সপ্তম শ্রেণীর সাতকাহন-পর্ব ২>>শিক্ষানবিশি কুচকাওয়াজ

ডিসক্লেইমার
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-কে আপনারা যতই মহিমান্বিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনে করুন না কেন,বুয়েটবাসীরা একে অত্যন্ত সম্মান ও ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে ”Bangladesh University of Extreme Torture” বলে সম্বোধন করে থাকে।গেল সপ্তাহে আমার ৩য় বর্ষ ১ম সেমিস্টারের ক্লাশ সমাপ্ত হল।৩টা কুইজ,১টা সি.টি(Class Torture),৪টা গিগা সাইজ ল্যাব রিপোর্ট সাবমিশন মিলিয়ে ”মানবীয় সিপিইউ” এর টাস্ক ম্যানেজারের উপর দিয়ে ”হারিকেন ক্যাটরিনা” বয়ে গেল।কুইজের প্রশ্ন হাতে পেয়ে মনে হল,আমি স্থির,আর বাকিসব আমার চারপাশে পর্যাবৃত্ত গতিতে ঘূর্ণায়মান!

”বুয়েটবাসীর বাঁশভক্ষণ” পরে বয়ান করব।তার আগে আজকের টাইটেল এর উপর আলোকপাত করা যাক।ব্লগ লিখনে আমার অন্যতম ত্রুটি হচ্ছে,লিখতে লিখতে চোথা(বুয়েটীয় ভাষা-নোট) বানিয়ে ফেলা।কিন্তু,কি করব?যা মাথায় আসে সব না লিখতে পারলে হাত খচখচ করে,মাথা মচমচ করে,হাজার হোক,এত্ত ভালোবাসি ক্যাডেট কলেজটাকে,স্মৃতিগুলোর প্রতি সম্মান দেখাব না?যাই হোক,আমার ৩য় ব্লগ কোন পাঠকের চোখে নিদ্রা আনয়ন করলে লেখক দায়ী না,সব নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দোষ!

সপ্তম শ্রেণীর সাতকাহন-পর্ব ১ এর পর থেকে……….

……………মে ২৬,২০০০ সাল।ক্যাডেট কলেজের ২য় দিন।মুন্তাসীরের ডাকে ধচমচ করে উঠলাম,ঘড়িতে দেখি ৫টা ২৪ মিনিট!আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সব হাফ শার্ট,হাফ প্যান্ট,পি.টি. শু পড়ছে।আমিও কিছু না বুঝেই সবাইকে ফলো করলাম।দেখি,রুম লিডার রাকিব ভাই(৯ম শ্রেণী) দিব্যি ঘুমাচ্ছেন।ভাবলাম,বড় ভাই,তাই ভাব বেশি,পরে রেডী হবেন হয়ত।যাই হোক,তার যাতে কোন ডিস্টার্ব না হয়,সেজন্য চুপচাপ রেডী হয়ে সবাই রুম থেকে বের হলাম।একজন বলল,’’কই যাব?কেউ তো এটা বলেনাই?খালি জানি পি.টি. হবে।“বিজ্ঞ একজন বলল,’’বোকা।পি.টি. হয় গ্রাউন্ডে,ওখানে যাব।“ বিচক্ষণ একজন বলল,’’আরে পি.টি কি খালি আমরাই করমু?আর কেউ তো দেখি উঠেনাই!’’আমাদের করিডরে দাঁড়িয়ে আলোচনা ভঙ্গ হল যখন দেখলাম বিশাল লম্বা এক ভাই ঢুলুঢুলু চোখে টয়লেট থেকে প্রাকৃতিক কাজ সেরে রুমে ফিরছেন।আমাদের কে দেখে প্রথমে তিনি বুঝলেন না,মানুষ দেখছেন,নাকি ভোরবেলায় ক্যাস্পার এর দল (নতুন সাদা পোশাকে) দেখছেন!একজনকে দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,’’অ্যাই পিচ্চি,ক্লাস সেভেন?কি বার আজকে।“ আমার বন্ধুটি উত্তর দিল,”জী ভাই,শুক্রবার।“ এইবার ভাই,সমগ্র হাউস কাঁপিয়ে হুঙ্কার দিলেন,”শুক্রবারে পি.টি. হয় এইটা প্রস্পেক্টাসে লেখা ছিল??যাও,ঘুমাউ সব।৭ টার আগে কেউ বের হবা না।“ আমরা বজ্রাহত হয়ে রুমে ফিরে গেলাম।আমি নিজে ভাবলাম,এখন থেকে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কোন কাজই আগে আগে করব না।

৭টা ২০ এর দিকে খাটে প্রকান্ড শব্দে প্রচন্ড চমকে লাফিয়ে উঠলাম ঘুম থেকে।দেখি,রাকিব ভাই যার বেডের পাশ দিয়ে হাঁটেন তার বেডেই লাত্থি কষান!রুম থেকে বের হওয়ার আগে বললেন,’’১০ মিনিটের মধ্যে সব রেডী হয়ে নিচে ফল-ইন হবা।“ আমি পাশে মুন্তাসীরকে জিজ্ঞেস করলাম,’’দোস্ত,ফল-ইন কি?’’ ও কটমট করে বলল,’’অই,আমি জানি??’’যাই হোক,রেডী হয়ে নিচে গেলাম।কোনমতে ‘’ফল-ইন’’ জাতীয় একটা কিছু করলাম।ডাইনিং এ গেলাম।ব্রেকফাস্ট এও যথারীতি পিন্টু পিন্টু রব উঠল।যাই হোক,সহ্য করলাম কোনোমতে।ব্রেকফাস্টের পর দুইজন স্টাফ(সেদিন ‘’স্যার’’ বলছিল সবাই) আমাদের খালিদ হাউসের পিছন দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।থরো মেডিকেল চেক-আপ হল।জীবনে দ্বিতীয়বারের মত ইজ্জতটা গেল!

