বিশ্বকাপ ডায়রি-০১

ম্যান্ডেলার শেষ ম্যাজিকটা এবার দুনিয়া দেখবে।
যিনি বলছেন, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কাস্টমস পুলিশের চাকুরে। নিজের পুলিশ পরিচয়টা অহঙ্কারের সঙ্গে একমাত্র বাংলাদেশি পুলিশই দিয়ে থাকে বলে ধারণা ছিল। পরশু জোহানেসবার্গের ওলিভার টাম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধারণাটা বদলে বাংলাদেশি পুলিশের চেহারায় দাঁড়াল ওই তরুণ। ব্যাগপত্র সব নাকি চেক করবে। যতই বুঝিয়ে বলা হলো, ইতিমধ্যে একাধিকবার চেক করা হয়েছে এবং তাতে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি এবং যাবেও না, তবু সে অনড়। ব্যাগ দেখেই ছাড়বে।
এসব ক্ষেত্রে পাসপোর্ট এবং তাতে কাস্টমস বিভাগের সিল দেখিয়ে দিলে রক্ষা মেলার কথা। কিন্তু দেখাতে সাহস হলো না। কারণ, পাসপোর্টের রংটা সবুজ, গায়ে লেখা বাংলাদেশি, সেটা আরো বেশি সন্দেহজনক। এমিরেটস বিশ্বকাপের অফিসিয়াল পার্টনার, কাজেই ফিফার চিঠি মানেই চিচিং ফাঁক, সঙ্গে আরব সুন্দরীর মোহনীয় হাসি। কাজেই দুবাইতে এমন পরিস্থিতিতে নির্দ্বিধায় নিজের পাসপোর্ট এবং কাগজটা বাড়িয়ে দিলাম। এই পাসপোর্ট অনেক কিছু করতে পারে জানতাম, কিন্তু একজন তরুণীর হাসি এমন কেড়ে নিতে পারে, জানা ছিল না। সে মুখ শক্ত করে বলল, তুমি ওই পাশে গিয়ে দাঁড়াও। এবং আমার জন্য সে একা যথেষ্ট হবে না মনে করে এক বিশালাকার হাবশিকে ধরে নিয়ে এল। সে কিছু বলে না, শুধু আপাদমস্তক আমাকে দেখে। অপরাধ না জেনেও আমি অপরাধ মেনে যেন দাঁড়িয়ে আছি। বাংলাদেশি হওয়াটাই একটা অপরাধ। এসব জায়গায় স্যার বললে খুব কাজ হয় বলে আমরা বাংলাদেশিরা মনে করি। আমিও বিগলিত হয়ে বললাম, স্যার কোনো সমস্যা?
কোনো সমস্যা কি না, সেটা তোমাকে বলার দরকার দেখছি না।
সমস্যাটা জানলে হয়তো…
তোমার এখন জানা লাগবে না। সমাধান হলে জানবে।
সেটা সমাধান হতে খুব বেশি সময় লাগল না। এবং আদৌ হলো কি না, বুঝলাম না। লোকটি পাসপোর্ট কিছুক্ষণ উল্টিয়েপাল্টিয়ে দেখে তাতে ধরার কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে চেয়ে থাকল। তারপর হতাশ ভঙ্গিতে ফিফার দেওয়া চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করল বাচ্চাদের মতো প্রায় শব্দ করে। তারপর বলল, তার মানে তোমাকে ওখানে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
জি।
তাহলে যাও।
এমন ভঙ্গিতে যেতে বলল, যেন ঘর থেকে বারান্দায় যেতে বলা হচ্ছে।
আমি আবার ‘স্যারটার’ বলে বেরিয়ে এসে নয় ঘণ্টার জার্নি করে জোহানেসবার্গে। বড় কোনো প্রতিযোগিতায় বিমানবন্দরে প্রতিযোগিতার মাহাত্দ্য বর্ণনা করা নানান ব্যানার, হোর্ডিং থাকে। এসে দেখেই যেন লোকের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এখানেও আছে। ম্যান্ডেলা ট্রফি হাতে নিয়ে হাসছেন, প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা ‘দেখিয়ে দেব’ ভঙ্গিতে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে, ইংরেজি-আফ্রিকানস-জুলু নানান ভাষায় খিচুড়ি বেশ কিছু বাণী। কিন্তু সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে যেন আরো চোখ ধাঁধানো চেহারা আশা করেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে কিছু ওভারব্রিজে দেখা গেল কালো শ্রমিকরা মইটই লাগিয়ে কী সব করছে। সঙ্গী দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভদ্রলোক খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, পতাকা লাগাচ্ছে। এভাবে সব দেশের পতাকা লাগানো হবে।
