ব্যক্তিগত ভাব নেওয়ার একটা ‘স্থূল প্রয়াস’

অনেকদিন সিসিবি’তে কিছু লিখা হচ্ছে না। কারণ আর কিছুই না, পড়াশোনার চিপায় পড়ে কিছুদিনের জন্য চ্যাপ্টা হয়ে আছি। মাসরুফ-কর্তৃক আমার ‘কি যেনো’ চাওয়ায় মনে পড়ল আমার একটা বিশেষ স্মৃতি; সিসিআর এবং আইসিসিএএম নিয়ে। আজ পড়া সময়ের একটু আগেই শেষ হয়েছে। এই সুযোগে সেই স্মৃতিটাই শেয়ার করি।

১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় আইসিসিএএম অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহীতে। আমি তখন ক্লাস ইলেভেনে। আমাদের কলেজ থেকে ১১০ মিটার হার্ডলস এ নাম লিখিয়েছি। ক্লাস নাইন থেকে এই ইভেন্টে বরাবর ১ম হয়ে এসেছি। তাই স্বভাবতঃই একটা আশা ছিল ভালো করার। আর সেনাবাহিনীর যে কোচ আমাদের ৩ মাস ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, তার ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী কমপক্ষে ৬টা গোল্ড মেডেলের একটা আসার কথা আমার হাত ধরে B-) ।

যাই হোক, রাজশাহীতে গেলাম। সময়টা ছিল সম্ভবত ১৯৯৪ এর ডিসেম্বর। কলেজে ছুটি হয়েছে। পদ্মার তীর ঘেঁসে বিশাল কলেজ। আমার খুব ভালো লাগল। নিজে গ্রামের ছেলে, তার উপর দাদা-বাড়ি যমুনার চরে হওয়ায় একটা আলাদা টান অনুভব করলাম। কিন্তু বিকেলে ট্র্যাক দেখে মনটা বেশ দমে গেলো। – ট্র্যাকের নানা জায়গায় বালুমাটি থাকায় সেটা ঢেকে দিতে তারা কাঁদামাটির প্রলেপ দিয়েছে। এর ফলে, কপাল খারাপ হলে পা পিছলে হার্ডলসের উপরে পরার সম্ভাবনা আছে যা’র পরিণতি পা’ ভাঙ্গা থেকে আরো খারাপ কিছু হতে পারে। যাই হোক, কি আর করা।

আগেরবার বরিশাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, আর আমরা ৫ম। এইবার আমাদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, চ্যাম্পিয়ন হবোই। সেই মহড়াও দেওয়া হয়ে গেছে হাই-জাম্পে সিসিআরের সকলের ব্যাক-জাম্প প্রদর্শনীর মাধ্যমে। প্রথম দিন যথারীতি লিড নিয়ে শেষ করলাম। দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই ছিল আমার ইভেন্ট- ১১০ মিটার হার্ডলসের হিট। বেশ ভালো লিড নিয়ে প্রথম হলাম। কিন্তু বিকেলে আমাদের দল ৪*৪০০ মিটার রিলে’তে ডিসকোলিফাইড হলো যেখানে কি না আমরা রেকর্ড আশা করছিলাম। পাশাপাশি একমাত্র ইভেন্ট হিসেবে লং-জাম্প থেকে কোন পয়েন্ট পেতে ব্যর্থ হলো সিসিআর। সর্বোপরি, দিন শেষে আমরা সামান্য ব্যবধানে ওভারওল লিডও হারালাম। শেষ দিনে চারটা ইভেন্টের সর্বশেষ দুইটা ৩০০০ মিটার ও ১১০মি হার্ডলস। দুটোতেই গোল্ড মেডেল প্রত্যাশি সিসিআর। ৩০০০ মিটারে আমাদের ব্যাচের শফিক দূর্দান্ত ফিনিসিং দিয়ে ১ম হলো, পাশাপাশি আমাদের সিনিয়র রহমান ভাইও ৬ষ্ঠ হয়ে ১ পয়েন্ট নিয়ে এলেন। সর্বশেষে এলো আমার পালা। আমি ৩য় হলেই সিসিআর চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু ১ম হতেই হবে, কারণ বরিশাল ইতোমধ্যেই চারটা গোল্ড পেয়ে গেছে, আর আমরা তিনটা। কাজেই, চ্যাম্পিয়ন হয়েও আক্ষেপ থাকবে যদি ওদের থেকে কম গোল্ড মেডেল পাই।