মেডিকেল শেষে হাউসে আসার সাথে সাথেই এইটের ভাইরা লাইনে দাঁড় করালেন।রওনক ভাই,আরেফীন ভাই,সুহান ভাই সবাই মিলে ভাবের সাথে যে লেকচার টা দিলেন,তার সারমর্ম হচ্ছে,”এখন থেকে কোন ক্লাস সেভেন এর ছেলে সূর্যোদয় দেখবে না,শুধু নিজের ছায়া দেখে বুঝে নিবে,সূর্য কোনদিকে আছে,নিচে তাকিয়ে হাঁটবে!কেউ হ্যান্ডসুইং দিয়ে হাঁটবে না (সেদিনই প্রথম খেয়াল করেছিলাম,মানুষ হাঁটার সময় হাত নাড়ায়!),সবাই হাত গুঁটিয়ে সাবধান হয়ে হাঁটবে।কাউকে ভাইয়া বলা যাবে না,ভাই বলতে হবে।অন্য হাউসে যেতে হাউস প্রিফেক্টের পার্মিশন নিতে হবে।৩নং বাথরুম ব্যবহার করা যাবে না,ড্রাইং রুমের ভিতরের বাথরুম এ জীবনেও ঢুকা যাবে না,হাউসের রুমপ্ল্যান মুখস্থ করতে হবে,টেবিল ম্যানার যত তাড়াতাড়ি পারা যায় শিখতে হবে,ইত্যাদি ইত্যাদি………

শুক্রবার পুরোটা দিন চুলকাটা,খাকী ইউনিফর্মের মাপ দেয়া,নিয়ম শেখা আর সিনিয়রদের টীজ খাওয়া এই করে কেটে গেল।রাতে খাকী পোশাকের কাপড় ছাড়া বাকী এক্সেসরিজ-এ্যাপুলেট,ব্যাজ,নেম্পলেইট,ক্যাপ,বেল্ট পেলাম।শনিবারে ঠিকমতই সকালে ফল-ইন হলাম সবার সাথে।গ্রাউন্ডে গেলাম,দেখি প্রকান্ড ভুঁড়িওয়ালা একজন লোক “প্রায়-আন্ডি টাইপ’’ হাফপ্যাণ্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাকে দেখে সিনিয়ররা দৌড়ে গ্রাউন্ডে ঢুকছেন।এক ভাই গালি দিলেন,’’শালা ভোঁদড়।আজকে আগে আসছে।‘’সেদিন ড্রিল ছিল।সবাই খাকী আর আমরা সাদা!বড়ই বেমানান।সবাইকে কত স্মার্ট লাগছে!ড্রিল শুরু হল,আমরা দাঁড়িয়ে দেখলাম।একজন দাঁড়িওয়ালা(এনাম স্টাফ) লোক ঐ ‘’ভোঁদড়’’ কে রিপোর্ট করছেন,’’২৯৪ জন ক্যাডেট,ড্রিল-প্যারেডে উপস্থিত,ছাড়ড়ড়!!” ড্রিল হল।মাঝে মাঝে দেখলাম,কিছু সিনিয়র মাঠে গড়াগড়ি খেলেন।আমরাও একটু মার্চ করলাম,কি মার্চ করলাম উপরোয়ালাই জানেন!……..

ড্রিলের পর ব্রেকফাস্ট এ ব্রেড,বাটার,জেলী,কলা ইত্যাদি ফর্মালিটি মেনে খেতে গিয়ে শার্টকেও খাওয়ায় ফেল্লাম।এই দুর্দশা শুধু আমার না,কম বেশি আমাদের ব্যাচের সবারই হয়েছিল।ব্রেকফাস্টের পর একাডেমীতে যাওয়ার জন্য ফল-ইন এ দাঁড়াব,দেখি এক স্টাফ এসে বলছে,’’ক্লাস সেভেন ক্লাসে যাবে না,এদের ড্রিল ক্লাস হবে।‘’আমি ভাবলাম,’’ড্রিল পিরিয়ডে কিছুই করাইলো না,এখন ক্লাস বাদ দিয়ে ড্রিল!পড়াশুনার কী হবে!’’যাই হোক,ড্রেস চেইঞ্জ করতে বলা হলো এবং যে ড্রেসটা পড়তে বলা হল,তার কম্বিনেশন যে কোন ‘’যেমন খুশি তেমন সাজো’’ প্রতি্যোগিতায় ১ম প্রাইজ পাওয়ার দাবী রাখে!স্যান্ডো গেঞ্জি,সাদা হাফ প্যান্ট,কালো মোজা,কালো বুট,কোমরে সবুজ বেল্ট,সবুজ ব্যারেট ক্যাপ,আর গেঞ্জিতে নেইমপ্লেইট!একে অন্যকে দেখে হেসে গড়াগড়ি খেলাম,কিন্তু আয়নায় নিজেকে দেখে গ্রাম্য চৌকিদারকেও আমার থেকে বেশি স্মার্ট মনে হল!

যাই হোক,ড্রিল গ্রাউন্ডে গেলাম।একজন সুন্দর চেহারার স্টাফ কে জিজ্ঞেস করলাম,’’স্যার,কতক্ষণ ড্রিল করব এই রোদে?” তার মুখ মূহুর্তের মধ্যে লাল হয়ে গেল,ধমক দিয়ে বললেন,’’আমারে স্যার মনে হয়!আমি আর্মি ড্রেসে আছি দেখ না?এইখানে আমরা সবাই স্টাফ,ফ্রফার জায়গায় যদি ফ্রফার ওয়ার্ড ইউজ না করছ,তাইলে খবর করে ফেলমু!’’ আমি কিছু বুঝলাম না,সারাজীবন দেখলাম ‘’স্যার বললে সবাই খুশি হয়,এদের এই দশা কেন?আর আর্মি পোশাকের কেউ স্যার না তো কি?’’ যাই হোক যেটা বুঝলাম তা হচ্ছে,তারা ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী এবং এদের স্টাফ বলে,এরা স্যার বললে মাইণ্ড করে,আর এই স্টাফ টার ‘’ফ’’-প্রীতি বেশি।স্টাফরা নিজেদের পরিচয় দিলেন,দাঁড়িওয়ালা স্টাফ-এনাম স্টাফ,৫ টার মধ্যে হেড; জাকির স্টাফ,কাসিম হাউস-মানে আমাদের স্টাফ;বাতেন স্টাফ-তারিক হাউসের;খালিদ হাউসের আল-আমিন স্টাফ (ফ-প্রীতি যার),আর ব্যান্ড স্টাফ-আমজাদ স্টাফ।সব স্টাফ স্ব-স্ব হাউস নিয়ে ভাগ হয়ে গেলেন।

