ম্যাজিক বয় – ০২

ম্যাজিক বয় – ০১
২.
রতনের কাকা রফিকুর রহমান বললেন, ভাত বন্ধ করে দিলেই হয়।
রফিকুর রহমান বিশ্বাস করেন যে কোনো সমস্যার সবচেয়ে বড় সমাধান, যে কোনো পাপের সবচেয়ে কার্যকর শাস্তি হলো ভাত বন্ধ করে দেয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র ছিলেন, সে হিসেবে তার চরিত্রে দার্শনিকতা প্রচুর ছিল, তিনি জুতো-প্যান্টের সঙ্গে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। কেউ বিশেষ দোষ ধরত না, দর্শনের ছাত্র এক-আধটু পাগলামি তো করবে তো! জগতের সব পাগলামির দায়িত্ব শুধু পাগলদের হাতে চাপিয়ে দিলে ওদের ওপর চাপটা একটু বেশি পড়ে যাবে না!

তা সুযোগে চূড়ান্ত পাগলামিটা তিনি করলেন অনার্স পরীক্ষার আগের দিন। সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, পরীক্ষাটা দিচ্ছেন না।
শফিকুর রহমান বললেন, পরীক্ষা দিচ্ছিস না মানে কী! প্রস্তুতি খারাপ?
প্রস্তুতি খারাপ হবে কেন? আমি কি খারাপ ছাত্র। এখনও প্রথম দুই বছরের নাম্বার যোগ করলে আমার ধারে-কাছে কেউ নেই।
তাহলে? আগামী বার পরীক্ষা দিবি।
না। আগামী বারও দেবো না।
তাহলে কয় বছর ড্রপ দিবি?
সারাজীবন। আর কোনোদিন আমি পরীক্ষায় বসবো না।
কেন?
কারণ আমি যা জানি সেটা মূল্যায়ন করার মতো কোনো শিক্ষক আমার ডিপার্টমেন্টে নেই।
তাহলে কি তোর পরীক্ষার জন্য অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজে যেতে হবে?
তা হয়ত যেতাম কিন্তু সেখানেও যে তেমন শিক্ষক আছেন তারই বা কি নিশ্চয়তা!
সেই নিশ্চয়তা তাকে কেউ দিতে পারেনি, কাজেই সব বাদ দিয়ে তিনি এখন বিছানায় শুয়েছেন। শুয়ে জটিল জটিল সব প্রবন্ধ লেখেন। সেগুলো কেউ বুঝে না। না বুঝলে তিনি হাসেন। তার কাছাকাছি বোধশক্তির কেউ যে এই দুনিয়ায় বিরাজ করছে না সেটা জেনে আরও জটিল সব লেখা লেখে যান।
আর মাঝে-মধ্যে ঘোষণা করেন, ভাত খেয়ে খেয়েই এই জাতির এই অবস্থা। ভাত বন্ধ করে দিলেই সব ঠিক।

ম্যাজিক বয়- মোস্তফা মামুন

ম্যাজিক বয়- মোস্তফা মামুন


কাজেই রতনের ফুটবলজনিত অপরাধের শাস্তিও হলো ভাত বন্ধ। কাজের বুয়া শেফালির কাছে সেটা শুনেই হুংকার দিয়ে বললেন, আজ থেকে ওর ভাত বন্ধ।
বুয়া শেফালি বাড়িতে কোনো একটা ঝামেলা দেখলেই খুশি হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে ওর লাগালাগি হলেই তার স্বর্গসুখ। তখন তার গুরুত্ব বেড়ে যায়। যেদিন রতনের বাবা-মায়ের ঝগড়া হয় সেদিন যে সে যে শাড়ির তলায় লুকিযে ভাত নিয়ে যাচ্ছে সেটা আর কেউ খেয়াল করে না।
কাল রাতে গরুর কলিজা রান্না হয়েছে। রয়েও গেছে অনেক। তার পুরোটাই আজ সে নিয়ে যেতে পারবে। এজন্য দরকার নাটকটা আরও জমানো। এবং জমাতে হলে কাকাকে ঠেলে-ঠুলে বাইরে নিয়ে যেতে হয়।
সে একটু পর ফিরে এসে বলল, কাকা কেউ তো আপনার কথা মানছে না। আমি বললাম কাকা বলেছে ভাত বন্ধ করে দিতে।
তারপর?
খালা ধমকে উঠল।
কী আমাকে ধমক দিল!
দিল তো!
তারও ভাত বন্ধ।
সেটা ঠিক আছে। কিন্তু উনারা তো খেয়ে ফেলেছেন।
খেয়ে ফেলেছে। তা হলে তো সমস্যা হলো।
সমস্যা ধরলেই সমস্যা। আপনি দুপুরে খাওয়ার আগে গিয়ে ভাতটা উল্টে ফেলে দিলেই হয়!
ভাল বলেছিস। কিন্তু ভাত ফেলে দিলে মেঝে নোংরা হয়ে যাবে না!
আরে সেজন্য তো আমি আছি।
তাও ঠিক। তুই তো আছিস।

