রানওয়ে

আজ দিনের শুরুটা হলো মগজ দৌড়িয়ে। যেমনে পারি গজগজ করে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দিতে পারলে বাঁচি। কিন্তু আফসোস, পড়াশোনার ইচ্ছার সাথে পাল্লা দিয়ে পড়া মুখস্থ করার ক্ষমতা কমছে ধীরে ধীরে। সেটা বুঝলাম পরীক্ষা দিতে বসে। প্রশ্ন কমন নিয়ে প্রস্তুতি নিলে যেটা হয়, ‘কমন পাইলে কোপাও আর না পাইলে কোপ খাও’, আজকে কমন পেয়েও কোপানোর ধারে কাছে যেতে পারলাম না। উৎসাহ নিয়ে একেকটা প্রশ্ন উত্তর করা শুরু করি, যত আগাই ততই পরের দিকের পয়েন্টগুলা ভুলে যাই এবং শেষের দিকে গিয়ে আটকে যায়। আধামাধা একখান পরীক্ষা দিয়ে মেজাজটা ছিল চ্রম খ্রাফ। …… হলে এসে দিলাম একখান বিষাদময় স্ট্যাটাস, ঃ”…… দিনে দিনে মুখস্থ করার ক্ষমতা ও তাহা পরীক্ষার খাতায় উগড়ানোর দক্ষতা যে হারে হ্রাস পাইতেছে তাতে করিয়া মন হইতে উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করার দুর্বিনীত আকাংক্ষা পরিত্যাগ করতঃ ‘বিজ্ঞানে ব্যাচেলর’ অর্জন করিয়া ছাপোষা চাকুরীতে যোগদান করাকেই সমীচীন মনে হইতেছে। ….. পরীক্ষায় চাপা মারিতে মারিতে (লিখিতে লিখিতে) নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হইয়া গেলাম।”…….

উল্লেখ্য,অধমের এই আফসোসের পোস্ট বটবৃক্ষ মাস্ফ্যুদার চক্ষু এড়ায়নাই। সাথে সাথে কিছুক্ষণ পর ফোন এবং অনেকদিন পর আবার সেই জলদগম্ভীর গলা! মনটাই ভালো হয়ে গেল। অবশ্য মন ভালো হওয়ার আরো কারণ আছে………………

রানওয়ে (http://www.youtube.com/watch?v=2ROaO4nxaO0) :

…..পরীক্ষা দিয়ে মন খারাপ করলেও বন্ধুরা এসে যখন বলল হঠাৎ, চল রানওয়ে দেখে আসি, মনটা ভালো হয়ে গেল। পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে কাল পর্যন্ত তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘রানওয়ে’, ‘নরসুন্দর(স্বল্পদৈর্ঘ্য)’, ‘একুশে(২মিনিট)’ দেখাচ্ছে। স্টার সিনেপ্লেক্সে গিয়ে ২০০-২৫০টাকায় বিদেশী ছবি দেখি আর দেশী ছবি ৫০টাকায় দেখব সেটা কেমন যেন লাগল। কি আর করার? তবে মানুষের উৎসাহ দেখে ভালো লাগল। প্রচুর ভিড় হয়েছিল। অবশ্য ফেব্রুয়ারি মাস আসলে বাংগালীর মধ্যে বাংগালীয়ানা জাগ্রত হয়। এই বিশ্বায়নের যুগে অন্তত একমাস দেশপ্রেম দেখালেও খারাপ কি? নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। যাই হোক, সিনেমার সমালোচনা করার সাহস ও যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই, আমি খালি বলতে পারি আমার কি ভালো লাগল, বাকিটা আপনারা দেখলেই বুঝে যাবেন……….

…….. শো শুরু হল ২মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র ‘একুশে’ দিয়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারীতে যে মানুষ ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি অভ্যররথনা জানায় তাই নিয়েই। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলগুলো অনেক মৌলিক, যেভাবে চিত্রধারণ করা হয়েছে এক কথায় তা অসাধারণ। এরপর দেখানো হল ১৫মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘নরসুন্দর’। একাত্তরকে একটা ভিন্ন আংগিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এই ছবিতে। যদিও ১৫মিনিটে নয়মাস তুলে আনা অসম্ভব, কিন্তু পরিচালক সামান্য একটা টুকরো ঘটনা দিয়ে একটা চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। চেতনাটা কী সেটা দেখলেই বুঝবেন। আবারো এখানে চলে আসে লোকেশন সিলেকশনের কথা। প্রতিটা জিনিস,আসবাব যত্ন করে বানানো। ক্যামেরা পিছনে কাজ করেছেন মিশুক মনীর। ইনিও আরেক জিনিয়াস। ‘গেরিলা’ যারা দেখেছেন,তারা বলবেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ সেট নির্মাণে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। আমি বলব, তারেক মাসুদ তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। মজা করে বললে হয়, ‘গেরিলা’ বানানোর আগে ‘নরসুন্দর’ দেখে নিয়েছেন। যদিও প্রতিটা পরিচালকেরই তাঁর নিজ নির্মাণ নিয়ে একটা অহম থাকে (… ইয়ে মানে,এই অধম একটা মঞ্চনাটক নির্মাণ করতে গিয়ে টের পেয়েছে সেটা..)