জাকির স্টাফ নিজের বায়োডাটা বললেন।আমাদের নাম জানলেন।এইবার আরামে-দাঁড়ানো ,সাবধান হওয়া শিখালেন।তার বর্ণনায় সাবধান ব্যাপারটা হচ্ছে>>’’বুক উঁচু,পেট নিচু,সিনা টানটান,লক্ষ্যদৃষ্টি সামনে,বুড়া আঙ্গুল প্যাণ্টের সেলাই এর সাথে মিলানো,মুষ্ঠি শক্ত,কনুই আর শার্টের ফাক দিয়ে যেন পরিবেশ না দেখা যায়!হঠাত করে হাত টান দিলেও যেন ছুটে না যায়……..।“কমান্ড দিলেন,”প্র্যাড্ডড্ড,আরামে দ্রাবে,আরাআআমে ধ্রাআআ।‘’ ‘’প্র্যাড্ডড্ড,সাব্ধান হবে,সাআআব্ধান।“এর মধ্যে কয়েক বার এনাম স্টাফ এসে ধরলেন,’’আরে তোমার কনুই এর ফাঁক দিয়ে তো হেলিকপ্টার চইলা যাবে!!এইটা সাব্ধানের নমুনা!!হাত টান দিলেই ছুটে কেন,গায়ে শক্তি নাই??” এদিকে খেয়াল করলাম,তারিক হাউসের বাতেন স্টাফ লম্বামতন এক ছেলের ‘’হস্ত-স্কন্ধ সন্ধিতে জন্মানো বয়ঃসন্ধিকালীন কুন্তলরাশি’’ ধরে টান দিয়ে বলছেন,”ইডা কি?ইডা?অ্যা,এইগুলা ক্লিন না কইরে গেরাউন্ড এ আসলে পরের দিন টাইনা টাইনা ছিড়ব।“ আমরা এইরকম ব্যবহার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম!

এভাবে প্রতিদিন ড্রিল চলত ১২টা পর্যন্ত।জলদি চল,ধীরে চল,জলদি তালে তালে,দৌড়ের তালে তালে,ডানে ঘুর,বামে ঘুর,উল্টা ঘুর……ইত্যাদি মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ পাক পারত।‘’জলদি চল’’ যখন শিখানো হয়,তখন অনেকের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত।যেমন আমাদের মিঠুন,সে জলদি চল শুরু করে ৫-৬ স্টেপ নেয়ার পরেই ডান পায়ের সাথে ডান হাত,বাম পায়ের সাথে বাম হাত চালানো শুরু করত।এইটা শুধরাতে বহুত সময় ও শ্রম লেগেছে স্টাফদের।মিঠুনের উপর দিয়েও কম ঝড় যায়নি!আমরা এর নাম দিয়েছিলাম ‘’প্রতিবন্ধী মার্চ।“ মেহেদীকে যতই বলা হত,হাঁটু আর কনুই বাঁকাবা না,সে আরো সিরিয়াসলি মার্চ করতে গিয়ে আরো হাঁটু বাঁকিয়ে ফেলত।তখন সেটা মার্চ হত নাকি ব্যালে ড্যান্স হত,তা হৃতিক রোশনই ভালো জানবেন!মুন্তাসীর এই মার্চ দেখে গেয়ে উঠত,’’তেরা জাদু চাল গ্যায়া……”।অবশ্য কম মার খাইনি মেহেদীকে টিজ করার জন্য!ওই ছিল আমাদের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী।আব্দুল্লাহ কাঁধ বরাবর হাত না উঠিয়ে মাথার উপরে পর্যন্ত হাত উঠাত,ওইটুকুতে যে সময় লাগত,তাতে আমরা দুই স্টেপ নিয়ে ফেলতাম।ফলশ্রুতিতে আব্দুল্লাহর ভাগ্যে জুটত পিছের জনের লাথথি!

একদিন আমি দাঁড়ালাম তামীমের পিছনে।ওই সময় তার উচ্চতা প্রায় ৫’ ৮’’ আর আমার ৪’ ৭.৫’’।জাকির স্টাফের শিখানো নিয়মানুযায়ী সামনের জনের মাথার উপর দিয়ে তাকাতে হবে মার্চের সময়।আমি তাই করছিলাম।হঠাত আল-আমিন স্টাফ এসে বললেন,’’আছিব।ফাঁস্টা ত্যাজ ফ্রন্ট রোল লাগাও,হারাপ,হারাপ(hurry up).।“ আমি কাতরভাবে বললাম,’’স্টাফ কি করলাম?’’স্টাফ বলল,”আকাশের দিকে তাকায় মার্চ করতেছ ক্যান?’’আমি বললাম,’’স্টাফ!তামীমের মাথার উপরে দিয়ে তাকাইছি তো,জাকির স্টাফ শিখাইছে!’’ স্টাফ বলে,’’তুমি তামীমের পাছার দিকে তাকায় মার্চ কর,বুঝছ?’’………..

…………..ওই টার্মে ৭ দিন ছিলাম।৩১তম ব্যাচের ভাইরা বিদায় নিলেন।সবাই কাঁদল।কিছু না বুঝে এটাই নিয়ম ভেবে আমরাও কাঁদলাম।কিন্তু জুনিওর-সিনিওর রিলেশন দেখে ভালোই লাগল।কিন্তু এইটের ভাইদের এত মাইর খেয়েও এদের জন্য কেন কাঁদব সেটা মাথায় তখন আসেনি।ছুটিতে গিয়ে কাউকেই বলিনি,ক্যাডেট কলেজ খারাপ লাগে।বলিনি,আমাকে অনেক মারে।বলিনি,খাওয়া ঠিকমত খেতে পারিনা।কিন্তু ঠিকই বলেছিলাম,সিনিয়ররা যাওয়ার আগে সবাই কাঁদে।সবাই সবাইকে অনেক আদর করে।অভিযোগ একটাই করেছিলাম,আব্বু ‘’আমি কি আসলেই খুব শর্ট?সবাই টিজ করে।‘’আব্বু বলেছিল,’’আরে ক্ষেপিস না।একটা সময় তুই সবগুলারে ছাড়ায় যাবি।হাইটেও বাড়বি,ব্যক্তিত্বেও বাড়বি’’।ব্যক্তিত্ব অনেক কঠিন শব্দ।এর সঠিক শব্দার্থ তখনো বুঝিনি এখনও বুঝি না।কিন্তু মানুষের কাছে কখনোই যে খারাপ ছিলাম না,এইটাই আমার কাছে ব্যক্তিত্ব মনে হয়।

তো ছুটি শেষে ঢাকা থেকে আব্বু কলেজে দিয়ে আসলেন।শুনে গেছি,এই টার্ম টা নাকি ভয়াবহ হবে।চোখ টলটল করছিল।আব্বু সব বুঝে,জানে,কিন্তু প্রকাশ করে না।শুধু বলল,’’যা যা বলছি মাথায় রাখিস,তাইলেই হবে।‘’…..যাই হোক,টার্ম শুরু হল।কত স্মৃতি যে মনে পড়ছে,কিন্তু কিছুই লিখতে পারবো না।পুরা বই হয়ে যাবে।তাই বাধ্য হয়ে টপিকেই ফিরে যাচ্ছি…………..