কাকা ঘর থেকে বেরোনোর আগে মাথায় হ্যাট চাপিয়ে নেন। কেন যে তার মনে হয় কোনো গুরুতর কাজে যাওয়ার আগে মাথায় হ্যাট থাকা উচিত। আর হ্যাটের সঙ্গে ঠিক ফুল-প্যান্টটা মানায় না। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরতে হয়। পছন্দের পোষাকটা চাপিয়ে কয়েকটা বুকডন নিয়ে নেন। শরীরকেও সব কাজে প্রস্তুত রাখা দরকার। এদেশের মানুষ ভাত খাচ্ছে এবং শরীরের যতœ নিচ্ছে না। দুয়ে মিলে দেশটা একেবারে রসাতলে যাচ্ছে।

বাইরে বেরিয়ে তিনি যে দৃশ্যটা দেখলেন সেটার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না। পৈতৃক সূত্রে তারা যে বাড়িটা পেয়েছেন তার সামনে অনেকখানি ফাকা জায়গা। দুই ভাইয়ের কেউই ঠিক বাস্তবমুখী নয় বলে ওই ফাকা জায়গাটা ফাকাই আছে। কোনো স্থাপনা নেই। এই খালি মাঠটাই হয়ে গেছে একেবারে ফুটবল মাঠ। প্রচুর দর্শক। তাদের দম ফাটানো হাততালি। এর মাঝখানে মধ্যমনি হযে দাঁড়িয়ে রতন। দাঁড়িয়ে ঠিক নয়। সে একটা বল নিয়ে নানান কসরত করছে।

