যুক্তির নিরিখে বিজ্ঞানমনস্কতা, সত্যজ্ঞান ও প্রগতিশীলতার বিষয়ে আমার ভাবনা

বিজ্ঞানমনস্কতা আজকাল ভার্চুয়াল বাংলা জগতে স্মার্টনেসের নির্দেশ করার সাথে সাথে বিজ্ঞানমনস্কতার দাবিদার ব্যক্তিকে অন্যান্য সকলের থেকে আলাদা এবং প্রাগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করার অন্যতম পরিমাপক হয়ে উঠেছে। ব্লগে, ফেসবুকে, এমনকি টিভির টকশো’তেও কেউ কেউ নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতার দাবি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটা বিশেষ ধারার জ্ঞানচর্চাকে প্রগতিশীল আর বাদবাকিগুলোকে প্রতিক্রিয়াশীল/পশ্চাৎমুখী/গোড়া ইত্যাদি বর্গে ফেলছে। মানুষ হিসেবে অগ্রগতি আমরা সকলেই চাই। আর এ’ পথের পাথেয় হিসেবে বিজ্ঞানমনস্কতাও একটা অতি প্রয়োজনীয়, ইনফ্যাক্ট অত্যাবশ্যকীয়, গুণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আশ্চার্যজনক বিষয় হলো এহেন গুরুত্বপূর্ণ+আরাধ্য গুণ বিজ্ঞানমনস্কতা আদতে কি তা’ নিয়ে খুব একটা আলোচনা দেখা যায়না। তবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো করে বিজ্ঞানমনস্কতা বোঝার একটা শর্টকাট তরিকা বাজারে চলতি আছেঃ যারা ধর্ম+অলৌকিকতা+প্রথা+ইত্যাদি (যা’ কিছু এম্পিরিক্যালি প্রমাণ করা যায়না) বিষয়াদিতে বিশ্বাস করেনা, তারা বিজ্ঞানমনস্ক। এখানে একটা মজার পর্যবেক্ষণ আছে। বিজ্ঞানমনস্কতা আল্লা-খোদায় বিশ্বাস করেনা কারণ স্রষ্টার অস্তিত্ব এম্পিরিক্যালি প্রমাণ করা যায়না। আবার নাস্তিকও আল্লা-খোদায় বিশ্বাস করেনা। এখান থেকে এই অনুসিদ্ধান্ত আসে যে, নাস্তিকও অনিবার্যভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞানমনস্কতা সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ ধারণাও অনেকটা এমন যে, ধর্মকে ছুড়ে ফেলে দেওয়াই বিজ্ঞানমনস্কতা। বিপরীতে, ধর্মকে আশ্রয় করা হলো পশ্চাৎমুখিতা, বা গোড়ামী। অর্থ্যাৎ, বিজ্ঞানমনস্ক হলে তা’র প্রভাব/ফলাফল কি হয়, তা’র উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানমনস্কতা কি তা’ বোঝার প্রয়াস। এই চর্চা অনেকটা এরকম যে, আমি বাংলা ভাষায় কথা বলি বলে আমি বাঙালি। অথচ, প্রকৃত সত্য হল আমি বাঙালি বলেই বাংলা ভাষায় কথা বলি। কারণ, বাঙালির ঘরে জন্ম না-নিয়েও অনেকে বাংলায় কথা বলা শিখে নিতে পারে। কিন্তু বাঙালির ঘরে জন্ম নিলে বাংলায় কথা বলাটা বাই-ডিফল্ট হয়ে যায়।

যাই হোক, বিজ্ঞানমনস্কতা কি তার তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে অনুজপ্রতীম মাসরুফের ফেসবুকে একটা সুন্দর+গোছানো সংজ্ঞা পেলাম (বিজ্ঞানমনস্কতা কি?)। [উল্লেখ্য, এখানেও আলোচনা শুরু হয়েছে সাধারণে প্রচলিত বিজ্ঞানমনস্কতা=নাস্তিকতা এ’ই অনুমানকে ভুল দাবি করে। অর্থ্যাৎ, এটা এ’ই প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানমনস্কতা আর নাস্তিকতাকে একাকার করে ফেলার একটা প্রবণতা বর্তমানে বিদ্যমান]। বিজ্ঞানমনস্কতা’কে ইংরেজী Scientific Mind ধরে নিয়ে এই সংজ্ঞা বিজ্ঞানমনস্কতার নিম্নোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেঃ

১। নিরপেক্ষতাঃ‬ কোন বিষয়ে পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত থাকা চলবে না।
২। প্রমান_সাপেক্ষতাঃ‬ বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রমাণ ছাড়া কোন বিশ্বাসের কানাকড়ি মূল্য নেই, তা সেটা যেই বলুক না কেন।
৩। নমনীয়তাঃ‬ প্রকৃত বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা প্রমাণে বিশ্বাস করে, এবং প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের মতামত পরিবর্তন করে| সত্যিকারের উন্মুক্ত মনের অধিকারী যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীরা।
৪। পদ্ধতিগত_ধাপ_অনুসরণ‬ : বিজ্ঞানমনষ্ক মন হুট করে একটা কিছু চিন্তা করেই উপসংহার টেনে বসেনা। কোন বিষয়ে উপসংহার টানার আগে সেটা পরীক্ষা নিরীক্ষা, গবেষণা, নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ এবং সঠিকভাবে ফলাফল প্রদর্শনের মাধ্যমেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

মাসরুফ তার নোট (স্বচ্ছচিন্তা#আট) এই সিদ্ধান্ত দিয়ে শেষ করেছে যে, কারো মধ্যে উল্লিখিত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে। চমৎকার যুক্তির গাঁথুনি আর ঝরঝরে গদ্যে বিজ্ঞাননমস্কতার প্রকৃত সংজ্ঞা তুলে ধরার এই প্রয়াসের জন্য মাসরুফ অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। আর বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি সম্পর্কে তার বক্তব্য ফেলে দেওয়ারও জো’ নাই। তবে এই সংজ্ঞা গ্রহন করার আগে এর ভিত্তিতে যে অনুমান আছে, তা’র যথার্থতার বিচার ছাড়া এই সংজ্ঞা অর্থহীন। এই অনুমানগুলো নিম্নরূপঃ

১। এম্পিরিক্যালি প্রমাণযোগ্য তথা ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান বিজ্ঞানভিত্তিক, এবং এই জ্ঞানই একমাত্র সত্য।
২। চিন্তাশীল মানুষ (subject) বাস্তব তথ্যের বিচারের মাধ্যমে এই জ্ঞান আহরন করতে, তথা বিষয়কে (object) বুঝতে সক্ষম।

কিন্তু মানুষ যে নিশ্চিৎ জ্ঞান লাভ করছে, তা’র গ্যারান্টি কি?- উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে ৪নম্বরটি তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (তথা, এম্পিরিক্যাল পদ্ধতি) এই নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে বলে আমরা জানতে পারছি মাসরুফের নোটে। এখন বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের আলোকে দেখা যাক বিজ্ঞানমনস্কতার ভিত্তিমূলে এসব অনুমানের যথার্থতা কতটুকু।

ইউক্লিডের জ্যামিতি, নিউটনের পদার্থ বিজ্ঞান ও ফ্রান্সিস বেকনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্র ধরে যে বিজ্ঞানচিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল ইউরোপে তা পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে ১৬ থেকে ১৭ শতকের মধ্যে। আধূনিক বিজ্ঞানের সেই যুগে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতিষবিজ্ঞান, প্রাণবিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন শাস্ত্র ইত্যাদি নানান দিক থেকে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে জানবার তীব্র তাগিদের শুরু। আমরা এইসব বিজ্ঞানকে সাধারণভাবে বলি প্রকৃতি বিজ্ঞান (natural sciences)। উল্লেখ্য যে, এসব বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে শুধু টেকনোলজির বিকাশই ঘটেনি, বিপ্লব ঘটেছে মানুষের চিন্তার জগতেও। আর সেই বিপ্লবের মোদ্দাকথা হচ্ছে, মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা প্রত্যক্ষ বিষয়ই কেবল সত্য। যা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে, তার সত্যতা/নির্ভুলতা নির্ণয় অসম্ভব। অর্থাৎ, যে সব বিষয়কে আমরা বস্তুপদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করি তা’ই সত্য এবং এদেরকে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ ভাবে দেখে+জেনে যে বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে সেই বিজ্ঞানই সত্যের একমাত্র দাবীদার। আর এই সত্যকে জানবার জন্য প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে আমাদের যে যুক্তি+বুদ্ধির অভ্যাস গড়ে উঠেছে (তথা পদ্ধতি, প্রকরণ, ইত্যাদি) সেসবই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পদ্ধতি বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে স্বীকৃতি পেতে পারে।

আধুনিক দর্শনের জনক হিসেবে স্বীকৃত ফ্রান্সের দার্শনিক রেনে দেকার্তে তার বিখ্যাত Discourse on the Method (১৬৩৬) গ্রন্থে ‘মানুষের ইন্দ্রিয় সঠিক তথ্য সংগ্রহ+সরবরাহ করে’ এই অনুমানকে ভুল প্রমাণ করলেন। স্বপ্নের মধ্যে আগুনের উত্তাপ উপলব্ধির উদাহরণ দিয়ে দেকার্তে ব্যাখ্যা করলেন কিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয় সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। তিনি বললেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয় আগুনের তাপ উপলব্ধি করার মাধ্যমে আমাদেরকে এই জ্ঞানদান করে যে, ধারেকাছে কোথাও আগুন আছে। কিন্তু তিনি নিজেই স্বপ্নে আগুন দেখেছেন এবং উত্তাপও উপলব্ধি করেছেন। তাহলে জাগ্রত অবস্থায় তার ইন্দ্রিয় তাপ অনুভবের মাধ্যমে আগুনের উপস্থিতিকে জানান দিল। আবার স্বপ্নের মধ্যে তার ইন্দ্রিয় আগুনের বাস্তবিক অনুপিস্থিতি সত্বেও আগুনের উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য দিল। অর্থ্যাৎ, ইন্দ্রিয় নিশ্চিত করে বলতে ব্যর্থ কোনটা বাস্তব আর কোনটা স্বপ্ন, তথা, অবাস্তব। দেকার্তে (এবং তার অনুসারীরা) এম্পিরিসিস্টদের ‘ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান একমাত্র সত্যজ্ঞান’ এই দাবীকে বাতিল করে বললেন যে, সত্য জ্ঞান আসে কেবলমাত্র নির্ভেজাল যুক্তির (pure reason) মাধ্যমে। দেকার্তের মতে, যুক্তি মানুষের মজ্জাগত (Essence)। [এ প্রসঙ্গেই দেকার্তে করেছিলেন পাশ্চাত্য দর্শনের অন্যতম বিখ্যাত উক্ত- I think, therefore, I exist]। আর এই যুক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রায়োগই (strict application) কেবল সত্যজ্ঞানের সন্ধান দিয়ে পারে। দেকার্তে যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের জন্য একটা সিস্টেম্যাটিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করলেন যা’কে নিম্নোক্ত চারটি ল’ এর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়ঃ
১। নিজে যা’ প্রমাণ করতে সক্ষম, তা ব্যাতীত অন্য কিছু কখনোই বিশ্বাস না করা,
২। যেকোন জটিল সমস্যাকে তা’র সবথেকে সরল (বিমূর্ত) পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা,
৩। যুক্তির সুবিন্যস্ত নিয়মের মধ্যে চিন্তাকে চালিত করা এবং সরল থেকে ক্রমান্বয়ে জটিল পর্যায়ে বিশ্লেষণকে এগিয়ে নেওয়া,
৪। সমস্যা সমাধানের বেলায় সর্বদা যুক্তির দীর্ঘ মালা (Chain of reasoning) তৈরী করা যেন বিষয়ের (object) কোনকিছুই বাদ না-থেকে যায়।

