জোয়ার্দারের কাণ্ড, মজুমদারের কীর্তি

১.
আনিস জোয়ার্দার পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, ঘরে কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। চোর হওয়াই স্বাভাবিক। তবু তিনি খুশি হয়ে ওঠেন। কারণ একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন। ঘুম ভাঙ্গাতে এখন আর স্বপ্ন নেই। চোর আছে বটে, কিন্তু চোরকে বধ করার কৌশলও তার জানা আছে। তিনি অভিজ্ঞতা থেকে জানেন চোরদের সঙ্গে একটু ভালো ব্যবহার করলে, একটু সুখ-দুঃখের কথা বললে ওরা ভড়কে যায়। আদর-সমাদর পেলে চোররা ভদ্রলোকের চেয়েও ভদ্রলোক।
আনিস জোয়ার্দার তাই কম্বলের তলা থেকেই বললেন কে-রে?
আমি?
আমি! বলি নাম-টাম একটা কিছু তো আছে নিশ্চয়ই।
নাম! তা আছে একটা। কিন্তু সুবিধার নয় বিশেষ। তাই খুব দরকার না হলে ব্যবহার করি না।
খুব খারাপ নাম নাকি? আমার নামও খুব সুবিধার নয়। এই যুগে কি জোয়ার্দার নামটা চলে? কলেজে পড়ার সময় বন্ধুরা নামের জন্যই পাত্তা দিত না। বলত, এই ১৪-১৫ বছরের একটা ছেলের নাম জোয়ার্দার হবে কেন? তাছাড়া উচ্চারণ করাও তো একটু কঠিন।
কিন্তু আপনার আনিস নামটা তো বেশ।
সেটাই তো সমস্যারে। এদেশে বন্ধু-বান্ধবরা সবসময় নামের খারাপ আর কঠিন অংশটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। আমার আনিস নামটা কী সুন্দর আর সহজ! কিন্তু ওদিকে কারও আগ্রহ নেই। সবার যত কাড়াকাড়ি জোয়ার্দার নিয়ে।
খুবই সত্য কথা। দুঃখের কথাও।
আমি কী করতে পারি বল। এটা বংশের টাইটেল। আমার তো এখানে করার কিছু নেই। আচ্ছা তুই কে বলতো!
আমার আবার বলার প্রশ্ন আসে কেন? আপনার কথাগুলো শুনতেই তো বেশ লাগছিল।
তা ঠিক বলেছিস। আমার কথা শুনে সবাই বড় পছন্দ করে। কিন্তু পুরো নামটা শুনলে…
নাম নিয়ে খুব সমস্যায় আছেন দেখছি।
ভীষণ সমস্যায়।
আমি সমস্যা সমাধানের একটা উপায় বাতলে দিতে পারি।
বলিস কী? তোর উপায় জানা আছে। বড় ভালো হয় রে। জানিস আমাকে পাড়ার ছেলেরা বলে ‘জোরদার চাচা’, চিন্তা কর কী বিকৃতি!
জোরদার তো ভালো শব্দ!
তা আমি পালোয়ান-শক্তিমান হলে মানাত। কিন্তু আমার বয়সী একটা ভীতু লোককে জোরদার বলবে। অন্যায় হয় না।
আপনাকে ভীতু বলে কে? কার এত সাহস!
আনিস জোয়ার্দার খুশি হন। কিন্তু তার একটু আগের স্বপ্নের কথাও মনে পড়ে যায়।
স্বপ্ন ইদানীং তাকে খুব বিরক্ত করছে। বলতে কী স্বপ্নের ভয়ে আজকাল তিনি ঘুমাতেও চান না। দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস ছিল আগে, বাদ দিয়েছেন। রাতের বেলাও যথাসাধ্য দেরি করেন। বই পড়ে সময় পার করার চেষ্টা করেন। অকারণে টিভি দেখেন। তবু একসময় ঘুম ঠিক চলে আসে। এবং তারপরই স্বপ্নের অত্যাচার। তাও একেবারে মাথামুণ্ডুহীন সব স্বপ্ন। আজ রাতে দেখেন তিনি একটা নদীর পাড়ে পড়ে আছেন। তিনি উঠতে পারছেন না। আর কয়েকটা ব্যাঙ তার আশে-পাশে লাফাচ্ছে। একটা আবার তার বুকের ওপর। তিনি হাত দিয়ে মারতে যান, হাত চলে না। বুকের ব্যাঙটি লাফ দিয়ে কী যেন বলে। অন্যগুলো আরও লাফায়। তাকে নিয়ে যেন কোনো খেলা চলছে। এই সময়ই শব্দ। তাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে ব্যাঙগুলোর হাত থেকে তিনি বেঁচেছেন। তাই খুশিও। চোর হলেও সে নিশ্চয়ই তার বুকের ওপর উঠে লাফাবে না। তাছাড়া তার ভাষাটাতো বোঝা যাচ্ছে। ব্যাঙের ক্ষেত্রে তো সে সুবিধাটুকুও নেই।
আনিস জোয়ার্দারের মন ভালো হয়ে যায়। তিনি ঘরের লাইটটা জ্বালাতে যান। কিন্তু লাইট জ্বালাতে গিয়ে দেখেন সুইচটা খুঁজে পাচ্ছেন না। লোকটা বাধা দিয়ে বলে, আপনি কি বাতি জ্বালাতে চাচ্ছেন নাকি?
জ্বি। চাচ্ছিলাম। তোর চেহারাটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমার চেহারাটাও নামের মতো খুব সুবিধার নয়। দেখলে আপনার কথা বলার রুচি হবে না।
বলিস কি? কেউ এসিড-টেসিড মেরেছিল নাকি?
জ্বি না। জন্ম থেকেই চেহারাটা খারাপ। আপনার তো তবু একটা সুবিধা আছে। নামটা বদলে নিতে পারবেন। আমার সেটাও নেই।
আজকাল না কীসব প্লাস্টিক সার্জারি-টার্জারির কথা শুনতে পাই।
ওসব আমাদের পক্ষে সম্ভব না।
ও। আচ্ছা তোর উদ্দেশ্যটা তো বললি না। চুরি-টুরি করতে এসেছিস নাকি?
উদ্দেশ্যের কথা না হয় পরেই জানলেন।
তা বাবা চুরি করলেও একটু রয়ে-সয়ে করিস। সব নিয়ে গেলে কাল ছেলের বউ বাড়ি ফিরে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। ঘুমাতেই পারব না।
না ঘুমালেই কি আপনার সুবিধা হয় না।
কেন? কেন? এ কথা বলছিস কেন?
মানে এই স্বপ্নের কথা বলছিলাম আর কী!
স্বপ্নের কথা। তুই জানলি কী করে?
জানার কথাটা না হয় থাক। কিন্তু ইদানিং তো স্বপ্ন আপনাকে খুব বিরক্ত করছে।
আনিস জোয়ার্দার উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তার এই স্বপ্ন যন্ত্রণার কথা শুধু তার ছেলের বউ জানে। এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন তাকে একটা বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে উল্টা করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তিনি পানি-পানি বলে চিৎকার করছেন। কিন্তু কেউ পানি দিচ্ছে না।
পরদিন ছেলের বউ রীতার কাছে স্বপ্নের কথাটা বললেন। রীতা খুব মন দিয়ে শুনে বলল, আপনি ঐ জায়গা থেকে পানির কথা বলছিলেন কেন?
পিপাসা পেয়েছিল মনে হয়।
