~ স্রেফ চার-ছয় মাসের যাদুমন্ত্র এটা নয় ~

অবিশ্বাসে ছেয়ে আছে মানুষের মন। সবার মাঝেই যেনো একই প্রশ্ন, এরা তো অভাবী পরিবারের সন্তান নয় যে এভাবে নিজেকে বিকিয়ে দেবে। নি:সঙ্গ এতিম নয় যে এক বিন্দু পিছুটান নেই, কিংবা এমন নয় যে যাদের কৃপায় বেঁচে থাকা তাদের প্রতি আছে অপার দায়। আলোকিত, নামে উজ্জ্বল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে তো তাদের মনের কোনায় এমন অন্ধকার লুকিয়ে থাকবার কথা নয়। মৃদুভাষী, অমায়িক, বন্ধু বৎসল, নির্দ্বিধায় আর দশ জনের চেয়ে এক কাঠি বেশী ইতিবাচক বলবে এদের যারা চেনে তারা সবাই।

অথচ এই এদেরই সবার চোখে জ্বলজ্বল করছে যেনো সহিংসতায় সক্ষমতার অপার আনন্দ। পেছনে জ্বলজ্বল করছে আইএস এর কালো পতাকা, গায়ে আত্মত্যাগের প্রতিকী কালো পোশাক, মাথায় আরব যোদ্ধার বিশেষ অর্থবহ কায়দায় ফেটি বাঁধা, হাতে এ.কে. শ্রেণীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। খুব নিশ্চিত বাকী সব ছাপিয়ে তাদের প্রত্যয়ী হাসিতে উদ্ভাসিত উজ্জ্বল মুখগুলো কাঁটার মতোন বিঁধছে ভীষণ সবার মনে।

এমনতরো অস্বস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে একজন মানুষ তখনই, যখন সে পুরোপুরি জানতে পারবে – কি করে কি হলো যে এরকম কয়েকজন তরুণের দ্বারা এমন নৃশংস একটা ঘটনা ঘটানো সম্ভব হলো। এর শতভাগ নির্ভেজাল জবাব বা তথ্যসম্ভার কারোই প্রাপ্তিতেই জুটবে না। তবু সত্য সন্ধানটি অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে একান্তই আবশ্যক।

প্রথমেই আসা যাক আইএস পতাকা আর তাদের ট্রেডমার্ক পোষাকের প্রসঙ্গে। আজ বিশ্বের প্রায় সব মানুষই জানে এটা যে, আইএস হলো মোসাদের একটা সংগঠন যারা সিরিয়ায় যুদ্ধে পিছু হটলে মরমে মারা যায় ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা। আরো জানে সবাই যে, সংগঠনটির জন্ম মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি তত্বাবধানে ও প্রশিক্ষণের সহযোগিতায়, কর্তা ব্যক্তিদের অনুমোদনে। শুধু কি এই? ইসলামী খেলাফত কায়েমে বদ্ধপরিকর এ সংগঠনটির শীর্ষনেতা প্রকৃতপক্ষে একজন ইহুদী, যে তার একান্ত সঙ্গী ও অনুসারী সহ (যাদেও অধিকাংশই ধর্মান্তরিত নয়া মুসলিম) মার্কিন বিশেষ কৃপা ও মদতপ্রাপ্ত। ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রাণান্ত এ সংগঠনের ভেতর ইসলামী চর্চাটি মোটামুটি ভাবে অনুপস্থিত। কারণ তারা সেই মুসলিম যারা একবিংশ শতাব্দীতে হাজার নারীকে যৌনদাসী করে রেখেছে, যার প্রতিবাদ করলে শিরোচ্ছেদ করছে, অর্থের যোগানের জন্যে এই যৌনদাসীদের নিলামে তুলছে। এর পর আর কি প্রশ্ন থাকে এরা মুসলিম নাকি মুসলিম না সে বিষয়ে! অথচ ইসলামের নামে মগজ ধোলাই করে সারা পৃথিবী থেকে ওরা রিক্রুট করে যাচ্ছে তাদের জেহাদী যোদ্ধা। কি নারী, কি পুরুষ নির্বিশেষে। পাশাপাশি অন্য যে কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টি ইসলামের নামে সন্ত্রাস ঘটাতে চাইলে তাদের অনুমোদন, সহায়তা, মদত, অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ, ঘটনার পর পরই (যেনোবা মহান নেক হাসিলের বাহবা নেওয়ার জন্য মরিয়া তারা) দায় স্বীকার করবার জন্যে ওরা এক নয়, দশ কদম এগিয়ে আছে। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমও লহমায় লোমহর্ষক অন্যায়কে পৃথিবীময় প্রচার করে তাদের হিরো বানাচ্ছে।

