|| ভ্যাট নিয়ে নাগরিক ভাটায় আগুন ~ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা খাতে ভ্যাট নিয়ে করমচার কড়চা ||

খুব ছোটোবেলায় যখন বাসার সবাই মিলে বাংলা সিনেমা দেখা একটা নিখাদ বিনোদন ছিলো। সেই রকম একটা সময়ে কোনো এক সিনেমায় দেখেছিলাম কমেডি ক্যারেকটারটি (খুব সম্ভবত খান জয়নুল) রান্নার বই দেখে রান্না করছে। কিন্তু মাঝে কিঞ্চিত বিঘ্ন ঘটায় বইটির পাতা উলটে যায়। তারপর মাছ রান্নায় দুধ, চিনি, এমন সব উপকরনের নাম পাঠ করে তার সবই দিতে থাকে সে রান্নার হাঁড়িতে। হল ভর্তি মানুষের হাসিতে দম আঁটকে মরার দশা। ছোট্ট মানুষ আমি ভাবছিলাম, রান্নার বিন্দু বিসর্গ এক ফোঁটাও জানে না নিশ্চিত মানুষটা। নইলে তার তো কিছুটা অন্তত বোঝার কথা। অমন ওলট পালট সব জিনিস কি এ রান্নায় যায় নাকি ! বুঝিনি সেদিন এটুকুই যে, হল ভর্তি মানুষের প্রত্যেকেই এমন অবান্তর ভুলের অবলীলায় ঘটে যাওয়া দেখে হেসে কতোটা কুটি পাটি হবে, তা পরিচালক সাহেব ভালোই বুঝেছিলেন।

আমাকে যদি কেউ বলে যে হিব্রু ভাষার যে কোনো শব্দের মানে জানতে চাইলে ফ্রি ফ্রি জানতে পারো। আমার প্রশ্নটা কি হবে তখন ! আমার যে হিব্রু ভাষার এক খানা অক্ষর সম্পর্কেও এক বিন্দু ধারণা নেই।

বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, সারাদিন এই রাজধানী শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের নাকাল অবস্থা দেখে এমন হাস্যকর দুটো কথাই মনে পড়লো। এই দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (বলা যায় এক রকম)। পড়তে গেলে সাথে নানান উপরি প্রাপ্তিও জোটে শিশুটির বা পরোক্ষভাবে তার মা বাবার। ব্যবস্থাটা এমন করে করা হলো কেন ? উৎসাহ আর প্রেরণা যোগাবার জন্য। কেননা শিশুরা ভবিষ্যত প্রজন্ম আর তারা কিছু শিক্ষার আলো পেলে জাতি উপকৃত হবে। ছোটোবেলায় পড়েছিলাম শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর এমন কোনো কারনেই নিশ্চিত নিহিত এর সকল প্রণোদনা।

তাহলে উচ্চ শিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষার পরের কোনো স্তর কি এমন ভাবনার বৈপরীত্যে অবস্থান করে ! নিশ্চিত করে না। এই যে তৈরী পোষাক রপ্তানী খাত থেকে দেশের সর্বাধিক বৈদেশিক মূদ্রা আয় হয়, তার পেছনে উৎসাহ আর প্রণোদনার প্রয়াস হিসেবেই এই খাতকে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। সেই সাথে অন্য আরো রকমের কর থেকেও মেয়াদী অব্যাহতির সুবিধা এই খাতকে দেয়া হয়েছে এই খাতে বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারী দুটোকেই উৎসাহিত করবার জন্যে।

উন্নত বিশ্বে আয়ের বিশাল এক অংশ, এমন কি কোথাও কোথাও আয়ের সিংহভাগই মানুষকে আয়কর দিতে হয়। আর তা মানুষ দ্যায়ও দিব্যি অনায়াসে। সেই করের বিনিময়ে সে সব দেশ তাদের নাগরিকদের দ্যায় নিরাপত্তা এবং নানাবিধ সামাজিক ও ব্যক্তিগত সুবিধা। বিষয়টা সে সব দেশের সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কথায় ও কাজে তাদের নাগরিকদের বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর সেটাই তাদের দেশের নাগরিকদের কর প্রদানের সুস্পষ্ট ও কার্যকর প্রণোদনা।

