ম্যাজিক বয় – ০৩

ম্যাজিক বয় – ০১০২
৩.
‘সর্বনাশ হয়ে গেছে। সর্বনাশ!’
ফরিদার এই চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল সবার। ঠিক কী হলে ফরিদা সেটাকে সর্বনাশ মনে করবেন এটা এত বছরেও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি এ বাড়ির কেউ, তাই একটু কৌতুহল দেখা যায়! সমস্যা হলো ফরিদা সর্বনাশের কারণটা জানান অনেক দেরিতে। অনেক নাটক করে।
কিন্তু আজকেরটা সর্বনাশা কথাই। রতনের বল চুরি হয়ে গেছে।
ফরিদা চিৎকার চেচাঁমেচি করছেন অকুস্থলে গিয়ে।
শফিকুর রহমানও সেখানে হাজির হলেন। এ সময় ঠিক কী বলা উচিত সেটাও তিনি বুঝতে পেরেন না। শান্ত্বনা দেবেন নাকি! বল হারিয়েছে রতনের, সেখানে ফরিদাকে শান্ত্বনা দেয়ার কি যৌক্তিক। একটা সমস্যায় পড়া গেলো। আচ্ছা, ছেলের খেলার বল যদি হারিয়ে যায় এবং স্ত্রী যদি কান্না শুরু করেন তাহলে আদর্শ গৃহকর্তার করণীয় কী! তবু কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে হয়।
শফিকুর রহমান ভালো করে খাটের তলাটার দিকে তাকিয়ে বলেন, ভালো করে খুঁজেছো?
না। খারাপ করে খুঁজেছি। যাও তুমি গিয়ে দেখো আমি মিথ্যা বলছি কিনা।
বলে শফিকুর রহমানের গায়ে একটা ধাক্কাও দিয়ে দেন। ভাগ্যিস কোনো মক্লেল এখানে উপস্থিত নেই। থাকলে খুব লজ্জার ব্যাপার হত। স্ত্রীদের কাছে এমন ধাক্কা খাওয়া লোকদের ওপর মানুষের ভরসা থাকবে কী করে!
রতনকে অবশ্য খুব দুঃখিত বলে মনে হচ্ছে না। সে তার মায়ের কাণ্ড কৌত’হলের সঙ্গেই দেখছে। তার চেহারায় হারানোর ব্যথা নেই। কৌত’হলও নেই বলে মনে হয় শফিকের। এটাই সবচেয়ে চিন্তার কথা।
যেদিন এমন গোলমেলে ব্যাপার ঘটে সেদিন বুয়া কেন যেন একটু তাড়াতাড়ি চলে আসে। এসে বিলাপে যোগ দেয়। দুজনের মধ্যে বিলাপের লড়াই চলে। শেফালির বিলাপ আরও উচ্চকণ্ঠ, আরও অমার্জিত।
শেফালি বলে, বল হারিয়ে গেলো। এখন কী হবে গো! ও বল। বল!
ফরিদা বললেন, তাও একটা নয়। দু-দুটো বল। নতুন বলটাও নিয়ে গেছে।
এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন তথ্য। ফরিদার কথামতো শফিকুর রহমান একটা নতুন বল এনেছিলেন কাল, চোর সেটাও নিয়ে গেছে। এবং আর কিছু নেয়নি। এতে প্রমাণিত হয় যে চোরটা শুধু বল নিতে ঢুকেছিল। এই ঘরে যখন এমন বিলাপ চলছে তখন রফিক তার ঘরে দরজা বন্ধ করে গভীর ভাবনায় ব্যস্ত। বুঝতে পারছেন না দ্বিতীয় বলটি চুরি করল কে? রহস্য আরও ঘনিয়ে গেলো।
রফিকের কৌত’হল ছিল পুরনো বলটা নিয়ে। গতকালের ঘটনার পর রফিক নিশ্চিত বলের মধ্যেই এমন কিছু ব্যাপার আছে। প্রথমে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে হবে। রফিক বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না বটে, কিন্তু জগতের সব নিয়মকেই বিজ্ঞান ব্যখ্যা করতে পারে। কাজেই এর মধ্যেও বিজ্ঞান থাকবে। গবেষণা করতে হবে লুকিয়ে। কাউকে জানতে দেয়া যাবে না, গবেষণায় দ্বিতীয় লোকের উপস্থিতি মানেই অনিবার্য ব্যাঘাত। তাছাড়া বেশিরভাগ লোকই তার গবেষণাকে পাগলামি মনে করে উত্যক্তও করে।
চুপি চুপি তাই বল চুরি করতে রাতের বেলা তিনি ঢুকেছিলেন খাটের নীচে। বলটা নিয়ে বেরিয়ে এসে রাতভর গবেষণা করেছেন। প্রথমে বলকে বায়ুশূন্য করে ভেতরের ব্লাডার খুলে দেখেছেন এর মধ্যে রহস্য কিছু আছে কিনা। তেমন কিছু নেই। ঠিক বিশ্বাস না করলেও তন্তর-মন্তর, তাবিজ-কবচ কিছু আছে কিনাও তাও পরীক্ষা করে দেখেছেন। নেই।
এরপর প্রয়োজন তুলনামুলক বিশ্লেষণ। তার জন্য আরেকটা বল দরকার। মনে পড়ল নতুন বলটাকে গবেষণার কাজে লাগানো যেতে পারে। আবার চোরের পোষাক পরলেন। আবার হামাগুড়ি। কিন্তু কী আশ্চর্য নতুন বলটা নেই। যতদূর মনে পড়ে পুরনো বলটা আনার সময়ও ওটা পাশেই রাখা ছিল। তাহলে গেল কোথায়?