খেলাধুলা রফিকের বিষয় নয়। ওটাকে শারীরিক শক্তির অপ্রয়োজন ক্ষয় এবং মুর্খদের অকারণ আনন্দের বিষয় বলে তিনি চিরকাল মনে করে এসেছেন। বিশেষত ফুটবলটা তিনি একেবারে সহ্যই করতে পারেন না। একটা বল নিয়ে ২২ জনের দৌড়-ঝাঁপ করাটা তার কাছে অযৌক্তিক।
তিনি চিৎকার করে বললেন, এখানে কী হচ্ছে?
ভাবী মানে রতনের মা বললেন, দেখছো না কী হচ্ছে? আমাদের রতনের কীর্তি দেখো!
কীর্তি বলতে রতন একটা বল নিয়ে লাথালাথি করছে। এই লাথালাথি দেখে এত ফুর্তির কী আছে সেটা ভেবে পেলেন না। কিন্তু সমবেতরা এমন তন্ময় যে তাদের কাছে তার উপস্থিতিও কোনো ব্যাপার নয় যেন। এমনকি তাকে বসতেও বলছে না।
স্কুলের গেমস টিচার বদরুলও চলে এসেছে। এক নম্বরের অপদার্থ লোক। খেলা খেলা করে জীবনটাকেই একেবারে ফাজলামি বানিয়ে দিয়েছে।
তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, মুর্খের দল তোমাদের এত খুশি কীসের? কাজ বাদ দিয়ে সবাই বল নিয়ে পড়ে আছো। বদরুল তোমার আক্কেল কোনোকালেই হলো না।
আক্কেলের কথা শুনে বদরুল ক্ষেপে উঠেন। ফুটবলের দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলেন, তোমার মতো বেআক্কেলের কাছ থেকে আমাকে আক্কেল শিখতে হবে।
কী আমি বেআক্কেল?
না। না। তুমি খুব জ্ঞানী। এখন বিরক্ত করো না তো!
কে একজন ফাজিল বলল, রফিক কাকা কি খেলবে নাকি? তোমার পোষাকটা তো…
এবার সবাইকেই খুব উৎসাহী দেখায়। হাততালিটা তার দিকে ঘুরে যায়। তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফুটবল মাঠে নামানোর সুস্পষ্ট চক্রান্ত।
তিনি এক দৌড়ে ভেতরে চলে আসেন। সারাজীবনই তিনি লক্ষ্য করেছেন দলবদ্ধ মানুষ সবসময়ই কুকর্মের দিকে বেশি মনযোগী। কিছুক্ষণ থাকলে ধরাধরি করে সবাই তাকে খেলতে নামিয়ে দেবে। এবং তারপর তাকে নানাভাবে অপদস্থ করে সেই গল্প এলাকার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে।
নিরাপত্তা বজায় রাখতে তিনি ফিরে আসেন ভেতরে। কিন্তু কৌত’হলটা থেকে যায়। আসলে কী হচ্ছে! ফুটবল খেলা তো টিভিতে-মাঠে নিয়মিতই দেখানো হয়। কই এত লোক তো ভীড় করে না। ভাসা ভাসা তার কানে খবর এসেছে আজকাল বাংলাদেশের লোকজন ফুটবলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাহলে ব্যাপারটা কী!
শুনতে পান অপদার্থ বদরুল বলছে, সাংবাদিক এসেছে নাকি?
সাংবাদিক হিসেবে কে একজন আত্মপ্রকাশ করে।
বদরুল ধমক দেন, এই সাংবাদিকে হবে না! টিভি সাংবাদিক লাগবে। একটা ছবিতে কী এর মাহাত্ম্য বোঝা যাবে।
টিভি সাংবাদিক কাউকে দেখা যায় না।
একজন বলে, এক কাজ করি স্যার। আমার একটা ভিডিও ক্যামেরা আছে, ওটাতে তুলে টিভিতে পাঠিয়ে দেই।
বদরুলের প্রস্তাবটা মনে ধরে। নিয়ে আয় তো ভিডিও ক্যামেরা।
ভিডিও ক্যামেরা আনতে কয়েকজন ছুটে যায়।
বদরুল বলে, আচ্ছা জাগলিং তো অনেক দেখলাম। তোরা কি জানিস এই যে ম্যারাডোনা তার খেলোয়াড়ি কীর্তি শুরু হয়েছিল জাগলিং দিয়ে।
দেখা গেলো কেউ জানে। কেউ জানে না। অবশ্য বদরুল নিজেই জানেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মিথ্যা কথা নির্দ্বিধায় সত্য বলে চালিয়ে দেয়ায় তার একটা খ্যাতি আছে।
বদরুল আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলে যান, ম্যারাডোনারা ছিলেন খুব গরীব। বাবার ফুটবল কিনে দেয়ার সামর্থ্য ছিল না। একটা চটের তৈরি বল দিয়ে ম্যারাডোনা মনের আনন্দে বলকে লাথি মারতে থাকল আর সবাই অবাক হয়ে দেখল বল যেন তার পোষ মানা পাখী। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস।
বদরুল ঠিক এমন জায়গায় এনে গল্পটা ছেড়ে দেন। তাতে দর্শকরা বিশ্বাস করছে কিনা বোঝা যায়। যদি বিশ্বাস করে তাহলে বলবে, এরপর…। নইলে আর কেউ কিছু বলবে না।
তার গল্পে সাধারণত কেউ ইতিহাসটা আর ঠিক জানতে চায় না। তিনি কিছু মনে করেন না। কারণ শতকরা ৮০ ভাগ গল্পই তার বানানো। কিন্তু আজ কেউ আর কিছু জানতে চাইছে না বলে তার মন খারাপ হয়। কারণ এই গল্পটা সত্যি। সত্যিই ম্যারাডোনার কৃতিত্ব শুরু হয়েছিল জাগলিং দেখানোর মধ্য দিয়ে। তার যাদু দেখে বড় ম্যাচগুলোর হাফ টাইমে দর্শকদের আনন্দ দিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হতো মাঠে। সে এমনই যাদুমখা কায়কারবার যে অনেক সময় খেলা শুরুর বাঁশি বাজলেও দর্শকরা তাকে ছাড়তে চাইতো না। অন্যদিন হলে এই ইতিহাস এবং শিক্ষাবিমুখ তরুণ প্রজন্ম নিয়ে তিনি অনেক আফসোস করতেন। কিন্তু আজ আফসোসের চেয়ে বেশি হলো বিস্ময়। এই ছেলেটা এমন করছে কীভাবে! রতনকে সবাই দুষ্ট দার্শনিক বলে জানে। একা একা নানান কাণ্ডকীর্তি করে। প্রথমে শুনে তিনি ভেবেছিলেন এটাও তেমন কোনো বদমাইশি হবে। হতে পারে তাকে ফাঁদে ফেলার কোনো কৌশলও। স্কুলের বদমাশ খেলাধুলাবিমুখ ছেলেগুলো তাকে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টার কোনো ত্র“টি করছে না। তিনি প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। বলতে নেই, তার জামার নীচে একটা জালি বেতও নিয়ে এসেছিলেন। তিনি অবশ্য ইতিহাসের শফিক স্যারের মতো যত্রতত্র বেত ব্যবহার করেন না। ছাত্রদের মেরে তিনি আনন্দ পান বটে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি আনন্দ হয় ওদেরকে বোকা বানাতে পারলে। তার ইচ্ছা ছিল ওদেরকে বোকা বানাবেন, প্রমাণ করে দেবেন এসবই ফাজলামি, তাই সদলবলে এসে ঘোষণা করেছিলেন, কোথায় রে রতন! আয় একটু খেলা দেখা দেখি! তুই নাকি যাদুকর সামাদ হয়ে গেছিস!
রতন বেরিয়ে এল। চেহারায় কেমন যেন একটা অসহায় ভাব, দেখে তার লড়াইয়ের ইচ্ছাটা মরে গেলো। চেহারার মধ্যে অন্তত তাকে ফাঁদে ফেলার কোনো ভাব নেই। তবু অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সতর্ক।
বললেন, দেখা দেখি একটু কসরত। আমি দশ এর মধ্যে মার্কিং করব। যদি ৫এর কম পাস তাহলে কিন্তু খবর আছে।
রতনের যেন খুব ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু বন্ধুরা সবাই এমন হাততালি দিল যে তার আর উপায় থাকল না।
রতন বল নিয়ে জাগলিং শুরু করল। তিনি ম্যারাডোনার জাগলিংয়ের গল্প শুনেছেন। দেখেননি। এখন মনে হল চোখের সামনে দেখছেন।