কিন্তু আপনার তো পিপাসার চেয়েও বেশি ভয় হওয়ার কথা। আপনার বলা উচিত ছিল ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’। তা ন্ াকরে পানি চেয়ে আপনি খুব অন্যায় করেছেন। তাছাড়া ভেবে দেখুন ঐ জায়গায় কেউ আপনি পানি খাওয়াতে চাইলেও সে কী করতে পারত। আপনি কি ওভাবে উল্টা করে বাঁধা অবস্থায় পানি খেতে পারতেন।
আনিস জোয়ার্দারকে স্বীকার করতেই হল তিনি ওভাবে পানি খেতে পারতেন না।
রীতা বলল, তাহলে আপনি পানি খেতে চাইলেন কেন?
স্বপ্নে কী করেছি না করেছি! তাছাড়া আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
স্বপ্নে তার ভূমিকাটাকেই রীতা এমন অন্যায় এবং নির্বুদ্ধিতা হিসেবে প্রমাণ করতে শুরু করল যে এরপর আর তিনি কাউকেই তার স্বপ্নের কথা বলেন না। একা একা ভয় পান। এবং ঘুম থেকে উঠে সারাদিন ভুলে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।
লোকটি তাকে তাড়া দেয়, আপনি একেবারে চুপ মেরে গেলেন যে!
তুই আমার স্বপ্নের কথা জানলি কী করে! আমি তো কাউকে বলি না।
কাউকে না।
বলেছি শুধু রীতাকে।
রীতা মানে আপনার ছেলের বউ।
তাকেও চিনিস নাকি?
তা কম-বেশি কিছু মানুষকে তো চিনতে হয়।
বলিস কি বাবা তোকে তো এখন আমার সহজ মানুষ মনে হচ্ছে না!
ধরে নিন আমি কঠিন মানুষই।
কিন্তু তোর উদ্দেশ্যটা কি?
উদ্দেশ্যটা বলতে পারেন আপনাকে দেখতে আসা। অনেকদিন দেখা হয় না।
মানে কী! আগে কি তোর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল নাকি!
তা একসময় তো হতই।
তাই নাকি? দাঁড়া একটু মনে করে দেখি তো! তোর চেহারাটাও দেখা দরকার।
বললাম তো ভয় পাবেন। আপনার রুচিও নষ্ট হয়ে যাবে।
এ সময়ই বাইরে হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার হৈ-চৈ শোনা যায়। আনিস জোয়ার্দার উত্তেজিত হয়ে বলেন, হচ্ছেটা কি? তিনি ওঠার চেষ্টা করেন।
লোকটি থামিয়ে দিয়ে বলে, ওসব গোলমালে জায়গায় আপনার যাওয়ার দরকার নেই।
গোলমেলে জায়গা! ওখানে হয়েছেটা কী?
না তেমন কিছু না। সামান্য খুন খারাবি আর কী!
খুন খারাবি! কে খুন হয়েছে? কে?
মজুমদার সাহেব। আপনাদের সেলিম মজুমদার আর কী!
সেলিম। বলিস কি? কে খুন করল তাকে?
খুন কে করল?
খুন কে করল সেটা কি আর খুব বড় বিষয়। খুন মানে মৃত্যু, আর মৃত্যু তো খোদা নির্ধারিত। যার যেভাবে লেখা!
জ্ঞানের কথা বলিস না? বল তুই কে?
শুনলে আপনি ভয় পাবেন। কষ্টও পাবেন।
তবু বল। নইলে…বলে আনিস জোয়ার্দার উঠতে যান। আঘাতের সম্ভাব্য অস্ত্রের খোঁজও চলে।
লোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, অতোসবের দরকার হবে না। বলছি।
বল।
আপনার স্বপ্নের কথা আপনার স্ত্রী ছাড়া আর একজন জানত। জানত যে আপনি স্বপ্ন দেখে খুব ভয় পান।
আনিস জোয়ার্দার একটু ভেবে বলেন, মনে পড়ছে না তো!
একটু চেষ্টা করুন। যে আপনার ভয়ের কথা শুনে আপনাকে একটা ওষুধের সন্ধানও দিয়েছিল।
আনিস জোয়ার্দারের আবছা মনে পড়ে। অনেক বছর আগের কথা। অনেক বছর! তার বন্ধু শওকত তাকে একবার বলেছিল, এটা একটা মনস্তাত্বিক সমস্যা। চিন্তা ও ভয় থেকে…
বললেন, হ্যাঁ। আমার বন্ধু শওকত জানত। আমার বন্ধু শওকত।
শওকতের কথা তাহলে আপনার মনে আছে।
থাকবে না কেন? আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও খুশির বদলে আসলে ভয় হয় জোয়ার্দারের। কারণ শওকতকে নিয়ে এমন একটা ঘটনা আছে তার যা মনে করলে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। খুবই গোপন কথা। খুবই ভয়ের কথা।
কম্পিত গলায় জোয়ার্দার বলেন, তুই তাকে কি করে চিনিস? সে তো মারা গেছে প্রায় ১৫ বছর আগে।
বলেন কি আমি তাকে চিনব না!
তুই কি শওকতের ছেলে! না-রে তার তো কোনো ছেলে ছিল না!
আমি নিজেই শওকত।
তুই শওকত! ফাজলামি করিস না। শওকত তো মারা গেছে সেই কবে!
মানুষ মরে গেলেও কি শেষ হয়ে যায়। আপনারা তাকে কবরে ফেলে আসেন, তারপর তো তার আরেকটা জীবন শুরু হয়।
তা ঠিক। কিন্তু তারা তো…
ভূত হয়ে যায়। আপনার হিসেবে তাই আমি শওকতের ভূত। আর আমার মতে আমি শওকত।
আনিস জোয়ার্দার বামপন্থী রাজনীতি করতেন। মার্কস-অ্যাঙ্গেলস পড়েছেন। ধর্মতেই তিনি বিশ্বাস করেন না, তায় আবার ভূত। তিনি হেসে দিয়ে বলেন, গল্প তো ভালোই ফেঁদেছিস। তুই শওকত!
জানি আপনি সেটা বিশ্বাস করবেন না।
না বিশ্বাস করি না। তুই কোনো গুপ্তচর। আমার সম্পর্কে সব তথ্য যোগাড় করে আমাকে ভয় পাওয়াতে এসেছিস!
ভয় তো আপনি এমনি-এমনি পান। আমার নতুন করে এই কাজটা করার কী দরকার?
শওকত হলে আমাকে তুই করে বলতি। শওকত আমাকে আপনি করে বলত না।
কী করব বলুন। আমার বয়স তো এখন আপনার চেয়ে ১৫ কম। আমি ৪২-এই আটকে আছি। আপনার এখন ৫৭। আপনি এখন তো আর আমার বন্ধু নন। সমবয়সীও নন।
আনিস জোয়ার্দার বিশ্বাস করছেন না, কিন্তু ভূতদের কিছু নিয়ম-কানুন আছে জেনে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। আরও কী কী নিয়ম তারা মানে এটা জানতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আর জানা হয় না। লোকটি চলে গেছে।
তার গলা না পেয়ে আনিস জোয়ার্দার সাহস করে বাতি জ্বালান। এঘর-ওঘর খুঁজে দেখেন। না। কোথাও নেই।
লোকট ভূত না চোর নাকি গুপ্তচর তার মীমাংসা না হওয়াতে তার মেজাজ গরম হয়। ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবতে পারলে হত। কিন্তু উপায় নেই। সেলিম মজুমদারের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে প্রচণ্ড চিৎকার। হৈ-চৈ।
সেখানে যাবেন নাকি? মজুমদার খুন, খবরটা জানাচ্ছে শওকতের ভূত, এর মধ্যে অনেক ঝামেলা লুকানো। এত বছর পর এ-কী যন্ত্রণা!