এই থেকে পরবর্তীতে উদ্ভব হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির, যা’ আজও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চার প্রধান রীতি। উল্লিখিত পদ্ধতিগত ল’ গুলোতে একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাবো কিভাবে দেকার্তে আধূনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন। প্রথম ল’ আমাদেরকে অনিবার্যভাবেই সংস্কার (prejudice) ত্যাগ করতে বলে, সেযব সংস্কার আমাদের মধ্যে চলে আসে বয়স+শিক্ষা বাড়ার সাথে সাথে। দ্বিতীয় ল’ আমাদেরকে বলে প্রত্যেক সমস্যাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে সবথেকে সরল পর্যায়ে নিয়ে আসতে, যা’ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের রীতি। তৃতীয় ল’ মূলতঃ যা’কে গাণিতের ভাষায় বলে order of operation; অর্থ্যাৎ, বিষয়ের সরল পর্যায়কে ব্যাখ্যা করা শুরু করে ক্রমান্বয়ে জটিল পর্যায়ে যাওয়া। আর চতুর্থ ল’ আসলে ডিটেইল এর প্রতি মনোযোগী হওয়াকে নির্দেশ করে।

দেকার্তের মূল শিক্ষাটি হলো- বস্তুজগৎ মানুষের অস্তিত্বের বাইরের বিষয় এবং কেবলমাত্র এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ তথ্যে জ্ঞান লাভ হয়না। এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যকে আমাদের স্বভাবজাত বুদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা+বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই কেবল সত্যজ্ঞানে উপনীত হওয়া সম্ভব। পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী দেকার্তের এই ধারা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চর্চাকে চালিত করেছে।

দেকার্তের প্রায় একশতক পরে আঠার শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে জার্মান দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানচর্চায় আরেকটা সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করলেন। বিজ্ঞান চর্চায় বিষয়ী (Subject) আর বিষয়ের (Object) মধ্যে যে পারস্পারিক বিচ্ছিন্নতা (অর্থ্যাৎ জ্ঞানানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিসত্বা অধীত বস্তুসত্বা থেকে আলাদা), কান্ট সেই অনুমানকে ভুল প্রমাণ করলেন। তিনি দেখালেন যে, বস্তুজগৎ আমাদের জ্ঞানের বিষয় (Object) ঠিকই, তবে এই জগৎকে আমরা যেভাবে আমাদের সত্বার থেকে বাইরে আছে বলে জানি তা পুরোটা ঠিক না। এটা এইজন্য যে, জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা যে জ্ঞানার্জন করি, তা’ শুধুমাত্র অধীত বস্তুর উপর ভিত্তি করে নয়, এরসাথে অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয়ে পড়ে অবস্তুগত কিছু উপাদান যা’র উৎস আমাদের বুদ্ধি। যেমন কোন বস্তুকে আমরা যখন প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করি তখন তাকে বিশেষ সময়ে বা বিশেষ কালে উপলব্ধি করি। আমার সামনে এখন একটা ল্যাপটপ আছে, জানালার ঠিক বাইরেই একটা সবুজ পাতাভরা গাছ দেখছি, সেই গাছের একটু দুরে আমাদের গাড়ি পার্ক করা। এই যে তিনটা ভিন্ন ভিন্ন বস্তু দেখছি, এর সবই বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ কালে আছে। ল্যাপটপটা লেনোভো থিংকট্যাংক, গাছে পাতার রঙ ঘন সবুজ, গাড়িটা হোন্ডা সিভিক মডেলের। উল্লিখিত এসব গুণাবলী এইসব বস্তুর নিজস্ব গুণ। কিন্তু যে সময় এবং যে স্থানে এই বস্তুগুলো প্রত্যক্ষ করছি, সেগুলো এসব বস্তুর নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। যেভাবে আমরা বলছি ল্যাপটপ বা গাড়ির মডেল, গাছের পাতার রঙ তাদের নিজ সত্বার মধ্যে ‘আছে’, সেইভাবে বলতে পারছি না যে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করার নির্দিষ্ট মুহূর্ত বা স্থানটিও তাদের মধ্যে ‘আছে’। অর্থ্যাৎ, সময় বা স্থান বস্তুর অন্তর্গত নয়, বরং এই উপাদানগুলোকে আমাদের বুদ্ধি জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বস্তুর উপর আরোপ করে।

কান্ট মনে করেন যে, এইসব বহিঃস্থ উপাদান বস্তুকে জানার আবশ্যিক শর্ত যা’ ছাড়া বস্তুকে প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব। যেমন, একটা গাছকে বাস্তবে প্রত্যক্ষ করতে হলে অবশ্যম্ভাবীরূপেই আমরা তাকে দেখি একটা বিশেষ সময়ে। এখন বর্ষাকাল বলে পাতার রঙ সবুজ; আবার শীতকালে গাছে কোন পাতাই থাকেনা। অর্থ্যাৎ, গাছের পাতা যে সবুজ তা’ বর্তমানের এই বিশেষ সময়েই (বর্ষাকালে) সত্য, অন্যসময় নয়। একইভাবে, গাছের সবুজ পাতা এইসময়ে শুধুমাত্র এই স্থানের ক্ষেত্রেই সত্য, অন্য কোথাও নয়। অতএব, স্থান (দেশ) বা সময় (কাল) বস্তুর অন্তর্গত গুণ না হলেও দেশ+কালের শর্ত ছাড়া আমাদের পক্ষে কোন বস্তু প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করা কার্যতঃ অসম্ভব। একারণে, কোন কিছুর উপলব্ধি করার অর্থ তাকে বিশেষ দেশ+কালে উপলব্ধি করা। উপরন্তু, কান্ট আরো দেখান যে, আমরা বস্তুজগতের ততোটুকুই জানি যতোটুকু দেশ+কালের শর্তের মধ্যে থেকে আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে ধরা দেয়, যাকে কান্ট বলেছেন phenomenon। বস্তুজগতের আরেকটা অংশ আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে অধরাই রয়ে যায়, যাকে কান্ট বলেছেন noumenon।

মোটকথা, ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এম্পিরিক্যাল বা প্রকৃতি বিজ্ঞান যে জ্ঞান অর্জন করে, তা সমগ্র জগৎকে ধারণ করে না। অর্থ্যাৎ, এরূপ জ্ঞান একমাত্র সত্যজ্ঞান হতে পারেনা। জগতের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই বিজ্ঞানের অধরা থেকে যায়। অতএব, এম্পিরিক্যাল বিজ্ঞানের জ্ঞানই চুড়ান্ত সত্য নয়। একইভাবে, প্রকৃতি বিজ্ঞানের আবিস্কৃত জগৎই একমাত্র বাস্তব জগৎ নয়, বরং এর একটা খন্ডিত অংশমাত্র।

অর্থ্যাৎ, এপর্যায়ে এই বিষয়টা পরিস্কার যে, “বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিমাত্রই সত্যজ্ঞানে জ্ঞানী, আর বিপরীতে বিজ্ঞানমনস্ক নয় এমন ব্যক্তির জ্ঞান ধর্তব্যই নয়”- এই ধারণা যুক্তির নিরিখে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ। অতএব, বিজ্ঞানমনস্কতাকে সত্যজ্ঞানের একমাত্র নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করাটা যুক্তির বিচারে অগ্রহনযোগ্য।

৫,৯৯২ বার দেখা হয়েছে

৪০ টি মন্তব্য : “যুক্তির নিরিখে বিজ্ঞানমনস্কতা, সত্যজ্ঞান ও প্রগতিশীলতার বিষয়ে আমার ভাবনা”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমাদের বিজ্ঞানমনষ্ক না হয়ে ইসলামমনষ্ক হবার সাধনা করতে হবে।
    কারণ তাতেই রয়েছে ইহজাগতিক ও পারজাগতিক সুখ সমৃদ্ধি।
    আর কোরানের চাইতে বিজ্ঞানময় কিতাব আর কি আছে!