আমাদের দেশের উন্নয়ন প্রয়োজন সেই সব উন্নত দেশের চাইতেও বেশী। শুধু বেশী নয়, অনেক অনেক বেশী। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এই কথা বোঝেও কম বেশী। কিন্তু সেই সব দেশের মতোন রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধা ও নিরাপত্তার বিষয়টা সেভাবে দৃশ্যমান করতে পারছে না আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। তাই মানুষ একদিকে বুঝতে পারছে না, অন্যদিকে বুঝতে নারাজ, নানাবিধ কর তাকে যে দিতেই হবে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় তথা নাগরিকদের আপন কল্যাণে। কল্যাণের অস্তিত্বটুকুই যে এদেশে সেভাবে আদৌ দৃশ্যমান নয়। বরং ভীত সন্ত্রস্ত হতাশ ও অবদমিত এদেশের তাবৎ নাগরিক। (মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাভোগী ও লুটেরা ছাড়া।) আর তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই কর প্রদানের যৌক্তিকতাটুকুন বোঝাবার জন্য প্রয়োজন যতো কথা আর কাজ, সেই সবকে অনুপস্থিত রেখে পদক্ষেপ যখন নেয়া হচ্ছে কর আরোপের। তখন হাস্যকর ও প্রাণান্ত সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে।

প্রথম কথা হলো শিক্ষা খাতকে প্রণোদনা দেবার প্রয়োজনের বিপরীতে এমন কর আরোপ নিরেট বৈমাত্রেয় আচরণ বৈ অন্য কিছু নয়। কেউ হয়তো বলতেই পারে, যে উচ্চমূল্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে তাতে তার সাথে কিছু বাড়তি দিতে এমন অনীহা কেনো ! আমার কিন্তু কেবলি মনে হয় এমন পদক্ষেপ নিয়ে যে রাষ্ট্র ভাববে, সে রাষ্ট্রকে অবশ্যই এসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার খরচের (ভর্তি ও বিবিধ চার্জের) হারটিকেও একটি নিয়ন্ত্রিত ছকের ভেতরে রাখতে হবে এবং এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যারা সরকারী ভর্তুকীযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতোন লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্রিয়াশীল, তাদের আয়ের ভেতর থেকেই সকল কর আদায়ের পন্থা নির্ধারণ ও নিশ্চিত করতে হবে। সেই মতোন যদি ঘটতোই সব তাহলে এমন প্রতিবাদ আর জনগণের ভোগান্তির মতোন অনাকাংখিত পরিস্থিতির মুখোমুখিও আমাদের আজ হতে হতো না।

পণ্যের মতোন সেবা প্রদানের বিপরীতেও ভ্যাট ট্যাক্স আরোপযোগ্য। তবে তা যথাযথ যৌক্তিক নিয়মতান্ত্রিকতার ভেতর দিয়ে আদায়তব্য। যাতে কিনা মুনাফালোভী বিনিয়োগকারীর ব্যাগ ভারী থেকে ভারীতর হবার বিপরীতে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য মরিয়া পিতা-মাতাকে পণবন্দীত্বের ঘেরাটোপে পড়তে না হয়। একজন শিক্ষার্থী যে কলমটি ব্যবহার করে, কাগজ ব্যবহার করে, ব্যবহার করে আরো নানাবিধি শিক্ষা উপকরণ, তার প্রায় সবগুলোর উপরই নানান রকম কর আরোপিত। কলম, পেনসিল, রাবার, কাগজ, খাতা এসব থেকে কর অব্যাহতির জন্য তো কখনো এমন আন্দোলন বা প্রতিবাদ হয়নি ! কেন হয়নি ! কারণ সেটা এমন একটা প্রকৃয়ার ভেতর দিয়ে হচ্ছে যার ফলে তা সরাসরি শিক্ষার্থী বা তার পিতা-মাতার উপর আরোপিত হচ্ছে না। কলমের কিংবা কাগজের কারখানা অথবা আমদানীকারক তা দিচ্ছে তাদের জন্য প্রযোজ্য নিয়মানুযায়ী।