২.
সেলিম মজুমদার রাতে ঘুমানোর আগে ভেবে দেখেন আজ তিনি কাউকে ঠকাতে পারলেন কি না! যদি দেখেন কাউকে ঠকানো গেছে তাহলে তার শান্তি-শান্তি ভাব হয়। নিশ্চিন্তে ঘুমান। যেদিন দেখেন কাউকে বোকা বানাতে পারেননি সেদিন তার ঘূম হয় না। তিনি অস্থিরভাবে পায়চারি করেন। বারবার পানি খান এবং অন্যদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে বিরক্ত করেন।
মজুমদার ব্যবসায়ী মানুষ। টাকা কড়ি বিস্তর। কিন্তু টাকা আয়ের চেয়েও তার মজা মানুষ ঠকানোতে। একজন ব্যবসায়ী যদি মানুষকে ঠকাতে না পারে তাহলে সে আবার কিসের ব্যবসায়ী!
আজ তিনি হিসাব করে দেখছিলেন কাউকে সত্যিই ফাঁদে ফেলা গেছে কি না! বেপারি বাড়ির চাকরটা ৫ কেজি চিনি নিতে এসেছিল, তিনি বাটখরাটা একটু কায়দা করে সাড়ে ৪ কেজি দিয়ে কাজ প্রায় সেরে ফেলেছিলেন, কিন্তু বেপারি বাড়ির চাকর বলে কথা! সে ভদ্রলোকের মতো চিনিটা নিয়ে নিল। তারপর প্যাকেটটা ওল্টে-পাল্টে বলল, মজুমদার চাচা চিনি তো সাড়ে ৪ কেজি মনে হচ্ছে?
তোর মনে হলেই তো হবে না। মনে হতে হবে বাটখরার। যা নিয়ে যা।
আপনার ৫ কেজির বাটখরাটা দেখি তো একটু।
মজুমদার সাহেব বিপদে পড়লেন, তিনি সামলাতেও জানেন। গলা বদলে বললেন, তোর বেপারি বাড়িতে কতদিন হল রে!
তা ১০ বছর তো হবেই।
বেপারি বাড়িতে ১০ বছর থাকার পরও তুই ব্যবসায়ী হতে পারিসনি, তোর সঙ্গে আসলে ব্যবসায়ই করা উচিত না! দে আমার চিনি দে।
বলে এক টানে তিনি চিনিটা নিয়ে প্যাকেটটা এমন দক্ষতায় খুলে ফেলেন যে বেপারি বাড়ির চাকরটি কী করবে বুঝতেই পারল না।
মজুমদার আরও দু চারটা কড়া কথা বলে পরিস্থিতি ভালোই সামাল দিলেন। ঠিক আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দিনের মধ্যে তো কাউকে ঠকানো যায় নি। তাহলে! ব্যবসায়ী হিসেবে তার পতনের দিন ঘনিয়ে আসছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা শেষ মানে দুনিয়া শেষ।
তিনি চিন্তায় পড়ে যান এবং পানি খেতে উঠে যান। লাইট জ্বালাতে গেলেই কে যেন ফিসফিস করে বলে, লাইটটা না হয় না-ই জানালেন?
কে? তুই কে?
এই রাতে কে আসতে পারে আপনার বাড়িতে।
চোর-টোর হবে। তা আমার বাড়িতে চুরি করতে এসেছিস! এত বড় অবিবেচক!
তা অবিবেচকই বলতে পারেন। এ অঞ্চলের সবাই তো জানে আপনার কাছ থেকে টাকা খসানো আর বাঘের মুখ থেকে খাবার কেড়ে আনা একই কথা।
তাহলে বাঘের মুখে না গিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিস কেন?
কয়েকটা কথা ছিল!
এই রাতে কয়েকটা কথা! তুই পাগল নাকি রে!
তা একরকম পাগলও বলতে পারেন। কিন্তু মনে হল আজ যখন আপনার ঘুম হবে না তখন আজই তো কথা বলার সুযোগ।
আমার ঘুম হবে না এই খবর তোকে দিল কে?
কিছু খবর-টবর তো রাখতে হয়। আপনাদের দোয়ায় সেটা পারি।
আমি তোর জন্য দোয়া করার দলে নেই। কী বলার স্পষ্ট করে বল। আমি একটু হিসাবের মধ্যে আছি।
তাও জানি। আজ কাউকে ঠকাতে পারেননি বলে খুব অস্থির আছেন। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
তা সাহায্য কর দেখি!
সেটা তো করবই। নিজেই যখন এসেছি তখন ওটুকু আপনি পাবেন। তার আগে দুটো কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
দুটো মাত্র কথা তো! বল।
এই যে আপনি এত টাকা পয়সা জমান কার জন্য করেন বলেন তো! আপনার তো ছেলে-পুলে কিছু নেই।
হাসালি। ছেলে-পুলে কেউ নেই বলেই তো করি। যার ছেলে-পুলে আছে তার তো টাকা লাগে না। ছেলে-পুলেই তাকে খাওয়াবে। কিন্তু যার ছেলে-পুলে নেই, টাকা না হলে তাকে খাওয়াবে কে?
যুক্তির কথা। তা টাকার এই হিসাবটাতে আপনি বরাবরই ভীষণ পাকা।
তা বটে। কিন্তু তুই কে তা তো বললি না! চোর হলে তো এত কিছু জানার কথা নয়।
একরকম চোরই বলতে পারেন। কারো বাড়িতে চুরি করে ঢোকাও তো এক ধরনের চুরিই।
তাও ঠিক। কিন্তু মতলবটা কি?
না। তেমন কিছু না। আচ্ছা জোয়ার্দার সাহেবের সঙ্গে আপনার আর আগের মতো বন্ধুত্ব নেই না!
কোন জোয়ার্দার? ও। আরে ও কি আমার বন্ধুত্বের যোগ্য নাকি। একটা ভীতুর ডিম। জীবনে বড় হওয়ার কোনো চেষ্টা নেই। ইচ্ছা নেই।
তা ঠিক। সেরকম লোকের পৃথিবীতে থাকা আর না থাকা একই কথা।
বেশ জ্ঞানের কথা বলছিস তো? তুই কে রে!
দেব। পরিচয় দেব। তখন চিনবেনও।
তা দেরি কিসের।
জোয়ার্দার সাহেবের কথা বলছিলাম না! ভদ্রলোকের সঙ্গে তো একসময় আপনার খুব খাতির ছিল তাই না।
তা খানিকটা ছিল।
খুব জানতে ইচ্ছে করে ওখানে চিড় ধরল কেন?
চিড় ধরেছে কোথায়? এখনও তো দেখা সাক্ষাৎ হলে তবিয়ত-খারিয়ত জানতে চাই।
মজুমদার সাহেব একটু অপ্রস্তুত বোধ করছেন। ঠিক জোয়ার্দারের সঙ্গে একসময় তার খুব খাতির ছিল, স্মৃতির পর্দা একটু সরে যাওয়াতে সব খুব স্পষ্ট হয়, কিন্তু সেই পর্দার আড়ালটা তার জন্য খুব সুবিধাজনক নয়। এমন একটা ঘটনা আছে পেছনে যা কেউ জানে না, তারা দুজন জানেন শুধু, এখন তো মনে হচ্ছে এই লোকও অল্প-বিস্তর জানে বোধহয়।
মজুমদার সাহেব একটু সতর্ক হয়ে বলেন, জোয়ার্দারের কথা থাক। তোমার কথা বলো!
হঠাৎ তুমিতে চলে এলেন যে! রাগ করলেন নাকি!
রাগ না। অকাজে আমি লোকজনের সঙ্গে কথা বলি না। কাজের কথা বলতেই আমার ভালো লাগে।
তা বটে।
বল। এই রাতে জোয়ার্দারের কথা আমি শুনতে চাচ্ছি না।
তার কথা আর খুব একটা শুনতে হবে না।
কেন?
একটু আগে আপনিই না বলছিলেন এমন লোকের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার কোনো তফাত নেই। বলেছিলাম নাকি! তা ঠিকই বলেছি।
তিনি আর নেই। এই একটু আগে খুন হলেন!
খুন হয়েছে? কে করেছে? তুই?
আবার তুই-তে চলে গেলেন। যাই হোক খুনটা কে করেছে সেটা বিষয় নয়, বিষয়টা হলো তিনি খুন হয়েছেন।
কে করল? কেন করল?
সেটা তো আর বড় ব্যাপার নয়। আপনার জন্য বড় ব্যাপার হলো, আপনার সেই গোপন খবরটা এখন থেকে আর আপনি ছাড়া কেউ জানে না।
গোপন ব্যাপার মানে কি বলতে যাচ্ছিস?
আর ভেঙ্গে বলতে চাই না। দেয়ালেরও কান আছে।
কিন্তু তুই তো জানিস!
আমার জানাতে খুব একটা সমস্যা নেই। আমি তো…
তা অবশ্য ঠিক। চোরের কথা তো আর কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু সত্যিই কি তুই জানিস?
দীঘির পাড়ে সেদিন সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল না!
মজুমদার সাহেব খুব চমকে গিয়ে বলেন, তা হচ্ছিল।
আপনাদের চুক্তিটার কথা মনে আছে। আপনি আপনার ব্যবসায়িক পার্টনার শওকতের পুরো ব্যবসাটা পেয়ে যাবেন। জোয়ার্দার সাহেব অবশ্য প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। আপনি বোঝালেন যে তার লাভ হল শওকত না থাকলে তিনি যাকে যান তাকে বিয়ে করতে পারবেন। আর তখন..
আর বলিস না!
কিন্তু তুই কে?
ধরুন আমিই শওকত।
শওকত! সে কী করে হয়! সে তো মারা গেছে ১৫ বছর আগে।
সত্যিই কি মারা গেছে?
আমি নিজেই ওকে…। ওহ!
থাক আর স্মরণ করে কষ্ট পেতে হবে না। আমি আসছি। দেখি জোয়ার্দার সাহেবের কী অবস্থা!
দাঁড়া। শোন। সেলিম মজুমদার চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু আর কোনো সাড়া নেই।
তিনি লাইটটা জ্বালান। না কেউ নেই।
তিনি পানি খেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবেন। ভেবে দেখেন, জোয়ার্দার যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে বিষয়টা খারাপ হয় না। তিনি যাবেন।
কিন্তু তার আগে পুলিশকে খবর দিয়ে রাখা একটু ভাল। জীবন দারোগার পকেটে কিছু ঢুুকিয়ে দিলে আর তদন্ত-টদন্ত কিছু লাগবে না। একেবারে তার নিজের লোক।

