বাংলাদেশ বদলাবেই

আজ থেকে ৩ বছর আগে মাত্র কেবল সেকেন্ড ইয়ারে পা দিয়েছি। আমাদের একটা কোর্স ছিল (নাম ভুলে গেছি) সেখানে ইন্টারন্যাশনাল বিযনেস পড়ানো হতো। বড় অর্থনীতি কিভাবে ছোট অর্থনীতিকে খেয়ে ফেলে তাই শিখছিলাম। বেনিয়া গোষ্ঠী (পড়ুন রাষ্ট্র) যারা আগে এলাকা দখল করে শোষন করত এখন তারা বিশ্বায়নের নামে অর্থনৈতিকভাবে শোষন করে। তারা ঋণ নিতে বাধ্য করে আবার তার কারনে তাদের নির্দেশিত পথে চলতেও হয়। খুব কঠিন বাস্তবের মাঝে আমাদের সরকারদের দেশ চালাতে হয়। তাদের ক্ষমতায় আসার স্বার্থেই হোক আর যে কারনেই হোক আমাদের সরকারগুলো কেন জানি এই বেনিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন প্রকার আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে না বা নেয় না। যার প্রমান আমরা পেয়েছি যমুনা সেতু ইস্যুতে হুন্দাই এর বিরুদ্ধে,মাগুরছড়া গ্যাস ইস্যুতে অক্সিডেন্টাল এর বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি।

এতো গেল প্রত্যক্ষ অন্যায় এর নমুনা। ব্যবসায়িক পক্ষের নতুন কৌশল হল মিডিয়ার মাধ্যমে পণ্যের প্রসার। (নতুন কি ?) যার প্রভাব আতঙ্কিত হবার মত। আজ ঈদের পোশাক হয় কারিনা,মাসাক্কালি নামক ভারতীয় পোশাক। ভারতীয় চ্যানেল না দেখলে আজ আমাদের পেটের ভাত হজম হয় না।(পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার পূর্নতা পায়না)। ফলাফল ভারতীয় পন্যে বাংলাদেশের বাজার সয়লাব। বাংলাদেশী পন্যের চেয়ে ভারতীয় পন্যের দাম কম। পাবলিক খাবে না ক্যান? আর বাংলাদেশী চ্যানেল সেখানে অচ্ছ্যুত। পন্যের প্রসার দুরের কথা।

সমাধান কি? আইন করে কি বিদেশী পন্যের বাজারে প্রবেশ বন্ধ করা যাবে? না। সেখানে আমাদের বিদেশী প্রভু রা বেকে বসবেন। উপায়? সহজ(বলার ক্ষেত্রে)। বাস্তবে অনেক কঠিন। আমরা জনগন (অর্থনীতির ভাষায় ‘ভোক্তা’) যদি বিদেশী পন্য ব্যবহার বন্ধ করে দেই? কাজ টা অনেক সহজ হয়ে যায় না? দেশী শিল্প বাচবে, প্রভুদের খবরদারি কমবে…আরো অনেক কিছু। (এটা আমার ভাবনা ছিল। আপনারা কি বলবেন জানি না)

এই সচেতনতা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেবার উদ্দ্যেশে আমি কয়েক জনের সাথে কথা বলি এবং অনেক ইতিবাচক সাড়া পাই। কাজে নেমে পড়ি। আমি যে সবাইকে বিদেশী পন্য বর্জন করতে বলব তারা ভোগ করবে কি? আমি বিদেশী নির্দিষ্ট পন্যের অল্টারনেটিভ দেশী পন্য খুজতে শুরু করি। এজন্য বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক দেশী পন্যের মেলার আয়োজকদের সাথে যোগাযোগ করি। এরপর হঠাত করে উতসাহ হারিয়ে ফেলি এবং সেখানেই আমার সেই উদ্দ্যোগের সমাপ্তি ঘটে। ফলাফল আমি নিজেও পুরোপুরি বদলাতে পারি নি। টেলিটক সিমের নাম্বার টা আজো সবার কাছে পৌছাতে পারলাম না। মাঝে মাঝেই বিদেশী পন্য কিনি।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের এক ফ্রেন্ডের টাইফয়েড হয়েছে। দেখতে গিয়েছিলাম ধানমন্ডিতে। অনেক ক্ষন গল্প টল্প করার পর ঐ  ফ্রেন্ডের ছোট ভাই আকিব এসে স্বভাব সুলভ দুষ্টামী করতে করতে গল্প শুরু করে দিল। প্রথমেই কার্টুন, তারপর গাড়ী এবং আরো অনেক কিছু নিয়ে গল্প করছিলাম । এক পর্যায়ে এসে ইউনুস(প,ক,ক) কোন কথা থেকে যেনো জিজ্ঞেস করলঃ

ঃগার্ল ফ্রেন্ড কি জানো?