এইসবের সূত্র ধরে আইএস পতাকা, জেহাদী পোশাক, হাস্যোজ্জ্বল আত্মত্যাগের পণমশগুল ছবি, কিংবা রক্তের পুকুরে ভিকটিমের মরদেহের ছবি – তড়িৎগতিতে আইএস উদ্যোগে ওয়েবে আপলোড হলে এসবের যোগসূত্র আর অস্পষ্ট থাকে কি করে! আজকের দিনে মুক্ত প্রযুক্তি ও অতি সহজলভ্য ইন্টারনেট সুবিধা যথেষ্ট মাত্রায় এগিয়ে দিচ্ছে তাদের। এ তথ্যপ্রযুক্তির উপর ভর করে আইএস অনেক কিছুই করে যাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু হাতের ওই অস্ত্র? ওটা কি ওয়েব আপলোড বা ইমেইলের ভেতর দিয়ে এসে পৌঁছে গেছে ঢাকার এই তরুণদের হাতে? এরা তো ঘটনাটা ঘটিয়েছে বাংলাদেশে, খোদ সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত রাজধানীর কুটনৈতিক পাড়ায়। না প্যারিসে, না মুম্বই, না ইস্তাম্বুল, না বাগদাদে, সিরিয়ায়, না মদিনায় বা আমেরিকায় কি লন্ডনে। এদেশের কারো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এটা ম্যাটার ট্রান্সমিশন সুবিধার কল্যাণে ওদের হাতে এসে পৌঁছায় নি নিশ্চিত। তাহলে কোন পথে? সেই সূত্রটাই গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে খুঁজে বের করতে হবে। বের করতে হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।

অস্ত্রের আগমন পথ না হয় ধরে নিলাম রুদ্ধ করা যাবে। তার বস্তুগত একটা পথের অস্তিত্ব আছে, কোথাও না কোথাও, তাই। কিন্তু মানুষগুলোর ভেতর কি মন্ত্র, কিভাবে এসে ঢুকছে যে রাতারাতি একজন সাধারণ মানুষ এমন প্রাণ সংহারী সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে? সে সত্যটি উদঘাটন করবে কে? সেটা ঠেকাবে কে? ঠেকাবে কিভাবে? এটা জানা ও এর পথ রুদ্ধ করা যে খুব বেশী বেশী দরকার আজকে।

চারপাশে সবার কথায় একই বিস্ময় প্রতিধ্বনিত, মাত্র চার-ছয় মাসে হাসি খুশী প্রাণবন্ত স্বাভাবিক একটা ছেলে কি করে এমন নৃশংস খুনে সন্ত্রাসীতে পরিণত হলো। মানুষ মাথা ঘামাচ্ছে হিপনোটাইজিং এফেক্ট সম্পন্ন ঔষধ নিয়ে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এটা স্্েরফ ক্যাপ্টাগনের মতোন হিপনোটাইজিং ঔষধ প্রতিক্রিয়া নয়। এটা নিশ্চিত ভাবেই একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রকৃয়া। এই ছেলেগুলো নিখোঁজ থাকার এই চার-ছয় মাস গোটা প্রক্রিয়ার একটা অংশ মাত্র। আমি বলবো এটা গোটা প্রক্রিয়ার পঞ্চম ধাপ।

