বিকেল আকাশটাও লাল

এক.
পথে একটি অদ্ভুত ব্যাপার কদিন ধরে খেয়াল করলাম। সকালে প্রথম যে বাসটিতে উঠি সেন্ট লওরেন্ট বুলেভার্ড থেকে সেটিতে নিয়মিত একটি বাদামী তরুণ কানে হেডফোন লাগিয়ে খুব মগ্ন হয়ে গান শোনে। সকালে যখন বের হই সাড়ে আটটা বা পনে নটায় বেশিরভাগ দিনেই সেই ছেলেটি থাকে বাসে। আমার বাসার আগের কোন একটি বাসস্টপ থেকে হয়তো ওঠে। ছেলেটির এবং আমার বাসে বসার স্থান প্রায় নিদ্রিষ্ট থাকে। বাসের পিছনের দিকে। ছেলেটি গান শোনে এবং বই পড়ে। ছেলেটির বেশ একটি সহজ ভাব অনায়াশে চোখে পড়ে। তার মাথায় একটি স্ন্যাপব্যাক হ্যাট। হার্ডম্যান নামের এক স্টেশনে নেমে বাস পাল্টানোর সময়টুকু যখন অপেক্ষা করি সেখানে একজন ছিপছিপে তরুণীও ‘ফোর ডাউনটাউন’ বাসের জন্য অপেক্ষা করে। দেখে মনে হয় হয়তো হিস্পানিক ধাঁচের। আবার নাও হতে পারে। চোখে সানগ্লাস। পরণে সেমি লং স্কার্ট। কোঁকড়া চুল। তীক্ষ্ণ সপ্রতীভ। তরুনীটি আসে শহরের দক্ষিন দিক থেকে। অন্য ছেলেটি এবং আমি আসি শহরের পূর্ব দিক থেকে।

সপ্তাহে অন্তত দু’তিন দিন সকালে এই দুটি মানুষের সাথে প্রায় নিয়ম করে দেখা হয। বেশ ক’মাস ধরে। হয়তো পুরো গ্রীষ্ম ধরেই ব্যাপারটি ঘটছে। কারো কখনো কোন কথা হয় না। তিনজনই জানি আমরা সেখানে আছি। কিন্তু তিনজনই নৈবত্তিক আত্মমগ্ন নীরবতায় নিজের মাঝে ডুব দিয়ে থাকি। অজানা কারণে একই সময়ে একই স্টেশনে একই বাসের জন্য অপেক্ষা করার পরও তিনজন বিচ্ছিন্ন তিনটি দ্বীপ। তিনটি মানুষ প্রায় ব্যতিক্রম ছাড়াই একজন অপরজন থেকে একটা ডায়াগোনাল অবস্থানে অপেক্ষমান। আশপাশে আরো অপেক্ষমান মানুষ থাকে। কোন কোন দিন বাস আসতে দেরি থাকলে তরুনীটি বেঞ্চে বসে পড়ে। বাসের ড্রাইভারও বেশিরভাগ দিনে সেসময়ে একই মানুষ। একজন বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। চোখে তার সানগ্লাস। সানগ্লাসের উপরে চশমা পরা। হাতে ছোট একটি চিপসের প্যাকেট। এবং সেটা সবসময়ই লাল রংঙের প্যাকেটের ডোরিটোস ন্যাঁচো চিজ চিপস। ড্রাইভার সেটা খেতে খেতেই বাসে যাত্রীদের এক এক করে সম্ভাষণ জানায়।