অবিশ্বাস্য কন্ট্রোল। পায়ে যেন চুম্বক লাগানো। বলটা সে যেমন ইচ্ছা মারছে, যত ইচ্ছা উপরে তুলছে, কিন্তু তাতেও সমস্যা নেই কোনো, ঠিকই ফের তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। অনেকেই এমন জাগলিং জানে, সার্কাসে দেখেছেন, তাছাড়া এদেশেও একজন বল মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে বলে তিনি শুনেছেন, কিন্তু সেগুলো ছিল গভীর অনুশীলনের ফল, রতনের তো ফুটবল নিয়ে কোনো তপস্যার খবর তিনি জানেন না। আর তার জানার বাইরে এই অঞ্চলের কোনো ক্রীড়া প্রতিভার বিকাশের খবর নেই। তাহলে!
কে একজন যেন মাঝখানে বলল, স্যার কতো পেল!
তিনি তন্ময় হয়ে দেখছেন।
রতন যেন এখন অন্য জগতের মানুষ। তার শরীরের ভাষার মধ্যে মানুষের চেয়ে অশরীরি ব্যাপারটাই বেশি। তিনি খানিকটা ভয়ও পেলেন।
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, স্যার কত পেল? দশে দশ?
দশে একশ।
কথাটা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল বটে, কিন্তু সেটাই সত্য কথা। দশে একশোই হবে।
এখন এটার প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিভিশনে লাইভ দেখাতে পারলে ভালো হত। কিন্তু টিভিতে কী করে ফোন করতে হয় সেটা তিনি জানেন না। পত্রিকা দেখে একজন পত্রিকায় ফোন করেছিল, ওখান থেকে বলা হয়েছে, এখন রিপোর্টার নেই। ছবি তুলে পাঠিয়ে দিতে। নিশ্চিত ওরা বিশ্বাস করছে না। তিনিও কি বিশ্বাস করছিলেন! এসেছিলেন তো বেত লুকিয়ে। ওকে আচ্ছামতো পেটাতে।
ছবি তোলা হলে তিনি বললেন, জাগলিং তো হলো। কিন্তু ওটা ফুটবলারের বিষয় নয়। ওতে কন্ট্রোল বোঝা যায় বটে, তবু সার্কাসের লোকজনও ওটা পারে। রতন দেখা তো দেখি একটু ড্রিবলিং।
রতন আবার অসহায়ভাবে তাকায়।
তিনি বলটা নিয়ে বলেন, আমাকে একটু কাটা তো!

