বৈ শা খী

~ এ ক ~

এই ঢলঢলে জামাটাকেই সব চাইতে প্রিয় মনে হয় ওর। গা জ্বালা করা গরমে এর চেয়ে আরামদায়ক কোন জামা মেয়েটি আর কখনো পরেনি। জামাটার পিঠের দিকটা ঘাড়ের পাশাপাশি বড় বৃত্তে এগিয়ে কাঁধ পেরিয়ে প্রান্তের দিকে সরে এসেছে বেশ অনেকখানি। সামনের দিকে গলাটা প্রয়োজনের চেয়ে অনেকখানি বড়। ওর চেয়ে স্বাস্থ্যবতী, বড় সড় আর সুখী কোন একটা শরীরের জন্য কখনো তৈরী হয়েছিলো এটা। ঢিলেঢালা জামার সামনের গলাটুকু সামলে না নিলে তাই বুকের বাগান বলতে গেলে সটান খোলা থাকতো। অপূর্ব দক্ষতায় সাধারণ একটা কালো রঙের চুলের ক্লিপ দিয়ে কয়েকটা ভাঁজে বাড়তি ঝুলটুকু আঁটকে সংক্ষিপ্ত করেছে জামার গলাটা। ভাঁজের কুঁচিগুলো বুকের ওপর জমে ফুলের মতোন ফেঁপে সুন্দর-দর্শনীয় একটা আচ্ছাদন তৈরি করেছে। হাতার শেষে আর ঝুলের সীমান্তে সুন্দর লেসের ঝালর লাগানো। রঙ চটে তাতে এখন হালকা একটুখানি মাত্র গোলাপী আভা অবশিষ্ট। তবুও একসময়ে নিপূণ যত্নে সুন্দর করে করা একটা কাজের প্রকাশ এখনো জানান দিচ্ছে লেসটার উপস্থিতি। ‘সিন্ডারেলার’ কাছে তার সেই স্বপ্নময় উৎসবের জামাটার চেয়েও বেশী প্রিয় মেয়েটার কাছে এই জামাটা। প্রিয়, শ্রেষ্ঠ। কারণ, এছাড়া আর কোন জামা-ই তার নেই। অবশ্য ‘সিন্ডারেলা’ শব্দটাও কখনো শোনেনি মেয়েটা। ওর জানা নেই সেই গল্প। সেই অপূর্ব প্রাপ্তি। ‘সিন্ডারেলা’ নামের সেই দুঃখক্লিষ্ট মেয়েটার কথা। একদিন সত্যি সত্যিই এক রাজকুমারের হাত ধরে তার ক্লিষ্ট জীবন থেকে অভাবিত স্বপ্নের পথে যাওয়ার কাহিনী। এসবের কিছুই ওর শোনা নেই, জানা নেই।

দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে অপার মুগ্ধতায় পায়ের ওপর বিছিয়ে থাকা জামাটায় পরিতৃপ্ত আঙুল বুলায় মেয়েটা। চোখ দুটাতে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিতে চারপাশে পথের মানুষগুলোর চলে যাওয়া দেখে। রাত বাড়ছে। আস্তে আস্তে পথ চলা মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। সময় নীরব হচ্ছে। শুধু চৌমাথার কোনায়, মোড়ের প্রান্তের হোটেলটায় মানুষের আসা যাওয়া যেন কমতে চায় না। বাস্তবে কমে আসে। তবে, রাত বাড়তে থাকলে চারপাশ যতোটা নীরব হয়, তার বিপরীতে মানুষের অনবরত আসা যাওয়া, ভেতরে বাইরে অসংখ্য আলো সারাক্ষণ জ্বলে থাকা। এসব কিছু মিলে রাতের অন্ধকার আর নীরবতার বিপরীতে আরো সরব করে তোলে হোটেলটাকে। হোটেলের মানুষগুলোর কর্মব্যস্ততা যেনো কমে না, বরং বাড়তে থাকে রাতের গভীরতার সাথে সাথে। খদ্দের লোকেরা ক্রমাগত আসছে। যাচ্ছে। খাচ্ছে। বিল দিচ্ছে। বখশিশ দিচ্ছে। মুরগী, পোলাও, বিরানী, নান, ঝালফ্রাই একের পর এক প্লেটে সাজছে। জোর সাজছে। খালি প্লেটগুলো দ্রুত, আরো দ্রুত ধোয়ার পাত্রে ডুব দিচ্ছে। খাওয়া শেষে ফেরত যাবার পথে কেউ পান-সুপারি-জর্দা, কেউবা পানপসন্দ-ধনিয়াভাজা চিবাচ্ছে। কেউবা একশলা-দুশলা নয়তো এক প্যাকেট বিড়ি কিংবা সিগারেট কিনছে। চলে যাবার আগে, শেষ সদাইয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে। সুখের ধোঁয়া বাতাসে ভাসাচ্ছে।

অবিরাম এমন সব দৃশ্যের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মেয়েটার অপেক্ষার পালা একটু একটু করে শেষ হয় আসে। অনেকক্ষণ আগে থেকেই ওর আর কোন কাজ নেই। সারা দিনের ক্লান্তিতে এখন শরীরটা ঝিমিয়ে আসছে। এখন বিশ্রাম। সেই সাথে মনে মনে করছে হিসাব। একই হিসাব বার বার। আবার। আর এভাবেই সময়ের দূরত্বটা একটু একটু করে কমে আসছে। সময় অতিক্রমণের সাথে সাথে হিসাবটা একটু এগোয়, একটু থামে, ভাবনায়, তারপর আবার এগোয়। ওর কাছে এখন সাতাশিটা টাকা আছে। এটারই হিসাব মাথার মধ্যে বার বার পাক খায়। রাতের খাবার খেতে দশ পনরো টাকা। সকালে আবার দশ বারো। এরপর থাকবে … …। ইশশ। কোনভাবে যদি একটা শাড়ী কাপড় কেনার মতোন টাকা জমাতে পারতো! আর একটু বেশী খাটুনি দিলে কি আয় বাড়বে ? সেই তো একই পথ, একই পথিক। পথে মানুষের ভীড় বেশী থাকলে বরং অনেকদিন দেখেছে মানুষগুলার মন মেজাজ বিগড়ে থাকে। বেশী মানুষে সেদিন বরং আয় আরো কমে।