নিজের বাড়িতে চুরি করা সহজ কাজ নয়, তাছাড়া দিনের আলোতে সবকিছুকে যেমন বিন্যস্ত মনে হয়, রাতের বেলা দেখা গেলো সব খুব এলোমেলোভাবে রাখা। তিনি দুইবার টেবিলের পায়ায় ধাক্কা খেলেন, ডাইনিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ফেলে দিলেন এবং একবার ব্যথা পেলে বেশ জোরে ‘উহ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
তুলনায় সেই চোরটি পাকা। কারণ অচেনা বাড়িতে এসেও তার কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি জেগে থাকলেও তো তার কোনো আভাস পাননি। শুধুমাত্র খেয়াল করলেন যে জানালার একটা পাল্লা খোলা। আর নিজের ঘরে ফিরে এসে আরও অবাক ব্যাপার, তার টেবিলে রাখা পুরনো বলটাও নেই। গেলো কোথায়?
রতনের ঘরে বিলাপ চলছে। ফরিদা এবং বুয়া শেফালি দুজন পাল্লা দিচ্ছে। যখন ফরিদার মনে হবে বুয়া চিৎকারে তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে তখন তিনি থামবেন। তার জিনিস নিয়ে অন্য কেউ তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে এটা তার অহংকে আঘাত করে খুব সম্ভবত। রফিক সেই সময়টার অপেক্ষা করে আছেন। কিন্তু আজ সময়টা আসতে অনেক দেরি হবে বোধ হয়। কারণ ফরিদা এই বাবদ শফিকুর রহমানকে দোষ দেয়ার দিকে গেছেন এখন।
সব হয়েছে তোমার জন্য? সংসারের দিকে কোনো মন নেই।
আমার সংসারের দিকে কোনো মন নেই!
খালি টাকা রোজগার করলেই হয় না। টাকাগুলো সঠিক ব্যয় হচ্ছে কিনা সেটাও তো তোমার দায়িত্ব। এই যে এখন গেলো।
টাকা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমি আজই…
তা চিন্তা করবো কেন? তুমি এখন আবার কোন মক্কেলের ঘাড় ভাঙ্গবে। সেটা তো খুব ভালো পারো।
না। এই আলোচনা এত সহজে থামবে না।
গবেষণার স্বার্থে রতনের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। রতন এমনিতেই মিতভাষী, ফুটবল ম্যাজিক শুরুর পর কথা বলছে আরও কম, তার কাছ থেকে কিছু জানা যাবে না।
রতনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা রতন তোর কি মনে হয়?
কোন বিষয়ে?
এই যে বল হারানো বিষয়ে।
বলটা চোর নিয়ে গেছে। তবে…
তবে?
লাভ নেই।
কার লাভ নেই!
চোরের।
ক্ষতি হবে কোনো?
ক্ষতি! হ্যাঁ হবে।
কী ক্ষতি হবে?
সেটা তো আর আমি জানি না। কিন্তু..
কিন্তু কী?
অনুমান করতে পারি। হয়ত মাথায় রক্ত উঠে মারা গেলো। কিংবা এমন কলেরা হলো যে..