মার খাওয়া,ডিউটি পালন করা,সিনিয়রদের প্র্যাক্টিকাল লিখা,ঘুম থেকে সিনিয়রদের ডেকে তোলার ডিউটি প্রভৃতি কয়েকগুন বেড়ে গেল।হাতের লেখা ভালো হওয়ায় আমাদের কয়েকজনের পিছে সিনিয়ররা রীতিমত লাইন দিতেন।এদিকে ড্রিল প্র্যাকটিস চলছে।পড়াশুনার খারাপ অবস্থা।পড়তে বসলেই নিদ্রাদেবী এসে স্বপ্নালোকে প্রেমলীলার আহ্বান জানায়।এটা সেটা করে হাউসে মোটামুটি বিখ্যাত হয়ে গেলাম,একটাও কোন পার্ফর্মেন্স না,সবই বোকামী।সিনিয়ররা আমাকে খাটিয়েই মজা পেতেন।জাকির স্টাফের কাছে হাউস প্রিফেক্ট রাশেদ ভাই শুনলেন,আমি মার্চ ভালো পারি।এক শুক্রবারে টানা ১.৫ ঘন্টা আমাকে করিডরে মার্চ করালেন……….সেইদিন টয়লেটেই বসতে পারছিলাম না…….

এদিকে দেখতে দেখতে novice’s parade এর সময় ঘনিয়ে আসল।একদিন বাতেন স্টাফ ঘোষণা দিলেন,সেপ্টেম্বরে তোমাদের ‘’নভিস প্যারেড’’ হবে।আল-আমিন স্টাফ বললেন,না ভুল হইছে,’’নভিন্সেন্স ফ্রেড’’ হবে।কতিপয় উতসুক বন্ধু জিজ্ঞেস করল,’’স্টাফ,এইটার মানে কি?এরকম ওয়ার্ড কি ডিকশনারীতে আছে?’’আমজাদ স্টাফ ব্যাখ্যা দিলেন,”আমরা কি না জেনে বলি?এইটা আর্মির ‘’passing away parade’’ এর মত।এটার পর তোমরা ফুল ক্যাডেট হয়ে যাবা।এখন হাফ ক্যাডেট আছ।‘’আমাদের বিজ্ঞ বাশার বলল,’’ইয়ে…. স্টাফ….passing away মানে তো মারা যাওয়া।তাইলে কি……”কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই ‘’বেশি ইংরেজি পারনেওয়ালা অপবাদ দিয়ে আল-আমিন স্টাফ বাশার কে ‘’১০টা ত্যাজ ফ্রন্ট রুল’’ দেয়ালেন।

আমাদের কমান্ডার বেছে নিয়ে প্যারেড করানো শুরু হল।সবাইকে দিয়েই কমান্ড প্র্যাকটিস করানো হল।হাসান কমাণ্ড দেয়ার আগে বলে নিল,’’বয়েজ,আমি যা কমাণ্ড দিব তাই যদি ঠিকমত না কর,তাইলে কিন্তু আমি স্টাফ কে বলে দিব।‘’পোলাপান তো শুনে পুরা ক্ষেপে গেল।উল্লেখ্য,হাসান আমাদের দ্বিতীয় কলেজ প্রিফেক্ট ছিল আর সে এখন আর্মিতে।আরেকবার নাহিয়ান কে কমান্ড করতে দেয়া হল,ওর কমাণ্ড শুনে স্টাফ বল্লেন,”নাহিয়ান,ড্রিল কমাণ্ড কি তোমার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত লাগে?প্যারেড গ্রাউন্ডেও গান শুনাবা?’’বলাই বাহুল্য,নাহিয়ান ৬ বছরই ICCLCM এ গিয়েছিল গান-এ,কিন্তু J.C.C. এর মিফতা আর M.G.C.C. এর অরিন নাশিদের কাছে ভাত পেত না।তবে মজার ব্যাপার হল,নাহিয়ান ও এখন আর্মিতে।আব্দুল্লাহ কে কমাণ্ড দিতে দেয়া হল,স্টাফ শুনে বললেন,’’আব্দুল্লাহ,কয় বোতল বাংলা খেয়ে আসছ?মাতালের মত কমান্ড দাও কেন?’’ঘুরে ফিরে আমার চান্স আসল।স্টাফ আমার সমালোচনা করলেন না।বললেন ,’’কয়দিন তুমিই করাইতে থাক……..

এদিকে প্রতিদিন ড্রিল প্র্যাক্টিস শেষে আমরা হাউসে এসে গোসল করে একাডেমী তে যেতাম।ওই সময়টা হাউসে কেউ থাকত না।মনের সুখে গলা ফাটিয়ে,শিষ দিয়ে গান গাইতাম,ড্রাইং রুমের ভিতরের বাথ্রুমে গোসল করতাম,হ্যান্ডসুইং দিয়ে হাঁটতাম।একদিন হাউস প্রিফেক্ট রাশেদ ভাই চলে আসলেন,শিষ দিতে দিতে এক্কেবারে সামনে পড়ে গেলাম।সবাইকে এমন পাঙ্গা দিলেন…….কয়েকজন বমি করল।দুইজন সিক হয়ে হাসপাতালে চলে গেল।আমাকে বেশি কিছু বলেন নাই…খালি ১২টা বায়োলজির চিত্র আঁকতে দিয়েছিলেন এক রেস্ট টাইমের মধ্যে!!!

হিল মার্চ করতে গিয়ে কত জনের জুতার তলা যে খুলে যেত রাস্তায়,তার কোন হিসাব নাই।শুক্রবারে মুচি আসলে লাইন দিতাম হিল লাগানোর জন্য।অনেকের হিল ৪-৫’’ ছাড়িয়ে যেত।মেয়েরা দেখলে যে কি ভাবত,আল্লাহই জানেন।রুমের মধ্যে মার্চ প্র্যাক্টিস চলত।একবার রেস্ট টাইমে লাঞ্চ করে এসে অনেকেই মার্চ শুরু করে দিল।নিচের রুম থেকে ১০ম শ্রেণীর ভাইরা উঠে আসলেন,লাঠিসোটা নিয়ে।সেইরাম টর্নেডো গেল পাছার উপর দিয়ে….আরেকবার,রুমে আমি মার্চ করছি,মুন্তাসীর বলল,’’এইভাবে না,তুই কমাণ্ড দে।আমি দেখাচ্ছি।‘’আমি কমান্ড দিলাম’’জলদি চল।‘’ও মার্চ শুরু করল।আমি বললাম,’’প্যারেড থাম’’।ও ডান পায়ে চেক দেয়ার জন্য ডান পা মাথা লেভেলে তুলতে গেল,কিন্তু আল্লাহর কি কাম!দৈবক্রমে বাম পা খানাও বসুন্ধরার আকর্ষণ ছেড়ে আকাশের দিকে উঠে গেল।ফলশ্রুতিতে,দুই পা গগনমুখী,মাথা গগনমুখী আর মাংসল পাছা পাতালমুখী হয়ে গগনবিদারী আওয়াজ তুলে হাউস কাঁপিয়ে মুন্তাসীর মাটিতে পড়ল।পুরো হাউস চলে আসল আমাদের রুমে।জিজ্ঞেস করল,ঘটনা কি?বর্ণনা করলাম,ভাইরা কিছু বললেন না,হেসে চলে গেলেন।এদিকে ছড়িয়ে পড়ল,কাসিম হাউসের কমান্ড আমি দিব।বন্ধুরা টিজ করল,অনেক সিনিয়র সাবাশি দিল,আবার অনেকে বলল,’’ধুর,এরে তো দেখাই যাব না।মনে হবে রেডিও থেকে কমাণ্ড আসতেছে।‘’আমি ভাবলাম,’আরে,সেভেনের প্রথম কম্পিটিশনেই পার্ফর্ম করতেছি,ভালোই তো।‘’…………..