প্রথম ধাপে রিক্রুটিং গ্রুপ তরুণদের মাঝে তাদের পছন্দসই মানুষগুলোকে খুঁজতে থাকে। তাদের টার্গেট ১৬/১৭ থেকে ২২/২৩ বছরের তরুণ। উল্লেখ্য, খেয়াল করলে দেখা যাবে এমনতরো আত্মবিসর্জন্মুখ সন্ত্রাসবাদেও লক্ষ্যে হামলাকারীদের বয়স থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১৮ থেকে ২৮ এর মধ্যে। আর এদের ছাঁচে ফেলার জন্য মোক্ষম সময় হচ্ছে এডোলোসেন্ট এজ বা বলাইয়ের বয়সটা। এক অর্থে সে বয়স বলতে টিনএজের শুরুটা বোঝালেও টিন এজের শেষ সময়ের অধিক উদ্দাম ও আবেগপ্রবণ সময়টাকেই সবচেয়ে বেশী ভালনারেবল হিসেবে প্রাধান্য দিতে হবে। এই বয়সে আমিত্ব সবচেয়ে আধিপত্যে থাকে অনেকের ভেতর। সেই সাথে তার কল্প জগতের ডানাটি সবচেয়ে জোরালো। কিছু একটা করে ফেলবার উদ্দামতা, হিরোইজম সিন্ড্রোম সবচেয়ে জোরদার। এই ভাবাবেগে ভাসমান সন্তানটিকে আগলে রাখতে গিয়ে বাবা-মা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বিরাগভাজন মানুষ। তার ওপর আছে পুঁজিবাদের ইঁদুর দৌড়ের ফলস্বরূপ সন্তানদের সাথে কর্মযুদ্ধে মরিয়া বাবা-মায়ের দূরত্ব কিংবা পারিবারিক অশান্তিকে ঘিরে সন্তানদের সংসার বিমুখতা। এমন কোনো না কোনো ভাবে ভাবাবেগ তাড়িত এক লেট টিনের সাথে দু’লাইন পিঠে হাত বোলানো কথা বলে ভালো-মন্দের দেখভাল করবার করবার মতোন বুলি আউড়ে তার কাছে ভেড়াটা মোটেও কঠিন নয়। বিশেষ করে মানসিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অন্যকে কুক্ষিগত করে নেবার বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে।

দীর্ঘদিন ধরে তরুণদের সাথে মিশে তাদের সাথে খাতির জমানো, মনের ভেতর আবেগ উচ্ছ্বাস ক্ষোভ ক্রোধ এসবের উৎস ও মাত্রা পরিমাপ করা প্রথম স্তরের কাজ। কার দুর্বলতা, ভাল লাগা, খারাপ লাগা কি; কার পরিবারে শান্তির পরিবেশ, পরিবারকে ঘিরে কার কতোটা অসন্তোষ, এসব খুঁজে বের করে ডাটা ফিড ইন করা প্রথম পর্বের কাজ। আমাদের দেশে এর জন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি আছে সরাসরি মানুষের সম্পৃক্ততার সুযোগ। পৃথিবীর অনেক দেশে যদিও এটা ঘটছে স্রেফ সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমেই।

দ্বিতীয় ধাপের কাজ হলো বাছাইকৃতদের সাথে খাতিরটা এমন মাত্রায় জমানো, নতুন বন্ধুটিই যেন হয়ে ওঠে তরুণটির আপন মা-বাবা ভাই বোনের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও কাছের। তরুণটিকে অধিক হারে প্যাম্পার করে, তার নানা কাজে প্রসংশা করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে খুব সহজেই মনস্তাত্বিক ভাবে ঘায়েল করা এই পর্বের মুখ্য কাজ। পিতা মাতা বা পরিবারের সদস্যরা যে শাসন আর বিধি নিষেধ আরোপ করবে তা এরা করবে না। আবার সরাসরি কোন খারাপ কাজে মত কিংবা মদতও দেবে না। ইসলাম কায়েম করা আদপে এদের মূল উদ্দেশ্য না হলেও ইসলাম নিয়ে সুন্দও কথা বলবে ওরা। এ পর্বে সহিংসতা বা অনুরুপ প্রসঙ্গকে সেভাবে টেনে আনবে না। নৈতিক অনৈতিকের চেয়ে বিরাগভাজন না হওয়াটাই এদের কাছে মুখ্য বিচার্য।

মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের পারিবারিক বন্ধনটা উচ্চবিত্তের চেয়ে বেশ খানিকটা জোরালো থাকে বলে, দায়িত্ববোধের কিছু হিসেব অল্প বয়সেই মনের মধ্যে জায়গা করে নেয়। তাই এদের চেয়ে উচ্চবিত্তের অভাবহীন কিন্তু আনন্দ উন্মাদনার সীমা সংকট ও ভালবাসার অভাববোধে ডুবন্ত তরুণদের খুব সহজেই উদ্দেশ্যবাদীরা ড্রাগ বা এরকম রাজকীয় সন্ত্রাসবাদের পথে টানতে থাকে।