বদরুল সাহেব এককালে জেলা ফুটবল দলের ডিফেন্ডার ছিলেন, একটা টুর্নামেন্টের ফাইনালে বিপক্ষ দল দেশসেরা ড্রিবলার ওয়াসিমকে নিয়ে এসেছিল, তিনিও তাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেননি। ম্যাচশেষে ওয়াসিম বলেছিলেন, তার মুখোমুখি হওয়া কঠিন ডিফেন্ডারদের একজন হিসেবে তিনি বদরুলের নাম মনে রাখবেন।
এখন বয়স হয়েছে। কিন্তু স্কুলের গেম টিচার হিসেবে অনুশীলনের মধ্যে আছেন এখনও, আজও তাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। বদরুল বলটা ওর পায়ে দিয়ে নেমে গেলেন এবং অবাক হয়ে দেখলেন রতন চোখের পলকে তাকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। এত অবিশ্বাস্য ইনসাইড ডজ এবং এমন ক্লোজ কন্ট্রোল যে তিনি ছিটকে পড়ে গেলেন। দ্বিতীয় দফায় সে করল আউটসাইড ডজ, বদরুল যেন চোখে সর্ষে ফুল দেখলেন। আগেরবারের প্রস্তুতির কারণে এবার ছিটকে পড়া এড়ালেন বটে, কিন্তু বুঝতে পারলেন যে রতনকে ঠেকানো তার একার কর্ম নয়। তিনি ইঙ্গিতে তার কয়েকজন শিষ্যকে ডাকলেন। সবাই দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু হলে কী হবে! রতন যা ইচ্ছা তাই করছে। যাকে যেমন ইচ্ছা কাটাচ্ছে। ৮-১০ জন কিছুই যেন কিছু না। বল পায়ে লেগে আছে চুম্বকের মতো, রানিংয়ে চিতার গতি, বডি ডজ দিচ্ছে সবাইকে হা করিয়ে রেখে। সে এক দেখার দৃশ্য। রতন বল পায়ে যা খুশি করছে, আর ৮-১০ জন তার পিছু ছুটছে কিন্তু কোনো কুল-কিনারা পাচ্ছে না।

