জামার পকেটে কিছু পোলাও এবং ভাঁজের ভেতর চোরকাঁটা

শাড়ীকে আমি বলি খুব উত্তেজক পোষাক। আপনি একমত হবেন কি হবেন না তা একান্ত আপনার ইচ্ছা- অনিচ্ছার স্বাধীনতা। তার, আপনার, উনার, সবার এতে সহমত কিংবা দ্বিমত যাই হোক, আমার দৃষ্টিতে সালোয়ার-কামিজ শাড়ীর চেয়ে অনেক শালীন পোষাক। পুরোটা শরীর অনেক ভালো মতোন ঢেকে থাকে এতে শাড়ীর চেয়ে। আপনি হয়তো এবার আনতে পারেন ওড়নার প্রসংগ। ওটা থাকলো কি থাকলো না, থাকলে কোথায় কি ঢং-এ থাকলো।

ধরুন শার্ট-প্যান্ট এর কথাই। পুরোটা শরীর ঢাকে না এতে ভালো? শাড়ীর চেয়ে ঢের ভালো ঢেকে থাকে বলেইতো মনে হয়। তাই না! শাড়ীতে যদি শরীরের বিশ থেকে পঁয়ত্রিশ শতাংশ কেবল সাদামাটা নয় সংবেদনশীল অংশ দৃষ্টিগোচরতায় উদার থাকে। শার্টে কিন্তু পাঁচ ভাগও উন্মুক্ততায় উদার থাকে না।

এবার হয়তো বলবেন মুম্বাই ফিল্মী কায়দায় যা সব কাট আর কেতা সালোয়ার-কামিজে দেখা যায় আজকাল! তাছাড়া শার্টের কোথায় কয়টা প্লিট-স্লিট, প্যান্ট কি পরিমাণ আঁটোসাটো! শালীনতাকে আপনি কিছুতেই তর্কের ছুরির নীচ থেকে সরতে দেবেন না। তর্ক করলে সেটা নির্ঘাত চলতেই থাকবে। আসল কথাটা তাহলে কি? যে কথায় এসে থামতে পারে এই তর্ক-বিতর্ক!

আমি যে শাড়ী নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলাম, উত্তেজক বললাম। শরীরটাকে যথাযথ আগলে আড়াল করতে না পারার জন্য। সেটা যদি ফিল্মী কিংবা অধুনা মডেলিং-এর নানা বিতর্কিত ঢংগী কায়দায় পরিধান করা হয়! তাহলে তো আরো সেরেছে! সমাজের সব রক্ষাকর্তারা মাঠে ঘাটে কথার ঝালে আগুন ঝরাবে নিশ্চয়।

অথচ সবচেয়ে জ্বলজ্বলে সত্যি হলো এই যে, আমার মা-খালা, নানী-দাদী সবাইকে আমি এই শাড়ীই পরতে দেখেছি। সেটা কি আদৌ আমার চোখে উত্তেজক অশালীন লেগেছিলো কোনোদিন! লাগেনি নিশ্চয়। আমারও যেমন, তেমনি আপনারও। ঠিক কিনা!

যে দেশে থামি, যে দেশে কাঁচুলি, যে দেশে ঘাগড়া, যেখানে স্কার্ট-টপস, প্যান্ট-গেঞ্জী কিংবা যে যুগে বাকল, পাতা, উদাম শরীর সে রকম কোনো দেশে কী কোনো কালেই মা-খালা, নানী-দাদী, বোন-ভাবী কাউকে দেখে একটুও খারাপ কিছু মনে হয়নি কারো। এটা অনেকটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

তাহলে! রীতি ভাংগাটাই সমস্যার শিকড়! সূতিকাগার! আরে, এই সবের সম্পূর্ণ অসুরটুকু আসলে কেবলি মানুষের মনে। দৃষ্টিভংগীতে। কু-চিন্তা এবং কু-দৃষ্টিতে।

আজকাল কিছু ছেলে-পুলে যেভাবে পশ্চাতদেশের ভাঁজ দেখিয়ে সুপারম্যানের ফ্যাশন মশকরায় মেতে আছে! তারা কি আদৌ জানে তাদের ওই ফ্যাশনের শিকড় সূত্র কোথায় প্রোথিত! জানলে আর বুঝলে নির্ঘাত তারা যারপরনাই লজ্জা পেতো। তেমনি মিনি-শর্ট ফ্যাশনে বিশ্বাসী এদেশের মেয়েরা কেউ থেকে থাকলে ওরাও পেতো লজ্জা।

