আলোচনার ধারাবাহিকতার স্বার্থে সারোয়ার ভাইএর একটা মন্তব্য দিয়ে ২য় কিস্তি শুরু করতে চাই। আমার আলোচনার ১ম কিস্তির এক মন্তব্যে তিনি বলেছেন যে, “আমার মতে সবচেয়ে আগে আসে আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এই আত্নপরিচয় এরপর আশে শেকড় অর্থাৎ বাবা মা।বাকীগুলু প্রয়োজনের তাগিদে আস্তে পারে কিন্তু কখনই প্রধান হতে পারেনা।”– সাধারণভাবে এই অনুকল্প (হাইপথিসিস) ঠিকই আছে মনে হলেও একটু গভীর ভাবে বিচার করলে কিন্তু বিপরীত অনুকল্প হাজির হয়ে যায়। আমি যদি নিজের পরিচয়কে এভাবে নির্ণয় করি যে ‘আমি মানুষ’। তাহলে কিন্তু আমাকে পুরোপুরি জানা/জানানো হলো না। না বলা অনেক কথা থেকে যায়, আরও অনেক কিছু জানার আগ্রহ, প্রয়োজনিয়তা থেকে যায়।এখান থেকেই শুরু হয় অন্যান্য ‘প্যারামিটার’ (এখন থেকে বৈশিষ্ট্য বলবো) এর আবির্ভাব, অবশ্যম্ভাবীরূপেই। আর বাস্তবে, মানুষের সাধারণ পরিচয়ের পরেই চলে আসা এইসব বৈশিষ্ট্যের নির্মাণ-বিনির্মাণ, লেন-দেন, ইত্যাদির মধ্যেই মূর্ত হয়ে ওঠে ব্যক্তির ‘আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি’।
আমাকে দিয়েই শুরু করি।
-” আমি কে?”
এই প্রশ্নটার অনেকগুলো উত্তর সম্ভব। আর সেইসব উত্তর অনুসন্ধানের পথও অগণিত। এই প্রশ্নের উত্তর এবং উত্তর খোঁজার পথ আবার নির্ভর করবে প্রশ্নকর্তা বা যাকে উদ্দেশ্য করে পরিচয়-প্রদান, তার অবস্থানের উপর। যেমন, আমাকে যদি এখানে কোনো বাংলাদেশী প্রশ্নটা করে, তাহলে আমি যা যা বলতে পারি, পর্যায়ক্রমে সেগুলো হল- আমার নাম, দেশের বাড়ী (জন্মস্থান অর্থে), বাবা-মা’র পরিচয়, কোথায় পড়াশোনা করেছি/করি (অথবা কি পেশা), কোথায় থাকছি, ইত্যাদি। কিন্তু যদি প্রশ্নকর্তা সদ্যপরিচিত আমেরিকান হ্য়, তাহলে বলতে শুরু করতে হয় আরেক লেভেল আগে থেকে, কিন্তু পরের কিছু লেভেল বাদ দিয়ে, অর্থাৎ আমার নাম, তারপরই আসে দেশ, এখানকার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান (বা পেশা), কিন্তু দেশের বাড়ী, বাবা-মা আসেনা।
আমরা আত্ম-পরিচয় নির্মাণের এইসব বৈশিষ্ট্য কে ‘উলম্ব বিস্তারে’ কল্পনা করতে পারি। সবার উপরে থাকে আমাদের সবথেকে ব্যাপক, সবথেকে সাধারণ পরিচিতি “মানুষ”। তারপর আসে লিঙ্গ, গায়ের রঙ, শ্রেণী, ধর্ম, পেশা, ভৌগলিকতা, জাতীয়তা, ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও আরো বৈশিষ্ট্য (যা সাধারণভাবে আমরা দোষ-গুণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকি) আছে যা স্বল্প-পরিসরে মূর্ত হয়ে ওঠে। ব্যাক্তি তার প্রয়োজন অনুসারে এইসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে তার “significant other” (বাংলাটা মনে আসছে না :bash: ) তুলনামূলক একটা আত্ম-পরিচয় দাড় করায়। যেহেতু ব্যক্তির নিজের অবস্থান, সেই সাথে তার ‘অপরপক্ষ’ (সিগনিফিকেন্ট আদার’এর বাংলা করলাম, জানি না সঠিক হলো কি না)এর অবস্থান নিয়ত পরিবর্তনশীল, তাই আত্ম-পরিচয় নির্মাণের জন্য ব্যবহারযোগ্য বৈশিষ্ট্যাবলীর সংযোজন-বিয়োজনও অপরিহার্য। (কাজেই, আত্ম-পরিচয়ও সতত পরিবর্তনশীল।) এই ‘সংযোজন-বিয়োজন’ প্রকৃয়ায় মূল কৌশল হল ‘অপরপক্ষের’ সাথে নিজের মিলগুলো এবং একইসাথে অমিলগুলোকেও স্পষ্ট করে তোলা। এই পারস্পারিক মিল-অমিলগুলো যতো বেশি স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা যাবে, নিজের আত্ম-পরিচয়ও ততোটাই মজবুত ভাবে তৈরি হবে। উল্লেখ্য, শুধু মিল অথবা অমিল কখনোই ‘পরিচয়’ কে নির্মাণ করতে পারে না।