৩.
দারোগা জীবন কানাই দাস চিৎকার করে বললেন, হ্যান্ডস আপ!
এমন জোরালো চিৎকার যে তিনি সত্যি-সত্যিই হাত উপর দিকে তুলে দাঁড়ালেন।
সিনেমায় দেখেছেন এসব ক্ষেত্রে হাত উপরে তুললেই ওপাশের পিস্তল বা বন্দুকটা নত হয়ে যায়। হাত তোলাদের কেউ গুলি করে না সাধারণত। কিন্তু জীবন কানাই দাস তবু পিস্তল তাক করে রেখে বলল, বলুন আপনি কি জানেন?
আমি কিছু জানি না।
তাহলে এখানে এলেন কিসের ভিত্তিতে? কেন এসেছেন?
চিৎকার শুনে এলাম।
চিৎকার শুনলেন কী করে? রাতে কি ঘুমান না!
আমার ঘুম একটু ঘুম। ঘুমালে নানান দুঃস্বপ্ন দেখি।
এই উত্তরটাতে দারোগা খুশি হয়ে বলেন, চিৎকার শুনে ভয় পান?
জ্বি। পাই।
দারোগা এবার আরও খুশি। পিস্তলটা নামিয়ে বলেন, খুব ভালো। ভয় পাওয়া খুব ভালো। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান সমস্যা হলো মানুষ ভয় পায় না। ভয় পেলে কী আর কোনো সমস্যা থাকে? চোর যদি পুলিশকে ভয় পেত তাহলে এই রাতে কেউ কারো বাড়িতে ঢুকে। ঢুকে না! আমারও এই মাঝ রাতে কম্বল ছেড়ে এখানে আসতে হয় না।
কী হয়েছে একটু দেখে যেতে পারলে ভালো লাগত!
দেখে আপনি কী করবেন? আপনি তো চোরও না। পুলিশও না।
কিন্তু.. শুনলাম মজুমদার নাকি খুন হয়েছে?
তা-ও শুনে ফেলেছেন। তা আপনাকে এই গুরুতর খবরটা কে দিল?
আনিস জোয়ার্দার বিপদে পড়ে যান। মুখ ফসকে কথাটা বলার পরই বুঝেছেন ভুল হয়ে গেছে। ভুল যখন হয়ে গেছে তখন ভুলটা শোধরাতেও হবে। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন, জীবন দারোগা ভয় পেতে ভালোবাসে। শোনা যায় একবার বাড়িতে বিড়ালের উৎপাতে সে ভয় পেয়ে খাটের তলায় লুকিয়েছিল, একবার পাগলা কুকুর দৌড়ে পানিতে পড়ে ডুবতে বসেছিল এবং একবার গরুর শিংয়ের আঘাতে মূর্ছা গিয়েছিল। তাই গলা নামিয়ে একটু রহস্যের ভঙ্গিতে বললেন, ভূত বলেছে।
কে বলেছে?
আরও গলা নামিয়ে, আরও রহস্য মিশিয়ে বলেন, ভূত বলেছে।
খেয়াল করেন জীবন দারোগার পা কাঁপছে। বলে, ভূতের সঙ্গে আপনার কথাবার্তা হয় নাকি?
নিয়মিত।
বলছেন কি? জীবন দারোগার পা আরও কাঁপে। মুখ আরও ফ্যাকাশে হয়।
বুঝলেন আমিও ভূত ব্যাপারটায় বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু দিন কয়েক আগে হলো কী, রাতের বেলা দেখি কী একটা পুলিশের পোষাক পরা লোক আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমি তো প্রথমে ভাবলাম আপনি!
ভূত কি আমার চেহারা নিয়ে আজকাল ঘুরে বেড়াচ্ছে নাকি?
ঘটনাটা শুনুনই না।
প্রথমে ভাবলাম আপনি। তা আপনি হলে তো ভয়ের কিছু নেই।
আমি হলে ভয় নেই কেন? আমাকে ভয় পাওয়াতে দোষ আছে নাকি?
সে কথা নয়, আপনি তো হলেন পুলিশ। আপনার বিচার-বুদ্ধি আছে। আমার মতো নিরীহ মানুষকে তো আর আপনি রাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে যন্ত্রণায় ফেলতে পারেন না।
তা বটে। তা বটে।
তারপর সে আমাকে বলে, আমাকে দেখে জীবন দারোগা ভেবে ভুল করো না যেন! আমি তাকে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম পোষাক আপনার হলেও চেহারাটা আপনার মতো সহজ-সরল নয়। নাকটা আপনার মতো বোঁচা নয়, বিরাট বড়। মাথাটা ন্যাড়া নয়, দারুণ কালো চুলে ভর্তি। আপনার মতো কুচকুচে কালো নয়, ধবধবে ফর্সা। আমরা পুলিশ মানেই জানি আপনি; বোঁচা নাক, ন্যাড়া মাথা, কুচকুচে কালো।
আমার কথা থাক। তার কথা বলুন।
বাকিটা না হয় আর না-ই বললাম।
বলুন। বলুন।
শুনলে ভয় পাবেন। অপমানিতও বোধ করবেন।
আমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলল নাকি?
না। তেমন কিছু নয়। বলল, আমাকে জীবন দারোগা ভেবো না। আমি এখানে ছিলাম ১০০ বছর আগে, তখন এখানে চোর-ডাকাত বলে কিছু ছিল না। এখন তো চোর-ডাকাতে সব কিলবিল করছে।
সেরকম মিথ্যা বলল, আর আপনি চুপচাপ সব শুনলেন!
না। না। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, বাজে বকো না। জীবন দারোগার সামনে এই কথা বললে তোমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।
সাধু। সাধু। তা সে খুব ভয় পেল।
তা আর পেল কই? বলল, জীবন দারোগা আমার সামনে দাঁড়ালে তো ওর…থাক না শোনাই ভালো।
বলুন না। বলুন। পুলিশের কাজ কী! মানুষের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান। সেজন্য প্রয়োজনে ভূতদের বিপক্ষেও আমাদের মাঠে নামতে হবে। ইনফরমেশন সব জানা থাকলে কাজে লাগবে।