নিজ ঐতিহ্য আর কৃষ্টিকে চেনাবার মতোন শিক্ষা এবং প্রতিপালন যদি পেতো আমাদের সন্তানেরা তাহলে তাদের পরিধানের ভীমরতি তেমন করে পেয়ে বসার কোনো সুযোগই হতো না। এর পাশাপাশি কে কেমন পোষাক পরলো তা নিয়ে কদাকার ভাবনা এবং অভিরুচিও তাদের কোনকালে হতো না। নিজেকে চেনাবার আর ভালোবাসবার মন্ত্রটাই আমাদের সন্তানকে শেখাতে ব্যর্থ আমরা।

পোষাকের তো কোনো ধরা বাঁধা প্রেসকিপশন থাকতে পারে না। ফুটবল আর ক্রিকেটের যেমন এক পোষাকে চলবে না । সাইকেল-গাড়ী-প্লেন-জাহাজ চালানো, কল কারখানায় মেশিন চালানো, দোকানে বাজারে কেনা-কাটা করা, নামাজ পড়া, স্কুলে-কলেজ যাওয়া, অফিস আদালতে কাজ করা ; এমন সব ক্ষেত্রে একই রকম পোষাকের প্রয়োজন আছে এমন কোনো দাবী উত্থাপনের কোনো যুক্তি নাই। বরং বাস্তবতার নিরিখে এমন ভিন্ন প্রেক্ষিত ভিন্ন পোষাকের প্রয়োজনটুকুই দাবী করে।

আমরা খাই নিজের জিভের তৃপ্তির জন্য। কখনোই অন্যের তৃপ্তির জন্য নয়। আবার পরিধান করি অন্যের মুগ্ধতা অর্জনের জন্য। এটা সার্বজনীন সত্য। সেই অন্যটি কে। প্রথমে আমার প্রিয়জন। যাদের ভালো লাগা আমাদের আপ্লুত করে বেশী। তারপর আমাকে যারা যারা দেখবে, জানবে। অর্থাৎ আমাদের প্রতিবেশ, আমাদের সমাজ। চীন দেশে গিয়ে হিব্রু আর নিকারাগুয়ায় যদি আমি চীনা ভাষায় কথা বলতে চাই। বিপত্তি অনিবার্য। আর তাতে দোষটি ভাষার নয়। যে ভুল করলো তার। তেমনিভাবে ভুল পরিধানে দোষটি পোষাকের নয়। যে ভুল পোষাক নির্বাচন করলো তার। এখন তার জন্য কি তার ওই কাপড়টুকুন খুলে নিতে হবে! অমন করতে চাইলে কিংবা করবার কথা কেউ ভাবলে বৈকল্যটি সেই করনেওয়ালা আর ভাবনেওয়ালার। তবে সবচেয়ে বড় সত্য হলো এই দ্বিতীয় দলের এরাও সবাই এই সমাজেরই কেউ।

তাই আমাদের ঘৃণা আর প্রতিরোধটাকে হতে হবে অপরাধের বিরুদ্ধে। অপরাধীর বিরুদ্ধে নয়। নৈতিক বৈকল্যের বিপরীতে সমাজের গতিকে সঞ্চালিত করতে হলে আমাদের সবাইকেই ভব্যতা সভ্যতাকে আপন কৃষ্টি সৌকর্যে সাজিয়ে, তাকে প্রদীপের আলোর কাছে পৌছে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা ও জ্ঞানের হাপড়ে গড়ে পিটে নিতে হবে ইস্পাতের মতোন।

কারণ সবচেয়ে বড় সত্য এই, যে পোষাকের দোহাই দিয়ে অশালীন বলে অঙ্গুলি নির্দেশ করবে! কিংবা সেই ইচ্ছার গলায় শিকল – হাতে হাতকড়া পরানোর উছিলায় আমার সন্তানকে অপমানিত করার মতোন কদর্য মানসিকতার পরিচয় দিবে। এই অদ্ভুতুড়ে মানুষগুলো কারা! এরা সবাই আমাদেরই ভাই কিংবা সন্তান। তাই দোষটা যতোটা তাদের, ততোটাই আমাদের । আমরা যারা ওদের বড় করে তুলছি, সেই আমাদের। প্রত্যেকের।