    সো বৃথা বিজ্ঞানের পিছনে টাইম না দিয়া ইসলামের পিছে টাইম দেয়া দরকার।
    বিজ্ঞান গোল্লায় যাক।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      ব্লগের জগতে চলতি বিজ্ঞানমনস্কতার একটা দারুন উদাহরণ হিসেবে তোর এই মন্তব্যটা অসাধারণ :thumbup:

      এই মন্তব্যের কি উত্তর দিবো বুঝতে পারছিনা। সিসিবি'র পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম কে কিভাবে এইটা নিয়ে ভাববে।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  2. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    বিজ্ঞানের দর্শন বিষয়টা আমার বরাবরি আগ্রহের। আপনার লেখা পড়ে আমার না পোস্ট করা একটা লেখার কথা মনে পড়ে গেল। অনেক স্লো ইন্টারনেটে আছি। দেখি লেখাটা আরেকটু সাজিয়ে গুছিয়ে পোস্ট করে ফেলতে পারি কিনা। এম্পিরিসিজম নিয়ে আমার চিন্তাগুলো সেখানেই বলব।

    জবাব দিন
  3. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    এই নিয়ে আমার লেখা একটা আর্টিকেল আছে। এই সিসিবি ব্লঘেই আছে।
    'কোন জ্ঞান বিজ্ঞান? সেই জ্ঞান পাঠ করা এতো জরুরী কেন?'
    লিংকটা দিলাম
    //cadetcollegeblog.com/ramit/49973

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      সাইদুল ভাই,

      অনেকদিন লিখিনা ত' সেই জন্য ঠিক বুঝতে পারিনি যে আরো সহজ করে লেখা দরকার ছিল। হয়তো কিছু পরিচিত উদাহরণ দিলে পড়তে+বুঝতে খানিকটা সহজ হতো।

      পরের বার চেষ্টা করবো সহজবোধ্য করে লিখতে।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    বিষয় কঠিন হলে লেখা আর কতই বা সহজ করা যায়? তুমি লেখা চালিয়ে যাও। আমরা পড়তে থাকবো, যতক্ষণ না বুঝি।
    পোষাকের জগতে যেমন সময়ে সময়ে ফ্যাশন বদলায়, পাঠকের জগতেও তেমনি।

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      ভাইয়া,

      অনেক ধন্যবাদ আপনার এমন উৎসাহব্যঞ্জক মন্তবের জন্য।

      লিখা চালিয়ে যাবো, এবং অবশ্যই সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবো পাঠকের জন্য আরো সহজবোধ্য করে লিখার।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  5. আন্দালিব (৯৬-০২)

    দুইটা প্রশ্নঃ
    ১। বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে জ্ঞান অন্বেষণের অন্য আর কি কি প্রগতিশীল ধারা আছে?
    ২। "প্রকৃতি বিজ্ঞানের আবিস্কৃত জগৎই একমাত্র বাস্তব জগৎ নয়, বরং এর একটা খন্ডিত অংশমাত্র", বাস্তব জগতের বাকি অংশটাকে তাহলে কোন জ্ঞানের ধারা ধারণ করে? সেই অংশটা কোন অংশ?

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      আন্দালিব,

      তোমার প্রশ্ন দুইটা হলেও আসলে এগুলো রিলেটেড। তাই একসাথেই উত্তর দিচ্ছি।

      দেকার্তে প্রমাণ করেছেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে জ্ঞানচর্চার ধারা, তা' পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয় যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারেনা। এ থেকে উত্তরণের জন্য দেকার্তে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যেখানে ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যকে সিস্টেম্যাটিকালি বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের যুক্তি বা 'pure reason' প্রয়োগ করার দরকার হয়।

      আর ইমান্যুয়েল কান্টের বরাতে বলেছি যে, প্রকৃতিবিজ্ঞান যা' পাঠ করে, তা'র মধ্যে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে কিছু উপাদান যা' অধীত বস্তুর অন্তর্গত নয়, বরং যা' আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি আরোপ করে সময়+স্থান ভেদে। অর্থ্যাৎ, কান্ট এইটা প্রমাণ করেন যে, প্রকৃতিবিজ্ঞান অসম্পূর্ণ। শুধু তাই নয়, আমরা যে জ্ঞানকে ধরে নিই সম্পূর্ণ বস্তুগত, তা'তে আসলে আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি তথা চিন্তাভাবনাসহ আরো নানান ব্যক্তিগত বায়াস ঢুকে পড়ে নানান মাত্রায়।

      বাস্তব জগতের বাকি অংশটাকে তাহলে কোন জ্ঞানের ধারা ধারণ করে? সেই অংশটা কোন অংশ?

      কান্টের পর অনেক বিজ্ঞানী নানা রকম জ্ঞানচর্চার পদ্ধতির সূচনা করেছে। একটা ধারা ভাববাদের দিকে, আরেকটা মিস্টিসিজমে, আর কতগুলো আরো বিভিন্ন দিকে যাদের অনেকগুলো পোস্টস্ট্রাকচারালিজম, পোস্টমডার্নিজম ইত্যাদি নামে পরিচিত। উল্লিখিত এসব জ্ঞানচর্চার ধারা একে অপরের থেকে আলাদা হলেও একটা বিষয়ে একমত যে, জ্ঞানচর্চায় এম্পিরিসিজম একটা অসম্পূর্ণ উপায়। এই অনুমান থেকে কেউ নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে (যেমন, দেরিদার ডিকন্সট্রাকশন), আবার কেউ এই অসম্পুর্ণতার ফলাফল বিশ্লেষণ করেছে (যেমন, মিশেল ফুকো)। আমি এখনো ঠিক জানিনা জ্ঞানের কোন ধারা বাকি অংশটা ধারণ করে। তবে এক জায়গায় পেয়েছি 'phenomenology', বিশেষ করে এডমন্ড হুসার্ল আর মার্টিন হাইডেগারের মাধ্যমে, এই বিষয়ে বেশ খানিকটা অগ্রগতি লাভ করেছে। এখন তাই এইটা পড়ে দেখছি। কিছুদিন পরে শেয়ার করার ইচ্ছে থাকল এখানে কি দেখি সেইটা। (সম্পাদিত)


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
      • আন্দালিব (৯৬-০২)

        দেকার্তে বা কান্টের সময় যন্ত্রপ্রযুক্তি কতটা উন্নত ছিল জানি না, কিন্তু এখনকার যুগে এই কথা বলা যায় না। বিজ্ঞানের গবেষণা এখন আর ইন্দ্রিয়নির্ভর নাই। কোন পরীক্ষালব্ধ তথ্যকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যন্ত্রের সাহায্যে ধারণ করা যায়, তারপর সেটা প্রসেসিং করাও হয় যন্ত্র দিয়েই, অনেকক্ষেত্রে সিদ্ধান্তও যন্ত্রই দিয়ে দেয়।

        উদাহরণ দেই, বিগ ব্যাংয়ের পরপরই এক সেকেন্ডের কয়েক ট্রিলিয়ন সময় পরে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটা অতিঅতিঅতি ক্ষুদ্র কণা থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেই ছড়িয়ে পড়ার সময় যে শক্তির বিকিরণ ঘটেছিল, সেটাকে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (cmb) রেডিয়েশন বলা হয়। গত বছর এই cmb এর অস্তিত্ব যন্ত্রের সাহায্যে ধারণ করা গেছে। ফলে বিগ ব্যাং থিওরির অনেকগুলো প্রপোজড ধাপের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ পরীক্ষা নিয়ে সন্দেহ বা বিভ্রান্তির কিছু নাই।

        আপনি যে বিদ্যাগুলো বলছেন, এগুলো তো নতুন কোন ডিসকভারি দিচ্ছে না। তাহলে সেটা নতুন জ্ঞান হয় কীভাবে? ভাববাদ কিংবা মিস্টিসিজম যাচাই বাছাইয়ের পন্থা কী? তাদের আউটপুট কী? এগুলা তো বিশ্বাস। বিশ্বাস থেকে ক্যামনে জ্ঞানের আহরণ হয়?

        আরো প্রশ্ন করা যায় যে বিশ্বাস কি ইন্দ্রিয়নির্ভর প্রক্রিয়া না? তাইলে সেটাকে কেন বিজ্ঞানের চাইতে "বেটার" কিংবা বিকল্প ধরা হচ্ছে?

        জবাব দিন
        • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

          আন্দালিব,

          বিজ্ঞানের গবেষণা এখন আর ইন্দ্রিয়নির্ভর নাই। কোন পরীক্ষালব্ধ তথ্যকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যন্ত্রের সাহায্যে ধারণ করা যায়, তারপর সেটা প্রসেসিং করাও হয় যন্ত্র দিয়েই, অনেকক্ষেত্রে সিদ্ধান্তও যন্ত্রই দিয়ে দেয়।

          আমার অনুমান ভুল হতে পারে, কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি ইন্দ্রিয়'র সংজ্ঞায় খানিকটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছো। ইন্দ্রিয় হলো "যেসমস্ত দেহযন্ত্র বা শক্তির সাহায্যে বাহ্য বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান ও বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদনে সামর্থ্য জন্মে"। মানুষের প্রধান পাঁচটি ইন্দ্রিয় হলো চোখ, কান, নাক, জিহ্বা আর ত্বক।- যন্ত্র দিয়ে যা' কিছুই করা হোক না কেন, সেটা অবশেষে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা গ্রহন করি। এরমানে আমি অবশ্যই বলতে চাইছি না যে, তোমার উল্লিখিত পরীক্ষাটা গ্রহনযোগ্য নয়। বরং, উল্টোটাই।

          আমার আরেকটা অনুমান (ভুলও হতে পারে) এই যে, তুমি প্রকৃতি বিজ্ঞান বনাম অন্যান্য সব বিজ্ঞান/বিদ্যা এভাবে দেখতে চাইছো।
          আমি দেকার্তে আর কান্ট এর বরাতে যে আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করেছি, সেটা এমন নয়। আমি বলছি না যে, প্রকৃতি বিজ্ঞান অকেজো বা ভুলে ভরা। আমি বলতে চাইছি এই যে, এইটা সমস্ত বস্তুজগৎকে ব্যাখ্যা করতে পারেনা+এর আবিষ্কৃত জ্ঞানের পুরোটাই বস্তুগত নয়, তার মধ্যে কখনো কখনো আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি থেকে আগত কিছু কিছু উপাদান ঢুকে যায়। তবে কোন বিষয়ে কতটা, তা'র মাত্রাগত তারতম্য আছে।

          আরো প্রশ্ন করা যায় যে বিশ্বাস কি ইন্দ্রিয়নির্ভর প্রক্রিয়া না? তাইলে সেটাকে কেন বিজ্ঞানের চাইতে "বেটার" কিংবা বিকল্প ধরা হচ্ছে?

          উপরে বর্ণিত কারণের বুঝতে পারবে যে, এই প্রশ্নটা অপ্রাসকঙ্গিক। এখানে প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাথে অন্যান্যদের মধ্যে যোগ্য/অযোগ্য, সঠিক/ভুলের তুলনা হচ্ছে না। প্রকৃতি বিজ্ঞান জগতের কিছু কিছু বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে পারছেনা বলার মানেও এইটা না যে এর থেকে অন্যান্যগুলো 'বেটার'। বরং, বলা যায়, এগুলো প্রকৃতি বিজ্ঞানের সহযোগী হয়ে ওঠার চেষ্টায় রত, বিশেষ করে যেখানে যেখানে প্রকৃতি বিজ্ঞান সীমাবদ্ধ।

          আর একটা কথা- বিশ্বাস ইন্দ্রিয়নির্ভর না। উদাহরণস্বরূপ, আমি+আমরা ইন্দ্রিয় (চোখ/কান/নাক/জিহ্বা/ত্বক) দিয়ে অনুভব করি আর না করি তার উপর আমাদের জাতীয়তা, ধর্ম, ইত্যাদি বিশ্বাস নির্ভর করেনা। একইভাবে, বিশ্বাসকে ইন্দ্রিয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না।


          There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

          জবাব দিন
        • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

          আন্দালিব,

          তোমার সাথে আলাপের মজা হচ্ছে তোমার প্রশ্নগুলো খুব গভীর হয়, যা' আলোচনা আরো গভীরে নিয়ে যায়। উপরের প্রতিমন্তব্য করার পরে দেখলাম আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছো-

          আপনি যে বিদ্যাগুলো বলছেন, এগুলো তো নতুন কোন ডিসকভারি দিচ্ছে না। তাহলে সেটা নতুন জ্ঞান হয় কীভাবে?