বলল, জীবন দারোগাকে এসব সরাসরি বললে সে না কি ভয়ে মূর্ছা যাবে। কাপড়-চোপড়ে প্রস্রাব করে দেবে।
কী! এত বড় কথা। কোথায় সেই দারোগা? কোথায়?
বেশি জোরে চেঁচাবেন না। আশে-পাশেই আছে। এসেও পড়তে পারে।
তা এখন এলে অবশ্য একটু সমস্যা আছে। জরুরী কাজে যাচ্ছি। ঠিক আছে আমি পরে ওকে দেখব। আচ্ছা ওরা কেউ আসছে না কেন? আমাকে একা এগিয়ে দিয়ে দেখি…
জরুরী কাজটা কি? কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ। আনিস জোয়ার্দার নামে এক লোকের বাড়ি।
আনিস জোয়ার্দার? কেন বলুন তো?
লোকটি নাকি একটু আগে খুন হয়েছে।
তাই নাকি? সেই খবর পেয়েই তো আমার এখানে আসা। চিন্তা করুন, এত রাতে মরার দরকার কী! সকালে হলে পুরো ফোর্স নিয়ে আসা যেত! এখন একা। তা আপনাকে তো বেশ কাজের লোক মনে হচ্ছে। ভূতের সঙ্গেও খাতির আছে। চলুন না আমার সঙ্গে।
তা যাওয়া যায়। কিন্তু কীভাবে খুন হয়েছে বা কারা করল তা কি জেনেছেন কিছু?
সেটা জানতেই তো আসা।
খবরটা কে দিল যদি একটু বলেন?
মজুমদারের সাহেবের বাড়ি থেকে লোক গিয়ে নিয়ে আসল আমাকে। এই রাতে, কম্বলের তলায় কী যে আরামে ঘুমাচ্ছিলাম! কিন্তু কী করব! কর্তব্য! চলুন আমার সঙ্গে।
আনিস জোয়ার্দার ঘটনাটা ঠিক বুঝতে পারেন না। সেলিম মজুমদারের বাড়ি থেকে চিৎকার-চেচাঁমেচি ভেসে আসছে এবং খবর মিলেছে তিনি খুন হয়েছেন, কাজেই তিনি ঘটনা দেখতে বেরিয়ে এসেছিলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর আসতেই তার পথ আগলায় জীবন দারোগা। আগড়ম-বাগড়ম নানা কথা তিনি বলছিলেন কথার প্যাঁচে পড়ে, তাছাড়া তার বাড়িতে যে কেউ একজন ঢুকেছে এবং বের হয়েছে তার একজন প্রত্যক্ষদর্শীও আছে।
তিনি ঘর ছেড়ে বেরোতেই পাশের বাসার আজিজ মাস্টার জানালা দিয়ে গলা বের করে বললেন, জোয়ার্দার সাহেব বলুন তো ঘটনাটা কি? কে এসেছিল আপনার বাসায়!
তেমন কেউ না!
ঘটনা বোঝা যাচ্ছে না। মজুমদারের সাহেবের বাড়িতে চিৎকার, আপনার বাড়িতে ট্রেসপাস। হলোটা কি?
অন্য কেউ দেখলে তবু সমস্যা ছিল না, কিন্তু আজিজ মাস্টার এক ঘটনা একশভাবে ব্যাখ্যা করে। একটার সঙ্গে আরেকটা মিলিয়ে গোলমাল পাকায়। সকালে বাজারে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তেই বলবে, কাল রাতে তো বিরাট ঘটনা।
কী ঘটনা? কেউ একজন জানতে চাইবে নিশ্চিতভাবে।
মজুমদার সাহেবের বাড়িতে চিৎকার শুনে আমি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েছি, তখন দেখি জোয়ার্দার সাহেবের বাড়ি থেকে কেউ একজন বেরিয়ে যাচ্ছে। মজুমদার সাহেব খুন এবং জোয়ার্দারের বাড়িতে গভীর রাতে অপরিচিত মানুষের উপস্থিতি বুঝতে পারলে কিছু?
সবাই আজিজ মাস্টার নয় যে সবকিছু প্যাঁচিয়ে বুঝবে।
শোনো তাহলে খুন হয়েছে এবং খুন হওয়ার পর সম্ভাব্য খুনী জোয়ার্দার সাহেবের বাড়িতে। আবার খেয়াল করো সেদিন বিকালেই জোয়ার্দার সাহেব তার বাড়ির সবাইকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছেন। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলছে।
কিন্তু জোয়ার্দার কেন মজুমদারকে খুন করতে যাবে! দুজন দুই জগতের বাসিন্দা।
সেখানেই তো সুবিধাটা। কেউ তাকে সন্দেহই করবে না। আর মজুমদারকে খুন করার একশ একটা কারণ আছে। তার ব্যাংকে কত টাকা আছে জানো? তার নামে কতগুলো জমি আছে সে খবর রাখো!
এমন লোককে খুন করবে না তো কি তোমাকে-আমাকে করবে? দুই টাকার চা খেতে যাদের দুইশ টাকা বাকি পড়ে!
এসবই তার কল্পনা। কিন্তু তার কল্পনাগুলো এমন সুসজ্জিত দেখতে পান যে তার বাড়িতে ভূতের উপস্থিতি প্রমাণ করা ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হল পুলিশকে সাক্ষী বানানো। জীবন দারোগাকে তাই তার মনে হয়েছিল সুযোগ। কিন্তু এখন সবকিছু কেমন যেন রহস্যময়। তিনি কেন খুন হবেন? সেই খবর সেলিম মজুমদারই বা দেবে কী করে? তারই তো ইতিমধ্যে খুন হয়ে যাওয়ার কথা!
জীবন দারোগা হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস করেন, এই দেখুন আপনি আমার নাম জানেন কিন্তু আমি আপনার নাম জানি না। আপনার নামটা কি?
আনিস জোয়ার্দার!
আনিস জোয়ার্দার!
জীবন দারোগার হাতের পিস্তল পড়ে যায়। মুখ হা হয়ে যায়। এবং তিনি ভূত-ভূত বলে একটা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে মূর্ছা যান।

