচেস্টারের সমানই প্রায়। খেলাটা ওদের মাঠে হওয়াতে ওদেরই বেশি তেজ। আর সারাক্ষণ ওরা গান গেয়ে যায়।
রতনের প্রথম ম্যাচ, তাই উপচে পড়া ভীড়। পুরো ইংল্যান্ডের সব পত্রিকা আর টিভির সাংবাদিকরা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ম্যাচের আগের দিন ওরা ওর কথা শুনতে পারলে মারামারি করে। কিন্তু স্যার ফার্গুসন আগেই জানিয়ে রেখেছেন ম্যাচের আগে কোনো কথা নয়। মনসংযোগ রাখতে হবে। মনসংযোগ।
মনসংযোগটা রাখল রতন। কিন্তু খেলাটা খেলতে পারল না। শুরু থেকেই খেয়াল করল বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কে বা কারা যেন তার পা আটকে রাখছে। একটুখানি ধাতস্থ হতে সে বল ছেড়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিল। বল পেলেই সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়ানো কাউকে দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু হায় সে যাকে বল দিতে চায়, তার পায়ে বল যায় না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনটি ভুল পাস দিয়ে ফেলল। এর মধ্যে একটা এমন ভুল যে তা থেকে ভিলার স্ট্রাইকার আরেকটি হলে গোল করেই ফেলেছিল। ফন ডার সার খুব সতর্ক ছিল, নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত। সে ভয়ে ভয়ে একবার স্যার্রে দিকে তাকাল, নিশ্চয়ই রেগে-মেগে আগুন হয়ে আছেন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, স্যারের কোনো ভাবান্তর নেই। তিনি চুইংগাম চিবিয়েই যাচ্ছেন। তার কাছে এটা যেন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
কী করবে রতন! এমন তো হওয়ার কথা নয়। ঠিক যে ওদের মান অনেক উঁচু, ডিফেন্ডাররা সব ভয়ংকর শক্তিশালী, কিন্তু রতন তো জানে এদেরকে ফাঁকি দেয়া তার পক্ষে এমন কিছু ব্যাপার নয়। তাহলেও হচ্ছে না কেন?
রতন আরেকবার চেষ্টা করল। বল নিয়ে একটা দৌড় দিল, কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করল কোনো ডিফেন্ডার নয় সে পায়ে-পায়ে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেছে। ভিলার সমর্থকরা যে ধ্বনি ধ্বনি দিল তার বঙ্গানুবাদ সম্ভবত ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’। প্রত্যাশানুযায়ী না খেলতে পারলে নিজ দলের সমর্থকরা আরও ভয়ংকর। ওরা বাজে ধরনের গালাগাল দেয়। নিশ্চয়ই এখন ম্যানচেস্টার সমর্থকরা ইংরেজিতে যা-তা গালাগাল দিচ্ছে।
এর মধ্যেও অবশ্য তাদের জন্য আনন্দের একটা ব্যাপার ঘটে গেল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ফ্রি কিকে অসাধারণ একটা গোল করে ফেলল। সেই গোলের উৎসবের সময়, রোনালদো কানে কানে বলল, ডোন্ট ওরি। বি ইজি। ইটস ইয়োর ফার্স্ট ম্যাচ ওনলি। বলল বটে, কিন্তু চোখে যেন একটু দুষ্টুমি। সে আর তেভেজ যে ভঙ্গিতে হাসল সেটার মানে যেন, কচি খোকা কাজটা এত সহজ নয়! এরা কেমন করে যেন মনের ভাবটা পুরো লুকিয়ে রাখতে পারে, বাঙ্গালীরা যেমন রেগে গেলে কোনো না কোনোভাবে রাগটা প্রকাশ হয়ে যায়, এদের ক্ষেত্রে বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়। তবু মনে মনে নিশ্চয়ই হিংসা ছিল! রতন নিজে হলেও হত। রোনালদো গত মৌসুমে গোলের রেকর্ড করেছে, দলকে ইংলিশ লিগ এবং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দুটোই জিতিয়েছে। অথচ কিনা এবার লিগের শুরুতে তার জায়গায় কোথাকার কোন এক পুঁচকে রতনকে নিয়ে মাতামাতি!
হাফ টাইমের পর আর ঝুঁকি নিলেন না স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। উঠিয়ে নিলেন রতনকে। এবং পিঠ চাপড়ে বললেন, প্রথম ম্যাচ হিসেবে তুমি ভালোই খেলেছো! তোমার কাছে এই ম্যাচে এর বেশি প্রত্যাশা করিনি আমি।
রতনের ভীষণ মন খারাপ হয়। ম্যাচ শেষে সোজা চলে আসে বাসায়। রফিক কাকা শুধু বলেন, ঠিক কী হয়েছিল বলতে পারবি! মানে বলতে চাইছি…
রতনের চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। শূন্য দৃষ্টি। কিন্তু এর মধ্যেও যেন কী একটা পড়ে ফেলে কাকা একেবারে চুপ করে যান।
