আজাইর‌্যা সুশীল প্যাচালে মজা পাইছি

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠলাম একটু দেরি করেই। টিভি অন করতেই দেখলাম চরাঞ্চল নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে যেখানে চরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের সমস্যা নিয়ে আলাপ করছে এক সুশীল উপস্থাপক আরেক সুশীল এমপি’র সাথে। তাদের আলাপের বিষয়বস্তু বড়ই মজা পাইছি। সেটা সিসিবি’তে শেয়ার না করে থাকতে পারলাম না।-

তারা বলছে, চরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের কারণ হচ্ছে সেখানকার মানুষের দারিদ্র্য+অশিক্ষা! প্রথমে ভাবলাম ঠিকই আছে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো, বিষয়টা আরেকটু ভেবে দেখি তো-

যৌতুক বলতে যা’র কথা বলা হচ্ছে তা’র মানে হচ্ছে বিয়ের সময় বরপক্ষ কনেপক্ষের কাছে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ/সম্পদ দাবী করে। যৌতুককে বলা হচ্ছে একটা সমস্যা আর এর কারণ বলা হচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষজনের দারিদ্র্য আর অশিক্ষা (মনে হলো বলতে চেয়েছে শিক্ষার অভাব)।

চরাঞ্চলে যৌতুক লেনদেনকে সমস্যা হিসেবে মানতে আমার আপত্তি নেই, অন্য আর সকলের মতোই। এর কারণ হিসেবে ‘দারিদ্র্য’কে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাহলে যৌক্তিক ধারায়ই দারিদ্র্য দূর করতে পারলে যৌতুক সমস্যা দূর হবে এই আশা করতে পারি। কিন্তু যদি একই সমস্যা (যৌতুক) যারা দরিদ্র নয় (তথা সম্পদশালী) তাদের মধ্যে দেখা যায়, তখন তা’র কারণ হিসেবে ত দারিদ্র্য’কে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তাহলে এই কার্যকারণ সম্পর্ক তথা দারিদ্র্য যৌতুকের কারণ যুক্তিতে টিকে না।

আবার, যৌতুকের আরেকটা কারণ বলা হচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষের ‘শিক্ষার অভাব’কে। একইভাবে এই অনুমান করা যায় যে, শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে চরাঞ্চল থেকে যৌতুক অপসারন করা সম্ভব। কিন্তু যেখানে ইতোমধ্যেই শিক্ষা ছড়ানো হয়ে গেছে অথচ যৌতুক সমস্যা রয়েছে, সেখানকার কি হবে? শিক্ষিতদের মাঝেও ত আমরা যৌতুকের সমস্যা দেখি!

কার্যকারণ সম্পর্ক (causal relation) একটা যৌক্তিক ধারা অনুসরণ করে যেখানে বিশেষ কোন এক/একাধিক কারণ একটা ফলাফল (যা এখানে সমস্যা) সৃষ্টি করে, আর সেই কারণ/কারণসমূহ দূর করলে সেই সমস্যাও দূর হয়।

উপরের ছোট্ট আলোচনার থেকে তাই আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে, ‘দারিদ্র্য’ আর ‘শিক্ষার অভাব’ যৌতুকের কারণ নয়। এগুলো ‘কারণ’ হলে এগুলোর অনুপস্থিতিতেও (তথা ধনী ও শিক্ষিতদের মাঝে) যৌতুক থাকার কথা নয়।

কিন্তু একথা ত অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যৌতুক সমস্যার উপস্থিতি দরিদ্র আর অশিক্ষিতদের মাঝেই বেশি দেখা যায়। তারমানে যৌতুকের সাথে দারিদ্র্য আর শিক্ষার অভাবের একটা সম্পর্ক অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা কি?- সেই সম্পর্কটা হচ্ছে প্রভাবকের; অর্থ্যাৎ দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব যৌতুক সমস্যার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বা প্রকট করে তোলে। একারণে, প্রকৃতপক্ষে, দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব হচ্ছে যৌতুক সমস্যার প্রভাবক (catalist), কারণ (cause) নয়। আর শুধু প্রভাবক’কে দূর করলে সমস্যা কখনোই দূর হবে না। কারণ, সমস্যার প্রকৃত কারণটা রয়েই যাবে, তা’ থেকে সমস্যা চলতেই থাকবে।

অতএব, দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাবকে কারণ ধরে যতইসুশীল প্যাচাল চলুক, সরকারী, বেসরকারী, ব্যক্তিগত, সামাজিক পরিকল্পনা নেওয়া হোক, যৌতুকের সমস্যা থেকেই যাবে। এই সমস্যা যথার্থই দূর করতে চাইলে এই প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে সেটা দূর করতে হবে।

১,৬৪৮ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “আজাইর‌্যা সুশীল প্যাচালে মজা পাইছি”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    😀 মজা পাইছি বস্‌
    অনুঘটকের কথা বললেন, আসল কারণের দিকে একটু হিন্টস দিতেন। তাইলে আমাদের জন্য একটু সুবিধা হইতো, বুঝেনইতো 😀

    তা বস্‌ বিবাহ যৌতুক এতদসংক্রান্ত আলোচনা আর কতদিন দেখবেন বলেন, আহসান ভাইতো জানতাম লাইন ক্লিয়ার করেই দিছেন ;)) ;))


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. আন্দালিব (৯৬-০২)

    যৌতুকের মূল কারণ সম্ভবত পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব। এটা পুরোপুরি আমার ধারণা, তবে আমার মনে হয় একটা বিবাহযোগ্য ছেলের বাবা-মা পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের উল্লসিত মনে করে এবং সম্ভাব্য বিয়ের কনে বাছাইয়ের সময় মেয়ের গোটা পরিবারটিকেই তাদের কাছে শোষণ আর ক্ষমতাপ্রকাশের মাধ্যম বলে মনে হয়। আড় পুরুষতন্ত্র ধনী গরীব, সাম্যবাদী-পুজিবাদী, সাদা-কালো সবধরনের মানুষের (নারী-পুরুষের) মাঝেই বিদ্যমান।

    তাই না?

