কোয়াড্রোলজি ~ পর্ব ১ | আমরা যদি না জাগি মা . . .

স্কুলছাত্র মুনীরের গায়ে আগুন, লেগুনায় আগুনে ছয় জন অগ্নিদগ্ধ, ককটেল আক্রান্ত চলন্ত মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে, সিএনজিতে আগুন চালক অগ্নিদগ্ধ, শাহবাগে বাসে পেট্রল বোমা ঊনিশ জন ঢাকা মেডিক্যাল বার্ণ ইউনিটে, বাসে অগ্নিদগ্ধ যুবকের মৃত্যু । এ যেনো ছোটোবেলার অবিরাম গল্প বলা প্রতিযোগিতার মতন এক বিরামহীন রুপকথার কুরুক্ষেত্র ।

ত্যাগের মহিমায় বাঙ্গালীর ইতিহাস অনেক গৌরবের । পৃথিবীর বুকে অনন্য । সময়ের প্রয়োজন ও সামাজিক বিবর্তন দেশে দেশে এমন ত্যাগের প্রয়োজন হাজির করেছে, মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে । আমরা অন্য কোন কোন ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় কতোটা এগিয়ে আছি তা নিয়ে বলবার কিছু খুঁজে না পেলেও এটা নিশ্চিত বলা যায় – দেশ ও জাতির জন্য ত্যাগের তালিকায় আমরা স্বীকৃতভাবেই অনেক এগিয়ে আছি । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তারই প্রত্যয়ন ।

সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত; আসাদ; মতিউর রহমান, হামিদুর রাহমান, মুনশী আব্দুর রউফ, মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ রুহুল আমিন, নূর মোহাম্মদ শেখ ও জানা অজানা ত্রিশ লক্ষ শহীদ । বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরে এমন প্রতিটি মৃত্যু ছিল মহিমাহ্নিত ইতিহাসের এক একটি অধ্যায় । পরিবার পরিজনদের জন্য বিয়োগ বেদনা ছাপিয়ে ত্যগের, মর্যাদার ও অহঙ্কারের । নূর হোসেন-এর আত্মত্যাগে যে গণতন্ত্রের মুক্তির আহবান ছিল স্পর্ধায় উচ্চারিত, তার স্বপ্ন যেনো আঁটকে গেছে ইতিহাসের শেষ সোনালী পাতায় । আমরা কেউই বোধ হয় জানতে পারিনি গণতন্ত্র কবে কোথায় কিভাবে মুখ থুবরে পড়েছে ।

ত্যাগের ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করতেই সম্ভবত মিছিলে প্রিয় শ্লোগান ছিলো – “রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়” সেই বন্যা থামেনি অন্যায়ও থামেনি; “দিয়েছিতো রক্ত, আরো দেবো রক্ত” … কিন্তু এভাবে অকারণে ! আজকে ককটেল, পেট্রল বোমা, আগন্তুক গুলি, গান পাঊডার, নাঙ্গা তলোয়ার অকস্মাত ছিনিয়ে নেবে প্রাণ ! কেন ? গণতন্ত্রের পরিশুদ্ধির নামে সামাজিক বিবর্তনের দোহাই আর অগ্রগতির ভাঁওতা দিয়ে !

এক পক্ষ বলবে বিরোধী দলের হঠকারী রাজনীতীর ফসল এসব মৃত্যু । অন্য পক্ষ বলবে সাধারণের ছল্মবেশে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা বিরোধী দলের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবার জন্য এসব ঘটাচ্ছে । কোনটা সত্যি তা জানে কজন ! কিন্তু এটুকু সবাই জানে, যে মানুষটা মারা যাচ্ছে তার জীবনে যে রাজনীতী দুই পয়সার ভূমিকা রাখতে পারেনি, মৃত্যুতে রেখেছে শতভাগ ।