হিটে আমি প্রথম। কাজেই আত্মবিশ্বাস পুরোটাই ছিলো। কিন্তু কপাল খারাপ হল ট্র্যাক সিলেকশনে। কার্ড-বাছাইয়ে পেলাম হার্টসের দুই। দুই নম্বর ট্র্যাকে গিয়ে দেখি মাঝখানে বেশ কিছু স্থান জুড়ে বালুমাটির উপর কাঁদামাটির প্রলেপ আর হার্ডলসগুলো কাঠের আলনার মতো দুইদিকে পা’ ছড়িয়ে দাড়িয়ে আছে। হার্ডলসের একদিকে পা’ থাকার কথা যেন পায়ের সাথে টাচ লাগলে সাথে সাথেই তা’ পড়ে যায়। বুঝলাম কপালে খারাবী আছে। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার লে.ক. ওবায়েদ স্যারের ওয়াইফ মাথায় হাত বুলিয়ে দোওয়া করে দিলেন দৌড় শুরু করার আগ মুহূর্তে। বাঁশি বেজে উঠল। দৌড় শুরু করলাম।

স্টার্টিং হয়েছিল জটিল B-) । প্রথম হার্ডলস পার হতেই বুঝলাম আমি এগিয়ে আছি। মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ খানিকটা লিড নিয়েই দৌড়ালাম। কিন্তু যে আশংকা করছিলাম, সেটাই ঘটল ৭ নম্বর হার্ডলে গিয়ে। পায়ের নিচে কাঁদামাটির প্রলেপ ভেঙ্গে গেল। আর তা’তে আমার স্টেপ খনিকটা ছোট হয়ে আমাকে ল্যান্ড করালো ‘আলনা-টাইপ’ ঐ হার্ডলের উপরে। পরিমরি করেও দৌড়ে চললাম। দেখলাম আমাকে পাশ কাটিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরে আর কিছুই মনে নাই। ফিনিশিং লাইনে গিয়ে সেই প্রথমবারের মতো বুকে ফিতার স্পর্শ পেলাম না। মনটা খুবই দমে গেলো। পাশাপাশি হাটুর ব্যথায় পড়েই গেলাম।

সবাই এসে ঘিরে ধরলো। জানলাম আমি প্রথম দুইজনের একজন। বন্ধুরা আমার হাটুতে খুব বেশি কিছু হয়েছে কিনা তা চেক করা+ম্যাসেজ করা শুরু করলো। প্রিন্সিপাল স্যার এসে কংগ্রাচুলেট করলেন সিসিআর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বলে। কিন্তু সেই কন্ঠে জোড় কম মনে হলো। এমন সময়েই ‘বিডি’ স্যার এসে সগর্বে ঘোষনা করলেন যে, আমিই ১ম হয়েছি। তিনি ফটো তুলেছেন শেষ মুহূর্তের যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমি আগে ফিনিসিং লাইন পার হয়েছি (ছবিটা আমার বাড়িতে আছে, এখানে দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত)। প্রিন্সিপাল স্যার গেলেন বিচারকদের কাছে চুড়ান্ত ফলাফল জানতে। তারাও কনফার্ম করলেন আমার ১ম স্থান। সাথে সাথেই সিসিআরের বিখ্যাত দুই স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল পুরো এলাকা। B-)

সেই থেকে সিসিআরের আইসিসিএএম’ এ নতুন ইতিহাস রচনার শুরু। পরপর চারবারের হিসাব নিয়েছিলাম। বরাবরই চ্যাম্পিয়ন। B-) এরপর আর হিসাব রাখতে পারিনি।

সেইবারের পুরষ্কার বিতরণী শেষে সিসিআরের গ্রুপ ছবিটা দিলাম।

iccalrajshahi

আমি বসে আছি ছবিতে ডান থেকে দ্বিতীয়, ডিউটি ক্যাডেটের ঠিক সামনেই। 😀 ছবির ডান দিকে সাদা ট্র্যাকস্যুটে দাড়িয়ে আছেন অংকের আব্দুল হাই স্যার, তার পরে ডিনার স্যুট পড়ে দাড়িয়ে আছেন যথাক্রমে রসায়ণের মোখলেসুর রহমান স্যার, এডজুটেন্ট মেঃ রিফাই হাসান (জেসিসি) এবং প্রিন্সিপাল লেঃকঃ ওবায়েদ স্যার।

৪,৫৮৬ বার দেখা হয়েছে

৬২ টি মন্তব্য : “ব্যক্তিগত ভাব নেওয়ার একটা ‘স্থূল প্রয়াস’”

    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      একটা ছিলো এই রকম- "ইমেলদা... হুঁ ......হাঁ" (কোরাস)

      আরেকটা ছিলো- "চাপতে চাপতে লাবাডিং চাপাত্তে...... ধা"(কোরাস)

      -কোনোটারই কোনো মানে নাই 😛 । কে আবিষ্কার করেছিলো, তা'ও মনে নাই 😀 কিন্তু একজন শুরু করলেই বাকিরা কোরাস ধরতো, আর অন্য সব কলেজের পুলাপাইন তাকায়া দেখতো আমাদের কান্ডকারখানা। কিন্তু কিছুই বুঝতো না।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    মাসরুফ-কর্তৃক আমার ‘কি যেনো’ চাওয়ায় মনে পড়ল আমার একটা বিশেষ স্মৃতি; সিসিআর এবং আইসিসিএএম নিয়ে B-) B-) B-)

    সিসিয়ারের "কামলা" নামের এই তাইলে ইতিহাস!!!আমরা আজো অবাক হই এইটা ভাইবা যে এরা এথলেটিক্সে এত্ত ভাল কেমনে! 😮 😮

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আপনাদের সময় কি তালুকদার স্যার ছিলেন?ওই লোক একাই একটা টীমের চেহারা পালটায় দিতেন-বাপ রে!২০০১ এ এমসিসিকে রানার আপ করার অর্ধেক কৃতিত্ব উনার,বাকিটা ক্যাডেটদের :boss: :boss:

    জবাব দিন
  3. ভাই,

    আপনি একটা সিরাআআম জিনিস।
    সেই সাথে সি সি আর এর কাহিনী জাইন্না ভালা লাগলো...

