তথ্য বিশ্লেষনের কিছু প্রাথমিক ধারনাঃ প্রেক্ষিত দারিদ্র্য ও সন্ত্রাস

আমরা প্রায় সব সময়ই কোন না কোন বিষয়ের আলোচনায় যুক্তিসমূহ তথ্যের মাধ্যমে ধারালো করি, যা বিপরীত যুক্তিকে ফালাফালা করে কেটে ফেলে। :duel: কিন্তু এইখানে কিছু ট্রিক্স আছে, যা একটু সচেতন চোখে দেখতে চেষ্টা করলেই ধরা পড়ে। এরকম দুয়েকটার উল্লেখ করছিঃ

এক, প্রায়ই দেখা যায় দুটো বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সহ-সম্পর্ক (correlation)- কে ব্যাখ্যা করা হয় কার্য-কারণ (causal) সম্পর্ক হিসেবে। উদাহরনস্বরুপ, ধরা যাক অংকে প্রাপ্ত স্কোর আর উচ্চতার মধ্যে সম্পর্ক। কোন একটা হাইস্কুলে গিয়ে ১০০ জন ছাত্রের মধ্যে জরীপ করে দেখা গেলো যে, অংকে প্রাপ্ত স্কোর আর উচ্চতার মধ্যে পজিটিভ সহ-সম্পর্ক বিদ্যমান, অর্থ্যাত উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে অংকের স্কোরও বাড়ে। এখানেই যদি কার্য-কারণ সম্পর্ক ধারনা করে উপসংহার টানা হয়, তাহলে কিন্তু বিরাট ভুল হবে। কারন, এই দুই ভেরিয়েবল এর মধ্যে আরেকটা ভেরিয়েবল আছে, যা দুটোকেই বাড়ায়; তা হলো ছাত্রদের বয়স বা ক্লাস। বড় ক্লাসের ছাত্ররা অংকে বেশি স্কোর ত পাবেই, ছোট ক্লাসের তুলনায় ওরা বেশি বেশি পড়ার সুযোগ পায় বলে। আর বড় ক্লাসের ছাত্রদের উচ্চতাও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক, বিশেষ করে হাইস্কুলে (কারন, এসময়ই পুলাপাইন বাড়ে)।

– পরিসংখ্যান ক্লাসে এই আলোচনাটা সব সময়ই মনে হতো আজাইরা। বাস্তবে এই বিষয়টা যে কতটা গুরুত্বপুর্ণ তা প্রথম উপলব্ধি করেছি উন্নয়ন বিষয়ক ক্লাসগুলোতে গিয়ে, বিশেষ করে দারিদ্র্যের সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক বিশ্লেষনে। আমাদের নোবেল-বিজয়ীর কল্যানে এখন বিশ্বের সবাই জানে যে, দারিদ্র্য সন্ত্রাসের জন্ম দেয় (দারিদ্র্য=কারন> সন্ত্রাস=ফলাফল)। এই মহান সূত্র আবিষ্কারের কৃতিত্ব আসলে ইউএনডিপি’র বিখ্যাত উন্নয়ন বিষয়ক তাত্ত্বিক পাকিস্তানী জিয়াউল হক যিনি ইউএনডিপি’র ১৯৯৪ সালের বার্ষিক রিপোর্টে প্রথম এই ধারনা দেন। এরপর থেকে ইউএনডিপি’র কার্যক্রমের কেন্দ্রে চলে আসে দারিদ্র্য বিমোচন, এই কারনে দারিদ্র্য যে দারিদ্র্য সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। এই সূত্রের সমর্থনে যত তথ্য, তার প্রায় সবই নেওয়া হয় তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশ থেকে যেখানে দারিদ্র্য+সন্ত্রাস পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে (কাজেই সহ-সম্পর্ক সহিহ)। যেমন, কঙ্গো, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ে, ইত্যাদি। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার দেশগুলোও আছে। ইউএনডিপি’ আর পশ্চিমের “তথাকথিত দাতা” দেশ+সংস্থাগুলোর ক্রমাগত প্রচারে এই সহ-সম্পর্কই উন্নয়ন-চিন্তায় (discourse) স্বীকৃত হয় কার্য-কারন সম্পর্কে- দারিদ্র্য সন্ত্রাসের কারন।