দিনের আলো যথেষ্ট না বাড়লে কাজ শুরু করে লাভ হয় না। সাত সকালে আয় রোজগার তেমন জোটে না। তাই ধীরে সুস্থ্যে, লোকজন এসে দোকানপাট খোলার কিছু সময় আগে পর্যন্ত সে এখানটায় শুয়েই থাকে। দেখতে দেখতে, এই কদিনে এ দোকানের সামনেটুকু মানুষের নিজ ঘর বাড়ীর চেয়ে তার কাছে যেনো বেশী কিছুই হয়ে গিয়েছে। সমস্যাটা হয় শুধু বৃষ্টি বাদলের দিনে। আয় রোজগার হয় বড্ড কম। সেজন্যে মন থাকে এমনিতেই একটু খারাপ। তার উপর তখন আবার বৃষ্টির দাপটে আচ্ছাদনহীন এই ফুটপাথটুকুও হাতছাড়া হয় তার। চলে যেতে হয় পেছনের দিকে, পরের বিল্ডিংটার সিঁড়ির গেটে। সেখানে এক তলা – দোতলার অফিস আর তিন তলা – চার তলার বাসার মানুষ-জনদের আসা যাওয়ার তোড়ে একবার এপাশ, একবার ওপাশ। সময়টা দিন হলে যেন চলতে থাকে এক রকমের লাথি গুতা। বৃষ্টির রাতগুলো কোনভাবে থাকা গেলেও, মানুষের আসা যাওয়া ভালোমতোন শুরু না হতেই সকাল সকাল সরে পড়তে হয়। আকবর মিয়ার মর্জি ভালো থাকলে অবশ্য গভীর রাতের সারাটা সময় সিঁড়ি গোড়ায় দারোয়ানের খুপড়ি ঘরটুকু মেয়েটার সম্পূর্ণ একার হয়ে যায়। রাত যখনই ভোরের কাছাকাছি আসতে থাকে, আকবর মিয়া আবার স্বরূপে ফিরে আসতে থাকে। রাতের মন্থর সোহাগী হাতেই দারোয়ানের খবরদারির লাঠিটা দিয়ে খুঁচিয়ে তোলে ওকে ঘুম থেকে। সাত তাড়াতাড়ি ভাগায়। বৃষ্টি যদি তখনো থাকে, খুব অসহ্য লাগে। কিছুক্ষণ হয়তো সিঁড়ির গোড়ায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকা যায়। তারপর মন না চাইলেও ঠিক ঠিক একসময় অবিরাম স্নানে নামতে হয়। আকবর মিয়ার পাতলা তোষকের ওপর ত্রিকালদর্শী এক পাটি পাতা বিছানাটা তখন তার মাথার মধ্যে সারারাতের গান বাজাতে থাকে। মাথার ভেতর তীব্র বাজতে থাকে বাঘ শিকারীদের বিকট শব্দের ঢোলের মতোন দ্রিম দ্রিদ্রিম শব্দ। মাথাটা দপ দপ করে। বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে জলের মিশ্রণে এসিডের মতোন ধীরে ধীরে রাগটা এক সময় যেনো তার তীব্রতা হারায়। হারাতে থাকে। তবুও আকবর মিয়ার ওপর রাগ করতে পারে না। মানুষটা সারা রাতভর তাকে বুকের গভীরে নিংড়ে সোহাগ করে। মানুষটার পরিশ্রমী দু’হাতের আদর পেতে তার শরীরের এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ থাকে না। এরকম সব অনুভূতি যেনো ওর নেতিবাচক মনোভাবগুলোকে কোথাও চেপে আড়াল করে রাখে। মানুষটাকে দোষ দেবে কোন মুখে। নিজের বাড়ী তো আর না। ফজরের আজানের আগে আগে বিছানা খালি না করলে বাড়ীঅলা দারোয়ান ব্যাটারে খাতির করবে না একটুও। অন্যথা হলে ফজর পড়ে ফিরে আসার পর এই বিছানার ঠাঁই আর কপালে থাকবে না। এই সত্য আকবর মিয়ার খুব ভাল করেই জানা। তাই, কোন দিনই ভুল হয় না। পূর্ন-নিখাদ পাহারায় কাটে ক্লান্তিহীন শ্রমে অখন্ড নির্ঘুম, প্রতিটা রাত। কোনদিন কোনভাবে একটু ভালো খাবার জুটলে কিছুটা খাবার ঠিক ঠিকই সামলে রাখে। দুনিয়ায় এতো মানুষ থাকতে শুধু মেয়েটার জন্যেইতো খাবার সামলে রাখে। অন্তর থেকে দরদ না থাকলে কি কেউ এমনটা করে? লোকটার ওপর রাগ করে কি করে ! যখনই সুযোগ পায়, সারা রাত শরীরের প্রতিটা খাপে খোপে আদর যত্ন করে ভরিয়ে তোলে যেনো কানায় কানায়। ওর জন্যে এতোটা যে করে তাকে কি দিতে পারে ও! তবে সে খাকনা সুযোগ পেলে ওর শরীরটা লুটে পুটে। এতে কারো তো কিছু যায় আসে না। বরং মানুষটার কাছে ওর দাবীটা আর একটু বাড়ে।

~ দু ই ~

হোটেলটায় লোকের ভীড় এখন একেবারে কমে এসেছে। সামনে ঝোলানো ন্যাংটো মুরগীগুলো সব উধাও হয়েছে। নান আর কাবাবের চুলো অন্ধকার। শিকগুলো চুলার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে যেন শরীর জুড়াচ্ছে। গোটা কয়েক আলো যেনো নিভে গেছে। টেবিল, চেয়ার, মেঝে সাফ-সুতরা চলছে। কোন কোন টেবিলের চেয়ারগুলো উল্টো হয়ে গায়ের উপর বসেছে। এখনো দু-চারটা টেবিলে লোকে খাচ্ছে। কাউন্টারের একপাশে এক স্তুপ থালা-বাসন-গেলাস জমে আছে পরিচ্ছন্ন হবার জন্যে।