তৃতীয় ধাপের কাজ হলো দ্বিতীয় ধাপে ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক স্থাপিত তরুণদের মাঝে মানসিক ভাবে নাজুকতা ও নির্ভরশীলতার মাত্রাকে ইসলামের নামে দিওয়ানা বানানোর মতোন একটা স্তরে নিয়ে যাওয়া। ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রের নামে চলতে থাকে মগজ ধোলাই। প্রাণের বিনিময়ে হলেও ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, এমন প্রতিজ্ঞায় মরণপণ করিয়ে তবে এ পর্বের শেষ।

চতুর্থ ধাপে আসে পরিপূর্ণ জেহাদী বানাবার পর্ব, আত্মঘাতী হবার সকল মন্ত্রে দীক্ষা দেবার পর্ব। যখন সেই তরুণটি নির্দেশ পাওয়া মাত্রই প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যখন তার মধ্যে সেই নির্দেশকে ঘিরে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হবার সম্ভাবনা পরিপূর্ণ ভাবে নিখোঁজ। এমন কি যা আর জেগে উঠবার সম্ভাবনা নেই। (একমাত্র তার পরিবার পরিজন জানতে পেরে মরিয়া হয়ে, ধরে বেঁধে যদি তাকে ঠেকাতে পারে, নচেত নয়। এমন কি টের পেলে সেই সুযোগটুকু সে তার পরিবার পরিজনকে দেবে না কিছুতেই।) এই চতুর্থ পর্বের সফল সমাপ্তি যাদের ভেতর ঘটানো সম্ভব হয় তাদের তখন স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে নেয়া হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ পর্বে।

পঞ্চম ধাপে চলে এই সামরিক প্রশিক্ষণ পর্ব। কমান্ডো ট্রেনিং-এর চেয়ে কোনো অংশে কম যায় না এই ধাপ। এই পর্বেই সে শেখে অস্ত্রের ব্যবহার। দীক্ষিত হয় নির্দ্বিধায় অপরাধী কি নিরপরাধ বিবেচনা ব্যতিরেকে মানুষ কতল করবার মন্ত্রে। নির্দেশটুকুই কেবল তার দরকার। যুক্তি বা বিচারের কোনো প্রস্তাবনা এখানে আর অবশিষ্ট নেই। এক কথায় বলা যায় এই পঞ্চম পর্বের শেষে যাকে আপনি পাবেন সে অনেকাংশে একজন রোবট। মানবিক বিচার বিবেচনার ক্ষমতাটুকুন তার ডিপ ড্রাগ ডোপড মানুষের মতোন সম্পূর্ণ লোপাট হয়েছে।

সবগুলো পর্বেই সব কিছুর পাশাপাশি তাকে শেখানো হয় বিবিধ রকম পরিস্থিতিতে কেমন করে সহজ স্বাভাবিক সাধারণ জীবনযাত্রা ও আচরণের মোড়কে সহজাত থাকতে হবে, নিতান্তই কাছের মানুষটিরও চোখে ধূলা দিয়ে। ব্যাপারটা এই নয় যে এই তত্ব বা এমনতর ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই ঘটছে। আমেরিকা কি ইংল্যা- সর্বত্রই ঘুরে ফিরে এই একই নোটেশনে চলছে র্যা ডিকেলাইজেশন প্রসেস।

এতো সব ধাপে না রাষ্ট্রব্যবস্থা না পরিবার পূর্ণাঙ্গ অনুপ্রবেশ ক্ষমতা রাখে একটা তরুণের জীবন ও মনস্তত্বে। এখানে পরিবার ও রাষ্ট্রের পাশাপাশি প্রতিবেশী আত্মীয় বন্ধু ও স্বজন সবারই ভূমিকা রাখবার অত্যাবশ্যকীয়তা আছে। আছে সহপাঠী ও শিক্ষকদের। কথা হলো এমন সামাজিক সম্পৃক্ততার সুযোগ কি আজ আদৌ বিদ্যমান আছে? যা স্বাভাবিক ভাবেই সমাজে বিদ্যমান ছিলো আজ থেকে চার বা পাঁচ দশক আগে।

