আজ আমার মন ভালো নেই…………

সকালে ঘুমে থেকে উঠলাম। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতেই রোজকার মতো দেখা গেল অদূরে দড়িয়ে শান্তা-মনিকা পাহাড়। জানালার পাশ দিয়ে সাততলা পর্যন্ত লকলক করে বেড়ে ওঠা ঝাঁও-জাতীয় গাছের মগডালে কাঠবিড়ালীদের ছুটোছুটি। কাছেই কোথায় যেন নাম-না-জানা কিছু পাখ-পাখালির কিচির-মিচির। বাইরে ঝকঝকে সোনালী রোদ।- সব কিছুই সুন্দর একটা দিন শুরুর যাবতীয় আয়োজনের ডালা মেলে বসে আছে। আমিও তা’ই দিনের শুরুটা ভালোমত করবো বলেই সিসিবি’তে ঢু মারলাম। কিন্তু বাড়ি থেকে একটা ফোন এসে সব কিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেল।-

জানলাম, আমার আম্মার কাছাকাছি বয়সি আম্মার ছোটমামা- আমি ভাইজান বলতাম- তিনি আর নেই (ইন্নালিল্লাহ)।………………………………।

বুকের মাঝখানটা ভীষন ফাঁকা হয়ে গেল। মুহূর্তেই আমার চোখ চলে গেল ডানহাতের কব্জিতে, ছোটবেলায় আমাকে কোলে নিয়ে ডানহাতের কব্জিতে কামড় দিয়ে দাগ করে দিতেন আর হেসে বলতেন, ঘড়ি বানিয়ে দিলাম……। আমার শৈশবের বেশিরভাগ দিন কেটেছে এই ভাইজানের সাথে। কত কিছু যে জেনেছি……আজ পৃথিবী বিখ্যাত সব জ্ঞানীদের বক্তৃতার সময় মাঝেমাঝেই মনে হয় মাত্র এসএসসি পাশ আমার ভাইজান কতো কতছুই শিখিয়েছেন আমাকে……বসতবাড়ি কেন দক্ষিণ-দুয়ারী হতে হয়, চৈত্রমাসে মাছ ধরা অমঙ্গল কেনো, কারেণ্ট জালে মাছ ধরা উচিত নয় কেনো……পৌষের প্রথম দিন কেনো মাঠে গিয়ে চড়ুইভাতি করতে হয়…… খালিহাতে মুঠি করে কিভাবে শিং মাছ ধরতে হয়…….বড়শিতে কিসের টোপ দিলে কোন মাছ বেশি ধরে……

বুঝলাম, আমার মূল শিকড়ের খুবই কাছের একটা শিকড় কেটে গেল। আমি জেনে গেলাম, এ’বছর বাড়ি গেলে সাইকেল নিয়ে হুড়মুড় করে গেটে ধাক্কা দিয়ে একজন প্রিয়মানুষ আমাকে আর ডাকবেনা……। ছেলেবেলার মতো ‘হলহলি বিলে’ বড়শিতে চিংড়ি গেঁথে বাইম মাছ ধরতে যাওয়া হবে না……। বাজারে গিয়ে গুলগুলিওয়ালার ছাপড়ার নিচে বাঁশের বেঞ্চে বসে আটআনা দামের গুলগুলি খাওয়া আর হবে না………

ইউসিএলএ-স্টোরে একটা সুন্দর ঘড়ি দেখে রেখেছি ভাইজানের জন্য কিনবো বলে, জুনে বাড়ি গেলে পড়িয়ে দিতাম…………

যেদিন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে যাই, ভাইজান বলেছিলেন আমি নাকি মেজর হবো। গত বছর বাড়ি গেছিলাম, বলেছিলেন আমি নাকি মস্ত জ্ঞানী হয়ে আকাশ ছুয়ে দিবো…… আমি কতো প্ল্যান করে রেখেছি তাকে বলব তিনি কত কিছু জানতেন…… আরো কত গল্প জমিয়ে রেখেছি তার জন্য……

জীবন এমন কেনো???

১,৬৮৬ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “আজ আমার মন ভালো নেই…………”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    ভাইজানের মঙ্গল কামনা করছি ...
    অসাধারণ হৃদয়স্পর্শী লেখাটা ভাইজানের মৃত্যুর অংশটা বাদ দিয়ে যদি উনাকে দেখাতে পারতেন ...

    ইউসিএলএ-স্টোরে একটা সুন্দর ঘড়ি দেখে রেখেছি ভাইজানের জন্য কিনবো বলে, জুনে বাড়ি গেলে পড়িয়ে দিতাম…………

    আমরা যেন প্রিয়জন চলে যাবার আগেই তার প্রতি আমাদের মনোভাব প্রকাশ করতে পারি ... আফসোস যেন করতে না হয় ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    মাহমুদ ভাই, মন শক্ত করেন...
    শোক কাটাতে মনোবল থাকাটা জরুরী...
    তিনি যেখানেই থাকুন আল্লাহ তার মঙ্গল করুন...


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    সবাইকে ধন্যবাদ সমব্যথী হবার জন্য।

    আসলে আমি বোঝাতে পারবো না তিনি আমার জন্য কতটা ছিলেন। আমার শৈশবের প্রায় পুরোটা কেটেছে নানাবাড়িতে, উনার বাড়ির পাশাপাশি। আমার জন্মের বছর আম্মার চাকরি হয় আমাদের বাড়ি থেকে দূরে, কিন্তু নানাবাড়ির কাছের এক প্রাইমারি স্কুলে। তাই আম্মা বেশির ভাগ সময় নানাবাড়িতে থাকতেন+আমাকে সেখানে রেখে যেতেন। আর আম্মার এই মামা আমাকে নিয়ে থাকতেন।

    সব সময়ই আমি বাড়ি গেলে তার কাছে আমার একটা এক্সট্রা জায়গা ছিল। আজ শুধুই মনে হচ্ছে একটা একান্ত নিজের মানুষ চলে গেলেন। তার স্থানে আর কেউই আসতে পারবে না। তিনি ছাড়া আমার পুরো শৈশবটাই যে ফাঁকা......

    সারাটা দিন শুধুই মনে পড়ছে তার সাথে জড়িয়ে নানান স্মৃতি। আর শুধুই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। ক্লাসে গেলাম ভুলে থাকার জন্য, মাঝখান থেকে উঠে চলে আসতে হলো। কারণ, সব কিছুই যে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল......

    পরবাসী এই জীবনে মাঝে মাঝে স্বজন হারাবার শংকায় ভীত হয়ে পড়তাম, মনে হতো কার যে দুঃসংবাদ শুনি। তাকে দিয়েই যে সেটা শুরু হবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি.........


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।