৪.
আনিস জোয়ার্দার বললেন, ভূত!
সেলিম মজুমদার প্রতিবাদ করে বললেন, তুই ভূত!
তুই ভূত!
তুই!
মাঝখানে পতিত এবং মূর্ছিত জীবন দারোগা। তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে জোয়ার্দার এবং মজুমদার এই ঝগড়া চালাচ্ছেন।
মজুমদার একা মানুষ। তিনি চাচ্ছিলেন দারোগাকে একা পাঠিয়ে সে সব সামাল দেয়ার পর তিনি আসবেন, অপেক্ষা করছিলেন, এই সময়ই হঠাৎ দারোগার ‘ভূত’ চিৎকার শুনে তাকে বের হতেই হয়েছে। বের হয়েছে যা দেখলেন তাতে তাকেও ভূত বলে চিৎকার দিতে হল। আনিস জোয়ার্দার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। আগন্তুকের কাছে পুরনো পাপের পুঙ্খানুপঙ্খ বিবরণ পেয়ে মজুমদার এমন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন যে তার মনেই হয়নি এই লোক ভুল বলতে পারে। আরও আশ্চর্য ব্যাপার জীবন দারোগার কথা তিনি যখন ভাবছিলেন তখনই দেখেন দারোগা দরজায় হাজির। বলে, এদিকে খুব চোরের উৎপাত শুনেছি। তাই এলাম। কোনো সমস্যা নেই তো মজুমদার সাহেব।
যাকে কম্বলের তলা থেকে পানি ঢেলে তুলতে হয় বলে সবাই জানে সে কারো কাছ থেকে টাকা না খেয়ে চোর খুঁজতে এসেছে এটা বিস্ময়কর। তবু মজুমদার খুশি হন। তার পকেটে কয়েকশ টাকা ঢুকিয়ে কানে কানে ঘটনাটা বলেন। দারোগা জীবন কানাই ‘তবে রে!’ বলে তখনই উদ্যত পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
মজুমদার বললেন, তুই মরিসনি!
জোয়ার্দার চেঁচান, তুই মরিসনি!
আমি মরব কেন?
তাহলে আমার মরার কথা আসে কেন?
ঐ যে শওকত বলল!
শওকত! তোর কাছেও এসেছিল নাকি?
হুঁ। আমাকে তো বলল, তুই মারা গেছিস তাই আমি বের হলাম দেখতে।
আমাকেও তো তাই বলল। বলল, তুই খুন হয়েছিস!
মজুমদার গলা নামিয়ে বলেন, যাই হোক যা হওয়ার হয়েছে। হিসাবের গোলমালে মাথা কাজ করছিল না বলেই কি না কি শুনেছি।
আমিও স্বপ্নের ঘোরে বোধহয় কি না দেখেছি!
মজুমদার বললেন, তবু সাবধান থাকতে হবে। তৃতীয় কেউ এই ঘটনাটা জানে। এত বছর পর! কী ঝামেলা বল তো!
আমি তো তখনই না করেছিলাম। বলেছিলাম খুনের দরকার নেই। ভয়-টয় দেখালেই হবে। খুন কিন্তু করার কথা ছিল না।
হুঁ। কিন্তু ও যখন আমার হাত ধরে পানি থেকে উঠতে চাইছিল তখন তুই ধাক্কা দিয়ে ওকে পানিতে ফেলে দেসনি।
তখন তো আর উপায় ছিল না। ও বেঁচে গেলে দুজনই মরতাম।
যাক এখন বাঁচা গেছে। চল।
সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার, বাঁচা গেছে! না!
মাঝখানে মূর্ছিত এবং পতিত জীবন দারোগা আবার দুনিয়া ফাটানো চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়।
মজুমদার বলেন, এই জোয়ার্দার তোর এত বয়সেও আক্কেল হলো না। দারোগাকে এরকম ভয় দেখায়। জানিসই তো জীবন বাবু ভীতু মানুষ।
আমি ভীতু না!
ঠিক তা নয়। কিন্তু ঝামেলার লোকও তো নন। চলুন ঘরে। এই শীতের রাতে গরম ভাপা পিঠা খেতে বেশ লাগবে।
খুনির ঘরে ভাপা পিঠা খাব? জীবন দারোগাকে এখনও তোরা চিনতেই পারিসনি! এই শওকত কোথায় রে? ধর দুটোকে!
শওকত! দুজনই আবার ভূতের ভয় পান।
শওকত নামে একজন আত্মপ্রকাশ করে। হাতে দড়ি।
সে বলে, দারোগাবাবু। এরা সম্মানিত মানুষ। হাতে দড়ি দেয়ার কী দরকার!
গলাটা দুজনেরই চেনা মনে হয়! এই তো সেই শওকত! শওকতের ভূত!
জীবন দারোগা বলেন, এখানে আসার পরই একটা উড়ো চিঠিতে ঘটনাটা জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু প্রমাণের অভাবে…। ১৫ বছর আগের ঘটনা তো! তাই একটু নাটক করতে হল। ভূতের নাটক। নাটকটা তো খারাপ হয়নি কী বলেন!
শওকত বলে, সবচেয়ে ভালো হয়েছে আপনার চিৎকারটা। আমি তো ভেবেছিলাম গেছেন মনে হয়!
জীবন দারোগা বলেন, বাজে কথা বলবি না। এখন আর তুই ভূত নয়। পুলিশের মতো কাজ কর।