বাসায় এসে টিভি ছাড়তেই দেখে হাজার সাংবাদিকের মুখোমুখি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। সবাই জানতে চায়, রতন এমন ব্যর্থ হলো কেন?
স্যার বললেন, ব্যর্থ কোথায়? ৫ বছর আগে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর প্রথম ম্যাচের কথা তোমরা ভুলে যেতে পারো। কিন্তু আমি ভুলিনি। সেদিন তার পারফরম্যান্স এর চেয়ে একটুও ভালো ছিল না।
একজন কঠিন ভাষায় জানতে চাইল, প্রথম ম্যাচেই তাকে নামিয়ে দেয়া ভুল হয়েছে কিনা! ম্যানচেস্টারের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর আগেই…
স্যার দুষ্টুমি করে বললেন, আজ তাকে না নামালে তুমিই আমাকে প্রশ্ন করতে কেন ওকে খেলালাম না। তোমাদের সবাই-ইতো ওর অনুশীলন দেখেছো। একবারও কি মনে হয়েছে ও তৈরি নয়। কালও আমাদের ফাইনাল প্র্যাকটিসে রিজার্ভ খেলোয়াড়দের বিপক্ষে ম্যাচে ও দুটো গোল করেছে। একটা তো এককথায় অবিশ্বাস্য। এবং আমি বলছি এই ছেলেটি অন্যরকম। একটু ধৈর্য ধর। তোমরা অনেক যাদু দেখবে। বলেই তিনি হলঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।
রতন কী করবে এখন? এই ভরদুপুরে ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। এখানে খেলা হয় দুপুর বেলায়, আজ ওদের ম্যাচটা শুরু হয়েছে সাড়ে ১১টায়। কারণটা খুব আশ্চর্যজনক, এশিয়ার লোকজন যেন টিভিতে খেলা দেখতে পারে সেটা ভেবেই নাকি! ইংল্যান্ডের সঙ্গে এই অঞ্চলের সময়ের ব্যবধান ৬ ঘণ্টা, সেক্ষেত্রে সন্ধ্যায় খেলা হলে সিঙ্গাপুর-ইন্দোনেশিয়ায় তখন হবে রাত ১২টা, ওরা খেলা দেখতে পারবে না বলেই…। তাই এখনও সারাদিন হাতে। আর খেলা হয় শুধু শনি এবং রবিবার, মানে ছুটির দিনে। সেই দিনগুলোতে সন্ধ্যায় ওরা একেবারে উন্মত্ত হয়ে যায়। বারে গিয়ে মদ খেয়ে রাতভর যাচ্ছেতাই মাতলামি। অথচ এই লোকগুলোই সপ্তাহের কাজেই দিনগুলোতে পারলে সন্ধ্যা ৭টায় ঘুমিয়ে পড়ে। শনিবারের এই কোলাহলের সন্ধ্যাটা তার একেবারে পছন্দের নয়। তাছাড়া টিমমেটরা হয়ত ওকে ক্লাবে নিয়ে যেতে চাইবে। ওরা মনে করে মন ভালো করার উপায় হলো এই হৈ-হল্লা।
রতন বেরিয়ে যায়। কিন্তু বেরোতে গেলেই প্রহরীর বাধা। যেতে হলে নাকি গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। নিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। সে তো ক্লাবের একটা পণ্য, সেটার কোনো ক্ষতি হলে তো সবার ক্ষতি।
না। রতন বড় একটা ধাধায় পড়ে যাবে।
মাকে একটা ফোন করবে নাকি! বাংলাদেশে এসব খেলা সরাসরি দেখা যায়। মা নিশ্চয়ই দেখে খুব মন খারাপ করেছেন। এবং হয়ত পাশের বাড়ির ডাক্তার আংকেলের বউ এসে মায়ের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। হয়ত মা এখন তার সঙ্গে ঝগড়ায় ব্যস্ত।
কিন্তু এমন হলো কেন? হওয়ার তো কথা নয়! তার তো সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছার কথা। এবং রতন পৌঁছলও।
তিন ম্যাচ বাকি থাকতেই যে ম্যানচেস্টার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলো তার মূলে রতনের ৩৫ গোল। এর মধ্যে একটা গোল তো ম্যারাডোনার ৮৬ বিশ্বকাপের সেই গোলটার প্রায় সমতুল্য।
পুরো মৌসুমে পত্র-পত্রিকায় তার ছবি এত ছাপা হলো যে রতন দেখে নিজের চেহারার কিছু ত্র“টিও বের করে ফেলেছে। ওর নাকটা একটু চ্যাপ্টা। আর হাসলে একদিকের দাঁত বেশি বের হয়ে যায়।

(চলবে……)

১,৬০৮ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “ম্যাজিক বয় – ০৯”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    এপর্যন্ত দারুন হয়েছে, স্বপ্ন এবং স্বপ্নের বুনন। মামুন ভাইকে :salute:

    কিন্তু এরপর?


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    রতন তো এখনো আমাদের জাতীয় দলে ডাক পাইলো না... 🙁


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।