মেয়েটা বসে থাকে রমজান আলীর অপেক্ষায়। এখন যে কোন সময়ই আসতে পারে রমজান আলী। আর যদি কিছু সময়ের মধ্যে না আসে, তবে ও নিজেই পায়ে পায়ে এগোবে হোটেলটার দিকে। দিনের তাপ কমে বাতাসে একটু একটু করে শান্তির পরশ লাগছে। এই খিধে পেটেও মনটা ফুরফুরা লাগে। সারা দিনে খাটুনি তো কম হয় না। সারাটা দিনই কেবল হাঁটাহাটি। একবার মোড়ের ডানদিকে। অনেক দূর। তারপর, আবার ফিরে আসা। খানিক দাঁড়ায়ে থাকা, এবার মোড় থেকে একটু বাঁয়ে। এরপর, আবার ফিরে আসা, এই দোকানের সামনে পর্যন্ত। আবার যাওয়া। আবার আসা। বিরামহীন। যাওয়া। আসা। যাওয়া। মানুষগুলো সব যেনো কেমন পাথর পাথর। গলায় বেশী শব্দ করে শ্রমের মাত্রা তাই বাড়ায় না মেয়েটা কোনোদিন। আজকাল মানুষের মুখ দেখলেই যেন কেমন করে বুঝতে পারা যায়। কে দেবে, কে দেবে না। অনেকগুলো চেহারা আছে, দেখতে দেখতে চেনা হয়ে গেছে। আশে পাশের দোকান-পাট, অফিস, বাসা এসবের মানুষ তো সব চেনা। তাদের দিকে কখনো এগিয়ে যায় না ও। জানে ওদের কারো যদি ইচ্ছে হয়, দু’কদম এগিয়ে এসে নিজেই দিয়ে যাবে। তবে আর ওদের কাছে চাইতে যাওয়া কেন? ভাবনার সাত পাঁকে ঘুরতে থাকে মন। আর ডান হাত – বাঁ হাতের আঙুলগুলো চিরুনির মতোন পালা করে লালচে চুলের জট ছাড়ায়। চুলগুলোকে পরিপাটি করার চেষ্টা করে। অনেকটা বাদামী রঙ পেয়েছে এখন তার চুলগুলো। আঠালো ধুলা-ময়লার সখ্যতায় গায়ে গায়ে এমন জড়াজড়ি হয়ে থাকে যে ছাড়ানো কষ্টকর। তবু বড় বড় জটগুলোকে অন্ততঃ ছাড়িয়ে ছোট করা তো যায়। এসব কিছুই কখনো কোন আয়নায় দেখতে পায় না মেয়েটা। ওর কখনো জানা হয়না, দেখা হয়না ওর আসল চেহারাটা। মনের আয়নায় যেমনটা ভাবে ঠিক তেমনটাই দেখা যায় ওকে। সুখে ভাটা পড়ে না ওর তাই কখনো।

ক্ষুধার তাড়নায় এবার ধৈর্যের থলে শুন্য হয়। অপেক্ষার পালায় ছেদ টেনে পায়ে পায়ে এগোয়। হোটেলের মুখে ফুটপাথটায় গিয়ে বসে। দুটা লোক ওর পিঠের কাছে, পান দোকানটায় এসে দাঁড়ায়। পানের খিলি মুখে নিয়ে সিগারেট ধরায়। দোকানদারকে পয়সা দিয়ে ফিরবার সময় একজন ফুচুক করে একদলা পিক ফেলে ওর পাশ দিয়ে। একটা রিকশাঅলা পাদানীতে বসে বিড়ি ফোকে আর তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। কুঁচিতে ঝুল কমানো জামাটা দুপাশে টান টান হয়ে অদ্ভুত এক পাহাড়ী উপত্যকার ঢাল এঁকে বসে আছে নির্বিকার ভাবে। জীবনের কোন অবহেলা, পরিহাস, চালহীন চুলোহীন যাপনের নির্যাস – এসব কিছুই থামিয়ে রাখতে পারেনি তার নির্লজ্জ শরীরের বৃদ্ধি ও প্রকাশ। রিকশাঅলাটা শুধু এর আবিষ্কারক আর সমঝদার মাত্র। পান খাওয়া লোক দুটোর ডাকে রিকসাঅলা পাহাড়ী উপত্যকার মাপজোক ফেলে চোখ সরায় তাদের দিকে। যাবে! প্যাসেঞ্জার নিয়ে সরে যায় সে দৃষ্টির সামনে থেকে। একটা দমকা বাতাস এক লক্ষ কণা ধুলা-বালি লেপ্টে দিয়ে মেয়েটার গায়ে, হারিয়ে যায় আপন গন্তব্যে।

তুই আসছস্ ! বস্। রমজান আলীর ভরাট আর দরদী গলায় সচকিত হয় মেয়েটা। ত্রস্ত হাতে মুখে, গলায়, ঘাড়ে দু’হাতের আঙুলগুলো বুলায়। ধুলাবালি ঝাড়ে। নিজেকে প্রকাশ করতে চায় আরও উন্মোচিত উপস্থাপনায় । মুঠি করে কোমরের কাছে গুঁজে রাখা ছোট্ট পলিথিনের পুটুলিটায় সতর্ক হাত বুলায়। সাতাশিটা টাকা! আরো কিছু টাকা হলে কালকেই একটা শাড়ী কিনতে পারতো। ইশশ! হলুদে লাল ছাপা, একটা শাড়ী যদি সত্যিই কিনতে পারতো। কেমন লাগতো ওকে! এক প্যাঁচে পড়তো! নাকি কুচি করে নাভির কাছে গুঁজে সিনেমার পোস্টারের নায়িকাদের মতোন, আঁচল গায়ের সাথে পেঁচিয়ে!