দেখা যাক সিসিবি’তে কিভাবে আমরা আত্ম-পরিচয় নির্মাণ করি।- সিসিবি’তে আমরা সবাই সবার সম্পর্কে যা জানি (সাধারণ বৈশিষ্ট্য), তা হলো, আমরা সবাই মানুষ, বাংলাদেশী, এক্স-ক্যাডেট, প্রাপ্ত-বয়স্ক, সর্বোপরি দৃঢ় ভ্রাতৃ-বন্ধনে আবদ্ধ। এগুলো আমাদের সাধারণ পরিচয়। এরপর শুরু হয় আমাদের ‘বিশেষ’ পরিচয় নির্মাণ। এটা আবার ভিন্ন ভিন্ন লেভেলে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আলোকে। দলগত ভাবে, প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘নিজ নিজ কলেজ’। যেমন, সব এক্স-ক্যাডেটদের সাথে একই রকম সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও পিসিসি’র এক্স-ক্যাডেটরা ‘একটু’ আলাদা ( ;;; , পিসিসি’র কেউ থাকলে আওয়াজ দিয়েন, মুইছা দিমু), অথবা জেসিসি’র ওরা (কপিরাইটঃ জুলহাস ভাই)। আবার ব্যক্তিগত ভাবে, আমাদের সবার সাথে একই রকম বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়েও আমাদের কেউ কেউ তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে আলাদা। যেমন, সানা ভাই (জুনিয়র পাইলে খালি রগড়ায় x-( )। এই পরিচয়গুলোও আবার চিরস্থায়ী নয় কিন্তু। সময়ের সাথে, নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ-বিয়োগের মাধ্যমে এসব পরিচয় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সর্বদা উপস্থিত (সানা ভাই, এখনো সুযোগ আছে ভাল হওয়ার, আরো খবিস হবারও 😛 )।
সিসিবি’র মধ্যে যে মিল+অমিল গুলোর কথা বললাম, এগুলোর একটা দিক হচ্ছে- আমার বিশ্বাস- সবাই আমরা এসবের সাথে একমত, অর্থ্যাত এগুলো আমাদের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে নির্মাণ করেছি, এবং স্বীকৃতি দিয়েছি। একারনে এই পরিচয়গুলোর মাধ্যমে আমাদের মধ্যেকার ভাবের (এবং বস্তুরও) লেন-দেন সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এটাই গল্পের শেষ নয়, সবে শুরু। আমাদের মাঝে দলগত এবং ব্যাক্তিগত পর্যায়ে অনেক বিষয় আছে যেখানে এখনও ‘পারস্পরিক সমঝোতা ও স্বীকৃতি’ পর্যায় অনুপস্থিত। এই পর্যায়ের পূর্বের কাহিনীগুলো শুধূই আত্মীয়তার-বন্ধুত্বের-সহমর্মিতার-সহযোগিতার, আর পরের কাহিনী শুধুই শত্রুতা-হিংসা-মারামারি-হানাহানি তথা ধ্বংসের।
(চলবে)
প্রথম। B-)
মাহমুদ ভাই, শিরোনামটা মনে হয় বাদ গেছে। 🙂
পড়ে এসে মন্তব্য করছি। 😛
অনেক ধন্যবাদ। ঠিক করে দিয়েছি।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
একটা কথাই বলতে চাই। দুর্দান্ত। অনেক, অনেক ভালো লাগছে। আপনার সিসিবিতে আরো একটা ডাইমেনশন যোগ করে দিলেন। অসাধারণ। :boss: :boss: :boss:
বাপরে বাপ... 😮
মাথা তো পুরা আউলায়া যাইতেছে... 🙁
আন্দাজ আপনা আপনা'র আমির খানের মতন কইতে ইচ্ছা করতেছে 'মে কন হু, ম্যা কাহা হু...' :-B
মাহমুদ ভাই, আপনি তো মিয়া চিন্তায় ফালায়া দিলেন... :dreamy:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
মাহমুদ ভাই, অনেক জোস লাগছে । লেখাটা পড়ে ভাবনার খোরাক পেলাম অনেক।
এই পোস্টে মন্তব্য করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছি আমি আমার নিজের অজ্ঞানতা প্রকাশ করে দিতে। অফটপিক হয়ে গেলে মাফ করবেন।আমি মাঝে মাঝেই আমার আমির সন্ধান করি। এই যে আমার হাত আমার মাথা আমার শরীর আমার মন এই সবের মালিক আমি টা কে। সেই আমিকে খুঁজে পাইনা কখনো। তেমনি ভাবে খুঁজে পাইনা জীবনের কোন বৃহত্তর মহৎ উদ্দেশ্য। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় যদি বলি, আমাদের জীবনটা হলো ক্ষণিকের আলোর ঝলকানি যার আগে ও পরে শুধুই অন্ধকার( থিমটা আজাদ সাহেবের। কথাটা এদিক ওদিক হয়ে গেছে।) যা হোক নিরর্থকতাতেই আমাদের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা। এসব নিয়ে অনেক আগে সামুতে একটা লেখা লিখেছিলাম। লিংক দিলাম।