শু পলিশ,মেটাল পলিশ রীতিমত একটা আর্টে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।শু পলিশ করার পর সবাই চেক করত,শু এর অক্সফোর্ডে দাঁত দেখা যায় কিনা!!!কারো উপর রাগ করলে,ঝাল মেটানোর সর্বোত্তম উপায় ছিল শু তে পাড়া দেয়া।সিনিয়ররা শু পলিশ চেক করে পছন্দ হলে ডিউটি ক্যাডেটশিপ এক্সকিউজ করে দিতেন।এরকম নানা কর্মকান্ড……কতই আর বলব……….

নভিসেস প্যারেডের এক সপ্তাহ আগে বাসায় লিখে দিলাম,’’হাউস কমান্ডার হচ্ছি।দোয়া করো।‘’ রাশেদ ভাই আদা খাওয়ালেন!!বললেন।গলা ভালো থাকবে!!একদিন লাঞ্চ শেষে রাশেদ ভাই লাইনে দাঁড় করিয়ে নভিসেস প্যারেডের হাউস-পার্ফর্মেন্স বর্ণনা করা শুরু করলেন।বললেন,ওনাদের সময় উনি কমান্ডার ছিলেন।আর হাউস চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।আমি ভাবলাম,’’বাহ,নভিসেসে কমান্ড দিলে আর হাউস চ্যাম্পিয়ন হইলে মনে হয় হাউস প্রিফেক্ট হওয়া যায়!’’ কতটা গাধা যে ছিলাম……..রাশেদ ভাই ওই বছর সাঁতার প্রতিযোগিতায় রিলেতে যে সাঁতারটা দিয়ে হাউস চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলেন,সেটা একবার যে দেখেছে সে জিন্দেগীতেও ভুলে নাই,ভুলবে না,রাশেদ ভাই এখন আর্মিতে…………তো সেদিন ভাই জিজ্ঞেস করলেন,’’জুতায় কি কি কালি দাও তোমরা?’’আমরা বললাম,’’ভাই,১ম এ কিউই অথবা চেরী কালি দিয়ে প্রলেপ দেই,তারপর ডায়মণ্ড কালি দিয়ে ওয়াটার পলিশ করি।“’ ভাই বললেন,’’তোমরা পপুলার ইউজ কর না?ওইটাও তো ভাল!’’ভাই চলে গেলেন…ছেলেপেলে সোতসাহে শু পলিশ শুরু করল।এদিকে আমি দেখলাম সিরিয়াস মেহেদী এক হাতে মেটাল পলিশ এর বোতল আর আরেক হাতে জুতা নিয়ে কিছু একটা করতে যাচ্ছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম,’’অই,তুই কি করিস?জুতায় মেটাল পলিশ লাগাবি??”’ সে বলল,সিরিয়াসলি,”থাবা মারবানি ঠাস কইরা।এমন থাবা দিবানি,এক্কেবারে দুইতলা থেকে নিচে গিয়ে পড়বি,পিন্টু শালা!রাশেদ ভাই বলছে না,পপুলার দিয়ে শু পলিশ করতে??’’ আমি ধমক খেয়ে কাঁদব নাকি এই থিওরী শুনে হাসব,বুঝতে পারছিলাম না।রাশেদ ভাই পপুলার জুতার কালি ইউজ করতে বলেছিলেন আর মাথামোটা মেহেদীটা পপুলার মেটাল পলিশ কেই সেই পপুলার ভেবেছিল!!কেননা,পপুলার কালি আমাদের সময় পাওয়া যেত না,বিরল প্রজাতির কালি!!

পরের দিন ড্রিল প্র্যাক্টিসে স্টাফ বোমা ফাটালেন।হঠাত করে রহমানের দিকে তার সুনজর পড়ল।তিনি রহমানকে বললেন কমাণ্ড দিতে।ভয়েস যদিও লো ছিল,কিন্তু হালকা-পাতলা আর লম্বা হওয়ায় ওকে কমাণ্ডার হিসেবে দেখতে ভালোই লাগছিল।স্টাফ খুশি হয়ে গেলেন…আমি বুঝলাম…আমার দিন শেষ।অতটা খারাপ লাগল না,হিংসাও হয়নি।শুধু ভাবলাম,বাপকে তো হেভী ভাব নিয়ে চিঠিটা লিখলাম,মুখটা এখন কই রাখি?!!!রাতে রাশেদ ভাই ডাকলেন।বললেন’’পিন্টু,স্টাফ বলছে,রহমানরে কমান্ডার বানাবে,ও উচা লম্বা আছে,তুই কি কস?’’আমি একখান চকোলেট হাসি দিয়ে বললাম,’’ভাই হাউস ফার্স্ট হইলেই আমি খুশি।আমার কমান্ডার হওয়া লাগবে না।‘’ভাই বললেন,’’বাপেরে যে চিঠী লিখলি,সেটার কি হবে?”আমি অবাক হয়ে গেলাম,’’ভাই,ইয়ে….আপনি জানলেন কিভাবে?!!”ভাই ভাব নিয়ে বললেন,’’হাউস প্রিফেক্টকে সব জানা লাগে।নইলে হাউস চলে?তুই মাইন্ড করিস না।প্যারেডের পর আমি তোরে খাওয়ামু,যা।“…….আমার সেদিন খুব ভালো লেগেছিল……..