ঃ জি, জানি

ঃ কি বলতো।

ঃযারা এক সাথে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে আর কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন ঘুরতে যায়। তাদের একসাথে টেপ দিয়ে বেধে রাখে। আর টেপ ছিড়ে আলাদা হয়ে গেলে ফিচ ফিচ করে কাদে।(এই পর্যায়ে সে অভিনয় করেও দেখালো কিভাবে কাদে। অভিনেতা ভাল। এরই মধ্যে একটা বিজ্ঞাপন আর দুইটা শর্টফিল্মে অভিনয় করেছে)

আবার ইউনুস এর কানে বলেই ফেললো (ওর ভাই আছে বলে হয়তো)

ঃ আবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে একসাথে ঘুরে বেড়ায়।

আমি, ইউনুস আর আশফাক (অসুস্থ ফ্রেন্ড) হাসব না কাদব বুঝতে পারছিলাম না। না বোঝার কারনেই হয়তো হাসলাম অনেক ক্ষন।

এর মধ্যে আবার অনেক কথা হল। অনেক মজার মজার অভিনয় করে দেখাল আকিব। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ছিলাম আমরা। চলে আসার কিছু আগে এক পর্যায়ে ফেসবুকের পোকার খেলার চিপস নিয়ে কথা উঠলো। সাথে সাথে আকিবের উতসুক চাহনি। জিজ্ঞেস করল…

ঃ ভাইয়া কিসের চিপ্স?

ইউনুস ওকে বিভ্রান্ত করার জন্য ফান করে বললোঃ চিপ্স খাওনা? লেইস চিপ্স।

ঃনা ভাইয়া। খাই না।

ঃ খাওনা? লেইস চিপ্স খাওনা?(ইউনুস আকাশ থেকে পড়ল)

ঃ চিপ্স খাই ভাইয়া। কিন্তু লেইস চিপ্স খাই না।

ঃ কেনো? লেইস চিপ্স ভাল লাগে না?

ঃ না ভাইয়া। ভাল লাগে। কিন্তু তাও খাই না।

ঃ কেন?

এইবার আমাদের আবার আকাশে উঠার পালা। আমি, ইউনুস আর আশফাক অবাক বিস্ময়ে শুনলাম মাত্র ক্লাস টু তে পড়া আকিব তার অস্পস্ট স্বরে থেমে থেমে বলছে…

ঃ ভাইয়া আমরা যখন লেইস চিপ্স নিয়ে টাকা দেই (বিরতি) লেইস চিপ্স নিয়ে টাকা দেই না? ওই টাকা ওরা ভারতে নিয়ে যায়। এই জন্য আমি লেইস চিপ্স খাই না।

আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি মাটির সাথে মিশে গেলাম। আমার এই বোধটা আনার জন্য ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আসতে হয়েছে। আর এই ছোট্ট আকিব বলে কি? আমরা চিতকার করে বলতে ইচ্ছে হল মাননীয় রাষ্ট্রপতি দেখে যান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখে যান, মাননীয় বিরোধী দলের নেত্রী দেখে যান, সারা বাংলাদেশ দেখে যাও , শিক্ষা নাও। কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়। কতটা গভীর করে।

আমার দেশে আজ এমন সন্তানও জন্ম নেয় যারা মাত্র ক্লাস টু তে পড়েও দেশকে এতটা গভীর করে ভালবাসে। আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল বাংলাদেশ একদিন বদলাবেই।

৩,২৩২ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “বাংলাদেশ বদলাবেই”

  1. রায়েদ (২০০২-২০০৮)

    কলেজে থাকতে একটা বইয়ে পড়েছিলাম ইন্দিরা গান্ধী ৯ বছর বয়সে একটা বিদেশি পুতুল তার জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলেন। কিন্তু বিদেশি হওয়ায় ওই পুতুলটা নেন নি। আশা করি আমাদের দেশের সবার মধ্যেও একদিন এই বোধ গড়ে উঠবে।

    জবাব দিন
  2. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    একদিন বদলাবেই.....................


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  3. আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

    খুবই আশার কথা, আসলে রাত্রি যত গভীর হয় প্রভাত তত সন্নিকটে আসে।
    কিন্তু প্রশ্ন হল আকিবের এই চেতনাগত অবস্থান বাস্তবতার হাতুড়িপেটায় সময়ের সাথে সাথে আরো পোক্ত হবে না ভেংগেচুরে খান খান হয়ে যাবে?

    জবাব দিন
  4. সামিয়া (৯৯-০৫)

    আকিবকে, এবং যারা তাকে এই মানসিকতায় দিক্ষীত করে যাচ্ছেন, তাঁদেরকে, স্যালুট।

    লেইস চিপ্স আমিও খাইনা, বিদেশী পণ্য সযত্নে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, কিন্তু বাস্তবতা হলো, আর কতদিন। আমি টেলিটক ব্যবহার করতাম দেশীয় ফোন বলে। প্রথম প্রথম ভালই ছিল, কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন তাদের নেটওয়ার্কের দূরবস্থা ঘটলো, সেইসব দিনেও কষ্ট করে হলেও ব্যবহার করেছি। ভেবেছিলাম দেশের কোম্পানী, প্রথম প্রথম তো এরকম হবেই, একটু সময় গেলে নিজেরাই উন্নতি করবে। কিন্তু একটা সময় এসে যখন কথাও আর শুনতে পাওয়া যায় না, দুই মিনিটের একটা কনভার্সেশনে চারবার ফোন কাটে, তখন আর পারলাম না। লেইস চিপ্স বিলাসবহুল, না খেয়ে থাকা যায়, কিন্তু মোবাইল ফোন অত্যাবশক দ্রব্য।