তাহলে উপায়? হতাশ না হয়ে আজ থেকে উল্লেখিত সব আঙ্গিকে সচেষ্ট হওয়াটা তাই বড্ড বেশী জরুরী। উদাসীন না থেকে প্রতিটি খুটিনাটি বিষয়কে গুরুত্বের সাথে নিয়ে প্রতিটি কিশোর ও তরুণকে পর্যাপ্ত মনযোগ দেয়া তাই সর্বাংশে অত্যাবশ্যক। সন্তান যাদের সঙ্গে মিশছে তাদের হাল-হদিস জানা বাধ্যতামূলক। সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলবার মতোন সম্পর্কটি বজায় রাখা তাই অতীব জরুরী।

এখানে সমাজ বা রাষ্ট্রের দায়িত্বটি বা তার খেলার মাঠ আর স্কুল প্রাঙ্গণের পরিবেশটি ভীষণ ভাবে বিচার্য। স্কুলগুলোতে এর পক্ষে পরিবেশ বজায় রাখবার লক্ষ্যে স্যেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা, স্কুলের নামে সন্ত্রাসবাদের ফা- সহজে আমাদের সন্তানের মাথা গুলিয়ে খাওয়ার সুযোগ রুদ্ধ করা সরকারের গুরু দায়িত্ব।

এতো সব দায়িত্ব করণীয় সব গুরুজন, বাবা মা, শিক্ষক আর রাষ্ট্রেও জন্য ভীষণ জরুরী এই কারণে যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ্য সবল ও সঠিক করে বাঁচিয়ে রাখবার ও বড় করবার দায়িত্বটি সেই শিশুটির নয়, আমাদের। আর সে বিপথে গেলে বা সন্ত্রাসী হলে, খুনী হলে, জঙ্গী হলে – বাবা মা, প্রতিবেশী, সমাজ সমষ্টি বা রাষ্ট্রের কোনোই ফায়দা নেই, থাকে শুধু দায়। তাহলে ফায়দা কার? কারো না কারো ফায়দা না থাকলে এসব তবে ঘটছে কেনো? কার স্বার্থে? এদেশ অরাজক অস্থির থাকলে, আত্মবিশ্বাসী না থাকলে যার লাভ তারই স্বার্থে। অন্য কারো নয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, প্যারিস, বাগদাদ, ইরাক, সিরিয়া, ইস্তাম্বুল কিংবা পৃথিবীর যেখানেই সন্ত্রাস ঘটুক তা নিশ্চিতভাবেই কোনো ধর্মের ফায়দা অর্জনের জন্য নয়। নয়া ঔপনেশিকতাবাদের ইচ্ছা পুরন কিংবা মুষ্ঠিকে শক্তিশালী করবার জন্যে। যার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনবার ক্ষমতা আজ বাকী বিশ্বের নেই। তাই পৃথিবীকে না পাল্টিয়ে নিজেকে পাল্টেই একে প্রতিরোধ সম্ভব। অন্যথায় নয়। কথা হলো আমি আপনি বা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কে কতোটা কার্যকর পদক্ষেপ নেবে একে ঘিরে আজ।

নইলে এক বোমায় দুশো মানুষ যেমন মরবে, তেমনি কোমল তরুণ হাতে নির্মমভাবে প্রাণ যাবে সাত মাসের অনাগত শিশু ও মায়ের। আমার আপনার প্রিয় মা বাবা ভাই ও বোনের। কিংবা ধ্বংস হবে তার রুটি রুজির পথ ও সম্ভাবনা। ১ ও ২ জুলাইয়ের নির্মম ভয়াবহতা যদি আমাদেরকে এর কালো চেহারাটি যথার্থ দেখিয়ে যেতে সক্ষম না হয় তবে আর ভবিষ্যৎ বলে ভাববার কিছুই অবশিষ্ট আর নেই আমাদের।

কথা হলো এই অকারণ নির্মমতা আজ সারা পৃথিবীর সমস্ত ভূখ-ের মাটিকে রঞ্জিত করেছে। বাদ যায়নি দেবালয়ও। তবু আমাদের ঘরে হলেই কেবল মোড়লদের বা দেবতাদের মাথা ব্যাথা হয় বেশী। তাই কারো মুখাপেক্ষী হবার বা কারো উপরে নির্ভর করবার মতোন বিষয় এটি নয়। একান্তই আমার আপনার এগিয়ে আসবার বিষয়। রাষ্ট্রযন্ত্রও তখন চাইলেও নির্বিকার বসে থাকতে সক্ষম হয়ে উঠবে না বা ভুল পথে চলতে পারবে না।