          শব্দ দুটো বোল্ড করলাম, কারণ মনে হলো তোমার সাথে আমার বোঝার পার্থক্য আছে জ্ঞান কি? তোমার কাছে জ্ঞানের সংজ্ঞা কি সেটা খোলাসা করলে আলাপে আরো এগুনো যায়।


          There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

          জবাব দিন
          • আন্দালিব (৯৬-০২)
            "আমি বলতে চাইছি এই যে, এইটা সমস্ত বস্তুজগৎকে ব্যাখ্যা করতে পারেনা"

            - তর্কের মূল কেন্দ্র এই অবস্থান নিয়ে। বস্তুজগতে এমন কী আছে যেটা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে না? কিংবা বস্তুজগতে এমন কী আছে যেটা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করলেও সেটা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা না?

            "এর আবিষ্কৃত জ্ঞানের পুরোটাই বস্তুগত নয়, তার মধ্যে কখনো কখনো আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি থেকে আগত কিছু কিছু উপাদান ঢুকে যায়।"

            - এমন কোন পরিস্থিতি আমি ধারণা করতে ব্যর্থ হই। আমাদের বুদ্ধিতে যে লব্ধ জ্ঞান নির্ভর করে গড়ে ওঠে, সে জ্ঞান সম্পূর্ণরূপেই বিজ্ঞান নির্ভর। বিজ্ঞান-অনির্ভর জ্ঞান বলে কিছু আছে কী? সেটাই কি বিশ্বাস না?

            ===
            আপনি প্রশ্ন করলেন জ্ঞানের সংজ্ঞার ব্যাপারে আমার ধারণা কী। আমার ধারণা এটাই যে জ্ঞান এমন কিছু যা ইনপুট হিসেবে আমাদের চেতনার সিস্টেমের সাম্যাবস্থাকে বদলায় দেয়। অনেকটা এরকমঃ

            জ্ঞান---->(পুরাতন চেতনা)---->নতুনতর চেতনা

            সংজ্ঞা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হলো, আমি বিশ্বাসলব্ধ জ্ঞানকে জ্ঞানের সংজ্ঞায় ধরি নাই আগে, কিংবা জ্ঞান বলতে আমি বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানকেই বুঝাচ্ছিলাম। বিশ্বাস/মিস্টিসিজম/ভাববাদ ইত্যাদি 'বাদ' বা 'ইজম' থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে আমি ঊনজ্ঞান বলে ধরে নিচ্ছি, যদিও তারা দ্বিতীয় লাইনের সংজ্ঞায় ভ্যালিড বটে।

            এরকম ধরে নেয়ার কারণ হচ্ছে এসব জ্ঞান আসলে আমাদের সম্মিলিত অস্তিত্বের খোঁজে কোন সার্বজনীন উন্নয়ন করে না, এটা ব্যক্তিগত এবং শেয়ার করতে গেলে পাল্টে যায়। বিজ্ঞান সার্বজনীন উন্নয়ন ঘটায়, যা যে কোন জ্ঞানের প্রধানতম উদ্দেশ্য বলে মনে করি। এবং বিজ্ঞান শেয়ার করলে পাল্টে যায় না, একই সূত্র বা নিয়ম প্রত্যেকে একইভাবে বুঝে নিতে পারে, তাই এটা সার্বিক (ব্যক্তিগত না)।

            আর আমি আপনার সাথে একমত নই যে বিশ্বাস ইন্দ্রিয়লব্ধ কিছু না। বিশ্বাসের আইডিয়াটা কারো থেকে শুনে বা কোথাও পড়ে বা দেখে আমাদের ভেতর ঢোকে। তাই ইন্দ্রিয় দ্বারাই বিশ্বাসের আত্মীকরণ ঘটে।

            জবাব দিন
            • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

              তর্কের মূল কেন্দ্র ঠিকই ধরেছো। আর এইখানে আমি যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছি, তা' আমার নিজের কিছু না। দেকার্তে আর কান্ট এর লেখা পড়ে আমি এই তথ্য জানতে পেরেছি। জ্ঞানের জগতে এদের দুজনেরই গ্রহনযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। প্রথমজনকে বলা হয় আধূনিক দর্শনের জনক, আর দ্বিতীয়জন জামার্ন দর্শনের পুরোধা। এসব বললাম এইজন্য যে, কেউ হয়তো না-জানা বশতঃ তাদের বক্তব্যের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে সংশয়ে থাকতে পারে (আমার ধারণা, তুমি এদের সম্পর্কে খানিকটা হলেও জানো। আমাদের আলাপে যারা নিরব দর্শক আছে, তাদের উদ্দেশ্যে এই বাক্যটা)।

              "এমন কোন পরিস্থিতি আমি ধারণা করতে ব্যর্থ হই। আমাদের বুদ্ধিতে যে লব্ধ জ্ঞান নির্ভর করে গড়ে ওঠে, সে জ্ঞান সম্পূর্ণরূপেই বিজ্ঞান নির্ভর।"

              - এই বাক্যের মধ্যে তোমার প্রবল আত্মবিশ্বাস টের পাওয়া যায়। আমি এর প্রশংসা করি। তবে এইখানে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। "আমাদের বুদ্ধিতে যে লব্ধ জ্ঞান নির্ভর করে গড়ে ওঠে", তারমানে কি আমাদের বুদ্ধিতে কুলায় এমন সমস্ত জ্ঞান? সেক্ষেত্রে গণিত যেসব বিমূর্ত ধারণা নিয়ে কারবার করে, সেগুলোও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত, অথচ আমরা জানি সেসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় (যেমন, 'পাই' এর ধারণা)। অর্থ্যাৎ, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মধ্যে ইন্দ্রিয়গ্রায্য (যা' এম্পিরিক্যাল) এবং অ-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সব জ্ঞানই অন্তরভুক্ত। এই অর্থে, তোমার দাবিটা ঠিকই আছে। আর ঠিক এইখানেই কান্টের পর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক। অর্থ্যাৎ, কান্ট যে বলছেন জ্ঞানের মধ্যে এমন উপাদান বিদ্যমান যা আসে আমাদের বুদ্ধি থেকে, যা' বস্তুর অন্তস্থঃ উপাদান নয়। (মূল পোষ্টের ৩ নং অংশ দ্রষ্টব্য)।

              ব্যক্তি হিসেবে আমরা অনেক কিছুই ধারণা করতে ব্যর্থ হই। আমি নিজেই ত' এম্পিরিক্যাল পদ্ধতির মধ্য দিয়ে অর্জিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মধ্যকার উল্লিখিত অসম্পূর্ণতা/সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আর তাই দেকার্তে আর কান্টের আপাতঃ দুর্বোধ্য বই+আর্টিক্যাল আর তাদের ধারণা নিয়ে লেখা অন্যান্য স্কলারদের লেখা পড়ে চলেছি। স্বীকার করছি যে, এই ব্লগে আমার আরো কিছু সহজবোধ্য+পরিচিত উদাহরণ যোগ করা দরকার ছিল দেকার্তে আর কান্টের মূল আইডিয়াগুলো ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। এতে হয়তো 'বৈজ্ঞানিক জ্ঞান' এর বিষয়ে তাদের বক্তব্য বুঝতে আরো সুবিধা হতো।

              জ্ঞানের সংজ্ঞার বিষয়ে তোমার সাথে অনেকটাই একমত। তবে 'উন্নয়ণ'কে যেকোন জ্ঞানের লক্ষ্য ধরলে সেটা আরেকটা সমস্যার সম্মুখিন করে। উন্নয়ণের ধারণা ইউনিভার্সাল নয়। এক সময় যা' উন্নয়ণ ঘটায়, আরেক সময় সেটাই আবার ধ্বংশ সাধন করে, আবার একই সময়ে একস্থানে যা' উন্নয়ণমুখী, আরেকস্থানে তা' ধ্বংশাত্মক। এজন্য জ্ঞানের সংজ্ঞার আলোচনায় আমি উন্নয়ণকে বিবেচনা করিনা। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বেলাতেও নয়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান উন্নয়ণমুখী/কল্যাণকর এইটা একটা আদর্শিক বক্তব্য (ideological claim), যা' বাস্তব পর্যবেক্ষণে টিকে না। বিজ্ঞান মূলতঃ মূল্যবোধ নিরপেক্ষ, আর উন্নয়ণ একটা মূল্যবোধগত প্রত্যয় (concept)।

              সর্বশেষ, "তাই ইন্দ্রিয় দ্বারাই বিশ্বাসের আত্মীকরণ ঘটে।"- আমার ধারণা আমরা জ্ঞান কি আর কিভাবে তা' অর্জিত হয় সেই আলাপ করছি। এখানে জ্ঞান আত্মীকরণ আলাদা বিষয়।


              There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

              জবাব দিন
              • আন্দালিব (৯৬-০২)

                দর্শনশাস্ত্র সম্ভবত এজন্যই পিছায় পড়ছে, কারণ এইখানে গুরুভক্তি একটা জরুরি ব্যাপার। আমি, যে দর্শনের কিছুই পড়ি নাই, সে কি কান্ট বা দেকার্তের কথাকে বাতিল করে দিতে পারবো? কারণ তারা তো শাস্ত্রের জনক! 😀