    এখনকার যুগ মার্কেটিং এর যুগ। ভোক্তাকে ধরে রাখতে হলে পণ্যের মান বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের চিপ্স কোম্পানী যখন আকিবকে পচা আলু খাওয়ানো শুরু করবে আকিব কিন্তু তখন আর থাকতে না পেরে লেইসের দিকেই ঝুকবে।

    তাই শুধু ভোক্তাদের দেশপ্রেম দেখালেই চলবে না, শিল্পপতিদেরও দেখাতে হবে। তারা কি বোঝে না একটা দেশের উন্নতির মূলমন্ত্র অর্থনৈতিক অবস্থা? অর্থনৈতিক উন্নতি না ঘটলে এই দেশ কিভাবে এগোবে?

    জবাব দিন
    • আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

      সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব বাস্তবতায় জাতীয় পুঁজির বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।সেক্ষেত্রে শুধু শিল্পপতিদের সদিচ্ছাও যথেষ্ট নয়। তবে তারা যতদূর যেতে পারে ততদূর যাওয়ার চেষ্টাটা অবশ্যই করা উচিৎ। কিন্তু শিল্পে উন্নত দেশগুলোতে শিল্পপতিদের যে নূন্যতম যোগ্যতা,উদ্দম,সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা,নৈতিকতা ইত্যাদি থাকে, এদেশের ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। হয়তো আগামী প্রজন্মের শিল্পপতিরা এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

      জবাব দিন
    • মাহমুদুল (২০০০-০৬)

      ধন্যবাদ আপু।
      আকিব এখন দেশী চিপ্সই খাচ্ছে (নাম বলেছিল, আমি ভুলে গেছি)
      ভেবেছিলাম আলাদা একটা পোস্ট দেবো। তারপরো সংক্ষেপে বলি। আমাদের শিল্পপতিরা পন্যের মানোন্নয়নের চেয়ে কিভাবে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে গাপ করে গিলে খেতে পারে সেই চিন্তা টাই করে। আমাদের শিল্পপতিদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারব। সালমান এফ রহমান উতকৃষ্ট উদাহরন।

      "Seven Deadly Sins

      Wealth without work
      Pleasure without conscience
      Science without humanity
      Knowledge without character
      Politics without principle
      Commerce without morality

      Worship without sacrifice."
      — Mahatma Gandhi

      এগুলোর জন্য দেশ ও জাতি শুধু ক্ষতিগ্রস্থই নয় রীতিমত পঙ্গু হয়ে যায়। আমরা সেই ক্লান্তিলগ্নের কাছাকাছি এসে দাড়িয়েছি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একদিন সবাই ফুসে উঠবেই।


      মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

      জবাব দিন
  5. আছিব (২০০০-২০০৬)

    পণ্যের প্রসার বা মিডিয়ার প্রসার যা-ই বলেন, সবকিছুতেই মূল টার্গেট কিন্তু মেয়েরাই। ভারতীয় চ্যানেল না দেখলে আর পোশাক না পরলে তারা নিজেদের ক্ষ্যাত মনে করে। খুব সহজেই মেয়েরা চটকদার প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়। মা যদি হিন্দীতে কথা বলে,সন্তান কী শিখবে বলেন ভাই?

    আকিব ও তার পরিবারকে সালাম

    জবাব দিন
  6. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    বাংলাদেশ বদলাবেই, তবে পজিটিভলি কবে নাগাদ বদলাবে সে ব্যাপারে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে।

    সামিয়া ইতিমধ্যে বলেছে, আমি আবারো বলছি বর্তমান সময়ে শুধু দেশপ্রেম বা সমাজ সচেতনতা দিয়ে দেশীয় পন্যের প্রসার ঘটানো যাবে না। পন্যের যথাযথ মান নিশ্চিত করতে হবে। আমিও টেলিটক ব্যবহারের যথেষ্ঠ চেষ্টা করেছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে সেটা বাদ দিতে হয়েছে।

    এই দেশপ্রেম ও সচেতনতা ভোক্তা শ্রেনীর পাশাপাশি ব্যবসায়ী, পন্য আমদানীকারক, উৎপাদক আর সবার উপরে দেশের নীতি নির্ধারক মহলে আসতে হবে, তাহলেই যদি কিছু বদলায়।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  7. হাসিব (১৯৯৯-২০০৫)

    আমাদের দেশ তখনেই বদলাবে যখন আকিবের মত ছেলেরা দেশ শাসনের দ্বায়িত্ব নিবে বড় হয়ে.... বাইরের দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেরা যখন রাজনীতি করে, আমদের সবচেয়ে অযোগ্য, বেকুব , অগ্রনযোগ্য , যাদের ক্লাসে কোন বেল নাই , তারাই রাজনীতি করে. যার ফলে আমদের যোগাযোগ মন্ত্রীর মত বেহায়া লোক মন্ত্রীত্ব পায়...........................।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।