রফিক একটু ভয় পেয়ে যান। বিশেষত কলেরার প্রসঙ্গে। মরাটা একটা বাজে ব্যাপার, তারচেয়েও বাজে ব্যাপার হলো বারবার বাথরুমে যেতে হবে। সবসময় পানি থাকবে কিনা তার ঠিক নেই। ইদানিং ওয়াসা লাইনে কী একটা সমস্যার কথাও শুনতে পান।
তিনি একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলেন, সব চোরই কি এমন শাস্তি পাবে।
সব চোর মানে?
মানে বলছি দুটো চোরই। দুই বল তো দুটো চোর চুরি করেছে?
একজনও তো হতে পারে। একজন কি দুটো বল নিয়ে যেতে পারে না।
তা খুব পারে। আমিও তো পারতাম। তাই না!
তুমি! রতন একটু অবাক হয়।
রফিক মিইয়ে গেলেও থামেন না। আরেকটা প্রশ্ন বাকি আছে তার।
আচ্ছা ধর, কেউ বলটা নিয়ে গেলো তারপর যদি আরেকজন বলটা চুরি করে তাহলে দুই চোরেরই কি এক শাস্তি হবে।
চোর তো চোরই।
না। মানে একজন ধর ঠিক চুরির উদ্দেশ্যে চুরি করেনি। মানে সৎ চোর আর কী!
চোর আবার সৎ চোর হয় কী করে! চোর তো চোরই।
বলে রতন রহস্যমাখা হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়।
রফিক খুব টেনশনে পড়ে যান। ভারী রাগও হয় তার। সৎ এবং অসৎ দুই চোরের সমান শাস্তি হবে কেন? কলেরার ভয়ও আছে। তিনি এই গরমেও লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন।

৪.
নিউ ইস্কাটন বয়েজ ক্লাবের কোচ মন্টু ভাই খুব একটা সমস্যায় পড়েছেন। সমস্যায় পড়লে তিনি বাঁশি বাজান। তাতে তার মাথা খুলে যায়। বুদ্ধি ঠিকঠাক কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু আজ বাঁশি বাজিয়ে দম-ক্ষয় করা এবং লোকজনকে বিরক্ত করার বেশি কিছু হলো না।
আর মাত্র ১৫ মিনিট সময়। তারপরই ম্যাচ শুরু হয়ে যাবে। কোনো কাপ প্রতিযোগিতার ফাইনাল নয়, তবু জীবনে কোনো ম্যাচ নিয়ে তার অতো টেনশন হয়নি। আজ হচ্ছে। মান-মর্যাদার সবটা এই ম্যাচের সঙ্গে সঙ্গেই তার শেষ হয়ে যেতে পারে।
মন্টু ঢাকার বড় একটা দলে এক বছর অতিরিক্ত তালিকায় ছিলেন, তার ফুটবল কৃতিত্ব সর্বোচ্চ এটুকুই, কিন্তু কোচ হয়ে তিনি রীতিমতো প্রবাদতুল্য। তিনি বিশ্বাস করেন তার ফুটবল ক্ষমতা কারও চেয়ে কম ছিল না, লোকজন সেটা না বুঝে তাকে অবহেলা করে গেছে, সেই অবহেলার জবাব দেয়ার জন্য তিনি খেলোয়াড়ী জীবনের পাট আগেই চুকিয়ে নেমে গেছেন কোচিংয়ে। এবং কোচ হয়ে কিশোর ফুটবলারদের তৈরি করাটাই তার জীবনের একটা ব্রত। তা তৈরিও করছেন। এই যে নিউ ইস্কাটন বয়েজ ক্লাব এরা গত ৪ বছরে কারো সঙ্গে হারেনি, কোনো দল তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারে না। অথচ সেই দলকে কিনা চ্যালেঞ্জ করেছে বশিরউদ্দিন বয়েজ স্কুল। গত বছরও দুদলের একটা প্রীতি ম্যাচে তার দল ৫-০ গোলে জিতেছিল। কাজেই ওদের চ্যালেঞ্জের খবর তিনি প্রথমে বিশ্বাসই করেননি। পরে জানলেন, ঘটনা ঠিক। ওরা চ্যালেঞ্জ করেছে। সেই চ্যালেঞ্জের উৎস রতন নামের একটা ক্লাস এইটের ছেলে।
এই তল্লাটে যারা ফুটবল খেলে তাদের নাড়ি থেকে হাড়ি সব খবরই তার জানা, রতন নামে কেউ যদি এমন প্রতিভাবান হয়ে থাকত তাহলে তাকে তিনি চিনতে পারতেন নিশ্চিত। কিন্তু মনে পড়ল না এমন কোনো ফুটবলার তার মনে দোলা দিয়েছিল। তবু বশিরউদ্দিন প্রাথমিক স্কুলের গেমস টিচার বদরুল তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। কিসের ভিত্তিতে! অধুনা ফুটবল যে জায়গায় গেছে তাতে একজন খেলোয়াড় একটা দলকে পার করে দেবে এটা ভাবাই হাস্যকর। বদরুল হাস্যকর লোক অবশ্য, কোচিংয়ের কিছুই জানে না, খেলোয়াড়দের বেশি দৌড়ে ম্যাচের আগেই ক্লান্ত করে ফেলে, একবার তার দলের তিনজন খেলোযাড় খেলা চলাকালীন বমি করে ফেলেছিল। একজন বাথরুমের নাম করে পালিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