                দেকার্তে বা কান্টকে পড়া জরুরি, কিন্তু তাদের সব কথাই ঠিক না। আপনার পুরো আর্গুমেন্টটা তাদের যে কথার ভিত্তিতে, তা দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক কিছুকেই ধরা যায় না, কারণ সেই বিজ্ঞান অনেক অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আজকেই একটা নতুন এক্সোপ্ল্যানেট পাওয়া গেছে, যা পৃথিবীর মতো আবাসযোগ্য, আমাদের থেকে ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে। এই তথ্য মানুষের যন্ত্র জানাচ্ছে, এখন যদি কোন 'বাদ' আমাকে বলে এইটা ইগনোর করতে, কিংবা কোন 'ইজম' বা ধর্ম যদি আমারে এইটার ভিন্ন/অপর ব্যাখ্যা দিতে চায়, আমি কেন মানবো? তারা তো এম্পিরিক্যাল কোন প্রমাণ দিতে পারতেছে না। তারা নতুন কোন ইনপুট দিতে পারতেছে না, যা আমার লব্ধ জ্ঞানকে বাড়ায়।

                তবে এইখানে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। "আমাদের বুদ্ধিতে যে লব্ধ জ্ঞান নির্ভর করে গড়ে ওঠে", তারমানে কি আমাদের বুদ্ধিতে কুলায় এমন সমস্ত জ্ঞান? সেক্ষেত্রে গণিত যেসব বিমূর্ত ধারণা নিয়ে কারবার করে, সেগুলোও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত, অথচ আমরা জানি সেসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় (যেমন, 'পাই' এর ধারণা)।

                আমাদের সম্মিলিত বুদ্ধিতে কুলায় না এমন কিছু মানব সভ্যতায় ভাবা হয় নাই, ভাই। পাইয়ের ধারণা ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কেন হবে? পাই সংখ্যাটা হলো একটা বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত। এটার মাঝে আর কোন ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য বিষয় আছে? গণিতবিদরাও মানুষ, তারা যা আবিষ্কার করেন বা প্রপোজ করেন সেগুলাও বাস্তবজগতের নিয়মনীতি মেনে চলে। এর বাইরে তারা কি কিছু বলেছেন যা আমাদের বস্তুজগতে নাই? আমি শুনি নাই এমন কিছু।

                এক সময় যা' উন্নয়ণ ঘটায়, আরেক সময় সেটাই আবার ধ্বংশ সাধন করে, আবার একই সময়ে একস্থানে যা' উন্নয়ণমুখী, আরেকস্থানে তা' ধ্বংশাত্মক।

                জ্ঞানের সংজ্ঞায় আমিও উন্নয়নকে ধরি নাই। জ্ঞানের জগতে বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানের চেয়ে বাকি অন্য ধারাগুলো গৌণ বুঝাতে উন্নয়নের প্রশ্ন আসে। আমার মতে, জ্ঞানের উপযোগ হিসেবে মানব সভ্যতার সামগ্রিক উন্নয়ন ছাড়া আর কোন সার্বজনীন মাপকাঠি নাই (ব্যক্তিগত মাপকাঠি থাকতে পারে, যেমন আমার কাছে সাহিত্য ইত্যাদি কখনো কখনো বিজ্ঞানের চাইতে বেশি জরুরি কিছু হয়ে ওঠে)।

                জবাব দিন
                • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
                  দর্শনশাস্ত্র সম্ভবত এজন্যই পিছায় পড়ছে, কারণ এইখানে গুরুভক্তি একটা জরুরি ব্যাপার। আমি, যে দর্শনের কিছুই পড়ি নাই, সে কি কান্ট বা দেকার্তের কথাকে বাতিল করে দিতে পারবো? কারণ তারা তো শাস্ত্রের জনক! 😀

                  দেকার্তে বা কান্টের রেফারেন্স দিয়ে আমি পাঠককে তাদের আর্গুমেন্ট বিশ্বাস করতে বলিনি। একাডেমিক আলোচনায় রেফারেন্স দেওয়ার উদ্দেশ্যও এটা নয়। রেফারেন্স দেওয়া হয় কোন বিষয়ের যথার্থতা বিচারে অন্যান্য স্কলারদের মধ্যে কি ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, এবং তার উত্তরে তারা কে কি ভেবেছে। অনেকটা পাবলিক ডিসকাশনের মতো। রেফারেন্স দিয়ে তাই দুইজনের আলোচনার মধ্যে আরো অনেককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা' আলোচনার পরিধিকে বিস্তৃত+সমন্বিত করে। আর এপর্যন্ত তুমি তাদের কোন কথাকে বাতিলের চেষ্টা করেছো তা' ত' দেখলাম না। শুধু নিজের মতের পক্ষে বলে গেলে। স্পেফিক্যালি তাদের কোন একটা আর্গুমেন্টকে ধরে কথা বললে বুঝতে সুবিধা হতো। আর গুরুভক্তির কথা যখন তুললেই, তখন বলি- দেকার্তে বা কান্টের মতো দার্শনিককে গুরু হিসেবে পেলে আমার কখনই সংকোচ হবেনা 🙂 । তবে এই ইঙ্গিতটা আলোচনাকে বিতর্কের দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে মনে হলো।

                  পাইয়ের ধারণা ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কেন হবে? পাই সংখ্যাটা হলো একটা বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত। এটার মাঝে আর কোন ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য বিষয় আছে?

                  'পাই' একটা বিমূর্ত ধারণা, তাই এইটা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ নয়। এইটা বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধির বিষয়, ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষ করার নয়। ইন্দ্রিয়ের সংজ্ঞা নিয়ে উপরে আমরা আলাপ করেছি। কাজেই, আরেকবার চিন্তা করে দেখার অনুরোধ রইল 'পাই' কেন ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য (তথা বিমূর্ত)।

                  গণিতবিদরাও মানুষ, তারা যা আবিষ্কার করেন বা প্রপোজ করেন সেগুলাও বাস্তবজগতের নিয়মনীতি মেনে চলে।

                  "বস্তুজগতের নিয়ম মেনে চলা" আর "বাস্তব জগতের অংশ হওয়া" দুইটা ভিন্ন বিষয়। এবং তুমি যে "সমস্তকিছুই অবশ্যম্ভাবীরূপে বস্তুজগতের নিয়ম মেনে চলে" দাবী করছো, এইটাও আদতে একটা 'বাদ', যা'কে Scientism (বাংলা প্রতিশব্দ জানিনা) বলে। এর মূলনীতিগুলোর কয়েকটি হলোঃ
                  ১। কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। বাদবাকি সবকিছুই 'ঊনজ্ঞান',
                  ২। প্রকৃতিবিজ্ঞানের পদ্ধতি সামাজিকবিজ্ঞান, মানবিকবিদ্যা, এমনকি শিল্পকলার জন্যও প্রয়োজ্য,
                  ৩। প্রকৃতিবিজ্ঞানের সম্পূর্ণতা এবং মানবসমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধানে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বা্‌
                  ৪। এই মতবাদ একটা প্রকৃতিগত+বস্তুগত+যান্ত্রিক অধিবিদ্যার (Metaphysics)উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
                  সূত্রঃ Richard N. Williams and Daniel N. Robinson (eds.), Scientism: The New Orthodoxy, Bloomsbury, 2015


                  There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

                  জবাব দিন
                  • আন্দালিব (৯৬-০২)

                    দেকার্তে নির্ভেজাল যুক্তির কথা তুলে ইন্দ্রিয়লব্ধ পর্যবেক্ষণকে উড়িয়ে দিতে চাইলে তা মেনে নেয়া কষ্টকর হয় কারণ দুই লাইন পরে গিয়ে সেই "নির্ভেজাল যুক্তি" দ্বারা স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। আমার আর্গুমেন্ট এটাই যে দেকার্তের পর্যবেক্ষণকে উড়িয়ে দিয়ে নির্ভেজাল যুক্তিতে জোর দেয়ার কারণ প্রধানত ওটাই। তিনি স্রষ্টায় বিশ্বাস করতেন, এবং সেই প্রেজুডিসড অবস্থান থেকে "যুক্তি" সাজিয়ে তিনি স্রষ্টার অস্তিত্বকে "প্রমাণ" করার চেষ্টা করেছিলেন।

                    স্বপ্নের ব্যাপারে ব্যাখ্যাও সম্ভবত মনোবিজ্ঞানীরা দিতে পেরেছেন। আমি যদ্দুর জানি, স্বপ্নে আমরা জাগ্রত সময়ের চেতন মস্তিষ্কের স্মৃতির ছোট ছোট অংশকে অবচেতন মন দ্বারা "প্রজেক্টেড" হতে দেখি। একারণেই পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষাভীতির কারণে দেখি উলঙ্গ হয়ে পরীক্ষাহলে বসে আছি, যদিও তা বাস্তবে কখনো ঘটেনি। আগুনের যে অনুভব, সেটাও পূর্বের অভিজ্ঞতাপ্রসূত, আর সেই অভিজ্ঞতাও ইন্দ্রিয়নির্ভর। অবচেতন মন ঘুমের সময় সক্রিয় হয়ে উঠে সেই স্মৃতিকেই relay করে। দেকার্তের সময় স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা এত উন্নত ছিল না, তাই এই উদাহরণ দিয়ে তিনি পার পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে অনেকেই এই উদাহরণের উপর গড়ে ওঠা আর্গুমেন্টকে ভুল প্রমাণ করেছেন। দেখা যাক এখানে, এখানে, এখানে

                    পাইয়ের ধারণা পুরোপুরি ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ। গণিতবিদরা এটা চিন্তা করে বের করেন নি। জ্যামিতিকভাবে মেপে বের করেছেন। গণনার প্রযুক্তি উন্নত হবার পরে আমরা এর অসীমসংখ্যক ঘরের কথা জানতে পেরেছি, কিন্তু তারপরেও এই সংখ্যাটি আসলে একটি সীমিত দৈর্ঘ্যই নির্দেশ করে, যা কল্পনাপ্রসূত বা চিন্তালব্ধ কিছু না।

                    সায়েন্টিজমের উল্লেখটাও ইন্টারেস্টিং, ভাই! এখনো একটা কিছু দেখালেন না যেটা বস্তুজগতের বাইরের কিছু প্রমাণ করতে পারে।

                    সায়েন্স বলতেছে ইন্দ্রিয়ের বাইরের কিছু নাই, কারণ কিছু আছে এমন পাওয়া যায় নাই। আপনি একটা অপর-সায়েন্স (বা জ্ঞানের ধারা) দেখান যারা বলতেছে ইন্দ্রিয়ের বাইরে 'এটা' আছে, কারণ 'এটার' অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। (সম্পাদিত)