আমাদের নিয়ম নীতি নির্ধারকদের তাই বিষয়গুলোকে আরো যথাযথ ভাবে ভেবে ও বুঝে প্রয়োগের পদ্ধতিটিকে সাজাতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের প্রযোজ্য ও প্রাপ্য সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার মাধ্যমে সব রকমের কর প্রদানের প্রণোদনা উচ্চকিত করতে হবে। করের টাকার ব্যয় আরো আরো স্বচ্ছ্ব ভাবে নাগরিকদের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার সীমায় পৌঁছে দিতে হবে। আর তা যদি না করা হয় তবে ঐ প্রথম দেয়া উদাহরণটির মতোন বা তার চেয়েও মর্মান্তিক ভাবে হাস্যকর হবে সব উদ্যোগ ও পরিণতি। কিংবা বলা যায় হচ্ছে।

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

২,১৭৪ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “|| ভ্যাট নিয়ে নাগরিক ভাটায় আগুন ~ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা খাতে ভ্যাট নিয়ে করমচার কড়চা ||”

    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      খুব ঠিক কথা বলেছেন খায়রুল ভাই। আমরা ক্যাডেট কলেজে পড়েছি ভর্তুকীতে। তার আগে শহরের জেলা স্কুলে পড়েছি ভর্তুকীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য যাখানেই পড়েছি সেখানেও ছিলো ভর্তুকী। আর তা আজো আছে। না হয় বুঝলাম আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই বলে শিক্ষাকে পরিপূর্ণ ভাবে পণ্যের কাতারে নামিয়ে নিয়ে আসার মতোন উন্নতি ! তাছাড়া সেই উচ্চ মূল্যের সাথে যে শিক্ষাটুকুন দেয়া হচ্ছে তার সাযুজ্য কতোটুকুন আছে !
      এগুলো কে যে দেখবে, বুঝবে ! আর কেনোই বা যাদের দেখবার কথা তারা দেখবে না বুঝবে না !

      জবাব দিন
  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এই প্রথম একজনকে এই ইস্যুতে কিছু যৌক্তিক কথা বলতে দেখলাম।
    কিন্তু হায়, এই যৌক্তিক কথা বুঝবার বা ধারন করবার মন মানসিকতা কি আমাদের আছে???


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      আমাদের কোন খাতকে উতসাহ প্রণোদনা দেয়া উচিত আর কোন খাতকে গাঁটের পয়সা খরচ করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত এসব কে আর বুঝবে !
      যে পকেটের সাইজ বড় করবার তাড়নায় তড়পাচ্ছে ! কারন তার উপরি ও অনায্য আয় রোজগারের অর্থের জন্য আরো বড় পাত্র-ভান্ডারের প্রয়োজনটাই তার কাছে অন্যের পকেট কাটার সমান জরুরী ও জরুর কর্তব্য !

      জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ফেসবুকের স্ট্যাটাসে লিখেই এখানে কপি পেস্ট। পরে আজ পড়তে গিয়ে দেখলাম রাজ্যের ভুল ভাল হয়ে আছে লেখার ভেতর। কিছুটা শুধরে দিলাম (আমার নিয়মিত টাইপো সীমাবদ্ধতাগুলো ছাড়া, যেমন খন্ডত)। এসব ভুল ভাল সহ পড়বার বিড়ম্বনাটুকুর জন্য ইতোমধ্যে যাঁরা পড়েছেন তাদের সবার কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি। আর একটা লম্বা লেখা পড়বার জন্য যেটুকু সময় ব্যয় হলো তার জন্য জানাচ্ছি কৃতজ্ঞতা ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।