তবু তার একটু কৌত’হল হয়েছিল। তিনি কৌত’হলবশত তার দলের কযেকজনকে কাল ওদের অনুশীলনে পাঠিয়েছিলেন। ওরা যে খবর দিল সেটা অবশ্য এখনও তিনি বিশ্বাস করছেন না। ছেলেটা বল নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। যতজনকে ইচ্ছা ড্রিবল করে। আর পায়ে এমন শট যে একটা দর্শক সারিতে দাঁড়ানো তার দলের মিডফিল্ডার যতীনের মাথায় লাগার পর যতীন আর উঠেই দাঁড়াতে পারছিল না। ওকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে আসতে হয়েছে। যতীন আজ খেলতেই আসেনি।
ফুটবল হচ্ছে তপস্যার বস্তু, এই যে পেলে-ম্যারাডোনাদের নিয়ে অতো লাফালাফি, তাদের ইতিহাস কয়জন জানে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বল নিয়ে তপস্যা করে তবেই না তারা! আর রতনের কিনা হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙ্গে মনে হলো যে দেখি তো ফুটবলটা দিয়ে কিছু করা যায় কিনা! আর সে দুনিয়া জয় করে ফেলছে। এর মানে ভেতরে কিছু একটা আছে।
তার দলের স্ট্রাইকার ইবরার যা বলেছে সেটাই তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। রতনের বলটাতেই যত ম্যাজিক। ইবরার তাকে না জানিয়েই ছোট একটা কাজ করে ফেলেছে। রাতের বেলা রতনের বলটা সে চুরি করে নিয়ে এসেছে। খুবই অন্যায় কাজ। কিন্তু প্রেম এবং যুদ্ধে যেমন অন্যায় কিছু নেই, তেমনি ফুটবলে জেতার জন্যও অন্যায় কিছু নেই বলে মনে করেন তিনি। তাছাড়া বলের জোরে কেউ একজন তাদের অত সাধনাকে ছিনতাই করে নিয়ে যাবে, এটা তো মেনে নেয়া যায় না।
বলটা নিয়ে আসাতে কাজ হবে বলেই মনে হচ্ছিল তার। কারণ খবর পেয়েছেন বল হারানোর পর রতনের বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। মা বিছানায় শুয়ে কান্নাকাটি করছেন। তার বাবা কোর্টে যাননি। বদরুলও মন-মরা।
আরেকটা নতুন বল কিনে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু রতন নাকি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। একটা ছোট সমস্যা হলো বল দুটো নিয়ে আসার পর কৌত’হলে সবাই বলগুলোকে তাদের নিজেদের বলগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছে। ঐ বলগুলো আলাদা করা যাচ্ছে না। এখনও কলোনির বিল্ডিংয়ের পেছনে বাছাই করার কাজ চলছে, কিন্তু কোনোভাবেই আলাদা করা যাচ্ছে না। একটা একদম নতুন বল, সেটা নিয়ে সমস্যা নেই, কিন্তু রতন যে বলটা দিয়ে ম্যাজিক দেখায় সেটা তাদের পুরনো বলগুলোর সঙ্গে এমন মিশে গেছে যে…
তিনি অবশ্য বদরুলকে বলেছিলেন, বদরুল তোমাদের বল দিয়েই খেলা হোক।
বদরুল হাসতে হাসতে বলল, আমাদের বল নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি, তাই তোমাদের মাঠে এসেছি, এখন বলটাও তোমাদেরই হোক। স্বাগতিক দলেরই বল সরবরাহ করার নিয়ম।
এরপর আর তর্ক করা যায় না। কাজেই তাদেরই বল দিতে হয়েছে। এখন কে জানে ভুল-ভাল করে রতনের বলটাই মাঠে দিয়ে দেয়া হয়েছে কিনা!