একটু ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায় এই সূত্রের অসারত্ব। এইসব দেশে যে সন্ত্রাস, তার কারন দারিদ্র্য নয়, বরং অন্যান্য কিছু বিষয় যা ইউএনডিপি’ + “তথাকথিত দাতা” দেশ+সংথাগুলো গোপন করতে চায় অথবা অস্বীকার করতে চায়। তেমন একটা বিষয় হলো, স্থানীয়দের মধ্যে বিবাদ জিইয়ে রেখে একদিকে সুলভে প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ, আরেক দিকে তাদের মধ্যে অস্ত্রের একচেটিয়া ব্যাবসা করা। এছাড়াও অর্থনৈতিক বৈষম্য, ডিপ্লোম্যাটিক স্বার্থ, সরাসরি বহিরাক্রমন, ইত্যাদি ত আছেই। এসব “না-বলা-ফ্যাক্টর” একই সাথে দারিদ্র্য+সন্ত্রাস বাড়ায়, ছাত্রদের বয়স যেমন একই সাথে অংকের স্কোর+উচ্চতা বাড়ায়।

দুই, শুধু সহ-সম্পর্ক থাকলেই যথেষ্ট না, কার্য-কারন সম্পর্ক দেখতে হলে আগে কোনটা আগে আর কোনটা পরে ঘটতে পারে তা যুক্তি দিয়ে নির্ধারন করতে হয়। যেমন, বোঝার স্বার্থে ধরা হলো যে, অংকের স্কোর আর উচ্চতা সম্পর্কিত। এখানে যদি ধরা হয় যে, ছাত্রদের উচ্চতা তাদের অংকের স্কোর বাড়ায়, তাহলে ঠিক আছে। কারন বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছাত্রদের পড়া বাড়ে, উচ্চতাও বাড়ে যা কিনা অংকের স্কোর বৃদ্ধি করতে পারে। তার মানে, আগে ছাত্রদের উচ্চতা বাড়ে, আর সেটা তাদের অংকের স্কোর বৃদ্ধি করে। কিন্তু যদি বলা হয় যে, ছাত্রদের অংকের স্কোর বাড়লে তা তাদের উচ্চতা বৃদ্ধি করে, অন্যভাবে, ছাত্রদের অংকের স্কোর বাড়ছে বলে তাদের উচ্চতাও বাড়ছে। হইলো?

– এই বিষয়টাও আগেরটার মত আজাইরা প্যাচাল মনে হইতো। কিন্তু আবারো দারিদ্র্যের সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক জানতে গিয়ে এটা পরিষ্কার হয়া গেল। যেই দেশগুলাতে দারিদ্রের কারনে সন্ত্রাস হচ্ছে বলা হয়, তাদের কোনটাই অনন্তকাল ধরে সন্ত্রাস-কবলিত নয়। সন্ত্রাসের সাথে তাদের সহবাসের ইতিহাস মাত্রই দুই, ক্ষেত্রবিশেষে তিন দশকের। এর আগে তো তারা মোটামুটি শান্তিতেই বসবাস করত। যদি আলোচনার খাতিরে ধরে নেই যে, দারিদ্রের কারনেই এসব দেশে সন্ত্রাস হচ্ছে, তাহলে আরেকটা বিষয় সত্য হওয়া আবশ্যক যে, এইসব দেশ আগে ধনী ছিল, তাই তখন সেখানে সন্ত্রাস ছিল না। কিন্তু প্রচলিত মাপকাঠিতে (গড় মাথাপিছু আয়) তাদের কোনটাই তো এখনকার থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না। তাইলে আয় অপরিবর্তিত (অনেক দেশের ক্ষেত্রে বেড়েছে) থাকার পরও কেনো সন্ত্রাস বাড়ছে সেখানে?- কাজেই, “দারিদ্র্য সন্ত্রাসের কারন” সূত্রটা একটা চাপাবাজি।