    এই তাহলে ইতিহাস??
    আপনি এই মানুষটা কত্ত জিনিয়াস !!!
    😀 😀 😀

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)
    সিসিআরের “কামলা” নামের এই তাইলে ইতিহাস!!!আমরা আজো অবাক হই এইটা ভাইবা যে এরা এথলেটিক্সে এত্ত ভাল কেমনে!


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    মাহমুদ ভাই, এর পাশাপাশি আমরা বাস্কেটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম বরিশাল ক্যাডেট কলেজ অনুসঠিত ঐ কম্পিটিশনে আমরা হটফেবারিট সিলেটকে হারিয়েছিলাম। সেখানেও সিসিআরের স্ট্যামিনারের একটা সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। চ্যাম্পিয়নশিপের কাপ হাতে সেই ছবিটা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছিনা। Me with ICCBM trophy

    জবাব দিন
  6. সামি হক (৯০-৯৬)

    আরসিসি র মাঠ সবসময়ে সিরাম ছিল সেই সব দিনগুলোয়, মাঠে গরু চড়ানোর ফলাফল, ট্র্যাক এ তাই এই অবস্থা ছিল। আর তারপর রংপুরের এক্স ক্যাডেট এ্যাডজুটেন্ট পরাম ওই ট্র্যাকে আমাদের প্যারেড আর পিটি করায়ে আরো ভালো মতো অবস্থা খারাপ করেছিল।

    ওইবার অ্যাথলেটিক্সের সময়েইতো মনে হয় আমাদের এ্যাডজুটেন্ট কে বাকী আট টা কলেজ মিলায়ে চরম পচানী দিয়েছিল না?

    ও আরেকটা কথা ডিউটি ক্যাডেট কি আমাদের কলেজের? ছবি দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ব্যাচের হায়দার(যাকে আমরা হারিয়েছি সড়ক দুর্ঘটনায়)।

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
      রংপুরের এক্স ক্যাডেট এ্যাডজুটেন্ট পরাম

      - তার নানান কীর্তিকলাপের কথা শুনেছি রাজশাহীতে যেগুলো ক্যাডেট হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন। এজন্য আমরা বেশ খানিকটা লজ্জিত হয়ে ছিলাম।

      আর ডিউটি ক্যাডেটকে আমিও ঠিক মনে করতে পারছি না।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
      • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

        আমাদের এডজু্টেন্ট স্যার ছিলেন রংপুরের ঐতিহাসিক গেমস প্রিফেক্ট এটিএম নুরুন্নবী সরকার।এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে ভাল-মন্দ মিলিয়েই ছিলেন তিনি-তবে এথলেটিক্সে তাঁর দক্ষতা কিংবদন্তীর পর্যায়ে।রিলে রেসে উনার সম্ভবত আইসিসি রেকর্ড ছিল যা আমাদের সময় পর্যন্ত বহাল ছিল।

        অফ টপিক-মাহমুদ ভাই, লজ্জা কিছুটা কমছে? :shy:

        জবাব দিন
        • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

          হুম।

          আইসিসি'র কথা জানি না। কিন্তু আমাদের কলেজে আমাদের সময় পর্যন্ত সবথেকে বেশি ব্যক্তিগত রেকর্ড উনারই ছিলো।
          "নূরুন্নবী ভাই ওয়াজ দি বস অফ এথলেটিকস"- B-) B-)

          রিলে রেসে উনার ব্যক্তিগত রেকর্ডের কথা বলে 'টিপ্পনী' দেওয়ায় তোমারে :thumbdown: :thumbdown:


          There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

          জবাব দিন
    • এ্যাডজুটেন্ট পরাম

      এই লোকের বীভসৎ কাহিনী শুনে আমাদের গায়ের রোম খাড়া হয়ে যেত।
      সিনিয়র ভাইরা আমাদের অনে-ক অনে-ক পানিশমেন্ট (যা আমাদের সময়ে ফৌজিয়ান্স বাদে আর কারো চিন্তার ক্ষমতা ছিলো না) দেয়ার পরে টলারেন্স বাড়ানোর টনিক হিসেবে ক্যাপ্টেন পরামের কাহিনী বর্ণনা করতেন।

      🙁 🙁 🙁

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামি হক (৯০-৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।