খেলা শুরু হতেই বলটা ধরে রতন রাইট উইং দিয়ে উঠে এল। আগেই বলা ছিল বিপদজনক অবস্থা দেখলেই পা চালিয়ে দিতে হবে। তার লেফট ব্যাক নির্দেশটা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছে। ফাউল থেকে যে ফ্রি কিকটা নিল রতন সেটাও এমন কাজের কিছু হলো না। জোর ছিল, কিন্তু উড়ে গেলো আকাশের ওপর দিয়ে। রতন দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল!
মন্টুর মনে হলো, বাজিমাত হয়েছে। বল নেই। ম্যাজিকও নেই।
এবং পরের আক্রমণেই বয়েজ ক্লাব গোল পেল। মন্টু ভাইয়ের ভয়ও দূর হলো। তার মানে রতনের ম্যাজিক বলেই। এবং সেই বলটা লুকিযে ফেলা গেছে।
বদরুলের মুখটা হলো দেখার মতো। চ্যালেঞ্জ করতে চায়! কে একজন কী একটা বল নিয়ে এক-আধটু ফাজলামি করেছে, আর তার জোরেই কিনা মন্টুকে চ্যালেঞ্জ। খুব আনন্দ হলেও মন্টুর বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খেলা চলাকালীন বাঁশি বাজানো যায় না।
বদরুল বললেন, কীরে রতন। সব ভুলে গেলি নাকি! এর রতনকে বল দে!
মন্টু টিপ্পনি কাটলেন, বাড়ির উঠানে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু মাঠে করা যায় না। আমিও তো বাড়ির উঠানে হাজার খানেক গোল দিয়েছি। আমার দাদী সাক্ষী।
খুব জম্পেশ জব্দ করা গেছে বলে দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল ওঠে। বয়েজ ক্লাব সফলতম দল, সবসময় ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকে বলে তাদের দর্শক অনেক বেশি। তারা আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে হাততালি দিতে থাকে। আর হাততালি চলতে চলতেই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে।
রতন মিডফিল্ডে বলটা পেয়ে চকিতে একজনকে কাটিয়ে নিল। তারপর তার শরীরে যেন চিতার গতি। এবার আর উইং দিয়ে যাচ্ছে না, কারণ ওখানে গেলেই লেফট ব্যাকটা মেরে দিচ্ছিল। মন্টু আগেই বলেছিলেন, ওয়ান টু ওয়ান হলে ফাউল করতে। যেহেতু সামনে এখনও চারজন ডিফেন্ডার আছে এবং শ্যুটিং রেঞ্জেও নেই রতন তাই কেউ পা চালাল না। রতনও এমন ভঙ্গি করল যেন সে বলটা লেফট উইংয়ের দিকে পাস দিয়ে দিচ্ছে। সেখানেই ভুলটা হলো, আগুয়ান লেফট উইংগারকে মার্কিং করতে একটা ডিফেন্ডার একটু বাঁদিকে সরে গেলো আর মুহূর্তেই গতি বাড়িয়ে রতন চলে গেল বাম দিকে। এবং সেখান থেকে এমন গোলমুখী শট যে ওটা ধরতে গেলে গোলকিপার মারা পড়ত নির্ঘাত। তার মানে বল বাছাইয়ে ভুল হয়েছে। সেই বলটাই…। হাফ টাইমে বদলে দিতে হবে।
এরপর থেকে বারবার ডিফেন্স ভাঙ্গল রতন। যত ইচ্ছা ড্রিবল করল। যাকে ইচ্ছা পাস দিল। কারোই কিছু করার নেই। গোল হলো মাত্র একটি, কিন্তু হতে পারত এক ডজন। বদরুল একটা ব্যাপার খানিকটা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন রতনের যেন গোল করার দিকে খুব মন নেই।
হাফ টাইমের বাঁশি বাজার পর পুরো দর্শক সারি হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাঠে। সবাইকে রতনের একটু কাছে যেতে চায়। ছুঁয়ে দেখতে চায় সে মানুষ তো!