লাগানো হবে! এখন! এতদিন পর! যখন আমাদের বাংলাদেশ পুরো পতাকারাজ্য হয়ে গেছে। বিশ্বকাপে এসে মূল যজ্ঞে ঢোকার আগে মনে হলো, আমাদের এই সবুজ পাসপোর্ট মূল্যহীন হতে পারে, এর জন্য নানান বিড়ম্বনা সইতে হয়, তবু কোনো কোনো জায়গায় আমাদের দেশ অনেককে হারিয়ে দিয়ে বসে আছে। সমস্যা একটাই, ওই দেশের মানুষরাই তা জানে না। কাল অ্যাক্রিডিটেশন নিতে গিয়ে, বাংলাদেশি সাংবাদিক পরিচয় যার কাছে দেওয়া হলো তিনিই বললেন, ‘তুমি বিশ্বকাপে, তোমাদের দেশ…।’ না, আমাদের দেশ সুযোগ পায় না, ভবিষ্যতেও হয়তো পাবে না, কিন্তু কাল এই প্রশ্নের উত্তর মাথা নিচু করে দিইনি। বিশ্বকাপে না যেতে পারলেও বিশ্বকাপের গৌরব ধারণ করায় আমরা তো কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। অল্পবিস্তর ইংরেজি জানা এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক কথায় কথায় বললেন, তিনি বাংলাদেশকে মানচিত্রে দেখেছেন, তাঁর ভারতে যাওয়ার খুব শখ।
ভারতে যাওয়ার শখ হলে ভারতে যাও। বাংলাদেশেও ঘুরে এসো।
কেন?
বিশ্বকাপ উপলক্ষে তোমার দেশে কতটা ব্রাজিলিয়ান পতাকা উড়ছে? পাঁচ লাখ, দশ লাখ?
হবে এ রকম! কেন বলো তো?
কারণ আমার ধারণা ব্রাজিলের চেয়েও বাংলাদেশে এবার বেশি ব্রাজিলিয়ান পতাকা তৈরি হয়েছে।
তাই নাকি!
ঠিক তাই।
কোনো আর্জেন্টাইন সাংবাদিকের দেখা পাইনি, পেলে তাঁকে জানাতাম, তাঁর দেশে যত আর্জেন্টিনার সমর্থক আছে, তার চেয়ে বাংলাদেশে সংখ্যাটা বেশি। আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার চেয়েই যে বাংলাদেশে বেশি লোক আর্জেন্টিনার সমর্থক। সেই আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বেশির ভাগই খুব উগ্র বলে একটা প্রচার আছে, তা খানিকটা সত্যও, কিন্তু আসল আর্জেন্টিনায় তার চেয়েও অনেক উগ্র একটা দল আছে। এদের নাম বারাব্রাভা। এরা ফুটবল সমর্থক, কিন্তু হতে চায় নির্ধারক। তারা চায় খেলোয়াড়রা একেবারে তাদের চাহিদামতো খেলুন, তা সব সমর্থকই চায়, কিন্তু এ জন্য তারা শক্তি প্রয়োগ করে। খেলোয়াড়ের বাসায় হাজির হয়ে জানিয়ে যায়, কাল গোল না করলে মাঠ থেকে ফিরতে পারবে না। মাঝেমধ্যে খেলোয়াড়দের বাবা-ভাইদের এরা অপহরণ করে এবং তাদের মুক্তিপণের দাবিটা হয় এ রকম, তুমি যদি এই ম্যাচে একটা গোল করতে পারো তাহলে…। কাজেই এদের দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল আগেই। তবু ফাঁক গলে পরশু রাতে একটা দল ঢুকে পড়তে চাইছিল। বিমানবন্দরেই পাকড়াও করে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে যখন তখনই ঘটনাচক্রে আমাদের বিমানের অবতরণ। ওদের ভাষা বিচিত্র, বিষয়টা তখন পরিষ্কার হলো না, মনে হলো বিশ্বকাপের স্বাভাবিক উত্তেজনার অংশ, পরে জানলাম এরাই সেই কুখ্যাত বারাব্রাভা দলের সদস্য। আর্জেন্টাইন খ্যাতিমান তারকাদের দেখার আগে কুখ্যাত সমর্থকদের দেখা হয়ে গেল! এরপর বেরিয়ে সেই পুলিশ, যে ব্যাগপত্র পরীক্ষা করে নিজের পুলিশি জাহির করতে চায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এখানে যেকোনো সমস্যা থেকে রক্ষায় একটা উপায় হলো, ম্যান্ডেলার নামটা সামনে নিয়ে আসা। পুলিশ অফিসারকে তাই বললাম, নো পিকচার অব ম্যান্ডেলা! আই হ্যাভ নট সিন ইয়েট!
ইউ লাইক ম্যান্ডেলা!
ইয়েস।
সে তাঁর সঙ্গে এগোতে নির্দেশ করে একটা জায়গায় এল, যেখানে ম্যান্ডেলার হাতে বিশ্বকাপ ধরা ছবি।
সে মুগ্ধ চোখে ছবিটার দিকে চেয়ে বলল, ম্যান্ডেলা এবার আমাদের শেষ ম্যাজিকটা দেখাবেন।
কী সেটা?
তিনি আমাদের বিশ্বকাপ জেতাবেন।
একটা ধাক্কা খেলাম। জানি দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ জিতবে না, তবু কিছু বলা গেল না। তাঁর আশাটা মিথ্যা, কিন্তু ভক্তিটা তো সত্যি।