প্যারেডের আগের দিন মাগরিবের নামাজের পর ১২শ এর ভাইরা ড্রিল প্র্যাক্টিস করালেন,বললেন,ভালো হইছে।১১শ শ্রেণীর ভাইরা তারপর করালেন,বললেন,’জটিল হইছে।“আমাকে বললেন,”কি রে পিন্টু,এই সাইজ নিয়েও তো দেখি পা ম্যালা উঁচায় তুলছস,তুই বস!!’’রহমানের কমাণ্ডের প্রশংসাও করলেন সবাই।

………শুক্রবার।নভিসেস প্যারেডের দিন।রাতেই ইউনিফর্ম একদম পরিস্কার,ভাঁজহীন,আয়রন করে রাখা ছিল।শু রেডী ছিল দুইদিন আগে থেকেই।ব্রেকফাস্ট করে এসে রেডী হলাম।হায়রে সে কি সতর্কতা!সুহান ভাই প্যান্ট পরিয়ে দিলেন টাওয়েলের উপর দিয়ে!গেঞ্জি,মোজা,আন্ডি সব নতুন।গাধার মত জিজ্ঞেস করলাম,’’ভাই,টার্ন আউট চেকিং এ কি এইগুলাও চেক করবে?’’ভাই কটমট করে চোখ পাকিয়ে বললেন,’’হাউস খালি ফার্স্ট না হোক,এই কথার মাইর একসাথে সুদে আসলে খাবা।আমরা কিন্তু ফার্স্ট হইছি,তোমরা না হইলে কিন্তু……….”।নাহ…এইবার ব্যাচ প্রেস্টিজ জিনিস্টাও মাথার মধ্যে ঘুরা শুরু করল….রোবোটের মত জুতা হাতে নিয়ে সুহান ভাই এর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে গ্রাউন্ডে গেলাম…পুরাই ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের মত অবস্থা………

গ্রাউণ্ডে ঢুকব,দেখি অন্যসব প্যারেন্টস দের সাথে আমার আব্বু,আম্মু,সদ্যবিবাহিত আমার ফুপু-ফুপা,আমার সমবয়সী চাচাতো বোন(:X) আর আমার পিচ্চি ছোট ভাই আসছে।আমাকে দেখে পিচ্চিটা আব্বুর কোল থেকে নেমে আমার দিকে যে দৌড়টা দিয়েছিল সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কয়েকটা মূহুর্তের একটা।যাই হোক,আব্বুকে কানে কানে বললাম,’’আব্বা লাস্ট মোমেন্টে এসে কমান্ডার চেঞ্জ করে ফেলছে।আমি কমান্ডার না,মেইন গাইড,ফার্স্ট রো তেই থকব,সামনে।‘’আব্বু বলল,’’আমি যে তোর দাদীরে বলছি,ফুপারে বলছি!আচ্ছা,যা ভালোমত মার্চ করবি,যাতে সবাই ভালো বলে।আর কোন কিছু করার আগেই কাউকে বলতে হয় না।মানুষ কাজ দেখেই তোকে চিনে নিবে,চিনে নিয়ে তোর কাজ দেখবে না।“আব্বুর এই কথাটা আমার কানে কানে মাঝে মাঝেই বাজে।আসলেই বাবারা গ্রেট হন……………..

প্যারেড শুরু হল।প্রথমে আগের বছরের বেস্ট কমাণ্ডার আলী ভাই এর নেতৃত্বে আমরা তিন হাউস মাঠে ঢুকলাম।তিন জাজ আমাদের টার্ন আউট চেক করলেন।তারপর আমরা মাঠ ছাড়লাম।আগে খালিদ হাউস পার্ফর্ম করল।হাউস কমাণ্ডার ছিল তানভীর।ওর গলা ভালো ছিলো।কিন্তু বেচারা কমান্ডের সিরিয়াল উলটাপালটা করে ফেলল।আমরা নার্ভাস হয়ে গেলাম।আমি রহমানকে বললাম,’’দোস্ত,চিন্তা করিস না,তুই বস তিন কমান্ডারের মধ্যে।সিরিয়াল মিস করিস না,তাইলেই হবে।‘’ রাশেদ ভাই এসে বলে গেলেন,’’বয়েজ,চ্যাম্পিয়ন হইলে কিন্তু স্পেশাল খানাপিনা আছে।perform at ur level best,that will do..”

আমরা মাঠে ঢুকলাম।রহমান রিপোর্ট করল,চীফ জাজের কাছে( অ্যাডজুটেন্ট মেজর নিয়ামুল ইসলাম-ভোঁদড়)।ওর রিপোর্টিং আর পা তোলা দেখে সবাই তাজ্জব হয়ে গেল।আমি কমেন্টেটর কে স্পষ্ট বলতে শুনলাম(সম্ভবত সাঈদ ভাই-কলেজ কালচারাল প্রিফেক্ট)’’this is the best reporting I have ever seen!!’’ আস্তে আস্তে একটা একটা করে পার্ট শেষ করি আর তুমুল কড়তালি পাই।মাঝে মাঝে দেখি আমার ছোট ভাইটা আব্বুর কোলে লাফাচ্ছে।শেষ করে চক্কর দিয়ে প্রিন্সিপালকে ডানে সালাম দিয়ে যখন প্যারেন্টস দের শামিয়ানা ক্রস করছিলাম,আমার ছোট ভাই প্লাবন বলে উঠল,’’ঐ যে ঐটা আমার ভাইয়া!’’কেউ একজন বলল,”কোনটা?’’ আমার ভাই বলল,”ঐ যে সবথেকে পিচ্চিটা!!”সবাই হো হো করে হেসে উঠল।আমরা হাসলাম না, মার্ক কাটা যাওয়ার ভয়ে।মনে মনে ভাবলাম,”পিচ্চি,তোরে খাইছি!!”……

তারিক হাউস পার্ফর্ম করতে চলে গেল।নূরুল ওদের কমাণ্ডার।নুরূল যদি ভুল না করে,তাহলে ওর বেস্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেও ভুল করল।আর রহমানের পার্ফর্মেন্স সেদিন অসাধারণ ছিল…ও এখন এ.এফ.এম.সি-তে পড়ছে।।….রাশেদ ভাই এসে রহমান কে জড়িয়ে ধরলেন আর আমাকে প্রায় কোলে তুলে নিলেন।সবার সাথেই কোলাকুলি করলেন।বললেন,”সেইরাম হইছে।সিওর চ্যাম্পিয়ন।“…আর সেই আমি এখন রাশেদ ভাই এর চেয়েই লম্বা!!!!……….