রফিক কাকা এতক্ষণ জানালা দিয়ে এসব মানেহীন কায়কারবার দেখছিলেন, ড্রিবলিং পর্বটা শুরুর পর খানিকটা উৎসাহ পেয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন, রতনের কীর্তিমুগ্ধ হিসেবে নয়, বদরুলের খুব শিক্ষা হচ্ছে বলে, তার ভূ-পতনটাতে তিনি ভীষণ মজা পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন এই ৮-১০ জনকে রতন যেভাবে নাচাচ্ছে তা দেখে তিনি সত্যিই বিস্মিত।
মানুষকে তিনি গাধার পোষাকী সংস্করণ বলে ধরে এসেছন এতকাল, মানুষের কাণ্ড-কীর্তি তার কাছে অকারণ এবং অপ্রয়োজন মুর্খামি, সেই তিনি আজ এত বছর পর একজন মানুষের কীর্তিতে মুগ্ধ।
আর উৎসাহও খুঁজে পান তিনি। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ তার আপাত বৈশিষ্ট্যহীন ভাতিজাটি কী করে এমন কীর্তিমান হয়ে গেল? কোন কলকাঠির জোরে? রহস্যের গন্ধে ভরে ওঠে নাক! রহস্যভেদের চেষ্টা করবেন নাকি!
বহু বছর পর পার্থিব কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ হচ্ছে।

বদরুল এখন একটা বক্তৃতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার খালি গলাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু কে একজন যেন একটা মাইকেরও ব্যবস্থা করে ফেলেছে। বদরুল ঘোষণার স্বরে বললেন, গত এক ঘণ্টা যা হলো তাতে আমি নিশ্চিত আমাদের রতন এখন এই তল্লাটের সেরা ফুটবলার। রতনকে সঙ্গে নিয়ে খেললে আমাদেরকে কেউ হারাতে পারবে না।
জনতার মধ্যে উল্লাসধ্বনি উঠল।
বদরুল বলে চললেন, এই অঞ্চলের সবচেয়ে সেরা ফুটবল দল হচ্ছে নিউ ইস্কাটন বয়েজ ক্লাব। গতবার তারা আমাদের স্কুল দলকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। এবং সেই চ্যালেঞ্জের ম্যাচ খেলতে গিয়ে আমাদের অপমানিত হতে হয়েছিল।
সবাই চুপ করে থাকে। সত্যি সে বড় অপমানের কথা। তারা হেরেছিল ৫-০ গোলে, তারচেয়েও বড় কথা ম্যাচশেষে বয়েজ ক্লাবের সমর্থকরা বদরুলের বিরুদ্ধে অপমানজনক স্লোগান দিয়েছিল। ‘হৈ-হৈ-রৈ-রৈ, বদরুলের দল গেলো কই।’ বদরুল লজ্জায় কয়েকদিন এলাকায় মুখ দেখাতে পারেননি। নৈমত্তিক ছুটি নিয়ে তিনদিন ঘরে লেপের নীচে শুয়েছিলেন। জীবদ্দশায় এই কলংক ঘুচবে না বলেই মনে হয়েছিল তার, কিন্তু আজ রতনের পায়ের ম্যাজিকে তিনি সব অপমান ফিরিয়ে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর।
হাততালি উঠল, ‘অপমানের বদলা চাই। বয়েজ ক্লাবের রক্ষা নাই।’
স্কুল টিমের ক্যাপ্টেন বিদ্যুৎ বলল, আজই আমরা গিয়ে বয়েজ ক্লাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসি।
বদরুল হাত তুলে থামিয়ে বললেন, আজই না। এখনও কিছু কাজ বাকি। এতক্ষণ আমরা রতনের কারিশমা দেখলাম, কিন্তু টিম গেমে সে কেমন সেটা দেখতে হবে। এই ড্রিবলিংয়ে কারো দাঁড়াতে পারার কথা না, কিন্তু রতন যা করছে তাতে টিমমেটরাও সম্ভবত দাঁড়াতে পারবে না। কাজেই তোদেরও ওর সঙ্গে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আজ বিকালে আমরা মাঠে দুই দল খেলব। তারপর ওখান থেকেই গিয়ে বয়েজ ক্লাবকে চ্যালেঞ্জ জানানো হবে।
এমন হাততালি শুরু হল যে মনে হচ্ছিল কোনোদিন বুঝি থামবে না। শেষে থামল। থামার পর স্লোগান উঠল, ‘রতনকে পেয়েছি ভাই। বয়েজ ক্লাবের রক্ষা নাই।’
স্লোগান দিতে দিতে দলটা রাস্তা পেরিয়ে মাঠের দিকে এগোতে থাকল।

(চলবে………………)

১,৬৭১ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “ম্যাজিক বয় – ০২”

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।