বাসে নিয়ম করে তরুণীটি প্রথমে ওঠে। তারপর সে বাসের মাঝামাঝি একটি জায়গায় বসে। ছেলেটি এবং আমার বাসে ওটা আগে পরে হয়। আমাদের বসার জায়গা পিছনে নিদ্রিষ্ট। বাস যখন স্মাইথ নামের একটি স্টপেজে থামে, সেখানে একজন ত্রিশোর্ধ শ্বেতাঙ্গ মহিলা তার দুটি শিশু সন্তান নিয়ে বাসে ওঠেন স্ট্রলারসহ। সম্ভবত দুটিই ছেলে। বড়ছেলেটি হয়তো মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। তাদেরকে সুন্দর পরিপাটি করে মাথায় হ্যাট পরিয়ে আনা হয় পিছনে ছোট ব্যাকপ্যাকসহ। বড় ছেলেটি কিছু দেখলে, “মামি লুক …” বলে কিছু একটা দেখায়। তাদের মা ছোট আয়না হাতে চোখে মাশকারা লাগানো বা কিছু একটা করতে করতে কিংবা টেক্সটিং করতে করতে তার প্রশ্নের ব্যস্ত ঝটপট উত্তর দেয়। প্রথমে বাস থেকে নেমে যায় তরুণীটি একটি সরকারি অফিসের সামনে। তারপর সানিসাইড নামের একটি জায়গার স্কুলের কাছে নামে শিশুসহ মহিলাটি। বাসটির গন্তব্যের মাঝামাঝি একটি জায়গায় নামি সেই ছেলেটি এবং আমি। এগুলো ঘটে প্রায়শই ব্যতিক্রম ছাড়া। তখন কখনো কখনো ক্ষনিকের জন্য ভ্রম বলে মনে হয়। সত্যিই বাসে যাচ্ছি তো। এই মানুষগুলোও কি আমার সাথে যাচ্ছে। নাকি সবটাই কল্পনা। একই ঘটনা একইভাবে ঘটে চলছে দিনের পর দিন। কখনো নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি আজ যা যা ঘটছে, এটা কি আগে কখনো ঘটেছে।

দুই.
পূর্ব কানাডায় গ্রীষ্ম বহু বছরের মধ্যে এবার সাংঘাতিক চরমভাবাপন্ন। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতহীন দীর্ঘসময় এবং গত কয়েক দশকের দীর্ঘতম খরায় জর্জরিত গ্রাম এবং শহরগুলো। অন্টারিওতে অবস্থা বেশ খারাপ। বস্তুতঃ সমগ্র উত্তর আমেরিকাতে এবার চরমভাবাপন্ন গ্রীষ্ম। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে চলা এই খরা এবং বৃষ্টিহীনতা একদিককার বিস্তীর্ন ফসলের মাঠগুলোকে ধূলিধূসর প্রান্তর বানিয়ে ফেলেছে। তাই এই বছরটি পূর্ব কানাডার জন্য সবথেকে র্দুভাগ্যের বছর গন্য করছে মানুষ। অন্য বছরগুলোতে এসময়টা থাকে চারদিকে সবুজ আর সবুজ। মাঠের পর মাঠ, মাইলের পর মাইল শুধুই সবুজ ক্যানভাস। কিন্তু এবছর এখনই সব ঘাস মরে গিয়ে ধূসর দেখাচ্ছে। গাছের পাতাও বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। যেটা সাধারণত হয় ফল সিজন শেষ হবার পর অক্টোবর বা নভেম্বর মাস পেরোলে।

শোনা যাচ্ছিল, ২০০৭ সালের খাদ্য সংকট এবং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত কানাডা বেশ ভালভাবেই মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু এতো কিছুর পরও শেষ রক্ষা হয়নি। তাই নতুন কৌশল এবছর দৃশ্যমান হয়েছে – তা হলো সরকারী ব্যয় সংকোচন। কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের আকার ছোট করে ফেলা। সরকারী আমলা এবং অন্যান্য পেশাজীবিদের অবসর দিয়ে তারা কৃচ্ছতা সাধন করছে। তাই সবমিলে ২০১২ হলো স্থানীয়দের ভাষায় “ভেরি ব্যাড ইয়ার” কারণ কৃচ্ছতাসাধন, চাকরি ছাঁটাই এবং খরায় কৃষিতে দুরাবস্তা। আঘাতটা ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়নেই প্রবল। এদেশের মানুষের জন্য সবকিছুরই একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকে। তাই যাদের চাকরি চলে যাচ্ছে বা যাবে এই আশংকায় দিনাতিপাত করছে এবং এই খাড়ার উপর মরার ঘা যারা সহ্য করতে পারছে না তারা হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সাইকোলজিক্যাল থেরাপিস্টদের শরণাপন্ন হচ্ছে কিভাবে এই মানুষিক চাপ সহ্য করবে তার কৌশল শিখতে।