                    জবাব দিন
                    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
                      দেকার্তে নির্ভেজাল যুক্তির কথা তুলে ইন্দ্রিয়লব্ধ পর্যবেক্ষণকে উড়িয়ে দিতে চাইলে তা মেনে নেয়া কষ্টকর হয় কারণ দুই লাইন পরে গিয়ে সেই "নির্ভেজাল যুক্তি" দ্বারা স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। আমার আর্গুমেন্ট এটাই যে দেকার্তের পর্যবেক্ষণকে উড়িয়ে দিয়ে নির্ভেজাল যুক্তিতে জোর দেয়ার কারণ প্রধানত ওটাই।

                      আমার কিন্তু মনে হয়নি দেকার্তে ইন্দ্রিয়লব্ধ (empirical) পর্যবেক্ষণকে (observation) উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, ইন্দ্রিয়লব্ধ পর্যবেক্ষণকে 'বুদ্ধি'র মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে জ্ঞানার্জন হয়। আর তিনি 'ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যই নির্ভেজাল যুক্তিতে জোর দিয়েছেন' বলে যে দাবী করলে, এটা আমার মনে হয়নি। আমার মতে, দেকার্তে তার সংশয়বাদী পদ্ধতি দিয়ে বেশ ভালোভাবেই বোঝাতে পেরেছেন এম্পিরিক্যাল টেষ্ট এর সীমাবদ্ধতা এবং জ্ঞানের জন্য বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে যৌক্তিক অসঙ্গতি তার প্রস্তাবিত পদ্ধতিকে বাতিল করেনা বলেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তার মডেলের উপরই বিকাশ লাভ করেছে+করছে। তোমার উল্লিখিত প্রথম সূত্র (টিম'স বুক) এমন উপসংহারই টেনেছে বলে মনে হলো। আর দ্বিতীয়টি দেখিয়েছে যে, দেকার্তের ড্রিমিং আর্গুমেন্ট সেলফ-রিফিউটেড হলেও এর যে উদ্দেশ্য- "to give us reason to doubt our sensory perception"- সাধনে সফল। অর্থ্যাৎ, দেকার্তের ড্রিমিং আর্গুমেন্ট ভুল প্রমাণ হলেও এর মাধ্যমে তিনি যে দেখিয়েছেন "আমাদের ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়" সেটা বাতিল হয়ে যায়নি।

                      "পাইয়ের ধারণা পুরোপুরি ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ।"-

                      কিভাবে? পাই কি চোখ দিয়ে দেখা যায়?- না। কান দিয়ে শোনা যায়?- না। নাক দিয়ে গন্ধ নেওয়া যায়?- না। জিহ্বা দিয়ে স্বাদ আস্বাদন করা যায়?- না। ত্বক দিয়ে স্পর্শ করা যায়?- না। তাহলে এটা কিভাবে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ হলো? এটা গণিতবিদরা বুদ্ধি দিয়েই জ্ঞানের আওতায় নিয়ে আসে। একটা সাধারণ যুক্তিই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। যেমন- আমরা ত' জানি 'পাই' অসীম। তাহলে সেই অসীমকে কোন ইন্দ্রিয় সম্পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ করতে পারে?

                      গণনার প্রযুক্তি উন্নত হবার পরে আমরা এর অসীমসংখ্যক ঘরের কথা জানতে পেরেছি, কিন্তু তারপরেও এই সংখ্যাটি আসলে একটি সীমিত দৈর্ঘ্যই নির্দেশ করে, যা কল্পনাপ্রসূত বা চিন্তালব্ধ কিছু না।

                      - এই বাক্যের মধ্যে সেলফ-কনট্রাডিকশনটা ত' স্পষ্টঃ অসীম সংখ্যক ঘর কিভাবে সীমিত দৈর্ঘ নির্দেশ করে?

                      তুমি উদাহরণ চাইছিলে বস্তুজগতের বাইরের কিছু একটা- 'পাই' সেই উদাহরণ। এইটা বস্তুজগতের কোন উপাদান নয়। এটা একটা বিমূর্ত ধারণা যা মানুষের বুদ্ধি থেকে উৎসারিত, এম্পিরিক্যাল পর্ববেক্ষণ থেকে নয়। তবে এটা অন্যান্য এম্পিরিক্যাল বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে সহায়ক। অর্থ্যাৎ, বিমূর্ত প্রত্যয় মানুষের বুদ্ধিজাত হলেও সেগুলো এম্পিরিক্যাল বৈজ্ঞানিক আবিস্কারে ভূমিকা রাখতে পারে।

                      শুধু যে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ বিষয়ের বাইরেও জ্ঞানের উপস্থিতি আছে, তাই নয়। কান্টের বরাতে আমি বলেছি যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বলতে আমরা যে নির্ভেজাল ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ জ্ঞানের দাবী দেখি, সেটাও অগ্রহনযোগ্য। কারণ, সেখানে দেশ+কাল ভেদে মানুষের নিজস্ব বুদ্ধির উপস্থিতি থাকে। (আর একারণেই পোষ্ট মডার্নিষ্টরা নৈর্ব্যক্তিক এবং ইউনিভার্সাল জ্ঞানের অস্তিত্ব অস্বীকার করে)।

                      সায়েন্স বলতেছে ইন্দ্রিয়ের বাইরের কিছু নাই, কারণ কিছু আছে এমন পাওয়া যায় নাই।

                      সায়েন্স যা' এম্পিরিক্যালি পর্যবেক্ষণ করতে পারে, শুধু সেইটুকু নিয়েই মাথা ঘামায়। অর্থ্যাৎ, কোন কিছু সায়েন্সের এন্টেনায় ধরা পড়লেই কেবল সেটা নিয়ে ব্যাখ্যা+বিশ্লেষণ চলে। যা' সায়েন্সের এন্টেনায় ধরা পড়েনা, সে সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির রীতি অনুসারে কোন বক্তব্যই নেই সায়েন্সের। কোনকিছু এম্পিরিক্যালি পর্যবেক্ষন করা যায়নি বলে তা'র অস্তিত্বই না এমন দাবী তাই অযৌক্তিক। একারণে সায়েন্স এই কখনোই বলতে পারেনা যে, ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষের বাইরে কিছু নাই। ইদানিং কেউ কেউ অবশ্য বেশ জোরের সাথে এই দাবী তুলছেন। এইটা সায়েন্স নয়, সায়েন্টিজম যা' সমগ্র জগতকে মানুষের ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষ করার আওতার মধ্যে সীমিত করে। অর্থ্যাৎ, মানুষের বুদ্ধি, কল্পনা, আবেগ, বিশ্বাস, সবকিছুর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে কারণ এগুলো ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ নয় বলে। সেক্ষেত্রে কিন্তু এইটা মানতে হবে যে এই গান এবং এর থেকে উৎসারিত ভাব, বা এই লেখা এবং এর পাঠ থেকে প্রাপ্ত ভালোলাগার অনুভূতি অস্তিত্বহীন। আমরা কি এটা মেনে নিব? তুমিও ত' সিসিবি'র একজন কবি, তোমার কবিতাগুলোই কি অস্তিত্বহীন? (সম্পাদিত)


                      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

  6. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    আপনার লেখাটা পড়েই আমার নিজের লেখা পোস্ট করার ভূত মাথায় চেপেছিল। এজন্য এই লেখাটা পরে আর পড়া হয়নি। আন্দালিব ভাইয়ের মন্তব্যে ও আপনার জবাবের সূত্র ধরে আবার পড়লাম লেখাটা। দর্শন বিষয়ে জ্ঞান খুবই কম আমার। তবুও নিজের কিছু মতামত জাহিরের লোভ ছাড়তে পারছি না। যথারীতি ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন। আলোচনার ক্লারিটির সুবিধার্থে বাংলা শব্দ না ব্যবহার করে ইংরেজি ব্যবহার করছি।

    যেকোন বিষয়ে নিজের মত করে চিন্তা করা আমার অভ্যাস বলেই আমি গোড়া থেকে আইডিয়াটা নিজের মত করে বলছি। আমার চিন্তাটা শুরু যুক্তিবিদ্যার ইনডাকশান আর ডিডাকশান থেকে। ডিডাকশানের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া যুক্তির ঝামেলা নাই। নিশ্চিতভাবেই বলে নেয়া যায়, শুরুর কথাটা ঠিক হলে, ডিডাকশান দিয়ে যা কিছু পাওয়া যাবে, সবই ঠিক। ডিডাকশানের ধাপগুলো ঠিক রাখতে হবে অবশ্য। অন্যদিকে ইনডাকশানে চলে আসবে সম্ভাব্যতার মানে প্রোবাবলিটির ব্যাপার স্যাপার।

    যদি গণিত দিয়ে শুরু করি, গণিত খুবই অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে। এই ধারণাগুলি এতই অ্যাবস্ট্রাক্ট, যে এখানে দ্বিমত/সন্দেহ ইত্যাদি করা যায় না। এরপর এসব ধারণা থেকে ডিডাকশানের মাধ্যমে গণিত আগায়। একারণে গণিতে যেসব কথা ডিডাকশানের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়, সেব্যাপারে আর সন্দেহ থাকে না। গণিতে মাঝে মধ্যে নতুন নতুন অ্যাবস্ট্রাক্ট ধারণার সূচনা হয়েছে। সেখানে থেকে তৈরি হয়েছে গণিতের নতুন নতুন শাখা- বীজগণিত, ক্যালকুলাস, সেট থিওরি আরও অনেক কিছু। এসবের মধ্যে অনেক ধারণার সাথে বাস্তব থেকে নেয়া। যেমন জ্যামিতির সরলরেখা কিংবা বৃত্ত। তবে তার পরেও এসব ধারণাগুলো অ্যাবস্ট্রাক্টই। গণিতে ইনডাকশান ব্যবহার করে যুক্তি আগায় না। এজন্যই গণিতকে ধরে নেয়া যায় নির্ভুল।

    তবে বাস্তবের সব কিছুই গণিতের মত অ্যাবস্ট্রাক্ট ধারণা আর ডিডাকশান দিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। বাস্তব বোঝার জন্য হয়ত শুরুই করতে হবে ইনডাকশান দিয়ে। বা জ্ঞান আহরণের কোন একটা ধাপে দরকার পড়বে ইনডাকশানের। কিন্তু ইনডাকশানের মাধ্যমে আসা সিদ্ধান্তে সন্দেহ রয়ে যায়। সেই সন্দেহ নিরসণ করাটাই এম্পিরিক্যাল টেস্টের কাজ। এই এম্পিরিক্যাল টেস্ট নিজেও একটা ডিডাকশান প্রক্রিয়া। আর এম্পিরিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে সন্দেহ নিরসণ করে সিদ্ধান্তে আসাটাই বিজ্ঞান। বা বলা যায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান।