ধন্যবাদ ভাইয়া এমন একটি সুন্দর লিখার৪ জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যাবাদ আমীন।নিজেকে জানাটাই ত আসলে আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ডের মূলে। কিন্তু তোমার সাথে একমত হতে পারলাম না যে "নিরর্থকতাতেই আমাদের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা।"
আমি অনুমান করতে পারি এই সিদ্ধান্ত কোথা থেকে আসে। এক সময় উত্তরাধূনিকতার ব্যাপক পছন্দ করতাম (আমার ঢাবি'র এমএ থিসিসটা এই ধারাতেই)। কিন্তু এটার 'নঞ-অর্থক' উপসংহারের কারনে ইদানীং কিছু কিছু প্রশ্ন, সেই সাথে নতুন নতুন চিন্তা এসে যাচ্ছে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ! ভাই মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। আমার বুদ্ধি ভাই হাটুতে।আমি আর এখানে নাই। আমি জাস্ট মন্তব্য করেছিলাম আমার মনোজগত দিয়ে।এখন সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ভাই। আমি ক্ষ্যামা দিলাম।তুমি চালিয়ে যাও। জ্ঞাণী ব্যাক্তিরা আছে ভালোচনা করার জন্য।
"আমার বুদ্ধি ভাই হাটুতে"
:pira:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
নতুন চিন্তাগুলি জানর অপেক্ষায় রইলাম।
:clap: পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম, :-B এট্টু তাড়াতাড়ি দিয়েন ভাইয়া।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
সহজ ভাষায় কঠিন লেখা । মজা পাচ্ছি । এরপরে কোন দিকে আলোচনা যাবে সেটাই ভাবছি । আপনাকে ধন্যবাদ । :salute:
খাইছে আমারে......। 🙁 ক্লাস লেকচারের মত লাগে।
তয় তুমি ঘাব্রাইয়ো না, চালায় যাও। ব্যকিং দিমু টাইম মত।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
বস,
কন কি? ক্লাস লেকচারের মতো? তাইলে ত চিন্তার বিষয়। আমি চাইতাছি আলোচনাটাকে হাল্কা ভাষায় বর্ণনা করতে।
ফিড-ব্যাক দিয়েন ভাইয়া। আমার আইডিয়া গুলা ক্লিয়ার করতে খুব কাজ দিবে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আরেক আন্দালিব ভাই আসছে 🙁 । আমার মত পাবলিকের বেইল গেছে সিসিবি থেকে। :(( :((
তাইফুর ভাই, নোটবই দেন 🙁
আমার একটা প্রশ্ন আছে,
দর্শন যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি কি বলে? পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা ভাল নাকি পরীক্ষা না দিয়ে ফেল্ করা ভালো? 😕
আমারে ব্যান... :bash:
বলতে ভুলে গেছিলাম, লেখা ভাল হইছে 🙂
প্রশ্নের 'গঠন' খিয়াল কইরা.........
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আলোচনা চলুক :thumbup:
চলুক :thumbup: :thumbup:
কিন্তু আমি কে? মানুষ। কে বললো? কেন বললো? আমার হাত-পা আছে। অনেক প্রাণীরই হাত-পা আছে। তারা কেন মানুষ নয়?
আমি এলাম কোথা থেকে? কিভাবে?
আমি নাকি সৃষ্টির সেরা জীব! এই মিথ কে তৈরি করলো? আমি সৃষ্টির কতোটা জানি? আমি যখন একা একটা জঙ্গলে যাই সেখানে অন্য প্রাণীগুলো কি মেনে নেয় 'আমি' সেরা?
মাথায় খালি একের পর এক প্রশ্ন আসে। মাহমুদ লিখতে থাকো।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
"আমি কে?" এই প্রশ্নটা প্রথমবারের মত সিরিয়াসলি ভেবেছিলাম "সোফির জগৎ" বইটা পড়ে। কিন্তু প্রশ্নের কোন সদুত্তর এখনও পাইনি। তবে সোফির জগৎ পড়ার পর বুঝেছিলাম, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যেতে হবে, আমৃত্যু।
এখন তাই আমার কাছে আমি কে- প্রশ্নের উত্তর একটাই:
"আমি একটা স্বাধীন সত্ত্বা যে এই "আমি কে"- প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে।"