……. অবশেষে ‘রানওয়ে’ শুরু হল। আগের দুইটা ছবি দিয়েই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘রানওয়ে’-র শুরুটা হল সত্যিকার অর্থেই একটা বিমানের উড্ডয়ন দিয়ে। এবং আবারো লোকেশন দেখে চমকে উঠলাম। আক্ষরিক অর্থেই এয়ারপোর্টের রানওয়ের পেছনে একটা ঝুপড়িঘরে বাস করা পরিবারের কাহিনী নিয়ে ছবিটা নির্মিত। এমন একটা জায়গা তারেক মাসুদের মাথায় কেমনে আসল সেটা নিয়েই রিসার্চ করা দরকার। চিত্রধারণ এত সুন্দর যে না দেখলে বুঝা সম্ভব না। ছবিটায় গরু,বিড়ালের অভিব্যক্তি দেখলে তাদেরকেও অভিনেতা মনে হবে! আর এক দুইজন ছাড়া সবাই অচেনা অভিনেতা কিন্তু এত ন্যাচারাল অভিনয় খুব কম ছবিতেই দেখা যায়। একটা ভালো ছবি বানানোর জন্য অনেক অনেক কষ্ট করতে হয়,তারেক মাসুদ কোয়ালিটির সাথে কখনও কম্প্রোমাইজ করেননি। প্রতিটা মূহুর্তে রয়েছে অসামান্য যত্নের ছাপ। ছবির কাহিনী গতানুগতিক বাংলাদেশ নিয়ে। কিন্তু এতটা স্পষ্ট প্রতিটা সিন যে মনে হল সিনেমা দেখতে আসিনি, একটা পরিবারের সাথে থেকে তাদের সংগ্রাম দেখছি!……….

……. নাহ, এভাবে বকবক করার কোন মানে হয় না। কাল সময় আছে, যে যেমনে পারেন ছবিটা দেখে আসেন, অবশ্য কালকে অনেক ভিড় হবে। আর বিকালে গেলে চারুকলার গেটের সামনে ১০টাকায় মুরগীভাজি খাইয়েন, কে এফ সি এর চেয়ে অনেক ভালা। …..এখন জ্বর জ্বর লাগতেছে,মেজাজ আবার বিগড়ায় গেল,তাই ভাবলাম কিঞ্চিত ব্লগাই,কদ্দিন পর!!……

তারেক মাসুদ আর ফিরে আসবেন না। এরপর কেউ আসলে সে তারেক মাসুদের ছায়ার সমানও হতে পারবেন না। তারেক মাসুদ একজন ফেনোমেনোন ছিলেন। তিনিও গেলেন,হুমায়ূন ফরিদী গেলেন। ভালো সবাই যাওয়ার মিছিলে যোগ দিয়েছেন, আর আসার মিছিলে আসতেছে সারিকা-শখ-তানজিকা! আফসোস খালি আফসোস আর আফসোস ……..

বিঃদ্রঃ পরিশেষে মাস্ফ্যুভাইকে অজস্র ধন্যবাদ। আপনারে ভালা পাই, ফোন্দিলে ব্যাপক ভাল্লাগে

১,৬৬৪ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “রানওয়ে”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    হুম। মুভি দেখার ইচ্ছা বেড়ে গেলো।

    কিন্তু এতটা স্পষ্ট প্রতিটা সিন যে মনে হল সিনেমা দেখতে আসিনি, একটা পরিবারের সাথে থেকে তাদের সংগ্রাম দেখছি!……

    এই একই জিনিস আমার মাটির ময়না দেখে মনে হয়েছিল।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এই সিনেমাগুলো দেখার জন্য অনেকদিন হরেই চেষ্টায় ছিলাম, কিন্তু কোন মাধ্যম পাচ্ছিলাম না। ঢাকায় থাকলে অবশ্যই দেখতে যেতাম 🙁 দেখি বিকল্প কোন ব্যবস্থা কয়রা যায় কিনা...

    লেখা ভাল লেগেছে আছিব , আরো পড়তে চাই 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আমিও দেখপোওওওওওওওওওওওওওওওও :(( :(( :((


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেজা শাওন (২০০১-২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।