    কিন্তু বাস্তবের সবকিছু এম্পিরিক্যালি যাচাই করা যায় না। আমার লেখাটায় বলার চেষ্টা করেছিলাম, কী কী নিয়ামক দিয়ে বোঝা যাবে, একটা বস্তুকে কতটুকু এম্পিরিক্যাল যাচাইয়ের মধ্যে আনা যায়। যেসব ক্ষেত্রে এম্পিরিক্যাল টেস্ট অনেকটা করা যায়, কিন্তু ডিডাকশানের পর্যায়ে আনা যায় না সেগুলো বোধহয় সামাজিক বিজ্ঞান বা সোশ্যাল সায়েন্সের মধ্যে ঢুকে পড়বে। যেমন অর্থনীতি বা সমাজ বিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব।

    আর যেসব ক্ষেত্রে এম্পিরিক্যাল প্রক্রিয়া একেবারেই আনা যাচ্ছে না, সেটা থেকে যাবে দর্শনের মধ্যে। অবশ্য দর্শনকে সব জ্ঞানের উৎস বলা যেতে পারে। আমার লেখাটার ছবির মত সার্কেল করে দেখাতে পারলে, গণিত হবে একদম ইনার সার্কেল। আর দর্শন হবে একেবারে আউটার সার্কেল। ক্রমটা হবে- গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, দর্শন।

    জ্ঞানের কাজ হল, চেষ্টা করা ডিডাকশানের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসতে। ডিডাকশান আনতে যেয়েই এম্পিরিক্যালি যাচাইয়ের ব্যাপারটা আসবে। যেখানে ডিডাকশান সম্ভব সেখানে ইনডাকশানে থেকে যাওয়ার কোন মানে নেই। আবার যেখানে ডিডাকশান সম্ভব না, সেখানে ইনডাকশানের মাধ্যমে আসা জ্ঞানকেই মেনে নিতে হবে। ডিডাকটিভ না বলে, সেই জ্ঞানকে অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নাই।

    শেষে বলি, বিজ্ঞান অনেক সময়ই অনেক বিষয়ে নিয়ে কাজ করে, যেগুলো এম্পিরিক্যালি প্রমাণ হয়নি। হয়ত আপাত দৃষ্টিতে এম্পিরিক্যালি যাচাইয়ের মধ্যে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সেখানে বিজ্ঞানের দাবীগুলোও আসলে ইনডাকটিভ। এই দাবীগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। অবশ্য এমনি এমনি চ্যালেঞ্জ করা যায় না, সমপর্যায়ের তত্ত্ব দিয়েই কেবল চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। বিজ্ঞান নিয়ে অনেকের মধ্যে এই গোঁড়ামী চলে আসে, যে বিজ্ঞান যেখানে এম্পিরিক্যালি প্রমাণ না করে কেবল ইনডাকটিভ তত্ত্ব বা হাইপোথিসিস দিয়ে রেখেছে, সেটাকেও অন্যান্য ডিডাকটিভ সিদ্ধান্তের পর্যায়ে নিয়ে যায়। কোন একটা ইনডাকটিভ তত্ত্বের পক্ষ কেউ নিতেই পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সেই তত্ত্বকে সমপর্যায়ের অন্য একটি তত্ত্ব চ্যালেঞ্জ করতেই পারে। অথবা একসময় এম্পিরিক্যাল প্রক্রিয়ায় এটি ভুল প্রমাণ হতেও পারে। অর্থাৎ, ইনডাকটিভ সিদ্ধান্তের পক্ষ নিলে ভিন্নমতের জন্য জায়গা রেখেই পক্ষ নিতে হবে। সেই জায়গাটা দিতে না চাওয়াই অনেক ঝামেলার কারণ।

    :-B বিশাল বয়ান দিয়ে ফেললাম! নিজের লেখা পড়ে নিজেরই মনে হচ্ছে, "অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী"। :-B

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
      বাস্তবের সবকিছু এম্পিরিক্যালি যাচাই করা যায় না।

      ঠিক এই কারণেই কোনকিছু এম্পিরিক্যালি যাচাই করা যায়না মানে এই নয় যে, সেটার অস্তিত্ব নেই। অর্থ্যাৎ, জগতের সম্পূর্ণটাই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ পদ্ধতি দিয়ে যাচাইযোগ্য নয়, কিছু অংশ এম্পরিক্যাল টেষ্ট এর বাইরে থেকেই যায়।

      যেখানে ডিডাকশান সম্ভব সেখানে ইনডাকশানে থেকে যাওয়ার কোন মানে নেই। আবার যেখানে ডিডাকশান সম্ভব না, সেখানে ইনডাকশানের মাধ্যমে আসা জ্ঞানকেই মেনে নিতে হবে।

      একমত।

      বিজ্ঞান অনেক সময়ই অনেক বিষয়ে নিয়ে কাজ করে, যেগুলো এম্পিরিক্যালি প্রমাণ হয়নি। হয়ত আপাত দৃষ্টিতে এম্পিরিক্যালি যাচাইয়ের মধ্যে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সেখানে বিজ্ঞানের দাবীগুলোও আসলে ইনডাকটিভ। এই দাবীগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। অবশ্য এমনি এমনি চ্যালেঞ্জ করা যায় না, সমপর্যায়ের তত্ত্ব দিয়েই কেবল চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। বিজ্ঞান নিয়ে অনেকের মধ্যে এই গোঁড়ামী চলে আসে, যে বিজ্ঞান যেখানে এম্পিরিক্যালি প্রমাণ না করে কেবল ইনডাকটিভ তত্ত্ব বা হাইপোথিসিস দিয়ে রেখেছে, সেটাকেও অন্যান্য ডিডাকটিভ সিদ্ধান্তের পর্যায়ে নিয়ে যায়।

      একমত।

      যেকোন আলোচনায় নামতে হলে যে বিদ্যার জাহাজ হয়ে তারপর নামতে হবে সেটা কে বলেছে? 🙂 আর এসব আলোচনার মাধ্যমেই ত' আমরা জানতে পারি, আমাদের জানার পরিধি বাড়াতে পারি। এই যেমন এই ব্লগের আলোচনায় অংশ নেওয়ার কারণে কত নতুন নতুন বিষয়ে ভাবতে পারছি, নতুন নতুন বই পড়তে পারছি। তবে আলোচনায় নামলে যেহেতু আমাদের সবার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক নয়, তাই আমরা আলাপে যেসব প্রত্যয় ব্যবহার করি সেগুলোর স্বীকৃত সংজ্ঞা নিয়ে একমতে আসা দরকার। তা নাহলে আলোচনায় কোন উপসংহারে উপনীত হওয়া মুশকিল।

      দর্শনে- আরো নির্দিষ্ট করে বললে, বিজ্ঞানের দর্শনে- তোমার আগ্রহ এবং জানাশোনার পরিধি রীতিমত ঈর্ষনীয়।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
      • গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

        এপিস্টেমোলজি আমার আগ্রহের একটি বিষয়। আর এই আগ্রহ তৈরি হওয়ার পেছনে সিসিবির একটা বড় ভূমিকা আছে। আপনার কথাগুলো আমার জন্য উৎসাহ হয়ে থাকবে। আমার এই মন্তব্যটার সাথে আরও কিছু সংজ্ঞা, উদাহরণ ও ছবি দিয়ে আরেকটা ব্লগ পোস্ট বানিয়ে ফেলা যায়। আপনার মন্তব্য থেকে আরও সাহস পাচ্ছি। তবে কাজের চাপ চলে আসলে আর সময় করতে পারব কিনা জানি না।

        জবাব দিন
        • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

          আমার এই মন্তব্যটার সাথে আরও কিছু সংজ্ঞা, উদাহরণ ও ছবি দিয়ে আরেকটা ব্লগ পোস্ট বানিয়ে ফেলা যায়।

          তাহলে ত' খুবই ভালো হয়। ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়ার আগেই তাহলে লিখে ফেলো।

          অপেক্ষায় থাকলাম তোমার পোষ্টের।


          There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

          জবাব দিন
  7. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    দিনশেষে সকলি ফুরায়:
    ভালোবাসা, প্রেম, ঘৃণা, বিরহের একান্ত অভিমান-
    কালের বিবরে হারায়
    জটিল এ সত্যজ্ঞান!


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      মোস্তফা ভাই,
      ছন্দের মধ্য দিয়ে একটা দারুন কথা বলেছেন। তবে বলার ভঙ্গির কারণে এ' থেকে একটা ভুল বোঝার সম্ভাবনা আছে যে, যেহেতু ভালোবাসা+প্রেম+ঘৃণা+বিরহ এক সময় হারিয়ে যায়, তাই এগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব নেই। বিদ্যমান সামাজিক কনটেক্সটও এই সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় যেখানে এমন ধারণা প্রচলিত যে, 'পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই'। কিন্তু যুক্তির বিচারে গেলে দেখা যায় যে, যা' কিছু এখন আছে (এক মুহুর্তের জন্য হলেও) এবং এক সময় হারিয়ে যায়, তা অবশ্যই অস্তিত্বময়। কোনকিছুর নশ্বরত্ব বা ক্ষণস্থায়ীত্ব তার অনস্তিত্বের নয়, বরং অস্তিত্বেরই অকাট্য প্রমাণ।


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  8. আন্দালিব (৯৬-০২)

    উপরের থ্রেডে আর প্রতিজবাব দিতে দিচ্ছে না। তাই এখানে জবাবটা লিখছি।

    ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে যৌক্তিক অসঙ্গতি তার প্রস্তাবিত পদ্ধতিকে বাতিল করেনা বলেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তার মডেলের উপরই বিকাশ লাভ করেছে+করছে।

    বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিকাশে তার অবদানকে তো আমি অস্বীকার করছি না। কেউই করছে না। আমার আর্গুমেন্ট ছিল তিনি যে পর্যবেক্ষণকে সীমিত বা অসম্পূর্ণ কিছু ধরছিলেন, এবং বলছিলেন যে বুদ্ধি/বাদ বা অন্য "কিছু" একটা দিয়ে মানুষ সিদ্ধান্তে আসে, সেটা প্রাচীন ও পরিত্যক্ত আইডিয়া। সেইসময়ে তা যুগান্তকারী ছিল হয়তো। কিন্তু আজ এতোদিন পরে সেটাকে বাতিল করে দেয়া যায়।

    ...যেমন- আমরা ত' জানি 'পাই' অসীম। তাহলে সেই অসীমকে কোন ইন্দ্রিয় সম্পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ করতে পারে?...
    এই বাক্যের মধ্যে সেলফ-কনট্রাডিকশনটা ত' স্পষ্টঃ অসীম সংখ্যক ঘর কিভাবে সীমিত দৈর্ঘ নির্দেশ করে?