নেলসন ম্যান্ডেলা নামের এই মানুষটি বাস্তবে থেকেও কল্পকথার নায়ক। বিশ্বমানবতা তাঁর কাছে অনেক ঋণী এবং মানবতার হয়ে ফিফা সেই ঋণ শোধের দায় থেকেই হয়তো বিশ্বকাপটা উপহার দিয়েছে তাঁকে। তাঁর দেশকে।
এখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ। শরীর-স্বাস্থ্য এমনই গোলমেলে যে সশরীরে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকা না থাকা নিয়ে একেক দিন একেকরকম খবর বেরোয়। তবু সেই ম্যান্ডেলাই প্রাক বিশ্বকাপ নায়ক। দক্ষিণ আফ্রিকার আয়োজনগত অক্ষমতা, নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা, আর্থিক অসহায়তা এ সব কিছু যতবার প্রশ্ন হিসেবে এসেছে ততবারই সামনে দাঁড়িয়ে গেছে ম্যান্ডেলার বিরাট ছায়া। কখনো সশরীরে, কখনো অশরীরে। ব্যস। সব সমস্যা শেষ। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতানো!
না। জেল খেটে, ত্যাগ করে, বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বকাপ জেতানো যায় না। বিশ্বকাপ জেতায় পায়ের জাদু। সেই জাদুকরদের লড়াই এটা। মেসি-কাকা-রোনালদোরাই এখানে নায়ক, সেই নায়কদের পদভারে আগামী এক মাস কাঁপবে গোটা দুনিয়া। এবং ম্যান্ডেলার দেশেই নতুন নায়ককে আমরা দেখব ১১ জুলাই।
দেখবেন, ১১ জুলাই, ম্যান্ডেলা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় পূজা হবে কোনো ফুটবল নায়কের। ম্যান্ডেলার জীবদ্দশায় তাঁর চেয়ে বড় কোনো নায়ক দেখেনি দক্ষিণ আফ্রিকা, এবার দেখবে। বিশ্বকাপ ফুটবলই এমন এক শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্র যে তার শ্রেষ্ঠতম দল শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পরাশক্তিকেও পেছনে ফেলে দেয়। এবং তাঁর শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড় কিছুটা সময়ের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বীর কিংবা মানবিক নায়ককেও পেছনে ফেলে দেবে।
মহামতি নেলসন ম্যান্ডেলা, মানবতার প্রতিভূ ম্যান্ডেলা নিশ্চয়ই তাতে রাগ করবেন না!

মোস্তফা মামুন
জোহানেসবার্গ

১,৪০৬ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “বিশ্বকাপ ডায়রি-০১”

  1. শিরীন (৯৬-০২)

    ফুটবল কম বুঝি বলে এর দিকে টান কম । কিন্তু বিশ্বকাপ এলে ছোটবেলার সেই "কিছু না বুঝেই কোন এক দলকে সমর্থন" করার উন্মাদনাটা মনে পড়ে যায় । আমি সুবিধাবাদী হব বলে ঠিক করেছি । কি বলতে চাইলাম বলেন তো ? ঠিক ধরেছেন................. যে দল জিতবে আমি তার সাপোর্টার B-)

    জবাব দিন
  2. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল!
    ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল!
    ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল!
    ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল!
    ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল! ব্রাজিল!

    জবাব দিন
  3. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    মামুন ভাই,
    অনেক ধন্যবাদ। ব্লগে আরো লাইভ সম্প্রচারের অপেক্ষায় থাকলাম...।
    ও হ্যা...
    আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!!
    আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!!
    আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!!
    আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!! আর্জেন্টিনা!!!
    আরো লাগবে? 😡

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মশিউর (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।