কৃষকদের উদ্ধারের জন্য কানাডার সরকার খরা-অনাবৃ্ষ্টি মোকাবিলায় অন্টারিওতে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঘোষনা করেছে। নানারকম প্যাকেজ হাতে নিয়েছে। কৃষকদের জন্য আমেরিকার বর্ডার খুলে দিয়েছে। তারা চাইলে সরাসরি তাদের কৃষিপন্য আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। কৃষকদের সরাসরি অর্থ সহায়তার প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সাহায়্যের হাত পেতেছে। কিন্তু বহু কৃষক তবু সন্দিহান কারণ আমলাতান্ত্রিকতার লালফিতে পেরিয়ে যখন সে সাহায্য তাদের হাতে পৌছাবে তখন ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এবং তাদের দৃঢ় আশংকা সে অর্থ সহায়তা ক্ষতির তুলনায় খুবই নগন্য হবে। এদিককার কৃষকরা সাধারণত কযেকশত একর বা তারও বেশি কৃষিজমি একটি পরিবারই চাষ করে। তাই যখন ক্ষতি হয় তখন তার আকারও অনেক বড়। কৃষকদের বেশিরভাগেরই কৃষি বীমা ছিল কিন্তু এবছরের দূর্যোগ এত দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে যে বীমা কোম্পানিগুলো চুক্তির ফাঁকফোঁকড় বের করে ক্ষতিপূরণ দিতে যাচ্ছে অনেক কেটেছেঁটে।

কারো হয় সর্বনাশ আর কারো তখন পৌষমাস। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার জন্য টর্নেডোর সংখ্যা এবার কানাডাতে অন্য যেকোন বছরের চেয়ে রেকর্ডসংখ্যক বেশি। ঝড়ের সংখ্যা বহুগুন বেড়ে গিয়েছে এবার সমগ্র উত্তর আমেরিকা জুড়ে। কানাডা এবং আমেরিকার আবহাওয়া অধিদপ্তরগুলো বেশ কাজের এবং এরা আগে থাকতেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস খুব ভালমতো দিয়ে থাকে। তাই কোথায় কখন কি মাত্রার টর্নেডো হবে তার সংবাদ আগভাগেই পাওয়া যায়। এই দেশে একদল মানুষ আছে যারা এই টর্নেডো চেস করে বেড়ায় ক্যামেরা হাতে। এরা টর্নেডোর ছবি তোলে এবং ভিডিও ধারণ করে। এবার তাদের পোয়াবারো বছর বলা যায়। ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এরা শতশত মাইল গাড়ি চালিয়ে বেড়ায় উত্তর আমেরিকা জুড়ে টর্নেডো দেখার জন্য। টর্নেডো চেসাদের মতে এবছর হচ্ছে চেসিংয়ের জন্য সেরা বছর।

টর্নেডো চেসিং জনপ্রিয়তা পায় মূলতঃ ডিসকাভারি চ্যানেলের দুটি অনুষ্ঠান “টর্নেডো চেসার এবং “টুইস্টার” যখন থেকে দেখানো শুরু হয়। তবে এই নেশাটা এদিকের মানুষের বেশ পুরোনো। এখন টর্নেডো চেসিং কিছু মানুষের পূর্নকালীন পেশা। যখন সবমানুষ শেল্টারে যায় তারা তখন বাইরে থাকে। জিপিএস দিয়ে ঠিকঠাক টর্নেডোর অবস্থান দেখে নিয়ে টর্নেডোর শক্তিশালী কেন্দ্র কুন্ডলীর পিছন পিছন বিশেষ গাড়িতে ছুটতে থাকে। এরা এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশ টর্নেডোর পিছন পিছন ছুটে চলে। কোথাও টর্নেডো এর্মাজেন্সি এলার্ট সিস্টেম চালু হলে এই টর্নেডো চেসারের দল প্রয়োজনে প্লেনে পৌছে যায় সেই শহরে বা গ্রামে। কানাডার প্রেইরি (তৃণভূমি) অঞ্চলে এবার প্রায় ৪২টি টর্নেডো আঘাত হেনেছে, যার প্রায় ৩২টি শুধু স্যাস্কাটচ্যুয়ানে। এই গ্রীষ্ম টর্নেডো চেসারদের জন্য খুবই ব্যস্ত সময়। কত সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব সখ যে মানুষের জীবনে থাকে!