    এটা ভুল বললেন। পাই অসীম না। পাই-এর মান ৩ আর ৪-এর মধ্যে। পাইকে মাপা যায়। হাতে কলমেই মাপা যায়। একটা গজফিতা আর স্কেল দিয়ে বৃত্তের পরিধি আর ব্যাস মেপে পাইয়ের মান বের করা সম্ভব। হয়তো সেটা সুপার কম্পিউটারের মতো দশমিকের পরে বিলিয়ন ঘর পর্যন্ত হবে না, কিন্তু কাছাকাছি হবে।

    পাই একটা সংখ্যা। যদি ১, ২, ৩...,০ এগুলো ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ ধারণা হয়, তাহলে পাই-ও একটি ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ ধারণা।

    মানুষের বুদ্ধি, কল্পনা, আবেগ, বিশ্বাস, সবকিছুর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে কারণ এগুলো ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ নয় বলে।

    এই দাবি বিজ্ঞান কবে করেছে যে মানুষের বুদ্ধি, কল্পনা, আবেগ ইত্যাদির অস্তিত্ব নাই? মনোবিজ্ঞানীরা তাহলে কোন ঘোড়ার ডিম পাড়ছে? মানুষের শিল্পসৃষ্টির কৌশল, মনের চিন্তা, বুদ্ধি, প্রতিভা, বিশ্বাস, এই সবকিছুর মেকানিজম বা ক্রিয়াকৌশল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্লেষণ করা হয়। আধুনিক শিল্পকলাতেও সায়েন্টিফিক মেথড খাটানো হয়।

    আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় বলে দেই। মানুষের এই শিল্পসৃষ্টি কোন অলৌকিক বা রহস্যময় ব্যাপার না। আমরা আগে জানতাম না কীভাবে আমরা এগুলো করছি, তাই রহস্যময় ভাবতাম। এমন bot আছে, যারা সঙ্গীত সৃষ্টি করতে পারে। আপনি বা আমি বা অনেক সঙ্গীতজ্ঞই সেই সঙ্গীত শুনে বুঝতেও পারছে না তা একটি রবোটের তৈরি। অনেক "জার্নালিস্ট" বট আছে, যেগুলো প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ আর্টিকেল লিখছে। অচিরেই উপন্যাস লিখবে এবং তা মানুষ পড়ে হাসবে, কাঁদবে, অভিভূতও হবে। আইবিএম একটি বট তৈরি করেছে যা মানুষ ডাক্তারের চাইতেও নিখুঁতভাবে রোগীর সিম্পটম শুনে রোগ নির্ণয় করতে পারে। আর দাবা খেলা কম্পু তো পুরানো খবর। এগুলো প্রমাণ করে যে আমরা যাকিছু মানুষের স্বতন্ত্র ও অনন্য মানবিক গুণ বলে এতোদিন জানতাম, তা আসলে উন্নত প্রোগ্রামিং দিয়ে পুনরুৎপাদন করা যায়।

    বুদ্ধি বলেন, চেতনা বলেন, শিল্পসৃষ্টি বলেন, এগুলো কনসেপ্টকে রহস্যময় মিস্টিসিজম দিয়ে আর "ইনট্যাক্ট" রাখা যাচ্ছে না। সায়েন্টিফিক ওয়েতেই এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে।

    এটা আমার জন্য অতো বেদনার কিছু না যে কবিতা বা গানের স্রষ্টা শুধু আমরা মানুষরা না, অচিরেই রবোট কপোট্রনও করবে, ইতোমধ্যে করছেও। The more the merrier। আমি নূপুর ভাইয়ের গান বা সাবিনা আপার গল্প পড়ে অভিভূত হই। একটা বট যদি এমন অভিভূত করার মতো গল্প লিখতে পারে, আর মানুষ যদি কোড দিয়ে অমন বট বানাতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী? বরং তাতে বিজ্ঞানের অগ্রগতিই আরো সুদৃঢ় হবে।

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
      আমার আর্গুমেন্ট ছিল তিনি যে পর্যবেক্ষণকে সীমিত বা অসম্পূর্ণ কিছু ধরছিলেন, এবং বলছিলেন যে বুদ্ধি/বাদ বা অন্য "কিছু" একটা দিয়ে মানুষ সিদ্ধান্তে আসে, সেটা প্রাচীন ও পরিত্যক্ত আইডিয়া। সেইসময়ে তা যুগান্তকারী ছিল হয়তো। কিন্তু আজ এতোদিন পরে সেটাকে বাতিল করে দেয়া যায়।

      তোমার এই আর্গুমেন্টের কেন্দ্রে আছে এই অনুমান যে, মানুষ যে জ্ঞানার্জন করে তা' সম্পূর্ণভাবে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে, তথা এম্পিরিক্যালি পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে। এইটা আধূনিক কোন পদ্ধতি নয়, এর শুরু ১৭ শতকে। আর এটার পর্যালোচনা করেই দেকার্তে বলেছেন যে, মানুষের ইন্দ্রিয় পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। যেজন্য মানুষকে বুদ্ধির প্রয়োগ করে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ তথ্য বিশ্লেষণ করে উপসংহারে আসতে হয় (দেকার্তে শুধু বুদ্ধির কথাই বলেছেন, কোন 'বাদের' কথা নয়)। এখনো ইন্দ্রিয়ের নির্ভরশীলতায় সংশয় প্রযোজ্য, যা' আমাদের আলচনার মধ্যে উপস্থিত 'পাই' সম্পর্কিত জ্ঞান বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়। এই পর্যায়ে, তোমার আর আমার মাঝে মতানৈক্য হচ্ছে 'পাই' ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ (বা, পর্যবেক্ষণযোগ্য) কি না সেইটা নিয়। আমি বলছি, পাই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ নয়, বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা এর সম্পর্কিত জ্ঞান/ধারণা লাভ করি। তুমি সেটা নাকচ করছো।- আমার জানামতে 'পাই', 'শূণ্য' সহ প্রায় সব গাণিতিক সংকেত/চিহ্ন/প্রত্যয় (আমি নিশ্চিত না সবগুলোই কিনা) বিমূর্ত, তথা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ নয়। এই ইস্যুতে মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার মতৈক্য হবে না। আর তা' নাহলে আমরা উপসংহারবিহীন একটা আলোচনা টেনে নিয়ে যেতেই থাকব। আর তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে তুমি আলোচনায় ধৈর্য হারাচ্ছো এইজন্য যে, কেন আমি তোমার মত মেনে নিচ্ছি না। তা নাহলে নিচের উক্তিটি করার কথা নয়-

      এই দাবি বিজ্ঞান কবে করেছে যে মানুষের বুদ্ধি, কল্পনা, আবেগ ইত্যাদির অস্তিত্ব নাই? মনোবিজ্ঞানীরা তাহলে কোন ঘোড়ার ডিম পাড়ছে? মানুষের শিল্পসৃষ্টির কৌশল, মনের চিন্তা, বুদ্ধি, প্রতিভা, বিশ্বাস, এই সবকিছুর মেকানিজম বা ক্রিয়াকৌশল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্লেষণ করা হয়। আধুনিক শিল্পকলাতেও সায়েন্টিফিক মেথড খাটানো হয়।

      বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কোথায় কোথায় খাটানো হয়, যেটা যে আমাকে তোমার জানানো দরকার নেই তা' বোঝার মতো কান্ডজ্ঞান তোমার আছে বলেই মনে করি। কাজেই, এই উক্তি দিয়ে তুমি কি বলতে চাও? আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি খাটালেই যে, সেটা সঠিক+একমাত্র হয়ে ওঠে এইটা কেমন ধরণের অনুমান?-

      তোমাকে ধন্যবাদ যে, তোমার সাথে আলোচনার সূত্রে বেশ কিছু নতুন বই/লেখা পড়া হলো। তোমার ধারণাগুলোও জানা হলো। আপাততঃ এইগুলোই এই আলোচনা থেকে আমার প্রাপ্তি। আমার মনে হচ্ছে, এখনই এই আলোচনার ইতি টানা দরকার। কেন, তা' বুঝে নিও।

      অনেকদিন পর সিসিবি'তে একটা সিরিয়াস আলোচনার অংশ হতে পেরে আন্দালিব ও গুলশানকে ধন্যবাদ সক্রিয় অংশ নেওয়ার জন্য, আর অন্যান্যদেরকেও উৎসাহ দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।

      শুভ ব্লগিং। 🙂


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন
  9. ওমর আনোয়ার প্রিন্স

    মাহমুদ, অনেকদিন বাদে ব্লগে তোমার এই লেখাটা পড়ে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। মনে হলো, বিষয়টা তোমার আগ্রহের আয়ত্তের মধ্যেই আছে। যেমনটা যথার্থই বলেছ, "বিজ্ঞানমনস্কতা আর নাস্তিকতাকে একাকার করে ফেলার একটা প্রবণতা বর্তমানে বিদ্যমান"...আবার অন্যদিকে কেনইবা "ধর্মমনস্কতা" - বিশেষত " ইসলাম-মনস্কতা"কে সরাসরি বিজ্ঞানমনস্কতার বিপরীতে অহেতুক দাড় করাবার ত্রুটিযুক্ত প্রবণতার হতভম্ব শিকার হতে হয় এই মুক্তমনের মানুষগুলোকে? আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না মাহমুদ, কোন "নির্ভেজাল যুক্তির" আওতায় এদেরকেই বারবার ঠাকুরঘরেই যেতে হয়, সবার অলক্ষ্যে চুরি করে কলাও খেতে হয়, আবার বোকার মত সেটাকে জানানো দিতে হয়!!

    জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      ভাইয়া,
      দ্বিচারীতা বাংলাদেশীদের মধ্যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের পর্দাও পাল্লা দিয়ে ছোট হয়ে আসছে। আর তাই অন্যদেরকে যেসমস্ত অপরাধের জন্য সমালোচনা করি, নিজেরাও সেই একই রকম কাজে লজ্জার মাথা খেয়ে নেমে পড়ি। মুক্তমনা আর বদ্ধমনা সবার মধ্যেই দেখছি। বিজ্ঞান এবং/অথবা যুক্তির দোহাই দিয়ে নিজ নিজ এজেন্ডা চাপিয়ে দিতেই বেশি আগ্রহ। সবকিছু দেখে প্রায়শঃই ভাবি চুপ হয়ে থাকাই ভালো। (সম্পাদিত)


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।