প্যারেড শেষ হল।রেজাল্ট দিবে।প্রিন্সিপাল আব্দুল কুদ্দুস স্যার ভাষণ দিলেন,…”আজকের পর থেকে একজন সত্যিকারের ক্যাডেট হিসেবে…ইত্যাদি….”রেজাল্ট কখন দিবে???অবশেষে রেজাল্ট দিল।স্যারের ছেলে কিন্তু আব্দুল্লাহ।আর আরেক স্যার মোস্তাফিজুর রহমান এর ছেলে তামীম।দুইজনই কাসিম হাউসের।আব্দুল্লাহ বেস্ট টার্ন আউট ক্যাডেট হল।নিন্দুকেরা ফিসফাস করল,প্রিন্সিপালের ছেলে বলে বেস্ট টার্ন আউট হইছে।বেস্ট কমান্ডার হল…..আর কে হবে? রহমান!!!তুমুল করতালি পড়ল।আমি নিজে এত্ত ভালো করতে পারতাম না কোনদিনও।মনটা খুশিতে ভরে উঠল।এইবার বেস্ট এন.সি.ও এর প্রাইজ।সবাই চুপ,কারণ বেস্ট এন.সি.ও.(স্টাফ) যে হাউসের হন,সেই হাউসই চ্যাম্পিয়ন হয়।যথারীতি জাকির স্টাফ মেডেল পেলেন।এখন আর কারো সন্দেহ থাকল না যে আমরাই চ্যাম্পিয়ন।ঘোষণাটা আসল,যতদূর মনে পড়ে ২য়-তারিক হাউসের চেয়ে প্রায় ১০ মার্ক এগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।হাউসের সবাই সাবাশি দিল।হাউসে আসার পর ভাইরা আমাকে বললেন ZEEL দিতে হাউসের নামে।আমি দিলাম,”Three cheers for QASIM HOUSE,hip hip hurray…..BLUE,BLUE,up up,QASIM HOUSE cheer up……”

প্যারেন্টস ডে পালন করতে চলে গেলাম।দাদী স্নেহভরা কন্ঠে বললেন,”দেখছি তরে।অনেক ভালো করছিস।আমার ভালা লাগছে।‘’ আব্বু বলল,’’আমার কথা আমার মা-ই বলে দিছে।‘’আম্মু কিছু বলে না,আমাকে খাওয়ায় দেয়।নতুন ফুপা বলল,”তোমাদের হাউসেরটা আসলেই ভাল হইছে।আর কমান্ডারটা অনেক ফিট।তুমিও ভালোই মার্চ করছ।‘’বলাই বাহুল্য,ফুপুর বিয়েতে আমি যেতে পারিনি,কলেজে ছিলাম।তাই নতুন জামাইএর সাথে সেটাই ১ম দেখা।আমার চাচাতো বোন খালি মিটিমিটী হাসে,কিছু বলে না।একবার অস্ফুটে বলল,”জীবন ভাইয়া,তোমারে তো অনেক পিচ্চি লাগে অন্যদের থেকে,কিন্তু তোমার পা ভালই চলে।তোমাদের কমান্ডারটা খুব কিউট!”……আমি আর কি বলব!রহমানের উপর মনে হয় তখন কিছুটা নাখোশ হয়েছিলাম………………………..

******************শেষকথাঃ**************************
অনেক কিছুই মনে আসে।কিন্তু ভয়ে লিখি না,দীর্ঘ হওয়ার ভয়,সেন্সর খাওয়ার ভয়!আমি খুব নস্টালজিক একজন মানুষ।অতীত নিয়ে পড়ে থাকি বলেই হয়ত এত কিছু মনে আছে।সেইসব সিনিয়র আর সিস্টেমের কথা মনে করি এখন আর ভাবি,…”আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম,হায়রে……………..”

কিছুটা হিউমার অ্যাড করার জন্য আমার নভিসেস প্যারেডের পরে আই.ডি. কার্ডের জন্য তোলা ছবিটা দিয়ে দিলাম।ভাই-ভাবী ও আপুরা,আশা করি মজা পাবেন…কি যে ছিলাম…আর কি হইছি!!!কি আছে জীবনে…………………

9132_171442764904_738529904_2524783_6730888_n

৭,৩৭৩ বার দেখা হয়েছে

১২২ টি মন্তব্য : “সপ্তম শ্রেণীর সাতকাহন-পর্ব ২>>শিক্ষানবিশি কুচকাওয়াজ”

    • আছিব (২০০০-২০০৬)

      x-( ...ব্যাটা...খুব ভাব না!আমি টানা ৭ বার নেট এর কল্যাণে ১ম হইতে গিয়া ২য় হইয়া গেছি ~x( ভাবলাম,নিজের পোস্ট এ নিজে কমেন্ট দিয়া ফাঁকা মাঠে গোল দিমু =(( কিন্তু মডু স্যারের প্রসেসের প্যাঁচে পইড়া এই প্ল্যানটাও ভেস্তে গেল :bash: !!আইসা দেখি,সব শ্যাষ। :(( 🙁

      জবাব দিন
  1. রকিব (০১-০৭)

    বস, সিরাম লেখা দিছেন, পুরানা সিরিতি মনে পইড়া গেলো।
    অফটপিকঃ ছবি তো দিয়া দিলেন, এখন দেখেন কেউ আবার আইডি কার্ড না চাইয়া বসে। 😛 :grr:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. আনোয়ার (০০-০৬)

    পিন্টু এইবার গিয়া তোর অটোগ্রাফ লওন লাগবো........তুই তো দিনে দিনে সিরাম লিখক হইয়া যাইতাসোস আমি আশা করি এর পরের বইমেলায় আমরা তোর ও বই বের করব দুইটা ডায়লগ খুব ই মজা লাগলো --

    একবার অস্ফুটে বলল,”জীবন ভাইয়া,তোমারে তো অনেক পিচ্চি লাগে অন্যদের থেকে,কিন্তু তোমার পা ভালই চলে।তোমাদের কমান্ডারটা খুব কিউট!”

    কই তারে তো কখন ও দেখিনা 😀

    আর একটা

    ”আমি অবাক হয়ে গেলাম,’’ভাই,ইয়ে….আপনি জানলেন কিভাবে?!!”ভাই ভাব নিয়ে বললেন,’’হাউস প্রিফেক্টকে সব জানা লাগে।নইলে হাউস চলে?তুই মাইন্ড করিস না।প্যারেডের পর আমি তোরে খাওয়ামু,যা।“…….আমার সেদিন খুব ভালো লেগেছিল……..