লুৎফুল হোসেন
০৬ জুলাই ২০১৬

৫,১৪০ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “~ স্রেফ চার-ছয় মাসের যাদুমন্ত্র এটা নয় ~”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    বিষয়টি নিয়ে বেশ ভালো ব্রেইনস্টর্মিং করেছো তুমি, লুৎফুল। বেশ কিছু ভালো পর্যবেক্ষণ আমরা পেলাম। যেমনঃ
    ১। এদেশের কারো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এটা ম্যাটার ট্রান্সমিশন সুবিধার কল্যাণে ওদের হাতে এসে পৌঁছায় নি নিশ্চিত। তাহলে কোন পথে? সেই সূত্রটাই গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে খুঁজে বের করতে হবে। বের করতে হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
    ২। তাই এদের চেয়ে উচ্চবিত্তের অভাবহীন কিন্তু আনন্দ উন্মাদনার সীমা সংকট ও ভালবাসার অভাববোধে ডুবন্ত তরুণদের খুব সহজেই উদ্দেশ্যবাদীরা ড্রাগ বা এরকম রাজকীয় সন্ত্রাসবাদের পথে টানতে থাকে। -
    ৩। এক কথায় বলা যায় এই পঞ্চম পর্বের শেষে যাকে আপনি পাবেন সে অনেকাংশে একজন রোবট। মানবিক বিচার বিবেচনার ক্ষমতাটুকুন তার ডিপ ড্রাগ ডোপড মানুষের মতোন সম্পূর্ণ লোপাট হয়েছে। -
    ৪। তাই পৃথিবীকে না পাল্টিয়ে নিজেকে পাল্টেই একে প্রতিরোধ সম্ভব। অন্যথায় নয়।
    ৫। ১ ও ২ জুলাইয়ের নির্মম ভয়াবহতা যদি আমাদেরকে এর কালো চেহারাটি যথার্থ দেখিয়ে যেতে সক্ষম না হয় তবে আর ভবিষ্যৎ বলে ভাববার কিছুই অবশিষ্ট আর নেই আমাদের। -

    খুব নিশ্চিত বাকী সব ছাপিয়ে তাদের প্রত্যয়ী হাসিতে উদ্ভাসিত উজ্জ্বল মুখগুলো কাঁটার মতোন বিঁধছে ভীষণ সবার মনে। - ঠিক বলেছো লুৎফুল, ঘটনা ঘটার পর থেকেই ঐ হাসিমাখা মুখগুলো বারবার ফিরে আসে মনে, আর ভাবি, কোন যাদুর বাঁশী তাদেরকে টেনে নিল শীতল মৃত্যুকে এভাবে ছড়িয়ে দিতে!

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      ভাই অনেক ধন্যবাদ দারুন ভাবে আপনার মন্তব্যে পয়েন্টওয়াইজ প্রস্তাবনাগুলো পুনরাবিষ্কারে সাজিয়ে দেয়ার জন্যে।
      মনের ভেতর মরিয়া হচ্ছি প্রতিনিয়ত। কি করে মানুষকে সচেন করতে পারি। কি করে এমন অনির্বচনীয় পতন থেকে বাঁচাই আমাদের উত্তরাধিকারকে। জাগাই সকল মা-বাবাকে। পঙ্কিলতার গহ্বর থেকে তুলে আনি বর্তমান সঙ্কট ও সম্ভাব্য ভয়াবহতা থেকে।
      আমরা সবাই মিলে লেগে না পড়লে যে পরিত্রাণ কখনোই ধরা দেবে না আমাদের কাছে। আর এসবকিছু তো রাতারাতি ঘটে যায়নি। দীর্ঘ সময় ধরে এটা ঘটে যাচ্ছিল। শুধু আমাদের জ্ঞানসীমায় তা বুঝে উঠবার মতোন স্থিরতাটুকু বিদ্যমান ছিল না। আমরা বুঝিনি কোথায় কি ঘটে যাচ্ছে। আজ যখন বুঝতে পেরেছি চড়া দাম দিয়ে, তখনও কি আমরা নিস্ক্রিয়ই থাকবো! মিরাকলের প্রত্যাশায় হাত পা গুটিয়েই থাকবো !
      ভুলে যাবো যে অপ হলো জ্যামিতিক প্রবৃদ্ধির জীবানু। তাকে না থামালে কর্কট রোগের মতোন তা অনায়াসে লহমায় হয়ে উঠবে প্রাণধ্বংসী।

      জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    র‍্যাডিকেল ইসলাম যা বলেছে আই এস তাই করছে।
    অনেক কিছুই হয়তো সাদা চোখে খারাপ লাগছে কিন্তু ওরা ধর্মের পথেই আছে।

    শুনলাম রেপ করার ভিডিও ওরা ছেড়েছে বা পিছনে রেপ হচ্ছে এটা একটা ভিদিও দেখে মনে হচ্ছে। এটা হয়তো ধর্মের মধ্যে ফেলা যায় না। যদি ও নবীর যুগে ভিডিও র সুবিধা থাকলে কি হতো তা বলা যাচ্ছে না।

    যৌনদাসী বিক্রয় এর কিথা বলা হচ্ছে।
    দাসী সম্ভোগ তো ইসলামে বৈধ।
    আর দাস দাসী ত নবীর যুগে কেনাবেচা হতো।
    দাসী শব্দটার সাথে যৌন দাসী যুক্ত করায় হয়তো আমাদের খারাপ লাগছে।

    গলা কাটাকাটি তো নবীর সংগিরাও করেছেন ইহুদিদের।
    ঐ কাহিনীগুলা আমরা পড়ি তাই হয়তো সেরকম বোধ জাগ্রত হয় না।
    আজ আই এস এর ভিডিও দেখছি বলে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
    বারবার মনে হচ্ছে ইসলাম তো এমন নয়।

    দুঃখজনক হচ্ছে ইসলাম এমনই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      বর্ণবাদী আর মৌলবাদী সব দেশ-জাতি এবং ধর্মালম্বীদের ভেতরই আছে। তফাত হলো এই যে বেয়াকুফের দল এখনও সেই তরবারীতেই আঁটকে আছে, যেখানে অন্যরা আধুনিক ও উত্তরাধুনিক অস্ত্র বা বলপ্রয়োগের চর্চায় সমসাময়িকতায় বিদ্যমান থাকছে।
      অন্যেরা সতর্ক ধর্মের আচকানে বা দেশ-জাতির পালিশ জুতায় যেনো বর্ণবাদ বা মৌলিবাদের ক্লেদের ছিঁটাফোঁটাও না লাগতে পারে। তাই অন্যত্র যেমন বিদ্বেষের বীজ অনুপ্ত রাখবার উদ্দেশ্যে সবাই সচেষ্ট সেখানে মুসলমানেরা এবং সেই সাথে উল্লসিত অন্যপক্ষ ওটা নিয়ে যেভাবে মেতে পড়ছে। তাতে ওই বিদ্বেষের চারাগাছ পুন:বপিত শুধু নয় বিশাল হাইব্রিড নার্সারী ব্যাপ্তি লাভ করছে।
      মনস্তাত্বিক প্রতিরোধের জন্যই আমাদেরকে এই উন্মাদ সহিংসতার পিক্ষের কথাগুলোকে পাল্টাতে হবে।
      পিক্ষ বিপক্ষ প্রতিপক্ষ সবারই ট্রোজান ঘোড়ার যুদ্ধকৌশলকে ঠেকাতে হবে। হেইট ক্যাম্পেইনের জবাব হেইট ক্যাম্পেইন নয়।
      এই ইহুদী কতলে একতরফা জার্মান নাৎসীদেরকেই সবাই দুষে সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাস বিবেচনায়। অথচ সেই একই মানসিকতার সুগার কোটেড ভার্শান গোটা ইউরোপ তখন থেকেই ইহুদী বিতাড়নে এক রকম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। বিপরীতে এটিএম শামসুজ্জামানীয় দরদ সূত্রে ফিলিস্তিনে ইহুদী পুনর্বাসনের মহৎ উদ্যোগ নিল মানবতার ফ্রি কমোডিটিকে বাজারজাত করে। সেই থেকে মানবতার অলৌকিক সুফিইজমের কল্যাণে সৃষ্টি হয়েছে তালেবান, লাদেন, সাদ্দাম আর হালে আইএসআইএস।
      একদিকে স্বার্থান্ধ রক্তপিপাসু আর আরেক দিকে মধ্যযুগীয় আদর্শে কোপাকুপির উন্মাদ। মাঝখানে সাধারণ মানুষেরা যেনো সব কসাইখানার সারবদ্ধ প্রাণীকূল।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।