দীর্ঘ সময় ধরে মনে হচ্ছিল গোটা দেশটাই বুঝি মরফিনে বুঁদ হয়ে আছে । … “চকচকে ব্লেডে দাঁড়ি কামাচ্ছি” অনায়াসে নিত্য অকারণ লাশ নামাচ্ছি … । রাজনীতী যে মানুষটার এক বেলা অন্ন জোটাবার ক্ষমতা রাখে না, আর রাখে না বলে তাকে ঝর-বৃষ্টি-বন্যা-খরা নিত্য দিন রুটি-রুজির সন্ধানে বাইরে বেরুতেই হয় – এই যে খেটে খাওয়া কর্মজীবী মানুষের লাশের মিছিল, আর আমাদের নির্বিকার দেখে যাওয়া ! কেন ! কি অর্জন দেবে আমাদের এবছর ৩২৮ দিনের সহিংসতায় ৩৪৮ মৃত্যু ! এমন অনাকাঙ্খিত প্রাণের অপচয় কেন, কোন পথে, ছিনিয়ে নিচ্ছে আমাদের চেনা অচেনা নিরীহ মানুষ ? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ সবচেয়ে বেশী জরুরী । রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা নিজেদের ঘি-মাখন, চেয়ার-গদি ভাগাভাগির মারামারিতে সকাল বিকাল মারা যাক – দেশের মানুষ তাতে আজ বিচলিত নয় । কিন্তু সাধারণ মানুষ যেভাবে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রহসনে বলির পাঁঠা হচ্ছে, তাতে তারা আজ যার পর নাই বিহবল, ক্ষুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত । কেবল সময়ের অপেক্ষা এই সব আবেগ ও ক্ষোভ সংঘবদ্ধ এবং বিস্ফোরণের জন্য আরো বেগবান হবার । একথা নিশ্চিত যে, পরিণতি সকল কর্মের সুনিশ্চিত গন্তব্য । ইতিহাস তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর ।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টির সমান বয়সী । এর জন্য পক্ষ বিপক্ষের বাইরে তৃতীয় পক্ষ কখনো কদাচিত অহেতুক বলি হতে পারে, নিত্য দিন নয় । কখনো কদাচিত যা হয়, তা ভুল কিংবা দুর্ঘটনা । আর নিত্য দিন যখন এমন ঘটে তখন তার পেছনে থাকতে হয় পরিকল্পনা । যদি কেউ দাবী করেই যে, পরিকল্পনা নয় । তবে অনস্বীকার্য এর জন্য দায়ী চর্চিত প্রকৃয়া, দীর্ঘমেয়াদী প্রকৃয়া। মানুষ মরেছে তবে এমন অকাতরে সাধারণ মানুষ এরকম অনাহুত মরেনি এর আগে । কিন্তু এখন মরছে । কারণ নিশ্চত রাজনীতী এখন মানুষ করে না, যারা করে তারা মানুষের আদলে অমানুষ ছাড়া অন্য কিছু নয় । মানুষের চাইতে বরং প্রবহমান একটা প্রকৃয়াই এ অনভিপ্রেতের জন্য দায়ী । তবে হ্যাঁ, এই প্রকৃয়া ভিন গ্রহ থেকে কেউ এসে ললাটে এঁকে দিয়ে যায়নি, বিবেক বর্জিত মানুষেরাই এর নির্মাতা ।

গত তিন দশক ধরে জামাত ছাড়া এদশের একটি রাজনৈতিক দলও কোনো ধরনের সাংগঠনিক প্রকৃয়া চর্চায় রাখেনি । রাখেনি বলেই ষোলো কোটি মানুষের দেশে প্রধান দুই নেতা অবরুদ্ধ হলে একজন বেকুব সমর্থকও তাঁদের জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি, কিংবা পথে নামেনি গত নির্বাচনের আগের সময়টাতে । যদি তাঁবেদার, পেটোয়া শান্ত্রী, চাটুকার আর ফায়দার ভাগীদার ও সহায়ক বাদে সত্যিকারের রাজনীতী ও মতাদর্শের অনুসারী তৈরী করবার সাংগঠনিক প্রকৃয়া চর্চা করতো তবে একজন মূর্খ হলেও কাঁদতো নেতৃত্বের প্রতি সহমর্মিতায় পথে নামতো । পাশাপাশি আজকের রাজনীতীতে পঞ্চাশ-একশো টাকায় সহিংসতা বিপননের জন্য ভাড়া হওয়া কিংবা ভাড়া করবার মতন মানুষ থাকতো না ।

পুরোনো প্রবাদ আছে, ‘যে দেশে প্রজা যেমন রাজাও তেমনি হবেন’ । আমরা সাধারণ মানুষই মূলত অন্য অর্থে এই সবকিছুর জন্য দায়ী । কারণ আমাদের সব ভোটারদের নব্বুই ভাগের বেশী মানুষ প্রতিটি নির্বাচনের আগে যথাযথ সঠিক বিশ্লেষণে চিহ্নিত করি কোন প্রার্থীটি সৎ, ভালো, যোগ্য; আর কোন প্রার্থীটি মুর্খ, অসত, সন্ত্রাসী, খুনী । আমরা আড্ডায় সঠিক বিচারের আলাপচারিতায় চায়ের কাপে ঝড় তুলি নিযুত বার । কিন্তু ভোটের দিন কেন্দ্রে গিয়ে ইউইনিং টিমের পার্ট হতে চাই এবং সততা আর যোগ্যতায় তালিকার সবচেয়ে নীচের নাম দুটার যে কোনো একটায় নির্বিচার ভাবে দিয়ে আসি নিজের মূল্যবান ভোট টা । কখনো ভেবে দেখি না এর ফলে আড়াই লাখ ভোটের মধ্যে পৌঁণে দুই লাখ ভোট পাইয়ে দিয়ে যে ভুল লোককে নির্বাচিত করলাম । এতে করে তার নির্বিচার সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আর অপরাধপ্রবণ মনোবাঞ্চাকে কতোটা অনুপ্রাণিত করলাম, কতোটা অনুমোদন দিলাম, কতোটা শক্তিশালী করলাম ! একটুও ধারণা রাখি না এ ভুল ভোটাধিকার প্রয়োগ যে বাস্তবিক ভাবে আমার সুখ, শান্তি, সামাজিক স্থিরতা, নিরাপত্তাকে কতোটা বিপন্ন করছে । নির্বাচিত হবার পর মুহুর্ত থেকেই সে আমাকে কতোটা নগন্য কীট ভাবছে । আমাদের এই নির্বোধ আচরণ যত দিন না পাল্টাবে, কোনো আলাদীনের চেরাগ কিংবা ঐশ্বরিক অলৌকিক কিছুই আমাদের দুর্ভোগের ইতি টানতে পারবে না ।