মন্টু এখনও হার মানতে রাজি নন। ভুলে সেই ম্যাজিক বলটা মাঠে চলে যাওয়াতেই এত কাণ্ড। হাফ টাইমের পর খেলা শুরু হলেই দেখা যাবে সব জারিজুরি শেষ।
ইবরারকে ডেকে খুব বকুনি দিলেন মন্টু। মারও লাগাতেন, কিন্তু এখন এই নিয়ে বেশি কথার সময় নেই। ইবরার রাতে যেমন কায়দা করে দুটো বল চুরি করে নিয়ে এসেছিল, তেমনি কায়দা করে সেই বলটা সরিয়ে ফেলল। মন্টু বলটা নিজের জিম্মায় নিয়ে নতুন বল দিলেন দ্বিতীয়ার্ধের জন্য। আর সেই দ্বিতীয়ার্ধে গোল হলো ৬টি। রতন করল ৫টি, দয়া করে একটি করাল অন্য একজনকে দিয়ে। সবমিলিয়ে ফল ৭-১। বয়েজ ক্লাব এবং মন্টু ভাইয়ের গর্বের সমাধি।
এন্টু ভাই বুঝলেন বল নয়, মাঠ নয়। এর মধ্যে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। অন্য কিছু। রতন যা খেলেছে এই পর্যায়ে কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এটা সম্ভবই নয়। আর যে এর আগে ঠিকমতো বলে লাথিই মারেনি তার পক্ষে তো অসম্ভবেরও বেশি কিছু।
রফিকও জানলেন, রহস্যটা বলে নয়। অন্য কিছুতে। সেটা বললেনও সাংবাদিকদের। এই কয়েকদিনে রতনের খবর মুখে মুখে এত প্রচার পেয়ে গিয়েছিল যে আজ বেশি কয়েজন সাংবাদিক সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। ম্যাচ শেষে রতনের কাছে যেতে তাদের সমস্যা হচ্ছিল, রতন তখন হাজার মানুষের ভীড়ে। রতনের অভিভাবক হিসেবে রফিক উপস্থিত। তাকেই সাংবাদিকটি ধরলেন, আচ্ছা আপনি তো ওর কাকা! ওর এই ফুটবল প্রতিভার খবর আপনারা প্রথম কবে জানলেন!
পরশু দিনের আগের দিন।
জানার পর কি করলেন?
তেমন কিছু করিনি। শুধু দেখলাম।
অনেকে এটাকে রহস্য মনে করছেন? আপনি কি মনে করেন..হঠাৎ করে…
আমিও রহস্য মনে করেছিলাম। কেউ কেউ ভেবেছিল বলটার জন্যই হয়ত! ওর দুটো বল কাল রাতে আমাদের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু আজ তো প্রমাণিত হয়ে গেলো!
তাহলে কি এটাকে স্বাভাবিক প্রতিভাই মনে করছেন?
রফিক এখনও রহস্য মনে করেন, কিন্তু এই রহস্যভেদ করতে চান তিনি একা। অন্য গোয়েন্দারা লেগে যেতে পারে পাছে, তাই তিন বললেন, আমার মনে হয় এখন এই প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহার কী করে করা যায় সেটা নিয়েই আমাদের ভাবা উচিত। এই দেশে প্রতিভাবানদের প্রতিভার মর্যাদা ঠিক দেয়া হয় না। আমার কথাই ধরুন…
ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাটি মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে। আমি আজই ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির সঙ্গে বসব।
সাংবাদিকটিও বললেন,আর আপনাদের চিন্তা নেই। ও এখন জাতীয় সম্পদ।
একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী রতনকে নগদ ২০ হাজার টাকা পুরষ্কার হিসেবে তুলে দেন।
ঈুরষ্কারের টাকাটা রতন হাতে নিয়ে ফিরে এলে, বদরুল ফিসফিস করে বলেন, আমার কথাটা ভুলিস না। সাক্ষাৎকারে বলিস। কত বছর ধরে প্রমোশন হয় না।
রতন শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। যেমন হওয়ার কথা সব তেমনই হচ্ছে। কিন্তু তার পরেরও যে আরেকটি অধ্যায় আছে।
এখানে রতন সবাইকে সঙ্গী হিসেবে পাবে। কিন্তু ওখানে যে সে একা!
রতনের চোখে পানি চলে আসে।
সবাই আনন্দের অশ্র“ ধরে নিয়ে আরও জোরে স্লোগান দেয়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে।
রতনের কিছু কানে যায় না। তার মনে মনে কে বা কারা যেন বলে দেয়, সময় কমে আসছে রে রতন! সময় কমে আসছে !

(চলবে………………………)

২,৪১৯ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “ম্যাজিক বয় – ০৩”

মওন্তব্য করুন : কামরুলতপু (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।