একটা নানরুটির ওপর ঝোল-মাংসে মাখামাখি তরকারি। সেটার তলায় আরেকটা নান। ফিক্ করে হেসে দেয় এটুকুতে সুখে ভাসা মেয়েটা। চকিতে সামনের সবকটা দাঁত দৃশ্যমান হয়। এক হাতে খাওয়াটা সামলে ধরে। অন্য হাতটা আগায় কোমরের ছোট পুটুলিটার দিকে। রমজান আলী হাত নেড়ে নিষেধ করে। বলে, আজকে টাকা লাগবেনা। মেয়েটার হাসিটা আরো প্রসারিত হয়। বাকী দাঁতগুলোও এবার দৃশ্যমান হয়। কিছুটাও দেরী না করে, যেখানে ছিল সেখানেই বসে পড়ে খেতে। একমনে নেড়ে চেড়ে দেখে, আর খায়। আস্তে আস্তে। এমন মজাদার খাওয়াটা যেনো তাড়াতাড়ি শেষ না হয়। মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে যায়। লোকটা আসলেই ভালো। খুব ভালো। অনেকদিন ঝুটা-বাসি বাদ দিয়ে এমন আসল খাবার খাওয়া হয়নি। মনে মনে রমজান আলীর কথা ভাবতে থাকে। লোকটা দেখতে অনেকটা ডাকাতের মতোন। কালো। মোটা পিটানো শরীর। অথচ আচরণের সাথে চেহারার কোনই মিল নাই। কোনদিন মুখে কোন খারাপ কথা নাই। চোখজোড়া উল্টা পুল্টা এদিক সেদিক তাকায়না। লাজুক লোকটা মুখে কিছু বলতে পারে না। লোকটাকে দেখতে যেমন মনে হয়, আচরণে যেন ঠিক তার উল্টা। যেদিন রাতে খাওয়ার টাকা নেয় না রমজান আলী। সেদিন রাতের খাওয়ার সময়ই জানা হযে যায়। রমজান আলী আজকে আসবে। সেই রাতে নির্ঘুম অপেক্ষায় থাকে সে।

~ তি ন ~

মুখে, গলায় আর বুকের কাছে কারো স্পর্শ পেতেই তন্দ্রা ছুটে যায় মেয়েটার। চোখ না খুলেই টের পায় চেনা হাতের স্পর্শ। নড়ে চড়ে সরে যেতে থাকে মুখে, বুকে, গায়ে, গলায়, পেটে, পিঠে, তলপেটে। হাত, মুখ, ঠোঁট, দাঁত পালা করে বিচরণ করতে থাকে সমস্ত উপত্যকা, ঢাল আর উচ্চতার বাঁকে। চাঁদের আলো মেয়েটার শ্যামলা শরীরে তার দখল বাড়াতে থাকে। প্রিয় জামাটা সংকুচিত হতে হতে, একটু একটু করে এক সময় সম্পূর্ণ সরে যায় তার শরীর থেকে। অভিজ্ঞ হাত এক সময় নিতম্ব খামচে ধরে। সুখের ভেলায় চড়ে। উত্তাল উথাল পাথাল ঢেউয়ের দোলায় দক্ষ মাঝি সামলে সামলে নাও ভাসায়। বৈঠা নাচায়। ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায়। একসময় সবকিছু শান্ত হয়ে আসে। এক টুকরা মেঘ চাঁদটাকে আড়াল করে। আধো আধো পূর্ণিমার আলো যেনো চারপাশের সব কিছুকে আরো রহস্যময়তায় ঠেলে দ্যায়। একটা বিছানায় লেপ্টা লেপ্টি হয়ে মিশে থাকে দুটা শরীর। আলো আঁধারির খেলায় হঠাৎ ঠাহর করা যায় না, মানুষ এখানে একজন না দুজন। একসময় আস্তে আস্তে বুকের তরঙ্গায়িত ওঠানামা কমে। নাকের অস্থির ফোশ ফোশ থামে। ওর মনে হয় মানুষটা তবু আরো কতক্ষণ শুয়ে থাক। আবারও উত্তাল ঢেউয়ে নাও ভাসাক। মানুষটা তাকে যতোবার খুশী ততোবার পাক। টের পায়, মানুষটাকে অন্তর থেকে চায় ও। মানুষটা লাজুক। বড় ভালো। শক্ত হাতে নাও সামাল দিতে পারে। মানুষটার কলিজাটারে বুকের চেয়ে বড় মনে হয়। এরকম ভাবতে ভাবতে একসময় অবসন্নতা গ্রাস করে। মানুষটাও নড়ে চড়ে ওঠে। হাতড়ে হাতড়ে মেয়েটার একটা করতল খুঁজে বের করে। এক হাতে তখনো মেয়েটার সেই যক্ষের ধন ছোট পুটুলিটা। আর খুঁজে পাওয়া অন্য হাতটাতে একটা মলিন, লাল কমলা রঙের নোট গুঁজে দেয় মানুষটা। মেয়েটা অবাক চোখে তাকায়। হাতের ভেতর আবির্ভূত নোটটাকে অনেক দীর্ঘ মনে হয়। সেটাকে চোখের সামনে এনে চাঁদের আলোয় পরখ করে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নোটটার দিকে। রমজান আলী তার সেই জামাটাকে গায়ের ওপর টেনে দিয়ে বুকটা ঢেকে দেয়। বলে, ‘যাই’। যেনো কোথাও অস্ফুট উচ্চারিত হয় – ‘মেয়ে, এই রাতের আলোয় আজকের মতো বিদায়। নতুন সকালে আবার দেখা হবে। আবার আরেক রাতে শরীরের নেশা হবে। বিদায়। এই রাতের জন্য, আজকের জন্যে বিদায়। যাই, যাই শুধু আবার ফিরে আসার নেশায়, যাই।‘

একা। একেবারে একা। পূর্ণ চাঁদের সামনে বিস্তৃত হয়ে শুয়ে থাকে মেয়েটা। সম্পূর্ণ চাঁদের কাছে গোটা পৃথিবী জুড়ে সমর্পিত একমাত্র মানুষ। একলা শুয়ে থেকে, তার একাকীত্বের গভীরতা মাপে। চাঁদের আলোর প্রখরতা মাপে। শরীরের এখানে ওখানে স্মৃতির ফেলে যাওয়া স্পর্শ খোঁজে। এক সময় তন্দ্রায় অবশ হয়ে আসে সব। ঘুমটা চেপে আসতে গেলেই জুত হয়ে শুতে চায়। কাত হতে গেলে সারা গায়ে কেমন যেন ব্যাথা ব্যাথা লাগে। আশ্চর্য, সেটায়ও কেমন সুখ সুখ অনুভূতির স্পর্শ পায় যেনো সে।