***********
এটা আমার একেবারেই নতুন লেখা। এখনো অপ্রকাশিত। একটা সাপ্তহিকের জন্য লেখা। তবে তার আগে সিসিবিতে গল্পটা নিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া জানার ইচ্ছে হলো।

২,৩৮৪ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “জোয়ার্দারের কাণ্ড, মজুমদারের কীর্তি”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ইইইইইইয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়াত্তো বড়ো......... , পড়ার আগে একটু ওয়ার্ম আপ কইরা লই :tuski: :frontroll: :goragori: :awesome:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    গল্প ভালো লেগেছে।
    অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও একটানে পড়া গেছে। আপনার সব লেখাই অবশ্য একটানে পড়া যায়।
    প্রথমদিকে ভৌতিক (১,২), মাঝখানে (অনুচ্ছেদ-৩) রহস্যময় আর শেষটায় (৪) এসে টুইস্ট- সব মিলিয়ে গল্পের কাঠামোটা খুব নিখুঁত।
    কোন সাপ্তাহিক ছাপছে?

    জবাব দিন
  3. নাসির (৯৮-০৪)

    ব্যাপক হইছে। মামুন ভাইয়ের ফুটবল কমেন্ট্রির মতন লেখাটাও গতিশীল। গল্পটায় শক্ত সাস্পেন্স এর কারণে বেশি রেস্পন্সিভ মনে হয়েছে।

    অফ টপিকঃ ভাই আপনার বুলেট ট্রেনের মতন অনর্গল কমেন্ট্রি সত্যিই দারুণ।

    জবাব দিন
  4. রহমান (৯২-৯৮)

    মামুন ভাই,
    সবার আগে লেখাটি সিসিবিতে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার লেখার ভঙ্গি ভাল লেগেছে। তবে শওকতের ব্যাপারটা আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়নি এখনো। ১৫ বছর আগে মৃত শওকতের কথা জীবন বাবুকে উড়োচিঠির মাধ্যমে কে জানাল, আর শেষের দিকের এই শওকত টা কে? ১৫ বছর আগে মৃত শওকতের সাথে তার গলার স্বরের মিল থাকার কি কারন? এই দুই শওকতের হিসেবটা ঠিক মেলাতে পারছিনা।