মনীষীর কথা ধরে বলবো কি! আরে ভাই পোষাকেই তো পরিচয়! আর জামার পকেটে উপহারের পোলাও-বিরিয়ানী ভরবো। যুগটা এখন আর সেখানে থেমে নেই। এখন বৈশ্বিক সংযোগ ও সম্পৃক্ততায় মেধা-চিন্তা-চেতনার প্রভেদ রাষ্ট্রের সীমানা ডিংগিয়ে বিলীন হবার পথ ধরে হাঁটছে। ভৌগলিক সীমারেখায় তা আর আঁটকে নেই।

আর যে চোরকাঁটা আমাকে অনবধানে হুল ফুটিয়ে দিয়ে যাবে তাকে আমি জামা-কাপরের ভাঁজে নির্বিবাদ বহাল তবিয়তে থাকতে দিবো। এমন সব ভাবনা নিঃসন্দেহে চিন্তা-চেতনার বৈকল্যের ছবি ছাড়া অন্য কিছু আঁকে না।

নিজ সন্তানকে দিয়েই তাই শুরু হতে হবে এর প্রতিকার। এছাড়া অন্য কোনো নির্মূল ঔষধি এর নাই। আমাদের প্রতিদিনের চর্চায় ও চলনে যতদিন না প্রতিটি ঘরে হবে এ দীক্ষার ক্লাস, প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায়, প্রতিটি শহরে…..ততোদিন নিগৃহীত হবে আমারই সন্তান। আর যে করবে সেই লজ্জার কাজটি তাকে ওটা লজ্জা বলে না চেনাবার দায়। সেটাও আমাদেরই।

পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এগুলোতো কোনো অলৌকিক রিমোট কন্ট্রোলে চলে না। চলে আমাদের ইচ্ছা, চর্চা, সচেতনতা, কী বিকারহীনতার সমন্বয়ে। আমাদের প্রতি দিনের গানে, নাচে, কথায়, আচরণে, ঘরে, বাইরে, রাষ্ট্রযন্ত্রে আমরাই চালকের ভূমিকায়।

যারা নিজ ভাষা ও ভূমির স্বাধীনতার জন্য গোটা পৃথিবীতে একটি অনন্য জাতির পরিচয়ে স্বীকৃত । সেই মুকুটে আমরা চাইলেই পরাতে পারি আরো একটি সোনার পালক। আমার মেয়েটি গ্রীবা উঁচু করে পরে থাকবে আপন কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের নকশা মাখা সাহসী নোলক।

[ ০২ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে লিখেছিলাম একটা ওয়েব পোর্টালের জন্য । সাম্প্রতিক বিবেচনায় দিলাম এখানে । ]

১,৭১৮ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “জামার পকেটে কিছু পোলাও এবং ভাঁজের ভেতর চোরকাঁটা”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    তাহলে! রীতি ভাংগাটাই সমস্যার শিকড়! সূতিকাগার! আরে, এই সবের সম্পূর্ণ অসুরটুকু আসলে কেবলি মানুষের মনে। দৃষ্টিভংগীতে। কু-চিন্তা এবং কু-দৃষ্টিতে

    মুগ্ধ হয়ে পড়লাম


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      সাইদুল ভাই । বিষয়গুলো সত্যিই ভীষণ বিবমিষায় স্থবির করে দেবার মতোন ।
      আমি হয়তো ভাবছি ... নাহ নিজে যে ভুল করেছি আমার মেয়েকে আর ছেলেকে ওই একই ভুলের মাঝে রাখবো না ।
      হয়তো তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেবো । কিন্তু গোটা দেশের মানুষ কি তাই করতে পারবে !
      আর উচ্চ শিক্ষা বা উন্নততর / আরো সম্ভাবনাময় পেশায় সম্পৃক্ততার কারণে মানুষ দেশ ছেড়ে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় যাবে । সেটা একটা স্বাভাবিক প্রকৃয়া । কিন্তু এইসব অনাচার, অনিশ্চয়তা যদি হয় কারণ, তবে সেটাতো চোরের ভয়ে মাটিতে ভাত খাবার মতোন স্বেচ্ছা পরাজয় । ওটা যে গ্লানিকর কোনো কিছুর চেয়েও নির্মম !!!

      আপনার মুগদ্ধতায় প্রীত ও দায়বদ্ধ হলাম ।

      জবাব দিন
  2. আহমদ (৮৮-৯৪)

    অনেক মার্জিত ভাষায় লেখা। বেশ গ্রহনযোগ্য করে এক্সপ্রেশন্স দেয়া হয়েছে। ভাল লাগল লেখটা। তার চেয়েও ভাল লেগেছে লেখার স্টাইলটা।


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।