বিপরীতে আমরা যদি আমাদের নিত্য দিনের বিচারে বিবেচিত ভালো মানুষ আর সৎ মানুষটাকেই আমাদের ভোটের রায় দিয়ে আসতাম তবে এই ভুল লোকটি দৈবক্রমে জিতে গেলেও জিততো পঞ্চাশ হাজারের বদলে মাত্র পাঁচ ভোটে । আর তাতে জেতার পর থেকেই আমার মতোন একজন নিরীহ ভোটারকে আবর্জনার মতন মুল্যহীন বেকুব ভাবার দুঃসাহসী ঔদ্ধত্ত্ব সে দেখাতে পারতো না । পরবর্তী নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে মানুষকে খেলার পুতুল মনে না করে মানুষ মনে করতে বাধ্য হতো । এর সামগ্রিক প্রেক্ষিত সামাজিক ভাবে পঞ্চাশ-একশো টাকায় সহিসতা ঘটাবার মতোন সুলভ মানুষের সহজলভ্যতায় একটা বড় বাধা হিসেবে কাজ করতো । সেই সাথে জবাবদিহিতার ভয় কিংবা পরবর্তী নির্বাচনে খেসারত দেবার শঙ্কা ইন্ধনদাতা আর অপকর্মের উদ্যোক্তাকেও থামিয়ে রাখতো ।

ভাবতে অবাক লাগে আজকে পক্ষ বিপক্ষ যেমন নির্বিচারে একে অন্যকে দোষ দেবার মিউজিক্যাল চেয়ার খেলছেন রাজনীতির নামে – সেই রাজনীতিটা কার ! মানুষের নাকি দানবের ! মানুষের সহায় ও সমৃদ্ধির জন্য রাজনীতি নয়, রাজনীতির জন্য মানুষকে বলি হতে হয় ! এই বিচিত্র সেলুকাস দৃশ্যপট পাল্টাবার কাজটা করতে হলে তা করতে হবে আমাদের দেশের আপামর সাধারণ ভোটার মানুষকেই । দীর্ঘদিন ধরে এদেশের মানুষ যে তৃতীয় শক্তির সন্ধান করছে তা যে তার মুঠোবন্দী হয়েই এতোকাল পড়ে আছে এই অজানা তথ্যটা প্রতিটা মানুষের কানে পৌছে দেয়া সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী ।

আমাদের যেনো একের পর এক জুটছে হয় মাতাল ড্রাইভার, নয়তো অপ্রকৃতস্থ, নাহয় পথ ও গন্তব্য না চেনা কোনো অর্বাচীন । এটা ওই গাড়ীর মানুষগুলোর চেয়ে বেশী জানবে বা বুঝবে কে ? এই ভুল চালক বদলাবে কে ? আমরা কি সেটা নিয়ে ভাববো বা কিছু করবো ! নাকি অপঘাতের অপেক্ষায় আরো একটু ঘুমাবো ! এখনো কি আমরা বুঝে উঠিনি পরের রাতটাই হয়তো হবে আমার ভাই, বোন, পিতা, মাতা, সন্তান এদের কারো লাশের পাশে শুয়ে ঘুমানোর রাত !

৩০ নভেম্বর ২০১৩
সংকট সংক্ষুদ্ধ বিনিদ্র রাতের দেশ – বাংলাদেশ ।

[ কোয়াড্রোলজির প্রথম পর্ব ]

১,৭৫৪ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “কোয়াড্রোলজি ~ পর্ব ১ | আমরা যদি না জাগি মা . . .”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    আপোসহীন। বড় বিচিত্র এদেশের রাজনীতি। জনকল্যাণ এখানে মুখ্য নয়, মোক্ষ লাভের একটি উপলক্ষ মাত্র। ক্ষমতাসীন হবার জন্য জনপ্রিয়তা বড় কোনো নিয়ামক নয়, যিনি জনতাকে যতবেশি ব্যবহার করতে পারেন তিনিই সরকারে গিয়ে সর খান।
    এই সর খাওয়ার রাজনীতি থেকে উত্তরণ চাই
    তোমার লেখাটা প্রাণে ধরেছে


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।