শিমুলের ফেব্রুয়ারী

এই গল্পটা আমার মায়ের লেখা… যখন আমার মায়ের বয়স ঠিক আমার এখনকার সমান…তাই অনেকদিন পর খুঁজে পেয়ে মনে হোল, ব্লগে দিয়েই দেখিনা!

পড়ার টেবিলে মিছেই সময় নষ্ট হতে থাকে।পড়া আর হয়না শিমুলের।
কেন বার বার ফিরে আসে ঐ অলক্ষুণে ফেব্রুয়ারী?ভীষণ রাগ হয় তার নিজের উপরেই।ভাবে, যদি পারতাম ক্যালেন্ডার থেকে ঐ মাসটাকে একেবারে মুছে ফেলতে…নিজের উপরে রাগ ক্রমশঃ বেড়েই চলে তার। ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে ওঠে ওর মুখ। কেন এমন হলো?ওর বেলাতেই কেন বিধির এ অনিয়ম? কি করেছিল আম্মু ওদের?কেন ওরা আম্মুকে ধরে নিয়ে গেল?আম্মু তো বলেছিলো আমায় ছেড়ে কোথাও যাবেনা?আম্মু মিথ্যে বলেছিল?
না না আম্মু মিথ্যে বলতেই পারেনা! কিছুতেই না।
তাহলে আম্মু ফিরে আসেনা কেন?পর মুহুর্তেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা শিমুল। অঝোর ধারা হয়ে নেমে আসে ওর কষ্টগুলো।
ও জানে – ভালোই জানে…আম্মু আর কখনোই ফিরে আসবেনা।আম্মু তো মিশে গেছে এদেশের ধূলিকণার সাথে। ঐ তো বাতাসের সাথে মিশে কি যেন বলে উঠলো ফিসফিসিয়ে।আম্মু তুমি অমন করে বলো কেন?স্পষ্ট করে বলো! আমি যে তোমার কথা শোনার জন্যে প্রতি মুহুর্তে ব্যাকুল হয়ে থাকি!
আম্মু তুমি ওদের বলে দাও ওরা যেন আর না আসে আমার কাছে-প্লিজ।
প্রতিটা ফেব্রুয়ারী আসতে না আসতেই ওরা সবাই শিমুলকে নিয়ে সেকি ব্যস্ত হয়ে পড়ে।ওদের কারো সাথে আলোচনা সভায় যোগ দিতে হবে কিংবা হতে হবে কোন প্রভাত ফেরীর অগ্রপথিক।
এবার শিমুল আগে থেকেই ভেবে রেখেছে ও কোথাও যাচ্ছেনা।যতই আসুক অনুরোধ।
আজ বিকেলে এসেছিলো ঢাকা ভার্সিটির একটি দল ওকে রিজার্ভ করতে।শিমুলের
উপর নাকি ওদের দাবী আছে কারণ ওর আম্মু তো ওখানেই পড়তেন।এমন একজন আত্মত্যাগি মহিলার একমাত্র সন্তানকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করিয়ে জনগনের মনকে আবেগে আপ্লুত করতে পারাটাও একটা বিরাট কৃতিত্বের কাজ।শিমুলকে তাই যেতেই হবে।
শিমুলের এতটাই রাগ হলো যে ও তাদের সামনে পর্যন্ত গেলনা।
বলে পাঠালো দেখাও করতে পারবেনা।ওর আব্বু ফেরেননি।তাই ওরা আবার কাল আসবে বলে আজকের মত উঠলো।
শিমুলের খুব কান্না পাচ্ছে।আম্মু কেন তুমি অমন করে চলে গেলে?কেন?সবাই বলে আমার মা বীরাঙ্গনা।এদেশের মাটি যাদের রক্তে কঠিন হয়েছে, শক্ত হয়েছে তাতে যে আমার মার ও রক্ত রয়েছে।কিন্তু এতে আমার কি লাভ হলো বলতে পার আম্মু? কি লাভ হলো?
রাহাত আজ কি বলে গেল তা কি শুনেছ আম্মু?
ওর বাবা আমার মা এর এই আত্মত্যাগের জন্যে গর্বিত কিন্তু সমাজ বলেতো একটা কথা রয়েছে। কেমন করে তিনি লোকের কাছে বলবেন তার ছেলে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে যার মা কে একাত্তরে পাকবাহিনীর ট্রাক তুলে নিয়ে গিয়েছিল আরও অসংখ্য অসহায় মেয়েদের সাথে। যাকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায় নি।
মা মনি ওরা বলে অনেকের মত তুমিও এই পৃথিবীর উপর অভিমান করে সরে গেছ।কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হয়না।
মাগো- তুমিই বলোনা ওরা মিথ্যে বলছে। এমন যদি হত মাগো হঠাৎ তুমি এসে ওদের সবাইকে মিথ্যুক প্রমানিত করে আমার গোপন আশাটাকে সত্যে রূপান্তরিত করে দাও…।
তাহলে কি হোত তা আমি কেমন করে বোঝাই।রাহাতের বাবাকে বলতে পারতাম মা আমার হারিয়ে যায়নি। আর যখন রাহাত ছুটে এসে বলতো “শিমুল, এখন আমাদের মধ্যে আর কোন বাধা নেই” – আমি বলতাম- অমন কাপুরুষকে আমি ঘৃনা করি।
কিন্তু মাগো তা কেন হবার নয়- কেন হবেনা?
পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন? সেকি শুধু আমার বেলাতেই?
আমি যে আম্মু রাহাতকে খুব ভালোবাসি। ওকে ঘিরেই যে আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলাম। মা গো এ তুমি কেন করলে? আমি তো কোন বীর মাতার কন্যা হয়ে অবহেলিত জীবন যাপন করতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সাধারন,স্বচ্ছন্দ একটি জীবন।
শিমুলের বাবা সবই বোঝেন।এই মাসটা এলেই শিমুল অন্য মানুষ হয়ে যায়। কত অনুরোধ করেছেন সবাইকে। তবুও ওরা আসবেই। শিমুল রাজি না হলেও ওরা তো তাকে ছাড়তে পারেনা। শত হলেও সে একজন বীরাঙ্গনার সন্তান। তাই শিমুল রাজি না হলেও ওরা বারবার ফিরে আসে। ঠিক যেমন করে ফেব্রুয়ারি মাসটিও বারাবার ফিরে আসে।

১,৭০৭ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “শিমুলের ফেব্রুয়ারী”

  1. লুবজানা (২০০৫-২০১১)

    আমার ইচ্ছা ছিল একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে নিজেই কিছু লিখব। কিন্তু মা'র লেখাতা পেয়ে ভাবলাম এটাই ভাল হবে। আমার সাধ্য নাই এর চেয়ে ভাল কিছু করার!


    নিজে যেমন, নিজেকে তেমনি ভালবাসি!!!

    জবাব দিন
  2. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    আন্টিকে :boss:
    একটা ছোট্ট ব্যাপার। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কি আসলেই পাকিস্তানিরা এরকম করা শুরু করেছিল? আমার মনে হয় মাসটা ফেব্রুয়ারি না হয়ে অন্য মাস হলে ভাল হত। অথবা এটা কি কোন সত্য কাহিনী থেকে লেখা? তাহলে অবশ্য অন্য কথা।
    লুবজানা নিজেও লেখ কিছু। আন্টিকে ধন্যবাদ পৌঁছে দিও।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মিশেল (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।