    লিখে যা পড়াশুনা বাদ দিয়ে আমরা তোর লিখা পড়ার অপেক্ষায় আছি।

    জবাব দিন
    • আছিব (২০০০-২০০৬)

      😡 দেখবি কেমনে...হেতী তো কবেই জামাই-আদর দেয়া আর খাওয়া শুরু করে দিছে =((।বিয়ে হয়ে গেছে হেতীর :party: ।তয় হেতীরে নিয়া আঁর কুনো হেডেক কুনো কালে ছিলনা।সো,তগো কওয়ার ও কিছু নাই । :-B
      খুব তো পড়ে ফাটিয়ে ফেলতাছ...খালি :gulli: পার্লে-জি বিস্কিট খাও আর পড়।আমারে আইসা একটু পড়াইস দোস্ত :-B ,খালি কি হেতীরেই পড়াবি 😡 ,আমরা কি তোরে ভালাবাসি না??? 😡
      :khekz: :goragori: তর কোটেশন মারার ক্ষমতা তো সেইরাম রে!!! :pira:
      অ্যানিওয়ে,যেটা কোট করবি সেটা সিলেক্ট করে then বোল্ড দিবি :salute:

      জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ১৯৯৭ সালের নভিসেস প্যারেড।কালকে পরীক্ষা-টানা পাঁচদিন চলবে।এই পোস্টে ডাবল সেঞ্চুরির আশা রাখি।

    পিন্টু, স্টার কাবাবে তোরে খাসির লেগ রোস্ট খাওয়ামু পাকা কথা দিতেছি।অসাধারণ বললেও কম বলা হবে।সিসিবিতে স্মৃতিচারণের উপর এরকম সরস লেখা অনেক দিন পর পড়লাম :boss:

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    কিন্তু J.C.C. এর মিফতা আর M.G.C.C. এর অরিন নাশিদের কাছে ভাত পেত না।
    এই এক লাইনে ২০০২ এর আইসিসিএলএমএম কুমিল্লায় চলে গেলাম।হাজার হাজার স্মৃতি-নাহ,পরীক্ষা শেষ হোক :((

    আছিব রে,এত ভালো লাগছে লেখাটা যে তোরে এই কমেন্টে আর পিন্টু কইলাম না :boss: :boss:

    জবাব দিন
  5. শাহরিন (২০০২-২০০৮)

    চরম লিখসেন ভাইয়া :thumbup: :thumbup:
    এত বড় লিখা পরতে কোন কস্ট হয় নাই,আমি ভবিষ্যত দেখতেছি আপনি বাংলার কোটি মেয়ের প্রিয় লেখক :guitar: :guitar:
    পুরা সেভেন এ চলে গেলাম,আর আপনার ছবি টা ত সেইরকম :)) :))
    পিন্টু ভাই :khekz: :khekz:

    জবাব দিন
  6. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আমাদের নভিসেসে হাউসের প্যারেড কমান্ডার ছিলাম, হাউস চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বেস্ট কমান্ডার হয়েছিল শামস, ওমর ফারুক হাউসের।

    হা, ২৩ বছর চলে গেছে এর মধ্যে, আজিব।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  7. আরাফাত (২০০০-০৬)

    তুই বুয়েটে বাঁশ খাইতেছিস নাকি খাইতেছিস না আমরা ভালোমত জানি।চাপাবাজি বন্ধ কর।

    আব্দুল্লাহ,কয় বোতল বাংলা খেয়ে আসছ?মাতালের মত কমান্ড দাও কেন?

    :khekz: :khekz: আব্দুল্লাহ রে দেখাইস না এই ব্লগ মাইর খাবি।

    আমাদের মিঠুন,সে জলদি চল শুরু করে ৫-৬ স্টেপ নেয়ার পরেই ডান পায়ের সাথে ডান হাত,বাম পায়ের সাথে বাম হাত চালানো শুরু করত।এইটা শুধরাতে বহুত সময় ও শ্রম লেগেছে স্টাফদের।মিঠুনের উপর দিয়েও কম ঝড় যায়নি!আমরা এর নাম দিয়েছিলাম ‘’প্রতিবন্ধী মার্চ"

    মিঠুনকে মার্চ করতে দিলে এখনও এইরকম হবার সম্ভাবনা আছে। :)) :))

    তারিক হাউসের চেয়ে প্রায় ১০ মার্ক এগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম

    তোরা আসলেই বস =)) =))

    আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম,হায়রে……………..

    এত মজা করলাম তাও মনে হয় কিছুই করি নাই।নেক্সট লাইফ থাকলে আবারো ক্যাডেট হইতাম। 🙁
    পড়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়লো।লিখতে থাক :clap: ।

    জবাব দিন
    • আছিব (২০০০-২০০৬)

      :goragori: দোস্ত,তুই পড়ছিস আর পড়ে কমেণ্ট করছিস দেখে আমার যে কি ভালো লাগতেছে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। :salute:
      আমার ব্যাচের ছেলেপেলে লেখা পড়ে কমেণ্ট দিলে পুরাই আবেগে ইমোশনাল হয়ে যাই রে দোস্ত। :(( 🙁 :hug:
      আর...তোরাও বস... :shy: ..আমরা সবাই বস........ :boss:

      জবাব দিন
  8. রিজওয়ান (২০০০-২০০৬)

    :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:
    আছিব, তোর লেখার হাত তো এখন দেখি অসাধারণ হয়ে গেছে!!!
    কোনো পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্যচর্চার মুভমেন্টে আছিস নাকি???
    লেখতে থাক, আরো পড়তে থাক, জটিল.........জটিল।

    জবাব দিন
  9. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)
    ‘’হস্ত-স্কন্ধ সন্ধিতে জন্মানো বয়ঃসন্ধিকালীন কুন্তলরাশি’’

    জটিল প্রকাশ :)) :)) । রহমানের চেক মারা আসলেও আমার দেখা বেস্ট। ও পারমিশন নেয়ার জন্য চেক মারার পর চিফ গেস্ট ভয় পেয়ে দুই স্টেপ পিছিয়ে গেছিল।

    জবাব দিন
  10. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    ব্যাপক মিজা পিলাম 😀
    আছিব, দারুন মজা কইরা লিখছ :thumbup: :thumbup:

    হায়রে নভিসেস প্যারেড, আমরা ফোর্থ হইয়া ব্যাপক পাঙ্গানির শিকার হইছিলাম পরে হাউসে আইসা 🙁


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  11. রুবেল (৯৯-০৫)

    =)) =)) =)) =)) মানিক রে...ও মানিক...।

    তবে লেখাটা কিন্তু সিরাম হইছে ছোড ভাই.........তোমাদের হাউস দেখি পুরা সেঞ্চূরী মারছে...জব্বর...। :clap: :clap: আহারে আবার ক্লাস সেভেন হইলে টেরাই মারা যাইতো...কেন যে তোমাদের হাউসের মত আমাগো হাউসটা ছিলনা...।।

    জবাব দিন
  12. রুবেল (৯৯-০৫)

    =)) =)) =)) =)) মানিক রে...ও মানিক...।

    তবে লেখাটা কিন্তু সিরাম হইছে ছোড ভাই.........তোমাদের হাউস দেখি পুরা সেঞ্চূরী মারছে...জব্বর...। :clap: :clap: আহারে আবার ক্লাস সেভেন হইলে টেরাই মারা যাইতো...কেন যে তোমাদের হাউসের মত আমাগো হাউসটা ছিলনা...।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আছিব (২০০০-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।