~ চা র ~

কদিন ধরেই শরীরটা কাহিল কাহিল লাগছে। শরীরটাকে খালি কেমন ভার ভার মনে হয়। ওর মনে হয়, সাত রাজ্যের আলসেমী ভর করেছে কোষে কোষে। শ্রান্ত পরিতৃপ্ত শরীরটা কখন যেনো একসময় ঘুমের কাছে সমর্পিত হয়। অজ্ঞানের মতো ঘুমায় মেয়েটা। আজকে সে আর একটুও টের পায় না রাতের কতোটা সময়ে পূর্ণিমার চাঁদ অমাবশ্যার পথে কতটুকু পাড়ি দিল। নিশি জাগা এ রাস্তায় কয়টা বাস গেলো। ট্রাক গেলো। কয়জন রিকসাঅলা ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত প্যাডেল চাপলো। তিনটে ছিচকে চোর কোন্ বাড়ীর সীমানায় ঢুকলে, আলো জ্বলতেই ছুটে পালালো। একজন যে আর একটু হলে তাকে পায়ে মাড়ালো। এই গভীর রাতের এসব কিছুই জানেনা মেয়েটা।

ঘুমের মধ্যেও ওর চিন্তার সিঁড়ি একটার পর একটা সোপান যেনো গড়তেই থাকে। দিব্যচোখে ও দেখতে থাকে ওর আগামীকাল। সকাল না হতেই আজ যেনো কোথায় ছুটতে থাকে। ব্যস্ত। ওর কোমরে গোঁজা আছে এখন সাতাশি আর পঞ্চাশ মিলিয়ে একশ সাতাশ টাকা। ছুটছে। হাঁটছে। হাঁটছে তো হাঁটছে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা মেলার মধ্যে চলে এলো। পুতুল, খেলনা, পিঠা, সন্দেশ, গামছা, চুড়ি, আলতা, পাউডার, আয়না। এক সময় একটা শাড়ীর দোকানও পেয়ে যায়। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে লাল হলুদে ছাপা একটা শাড়ী। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায়। আর অপেক্ষা সয় না। পাশের দালানের আড়ালে দাঁড়িয়ে কাপড়টা পরে। আঁচলটা কায়দা করে পেঁচিয়ে বুক ঢেকে কোমরে গোঁজে। ব্লাউজের অভাবটা মোটেই টের পাওয়া যায় না।

গায়ের জামাটা গুটিয়ে হাতে নিতে নিতে ছোট্ট পুটুলিটা আঁচলের গুঁজে দেয়া মাথায়, গিঠের মধ্যে আঁটকে নেয় দক্ষ হাতে। পুটুলিটার গায়ে হাত বুলিয়ে যেনো হিসেবটা পোক্ত করে। এখনো সাঁইত্রিশ টাকা আছে। মিঠাই মুরুলির দোকানটায় এসে থেমে থাকে মেয়েটা। খুব বেশী কিছু বয়স হয়েছে কি! ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়। শিউলিতলা গ্রামের বড় দীঘিটার পাড়ে বসতো সেই অপূর্ব সুন্দর বৈশাখী মেলা। মাটির পুতুল। ঢোল। একতারা। খোল-করতাল। তালপাতার পাখা। নাচুনে সেপাই। টিন কেটে বানানো গাড়ী-উড়োজাহাজ-লঞ্চ। আলতা, চুড়ি, আয়না। এখনো চোখে ভাসে – কাগজের ফুল। মিঠাই মুরুলির দোকান। এই ঝকমকা ঢাকা শহরটাও কিচ্ছু না সেই দীঘির পাড়ের মেলাটার কাছে। মনে আছে, বাপের সাথে গিয়েছিলো একবার সে আর তার ভাই। মিঠাই-মুরুলি ছিল দুই ভাই-বোনের হাতে দুই প্যাকেট। তা বাদে, ছোট ভাইটার হাতে একটা কাঠের লাটিম, আর ওর হাতে একটা তালপাতার সেপাই। কাঠি নাড়ালে হাতের প্যাঁচে হাত পা নাচিয়ে লাফিয়ে নড়ে উঠতো তালপাতার সেপাইটা। মনে পড়লে পুলকিত হয়ে ওঠে ও সেই ছোট বেলার মতোন। এসব ভাবতে ভাবতে একটা মুরুলি মিঠাইয়ের দোকানের সামনে পৌঁছে যায় মেয়েটা। হঠাৎ খুব মুরুলি কিনতে ইচ্ছে করে। ঠিক ঠিক কাগজের ঠোঙায় ভরা দুই টাকার লাল মুরুলি কিনে খেতে খেতে এগুতে থাকে। একটা চুড়ি-আয়নার দোকানের সামনে থামে। চুড়িগুলো নেড়ে চেড়ে দেখে। আয়নায় নিজের মুখটা চোখে পড়তেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মুরুলির টুকটুকে লাল রং মেখে একজোড়া ঠোঁট ফুটে আছে একটা অপূর্ব সুন্দর মুখের মাঝখানে।

~ পাঁ চ ~

কিছু একটার খোঁচা খেয়ে ঘুমটা ভেঙে যায়। কেউ যেনো কিছু একটা দিয়ে সজোরে খোঁচাচ্ছিল বুকের পাঁজরে। ঘুম ভাঙতেই টের পেল, জুতোটা সরে গেলো ও নড়ে উঠতেই। এক ঝটকায় উঠে বসে একপাশে সরে গেলো। দোকানীরা তালা খুলে, শাটার তুলে দোকান খোলায় ব্যস্ত হলো। আরো এক পাশে সরে এলো মেয়েটা, দোকানের সামনেটুকু ছেড়ে। কেমন যেনো মাথা ঘুরছে। গা গোলাচ্ছে। আবারও একটু পাশে সরে, ফুটপাথের শেষ মাথায় এসে মাথাটা নীচু করলো ড্রেনের ওপর। ওয়াক্ ওয়াক্ করে নাক মুখ ভরে নেমে এলো ঝাঁঝালো তরল। মুখটা তেতোয় ভরে গেলো। একসময় বমি থামতে নিজেকে অনেকটা ভার মুক্ত মনে হলো। শুধু মাথাটা দপ্ দপ্ করতে থাকলো। ভারসাম্য হারিয়ে যেনো শুন্যের ওপর দুলছে – অনুভূতিটাকে ঠিক এমনই মনে হলো। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকলো দীর্ঘক্ষণ মেয়েটা। আসলে ধাতস্থ হতে চাইছে ও। দোকানের লোকগুলো বিরক্ত চোখে তাকিয়েছিলো এতোক্ষণ। একজন হঠাৎ মুখ খুললো।