কিন্তু সন্ত্রাস ঠিকই দারিদ্র্য বাড়াতে পারে। কারন, সন্ত্রাস-কবলিত হলে সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, দৈনন্দিন নিরাপত্তা, জীবনের নিশ্চয়তা (সবগুলোই আয় এবং জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে) এসব কিছুই ব্যাহত হয়। ফলে অনিবার্যভাবেই দারিদ্র্য আসে।

২,৫০৭ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “তথ্য বিশ্লেষনের কিছু প্রাথমিক ধারনাঃ প্রেক্ষিত দারিদ্র্য ও সন্ত্রাস”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    হঠাৎ কইরা আবার এইটা নিয়া কেন পড়লা বুঝতে পারলাম না। মাথায় সন্ত্রাস ঘুরছে নাকি? জাহিদের পোস্টে আমার কমেন্টে কি কইতে চাইলা তাও বুঝবার পারি নাই, যদিও তোমারে ছাড়ি নাই, আমিও একটা মারদাংগা উল্টাপুল্টা কমেন্ট মাইরা আসছি।

    থিসিসে পেপার গুছাইতেছ নাকি?

    যাউজ্ঞা, লালন সঙ্গীতের/দর্শনের কি খবর?


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. আলম (৯৭--০৩)

    আপনার লেখাগুলোর ভেতর বাস্তব জীবনের কোনো অ-সাধারন অর্থবহ ইংগিত লুকানো আছে কিনা, খোঁজার চেষ্টা করি। আরো লিখুন, নিরপেক্ষ মন্তব্য পড়তে ভাল্লাগে। 🙂 তবে আরেকটু সহজ করে লিখলে ভাল হয় আরকি। 😉

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    মাহমুদ ভাই,
    সেরকম দুর্দান্ত এনালাইসিস বস্‌ :boss: :boss:
    সামনে নিশ্চয়ই তথ্য বিশ্লেষনের অন্যান্য আরো পরিপ্রেক্ষিত আনবেন আলোচনায়। এত সাবলীল ভাষায় সহজে বোধগম্য করে লিখার জন্য আমাদের মতন ম্যাংগো পাব্লিকের পক্ষ থেকে :salute:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. মোস্তফা (১৯৮৮-১৯৯৪)

    তোমার কথা ঠিক আছে, কিন্তু এটাও তো পর্যবেক্ষন করা যাচ্ছে যে বিভেদ (রাজনীতি) বল, মৌলবাদ বল, আর অস্ত্র ব্যবসায়ী বল, সবাই দরিদ্রদের ব্যবহার করছে। তারমানে দারিদ্রতার সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক থাকেই।

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      @মোসফা ভাই,

      দারিদ্রতার সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক আছে, সেটা আমিও স্বীকার করেছি। কিন্তু আমার কথা হল, সেই প্রকৃতি নিয়ে। আমি বলতে চাইছি যে, সম্পর্ক থাকলেই তা কার্যকরন সম্পর্ক নয়। দুইটো ভ্যারিয়েবল এর মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে কার্যকরন সম্পর্ক হতে হলে দুটো শর্ত পূরণ করতেই হয়, যা উপরে উল্লেখ করেছি। এটা স্ট্যস্টিসটিকসের খুবই বেসিক একটা ধারণা 🙂 ।

      কোনটা কারণ আর কোনটা ফলাফল, তা নির্ণয় করা খুবই জরুরী। কারণ, কারণকে ফলাফল আর ফলাফলকে কারণ হিসেবে বিবেচনা করলে পুরা দৃশ্যপট উল্টে যায় :no:


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রবিন (৯৪/ককক)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।