    একটা জায়গায় সামান্য একটু ভুল করেছেন সম্ভবত। ২য় অনুচ্ছেদের মোটামুটি শেষের দিকেঃ

    দীঘির পাড়ে সেদিন সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল না!
    জোয়ার্দার সাহেব খুব চমকে গিয়ে বলেন, তা হচ্ছিল।

    এখানে "জোয়ার্দার সাহেব" এর নামের জায়গাতে আমার মনে হয় "সেলিম মজুমদার" হবে। ধন্যবাদ

    জবাব দিন
    • রহমান ভাই

      শেষের দিকের শওকতটা আসলে পুলিশের লোক। ( এখন আর তুই ভূত নয়। পুলিশের মতো কাজ কর।) ওকে শওকত বানানো হয়েছে সাজানো নাটকের প্রয়োজনে।

      গলার স্বরে আর চেহারায় মিল খুঁজে পাওয়াটা আসলে খুনীদের হ্যালুসিনেশন। চোরের মন পুলিশ পুলিশ টাইপ ব্যপার আর কি।

      এইহচ্ছে আমার ধারনা। মামুন ভাই নিজে এর ভালো ব্যাখ্যা দিবেন। আর আরেকবার পড়লেই আমার ধারনা আপনারো ঘটনাটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

      জবাব দিন
  5. এহসান (৮৯-৯৫)

    গল্পটার কাহিনী ইন্টারেস্টিং। টীনেজার ক্যাডেটরা এই সব গল্পে খুব মজা পায়। গল্পটা ক্যাডেট কলেজের মঞ্চে নাটক হিসাবে দারুন জমবে। চরিত্র কম। কোনো মেয়ে ক্যারেক্টার নাই। আর ডায়ালগ গুলোও মার মার কাট কাট হয়েছে।গল্পটা এগিয়েছে সাস্পেন্স ধরে রেখে। আমি নিশ্চিত আবুল হোসেন স্যার এই পান্ডুলিপি পেলে বর্তে যেতেন। 🙂 ইন্সপেক্টর জীবন কানাই হিশাবে আপনাদের ব্যাচের মিলন ভাইরে দারুন হইতো!!!

    মামুন ভাই আপনার লেখার সাহিত্যমান নিয়ে লেখার মতো বোদ্ধা এখনো হইনি। :boss: কিন্তু গল্পটা এক টানে শেষ করেছি। ভালো লেগেছে। :clap:

    আরেকবার রিভাইস করতে হবে একটি জায়গায় “জোয়ার্দার সাহেব” আর “সেলিম মজুমদার” ওলট-পালট হয়ে গেছে।

    জবাব দিন
  6. লেখা সব সময়ের মতোই গতিশীল। এহসান ভাইয়ের মতো একটানে পড়েছি।
    শুরু থেকেই অবশ্য রহস্য গল্প বুঝতে পারছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম শেষের টুইস্টের জন্য। মামুন ভাইকে ক্রেডিট দিতে হয়, কারন যা ভাবতে ভাবতে এগিয়েছিলাম তার সাথে মিলেনি।

    জীবন দারোগার খুনের উড়োচিঠির ব্যপারটা আরো একটু খোলাসা হলে ভালো হতো। এছাড়া বাদ বাকি সব জমজমাট। টানটান, কোথাও একেবারেই ঝুলে যায় নি।

    লেখার মান নিয়ে কিছু বলার নাই। আমার ধারনা মামুন ভাই এ সময়ের সেরা ২/৩ জন কিশোর ঔপন্যাসিকদের একজন।

    এক জায়গায় “জোয়ার্দার সাহেব” আর “সেলিম মজুমদার” ওলট-পালট হয়ে ছিলো। মামুন ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে ঠিক করে দিলাম।

    জবাব দিন
  7. `কিশোরবেলা' নামে একটা কিশোর পত্রিকা বেরোচ্ছে। সেখানেই ছাপা হবে। প্রথম সংখ্যায় ছাপা হবার কথা ছিল, ক্যাডেটসুলভ ফাকিবাজিতে লেখাটা লিখেছি প্রথম সংখ্যা প্রেসে চলে যাবার পর। তাই ছাপা হবে দ্বিতীয় সংখ্যায়।

    সাধারণত লেখার পর কেউ একজনকে দিয়ে পড়াই (আমার লেখা যার কাছে অত্যাচার মনে হয় না এ জাতীয় পাঠক),তারা অসঙ্গতি ধরলে তবে সেটা ঠিক হয়। এবারে তেমন পাঠক কিংবা প্রুফ রিডারের আগেই চলে এসেছে এখানে। তাই বেশ কিছু অসঙ্গতি হয়ত। সেগুলো ধরার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। রহমান কামরুল যে ব্যাখ্যা দিয়েছে বিষয়টা এরকমই, মানে আমি এরকম করেই ভেবেছি।তবু বোধহয় আরেকটু পরিষ্কার করা দরকার।

    আচ্ছা নাসির তুমি কি আমাদের কলেজের? ঠিক চেহারাটা মনে করতে পারছি না কেন?

    ভালো লাগছে এহসানকে নিয়মিত দেখে। আর কামরুল, নামগুলো ঠিক করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

    মোস্তফা মামুন

    জবাব দিন
  8. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    মামুন ভাই অসাধারন অসাধারন :boss: :boss: :boss:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  9. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    পড়তে দেরী হইয়া গেল। ব্যাপার না।

    এহসানের মন্তব্যটা মনে ধরছে

    গল্পটা ক্যাডেট কলেজের মঞ্চে নাটক হিসাবে দারুন জমবে। চরিত্র কম। কোনো মেয়ে ক্যারেক্টার নাই। আর ডায়ালগ গুলোও মার মার কাট কাট হয়েছে।

    তুমি কিশোরদের ইনোসেন্স ভাবটা কেমন ধরে রাখ লেখায়। আমি কিছু লিখতে চাইলেই দুইনম্বর চিন্তা চইলা আসে। কি যে যন্ত্রনা।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  10. টিটো রহমান (৯৪-০০)
    কিন্তু আপনার আনিস নামটা তো বেশ।

    তখন স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে না, আনিস নামটা জানল কেমনে????
    সম্প্রতি এই প্যাটার্ন শীর্ষেন্দুর একটা গল্প পড়লাম

    যাইহোক.........একটানে পড়ার মত


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬ - ০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।