“অসুখ বিসুখ বাধাইয়া কোন দিন মইরা পইড়া থাকবো। ঝামেলা ফ্যাসাদে ফালাইয়া আমাগোরেও মারবো। জন্ডিস-ফন্ডিস একটা কিছু নিশ্চয় বাধাইছে।“
“অইটারে সরা। অন্যদিকে যাইতে ক। এইখানে বমি কইরা ভাসাইয়া কাস্টমার আসার রাস্তা বন্ধ করবো। আমাগোও জন্ডিস ধরাইবো।“ মালিক লোকটার গলা শোনা যায়।
“আরে দূর স্যার! অগো আবার জন্ডিস হয় নাকি?” ম্যানেজার লোকটার গলা শোনা যায়। “স্যার, আসল কাহিনীতো মনে হয় অন্য। চাইয়া দেখেন। চোখ মুখ কেমন হইয়া আছে। নিশ্চয় পোয়াতী হইছে। কোনো রাইতে কি কেউ ছাইড়া রাখে। হগলেই ধইরা দেখে। পোয়াতি হওন ছাড়া অন্য কোন রোগের কারণ নাই। জন্ডিসের চিন্তা কইরেন না স্যার।“

বমি থামলেও মাথাটা আবার চক্কর দিয়ে ওঠে। যদি তাই হয় ! তবে ! কাজ কাম বন্ধ! কামাই রোজগার সব তো বন্ধ হয়ে যাবে। মহাসমুদ্রে তীব্র ঝড়ে পড়া ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকার মতোন পলকা ভাবে ঢেউয়ের দোলায় দোলায় দুলতে থাকে যেনো সবকিছু। চকিতে একবার রমজান আলীর কথা মনে হয়। একবার ভাবে আকবর মিয়ার কথা। একটা রিকশাঅলা চার-পাঁচদিন আগে বাড়ী ফেরার পথে ক্লান্তি ঝেড়ে গেছে তার ঘুমন্ত শরীরে। একদিন দুই মাতাল পাগলের মতো ছানাছানি করলো শরীরটাকে।

নাকি প্রথম যেদিন দেড় মাস আগে চাচা ঢাকা শহরে কাজের উছিলায় এনে ডান পাশের হোটেলটায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো মধ্যরাতে। আদিমতম সেই কাজটাই যে, তার কাজ হবে। তা ওর জানা ছিলো না। কিছুমাত্রও বোঝা ছিলো না। সেই রাতের লোক দু’টার কেউ কি ? সেই রাতটার কথা মনে হতেই গা টা আবার গুলিয়ে ওঠে। লোক দুটার সেকি হাসি! দমকে দমকে খুশি। তাজা শরীর পায় নাই বহু দিন। জীবনে প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা! অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, সবকিছু শুরু না হতেই। তারপর কি হয়েছে, কি হয়নি, তার কিছুই জানা নেই। শুধু সকালের দিকে যখন ঘুম ভাঙলো তখন টের পেলো নীচের দিকটা অসাড় অনড় আর ভেঁজা লাগছে। মনে হচ্ছিল উঠে দাঁড়াতে পারবে না। অথচ এক সময় দিব্যি আবিষ্কার করলো সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। কি এক অজানা কারণে চাচাও আর ফিরে এলো না। একটা মানুষও আজো তার কোন খোঁজ করলো না। তীব্র ব্যাথায় সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো। এইতো। ব্যস। দিন ঘুরতে না ঘুরতে, এই কদিনেই ক্ষুধা তৃষ্ণার কাছে সবকিছু জল তরল।

একটা দিনেই সবকিছু কেমন পাল্টে গেলো। শরীরটাকে এর পর থেকে আর কিছুই মনে হয় না। হাত, পা, নাক, চোখের মতো সবই শরীরের একটা অঙ্গ মাত্র, এছাড়া আর কিছুতো নয়। মনের সাথে শরীরটার সম্পর্কের সব সুতো ছিঁড়ে গেছে সেদিনই। এটাকে এখন এ ও সে যেই ছানুক, যতোই ছানুক। কিছু যায় আসে না। যা হোক কিছু একটা উপায়ে এই কয় দিন একটা জীবন তবু তো যাপিত হচ্ছিল। খেয়ে পরে দিন তো তবু চলে যাচ্ছিল। এখন ও কোথায় যেতে পারে ! যাবার কি কোন জায়গা আছে ! কি সুন্দর, নিজেকে এই চৌরাস্তার মোড়ে, দোকানের সামনের এই ফুটপাথটুকুতে সাবলীল থিতু করে নিয়েছিলো! এটুকুও সইলো না!

আজ এই সাত সকালে অকস্মাৎ এ কোন মেঘ জমলো শরতের সতেজ নীল আকাশে! কোন সীমান্তের বৃষ্টি এসে হঠাৎ ভারী করলো সমস্ত বাতাস! কার অধিকারের বীজ এসে বাসা বাঁধলো তার দেহের ভেতর ! কার ! একে একে সবগুলো মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। একের পর এক রাতের চেহারা। একটা-দুটা মুখ এসে অনেকক্ষণ থেমে থাকে চোখের সামনে। চোখ বুঁজে আসে। অকস্মাৎ মনে হয়। কারো না। অস্ফুট চিৎকারে বলতে থাকে। কারো না। আমার অধিকার জন্ম নিবে আমার ভিতর। আমার জীবন বেড়ে উঠবে আমার ভিতর। এখানে কথা বলবে কেউ কোন অধিকারে !