    (অট. কি বলেন কাইয়ূম ভাই? :grr: )

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    দরিদ্র আর অশিক্ষিতরা নিলে সেটারে কয় যৌতুক, আর ধনী এবং শিক্ষিতরা নিলে সেটারে কয় 'গিফট'। :))
    যৌতুক খুব খারাপ, কিন্তু গিফট নেয়া ভালো। :grr:


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  4. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    একটা বড় সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেছো।
    আরব দেশে (মুসলিম সংস্কৃতিতে) ছেলেদেরকে যৌতুক দিতে হয় আর ইন্ডিয়াতে (হিন্দু সংস্কৃতিতে) মেয়েদের। ভৌগলিক কারনে আমরা দ্বিতীয় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত।
    আমি একবার (১৯৯৬) দিল্লির একটা নামকরা মেডিকেল কলেজে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখে অবাক হয়েছি যে শিক্ষিত ডাক্তার মেয়েরা দিব্যি বলছে যে তাদের বাবা-মাদের বিয়ের সময় যৌতুক দিতে বাধ্য নইলে তাদের বিয়ে হবে না এবং কোন ধরনের পাত্রের যৌতুকের রেট কতো সেটাও তারা গরগর করে বলে দিচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম এটা বোধহয় শুধু হিন্দু মেয়েদের সমস্যা কারন বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের কোন ভাগ নেই বলে। কিন্তু দেখলাম মুসলিম মেয়েরাও একই কথা বলছে। ওরা আমার বন্ধু (সেও আমার ক্যাডেট কলেজের) আর আমার কথা শুনে অবাক হচ্ছিল যে বাংলাদেশে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে যৌতুকের কোন চল নেই শুনে। ওদের বক্তব্য ছিল চল ঠিকই আছে হয়তো আমরা জানি না।
    কথাটা যে অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক তা পরে জেনেছিলাম। ১৯৯৯ সালে আমেরিকায় এসে আরেকটা ধাক্কা খেলাম। তখন একে একে প্রবাসী ইঞ্জিনিয়াররা দেশের সব সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করে আনছিলো। অধিকাংশ মেয়েই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। কিন্তু কেন জানি অনেকেই কনফিডেন্সটা খুঁজে পেত বাবার দেওয়া শাড়ি-গয়নার জৌলুসের উপর ভিত্তি করে। ছেলেরাও আরেকদিকে বড়াই করতো শ্বশুরদের বড়লোকিত্বের। তবে এটা একটা ধরন। আবার অনেক ছেলে-মেয়েও আছে যাদের এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই।
    এক নিম্ন মধ্যবিত্ত মহিলার কথা জানি যিনি যৌতুক এড়ানোর জন্য নিজের মেয়েকে একজন বোবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিছুদিন যাওয়ার পরই সেই বোবা বৌ পেটাতে শুরু করলো তাকে কেন যৌতুক দেওয়া হয়নি তাই। এবং এ ব্যাপারে তাকে বন্ধু এবং প্রতিবেশীরা ইন্ধন যোগাতো।
    এবার পেছনের কথায় আসি। কেন এই বেশম্য?
    মেয়েদেরকে আনপ্রোডাক্টিভ বা বোঝা ভাবা হয় বলে ছেলেপক্ষ হয়তো ভাবে ব্যালেন্স করার জন্য নিক্তিতূল্য যৌতুকের দরকার। এটা যেহেতু যুগের পর যুগ ধরে হয়ে আসছে তাই এখন লোকজন কিছু না ভেবেই যৌতুকের আদান-প্রদান করে।
    মেয়েদের নিজেদের ব্যাপারে হীনমন্যতা দূর করতে হবে এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা মেয়েরাই তো মা সেই সাথে একটা শিশুর জীবনে প্রথম শিক্ষক। পরিবারে যদি মায়ের সন্মান অক্ষুন্ন থাকে এবং তাকে সব রকম সহযোগীতা করা হয় তাহলে সন্তানও মাকে সন্মান করতে শেখে। সেক্ষেত্রে মায়ের পক্ষে সহজ হয় সন্তান মানুষ করা। বাবা-মা নিজেরা যদি আদর্শিক হন তাহলে সন্তানকেও সেই ভ্যালুস দিয়ে বড় করা সম্ভব। সব কথার শেষ কথা আমি সুশিক্ষার কোন বিকল্প দেখি না। শিক্ষার ধারাবাহিকতা থাকলে এক প্রজন্মে না হোক দুতিন প্রজন্ম পরে হলেও এ সমস্যা কেটে যেতে পারে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ভাবতাছি এবিসি রেডিও'র নেক্সট টক-শো'তে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে মাহমুদকে আলোচক হিসাবে ডাকবো। আলোচনার বিষয় : বয়স হলেও বাংলাদেশে ছেলেরা কেন আইবুড়ো থাকে!

    কি বলেন কাইয়ুম ভাই?? B-)


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেজওয়ান (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।