তিন.
স্নাতক শ্রেনীতে পড়ি সেই সময়। এক বন্ধুর বাসা ছিল ইস্কাটন গার্ডেনে। নিয়মিত তাদের বাসায় যাতায়াত। পরিবাবের সবাই চেনা। বন্ধুদের কোন এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয় মারা গিয়েছেন যিনি একজন লেখক বা সাংবাদিক হবেন হয়তো। নামটি ঠিক মনে নেই। বন্ধুর মা আমার সাথে কথা বলছেন। চাচীর মন খারাপ। কথায় কথায় বললেন, দেখবা বয়স যত বাড়বে দোয়া চাওয়ার মানুষরা সব হারিয়ে যাবে। মাথার উপর ছায়া থাকবে না। বিশ-একুশ বছর বয়সে যা হয়, এসব কথা তেমন মনে রেখাপাত করেনা। আমারও তখন করেনি। এতদিন পর একটু একটু কথাটা ধরছে। আমরা যখন বড় হবার জন্য দিনগুনি তখন নিজের অজান্তে কাছের এবং দূরের কিছু মানুষ নানাভাবে জীবনে এক একটি পিলারের মত দাড়িয়ে যায়, অস্তিত্ত্বের অংশ হয়ে। হয়তো অনেকটাই এটা ঘটে নিজের অজান্তে। একসময়ে চারপাশের পরিচিত পৃথিবী থেকে এক এক করে এই প্রিয় মানুষগুলো খসে পড়ে এক পার্থিব শূন্যতায় রেখে। হয়তো তখন স্মৃতিবাহী প্রাণী হিসেবে উপলব্ধি করি প্রিয় মানুষটির যে ছায়া আমাকে ঘিরে থাকতো তা হয়তো হারিয়ে গেলো। সেই শূন্যতা খুব খুব গভীর সেটাই হয়তো চাচী সেদিন দোয়া করার মানুষ হারানো বলতে বুঝিয়েছিলেন। মানুষের হারিয়ে যাওয়া যত ক্ষতই তৈরি করুক মনে, দুঃখ কাটিয়ে ঠিকই আবার তাড়াতাড়ি জীবনের ব্যস্ততায় ডুব দিই। তবে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা আর পূরণ হয় না। কারণ এই শূন্যতাগুলো দিয়েই আমাদের জীবনের গল্প লেখা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যেতাম শামসুল ওয়ারেস স্যারের কথা শুনতে। পুরো সময়টা স্যার এমন যাদুমন্ত্র দিয়ে মুগ্ধ করে রাখতেন গল্পে গল্পে সময়টা যে ভাষায় বলার না। নাহলে কার এতো সময় আছে তখন বিংশ শতকের চিত্রকলার ধারা কি ছিলো তা শোনার। স্যার বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। একদিন শামসুল ওয়ারেস স্যারের থেকে জানলাম ভালভাবে স্থপতি শিক্ষক মাজহারূল ইসলামের কথা। এবং তাকে চিনলাম। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবার জন্য যে একগাদা নৈবত্তিক প্রশ্ন পড়তে হয়। সম্ভবত সেখানে পড়েছিলাম স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নাম। কিন্তু নৈবত্তিক প্রশ্নোত্তর সবাই যেমন গুলে খায় এবং তারপর ভুলে যায়, আমারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওয়ারেস স্যার চেনালেন এই সেই ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশের সাথে মর্ডান আর্টকে সংযুক্ত করেছেন স্থাপত্য এবং শিল্পকলায়। যিনি না থাকলে হয়তো তাঁর শিক্ষক লুই আই. কান কোনদিন বাংলাদেশে আসতেন না। মাই আর্কিটেক্ট ডকুমেন্টরিতে পিতাকে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে খুঁজতে হয়তো কোনদিন কানের ছেলে নাথানাইয়েল বাংলাদেশ পর্যন্ত যেতো না। সারা বিশ্বের স্থাপত্য এবং শিল্পকলার ছাত্ররা হয়তো একটুখানি হলেও কানের সৃষ্টি দিয়ে অন্য বাংলাদেশকে চিনতো না। যতবার রাঙামাটি গিয়েছি, সবসময় কেন যেন শহরটাকে অন্যদেশ মনে হতো। পরে জেনেছিলাম মূল রাঙামাটি শহর কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে যাবার পর স্থপতি মাজহারুল ইসলাম নতুন রাঙামাটির পরিকল্পনা নকশা করে দিয়েছিলেন। মাজহারুল ইসলাম না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা কোনদিন এই আর্টকলেজ হতো না। হয়তো চট্টগ্রাম বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্যাম্পাসটা এতো সুন্দর মনে হতো না। কিংবা হয়তো জীবনের একটা সময় বকুল তলায় কিংবা লাইব্রেরির আড্ডাগুলো মাজহারুল ইসলামের আলো, ছায়া এবং স্পেসের খেলায় মেতে থাকতো না।

তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। রাজশাহীতে গিয়েছি বেড়াতে। সেখানে পড়লাম দারুচিনি দ্বীপ। তখন যে কোন বই পড়লে সেই বইয়ের একটি চরিত্র নিজেকে মনে করতাম। সেই চরিত্রের আনন্দে আমার নির্মল ভাললাগা কাজ করতো, আর দুঃখে আমি ভীষণ দুঃখিত হতাম। সেই বইটা পড়তে পড়তে মনে হলো আমি শুভ্র। বড় হয়ে কাঁনাবাবার মতো হতে হবে। মনেমনে ঠিক করে ফেললাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার চোখ খারাপ হোক। তাহলে চশমা পরতে পারবো। কারণ শুভ্র চশমা পরতো। আমি জানিনা তখনো সেন্টমার্টিন কি? শুভ্র যেতে পারুক আর না পারুক আমি জানতাম একদিন আমার সেই দ্বারুচিনি দ্বীপে বন্ধুদের সাথে যেতে হবে। সত্যিই একদিন গেলামও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শেষ বর্ষে। তখন আমি চশমা পরি। আমি শুভ্র না, ততোদিনে আমি শুধু আমি হয়েই গেলাম সেই দ্বীপে। অবহেলায় পড়ে ছিল তখন সমুদ্র বিলাস। সেন্টমার্টিনবাসী হুমায়ূন আহমেদকে ততোদিনে অবাঞ্চিত ঘোষনা করেছেন দ্বীপে। অযত্নে সমুদ্রবিলাসের দরজার কোথাও কোথাও ভেঙে পড়েছে। সেখানে দেখতে গিয়ে সমুদ্রবিলাসের ঘরের দেয়ালে মানুষ অমুক যোগ তমুক লিখে রেখেছে। বইটি না পড়লে হয়তো দারুচিনি দ্বীপ যাওয়া কোনদিন এতো অর্থপূর্ন হতো না। চেনা গন্ডিতে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কে আমাদের মধ্যবিত্ত কৈশোর এবং তারুণ্যকে এতো কাঁনায় কাঁনায় ছোট ছোট অনুভূতিতে ভরে দিতে পেরেছে। এক এক করে আমি কি কোনদিন পরিচিত হতাম মিসির আলী, হিমু, সাহানা, পরী, খাদক বজলু, বাকের ভাই কিংবা নান্দাইলের ইউনুসের মতো চরিত্রের সাথে! কৈশোর এবং তারুণ্য স্মৃতি হয়তো একদিন ধূসর হবে কিন্তু অনন্তকাল হুমায়ূন আহমেদ থাকবেন প্রিয় লেখক হয়ে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে সবার মনে।

১,২৯১ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “বিকেল আকাশটাও লাল”

    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ব্যাপারটা তেমন কিছু না। এখন যে কারণে তিনি নিন্দিত সেই একই কারণ। দ্বীপের স্থানীয় মানুষরা বেশ কট্টর। তারা সিদ্ধান্ত নিসিলো যে হুমায়ূনকে আর সেন্ট মার্টিনে ঢুকতে দিবে না। যাতে দ্বীপটা অপবিত্র না হয়। তাই এই ঘোষনা দিসিলো।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      সবই ভ্রান্ত ধারমা!

      তোমাদের ডিপার্টমেন্টে আমার দুই বন্ধু পড়তো। একজন ডিগ্রী শেষ করতে পারছে, আরেকজন শেষ করতে পারে নাই। যে শেষ করতে পারে নাই সে বেশি মেধাবী। অনেক গেছি এবং আড্ডা পিটাইছি।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শুরু হতে না হতেই ফুরিয়ে যাওয়া -এই হচ্ছে স্বাদু গদ্যের লক্ষণ।
    ক্রিসপি, ইফোর্টলেস।

    লেখালেখি কমে গেছে কি তোমার?

    উত্তর আমেরিকায় এসেছি দু'বছর পার হয়ে গেলেও একে অনুভব করতে পারিনা আমি সেভাবে।আমার মাথায় এখনো বাংলাদেশের বর্ষা, রিকশা, মাছের বাজার আর আড্ডা ঘোরে - মাঝেমাঝে অসহনীয় মনে হয়।

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। আগের চেয়ে সময় কম। আলসেমিও একটা কারণ। এখন পড়তে বেশি ভাল লাগে। তবে খেয়াল করলে দেখবেন সব কমুউনিটি ব্লগেই এখন কিছুটা ভাঁটার টান।

      দেশের বর্ষা, কদম, জারুল, রিকশা, আড্ডা আমাকেও ভীষণ টানে। এটা অনিবার্য। কিন্তু যে জায়গাটায় এখন আছি সেটাও জানার একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।