মায়ের মুখটা আবছা ভেসে ওঠে মনের আয়নায়। বন্ধ চোখ দুটোর কোনা থেকে গরম নোনা জল গড়ায় নীচের দিকে। এক হাত খামচে ধরে পেটের ভেতরটা। অন্য হাত কংক্রিটের মতোন শক্ত করে ধরে থাকে ছেঁড়া পাজামায় কোমরের কাছে গোঁজা পুটুলিটা।

সূর্যের আলো ফুটে উঠে গায়ে ছড়াতে শুরু করেছে। কড়কড়ে রোদ গায়ে মেখে, স্থির বসে থাকে। যেনো মহাকাল উপবিষ্ট কোন সময় ভেলার ওপর। হঠাৎ দমকা বাতাস এসে উড়িয়ে নিতে চায় অসহায় হতবিহ্বল মেয়েটাকে।

বছরের প্রথম দিনেই বাতাসটা জানান দিয়ে যায় কালবৈশাখীর আসার খবর। চোখ খুলে মেয়েটা বাড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকায়। যে কোন সময়ে উজ্জ্বল সূর্যটা সম্পূর্ণ ঢাকা পড়বে চলমান মেঘের আড়ালে। তারপর! একসময় নিশ্চয়ই আবার উঁকি দিবে সূর্য। মেয়েটা ভাবে, যদি একটা মেয়ে হয় তাকে সে ডাকবে ‘বৈশাখী’।

[ রচনাকাল ~ পহেলা বৈশাখ ১৪১২ ]

২,২১৩ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “বৈ শা খী”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    গল্পগুলো বড় হয়ে যাওয়ায় এক রকম ভয়ে ভয়েই দ্বিতীয়টা পোস্ট করলাম। কে মনে মনে কিভাবে গালমন্দ করবে জানিনা।
    সময় করে সুযোগমতো পড়ে ডিটেইলে মতামত জানিও। স্বরস্বতী তো দেবী দয়াময়। দাক্ষিণ্য কিছু হয়তো কখনো দিতেও পারেন অকারণেই। মানুষকে কি আদৌ পৌঁছুতে পারলাম ! জানতে উদগ্রীব থাকলাম।
    অবশ্য এটাও অনেক আগের লেখা।

    জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    খুব মনদিয়ে পড়েছি। মাঝে মধ্যে চোখ ভিজে এসেছে। এই ক্লেদাক্ত জীবনের গল্প লেখা সহজ নয়। চমৎকার হয়েছে ছবিটা। শেষ বাক্যটা আরোপিত মনে হয়েছে। এই মেয়ের এতক্ষণের যে ইমেজ দাঁড়িয়েছে তাঁর সাথে ওই অনুভব মনে হয় মেলেনা । ( সম্পূর্ণ আমার ভাবনা) (সম্পাদিত)


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      অনেক ধন্যবাদ সাইদুল ভাই । পড়বার কষ্টটা নেবার জন্য আর সুন্দর মন্তব্যের জন্য ।
      যথার্থ বলেছেন শেষটা নিয়ে । আসলে গল্পটা লেখা একটা লিটল ম্যাগের সে বছরের বৈশাখ সংখ্যার জন্য । হয়তো সে কারণে শেষটায় এসে ওভাবে ইতি টানা ।
      আর একটা মনস্তাত্বিক ব্যাপার অবশ্য ছিলো, ভেতরে যে কয়েকবার এসেছে বৈশাখী মেলার নানান খেলনা পণ্য ও অনুসংগের কথা । সেই সূত্র ধরে নিজ জীবনের অপ্রাপ্তির স্বপ্নাটাকে সন্তানের প্রাপ্তির ভেতর দিয়ে দেখবার যে সহজাত মানবিক মনস্তত্ব, সেটার একটা যৌক্তিকতায়ও এমন ভাবে শেষ করা ।
      তাছাড়া, তাদের জীবনেও বৈশাখ আসে, উদযাপনের স্বপ্ন ভাসে, উল্লাসের বুদবুদ ফোটে । সেই ইতিবাচকতাকে ধরবার চেষ্টা ।
      তবে যথার্থ বলেছেন ।
      আবারো ধন্যবাদ ভাই ।

      জবাব দিন
  3. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    নিরুপদ্রব অবসর বের করে পড়বার কারণে মন্তব্যে বিলম্ব হলো। ভেবেছিলাম অনেক কিছুই লিখব। কিন্তু লিখতে এসে থেমে গেলাম। তবু মূক চৈতন্যের কথকতা একরাশ বিস্ময়-ভালোলাগা-আবেগ হয়ে সন্ধ্যাকাশের তারার মত ফুটে রইল। মিলনের ও মিলন পরবর্তী আবেশের বর্ণনাও কত শৈল্পিক হতে পারে তা আবারো নোতুন করে অনুভব করলাম। সেই সাথে লেখকের মহৎ ও দরদী মনের পরিচয়টাও শব্দে-বাক্যে-বোধনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। পরিপাটি শব্দবুননের কথা, বাক্যের মিহিন সেলাইয়ের কথা, অন্তর্গত গূঢ় দর্শনের কথা না হয় বাদই দিলাম। এক কথায় বলতে পারি রচনাটি বেদনার শিশিরে সিক্ত একটি ক্লেদজ কুসুম যেন! প্রত্যাশার ঘ্রাণ তার গায়ে লেগে আছে।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "বুকের বাগান" - ফুলেল কাব্য!
    "হাতের ভেতর আবির্ভূত নোটটাকে অনেক দীর্ঘ মনে হয়" - হ্যাঁ, এরকমই মনে হয়। সঠিক পর্যবেক্ষণ।
    "মেয়েটা ভাবে, যদি একটা মেয়ে হয় তাকে সে ডাকবে ‘বৈশাখী’" - শেষ কথাটা চমৎকার!

    জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    লুৎফুল ভাই,
    বুঝিয়ে না বলতে পারলে মার্জনা করবেন।
    লেখাটি আরো সময় নিয়ে পড়তে চাই বলে কিছু বলা হয়ে উঠছেনা। সপ্তাহের মধ্যে সময়ও হয়ে ওঠেনা সে তো জানেনই।
    ফের পড়তে গিয়ে দেখলাম কাহিনী শেষ করার আগেই খলবল করে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। নন্দন পথের পুরোটাতেই যে শেষের লক্ষ্যেই চলতে হবে এমন দিব্যি কে দিয়েছে বলুন! তাই একটু থেমে গিয়ে মুগ্ধতা রেখে গেলাম। শেষ করে কিছু বলবার জন্যে ফিরবো তো বটেই।

    জবাব দিন
  6. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    ভাষা নিয়ে কিছু বলার নাই- তোমার কলমের স্পর্শে পাথরে ফুল ফোটে। গল্পের প্লট সাধারন, কিন্তু মন ছুঁয়ে যায়। হঠাৎ যেন মানিকের প্রাগৈতিহাসিক গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল।

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      মগবাজারে ছিলাম দশ বছর। তখন মগবাজার চৌরাস্তার মোড়ে এক ভিখারিণীকে দেখতাম প্রতিদিন মগবাজার থেকে বেরুতে বা ফিরতে। ওটাও একটা জীবন রোদে জলে পথের মাঝখানে।
      ঐ দেখাকে ঘিরে গল্পটা কল্পণায় সাজানো। আমাদের চারপাশের দেখা আর চেনা কথাই।

      জবাব দিন
  7. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    কবিদের হাতের গদ্যে এই এক সমস্যা, গদ্যের চাছা ছোলা রুক্ষতা ছাপিয়ে ভর করে কাব্যময় আবেশ।
    অবশ্য সেটা যে খারাপ কিছ, তা বলছি না।
    বললাম সেটা একটা ভিন্নতা।
    আর মাঝেমাঝে এই ভিন্নতা পেতে মন্দ লাগে না...

    একটা অবজারভেশন।
    কোন কোন অনুচ্ছেদ বেশ বড় হয়ে গেছে।
    বেশী বড় অনুচ্ছেদ চোখের শান্তি কেড়ে নেয়।
    চোখের শান্তির জন্য ভেঙ্গে দেয়া গেলে ভাল হয়।

    গল্প চেনাজানা হলেও তা বর্নন ফাটাফাটি। মোটেও চেনাজানা ছকে পড়ে না।
    পাঠসুখের রেশটা যে দীর্ঘক্ষন সাথে থাকবে, এটা নিশ্চিত......


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      ভালো কথা। কাব্যিক ছাপ থাকে মন্তব্যটা অনেক আগে থেকেই সেটে আছে আমার লেখার গায়ে। সেই দেড় যুগ আগে মিটুন ভাই (আনিসুল হক) এই মন্তব্য করেছিলেন। আরো কয়েকজনও করেছেন। সেই সাথে বেশ কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক মন্তব্যও ছিলো।
      তবে অনুচ্ছেদ এর ব্যাপারটা বলাতে উপকৃত হলাম। যদিও এখানে কোথাও একাধিক অয়ারা মিলে যেতেও পারে। তা দেখতে হবে এবং ভবিষ্যতে এটা মাথায় রাখতে হবে।
      অনেক ধন্যবাদ বন্ধু।

      জবাব দিন
  8. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    কোনপ্রকার দ্বিধা না রেখে বলি - অন্যতম সেরা একটি গল্প পড়লাম। শেষে এসে যেন আর নিতে পারছিলাম না।
    এমন নান্দনিক নির্মমতা! এমন গল্প লিখতে গিয়ে লেখক নিজে কত কতবার ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যান তাই ভাবি।
    আমার কাছে বর্নণার কোথাও কিছু বাড়তি মনে হয়নি। জীবনের এ যাপনকে আপনি দেখেছেন -- দেখাতে পেরেছেন।

    পথের ওপর পথচলতি মানুষের পায়ের কাছে যার চোখ মন দেহ পড়ে থাকে তার কাছে মানুষের রূপ তো ভিন্ন হবেই। সেই কৌণিক অবস্থাণের বয়ান দেখে আমাদের সৌখিন হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়।

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      তোমার মন্তব্যে অপার ঋদ্ধ মনে হচ্ছে ।
      এতোটা পেরেছি কিনা জানিনা ।
      তবু এমন মন্তব্য সপ্তমাকাশে তুলে দিচ্ছে নিশ্চিত ।
      অন্য লেখা নিয়ে এতে উতকন্ঠা বাড়লো ।
      সর্বোপরি মন্তব্যশৈলীর মুগ্ধতা দায় বাড়ালো অধমের কলমের ।
      :boss: :boss:

      জবাব দিন
  9. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    গল্প পড়ছি না কবিতা? বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগছিল। তোমার গদ্যে কাব্যের মিশ্রণটা অদ্ভূত। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে পড়তে পড়তে এগুলাম।

    বিষয় পুরনো। শেষদিকে পড়তে পড়তে একটু মনোযোগ ছিন্ন হয়। কিন্তু এতো অসাধারণ নির্মাণ! শব্দের বুননে কি মমতায় তুমি পুরনোকে নতুন করে সেলাই করেছো! অনেক ধন্যবাদ আর শুভকামনা।

    একটা বিষয়, গল্পটা পড়তে পড়তে আমার কেন জানি, মগবাজার চৌরাস্তার তাজ হোটেলের ফুটপাত আর চারপাশটাই চোখে ভাসছিল।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      অপার ধন্যবাদ সানাউল্লাহ ভাই।
      এটা লিখেছিলাম ২০০৫ সালে।
      তবে প্রেক্ষাপটটা ১৯৯৫ থেকে ২০০২ এর।
      যেভাবে লেখা সেভাবেই এখানে দেয়া। পুরোনো সফট কপি হারিয়ে ফেলায় নতুন করে কম্পোজ করা হয়েছে।
      গদ্যে কাব্যের মিশ্রণটা কতোটা ভালো আর কতোটা মন্দ তার ওপর কয়েক লাইন আরো শুনতে পেলে অনেক বেশী ভালো লাগতো।
      আবারো ধন্যবাদ ভাই।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।