দেশে ফেরার গল্প – দুই

দেশে ফেরার গল্প – এক

চ.
লন্ডন-কুয়েত ফ্লাইট কিছুটা দেরি করায় কুয়েতে স্টপওভার পেলাম মাত্র এক ঘন্টার। তবে কোন সমস্যা হয়নি কারণ একটি গেইট দিয়ে নেমে কুয়েত এয়ারলাইনসের ঢাকা ফ্লাইট ছিল কাছাকাছি আরেক গেইটে। কুয়েত এয়ারপোর্টের ঢাকা ফ্লাইটের আশেপাশে পরিবেশ খুবই অন্যরকম। স্মোকিং রুমের একশো গজের মধ্যে টেকা দায়। ধূমপায়ী-অধূমপায়ী সবার জন্য। স্মোকিং রুম ছাড়াও এয়ারপোর্টের যত্রতত্র মানুষজন বিড়ি ফুঁকছে। বাথরুম ছাপিয়ে পানি ছলাৎ ছলাৎ টার্মিনালের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। দুই বাংলাদেশি ভাই সেই পানি টার্মিনালে আসতে না দেবার অসাধ্য সাধন করে চলেছেন। অসংখ্য বাংলাদেশি শ্রমিক। সবাই দেশে ফেরার অপেক্ষায়। কেউ বৈধ। কেউবা অবৈধ। সবই কাগজের খেলা। যারা দেশের বাইরে থাকেন তাদের কাছে “কাগজ” শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ন। যাদের কাগজ নেই তারা অবৈধ। তাদেরকে ডিপোর্ট করা হচ্ছে দেশে। কাগজ থাকুক বা না থাকুক সবার মাঝে সেকি টান টান উত্তেজনা! কুয়েতে এয়ারপোর্টের ঢাকা ফ্লাইটের আশেপাশে এয়ারকন্ডিশনিং সম্ভবত কাজ করে না। মরুর তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছিল বেশ। তার মাঝেই দেখলাম বেশ কিছু যাত্রী উইন্টার স্যুট-টাই লাগিয়ে দিব্যি দাড়িয়ে আছেন। তারা অবশ্য শ্রমিক নন। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, বাহরাইন, কাতার এবং এবার কুয়েত দেখলাম। সব এয়ারপোর্টে বাংলাদেশি ফ্লাইটের গেইটের আশেপাশে কমবেশি একই চিত্র। মধ্যপ্রাচ্যে পৌছলে অনুভব করা যায় দেশের কাছাকাছি।

ছ.
ফ্লাইটের জন্য লম্বা কিউতে দাড়ানো। আমার সাথে সাথে আগের ফ্লাইটে পরিচয় আজরা আপা এবং তার ছেলে আছেন। ঠিক আমার কয়েকজন সামনে দেখি এক শ্যামাঙ্গিনী। বাকি যাত্রীদের চেয়ে বেশ অন্যরকম। এক দেখাতেই চোখে পড়ার মতো অন্যদের চেয়ে বৈসাদৃশ্যের কারণে। বালিকা বয়সের চেয়ে যথাসম্ভব অধিক ভারিক্কি মুখে ফুটিয়ে যাত্রীদের লম্বা সারিতে দাড়িয়ে। তারপর পুলসিরাতের মতো লম্বা লাইনের সিকিউরিটি চেইকের জন্য বেল্ট, জুতা খোলা এবং ল্যাপটপ বের করার হাঙ্গামায় সেই বালিকা কোথায় গেল আর বেশি খেয়াল করা হয়নি।

ফ্লাইটে উঠছি সারিবদ্ধ লাইন দিয়ে। আমি বরাবর একটু দেরি করে ফ্লাইটে উঠি। যথাযথ সিট নম্বরের দিকে এগোতে থাকলাম। আমার সামনে এক হুজুর। পিছনে আমি। একটু দূর থেকেই আমি আমার সিট নম্বর খেয়াল করলাম। আমার সিটের ঠিক পিছনের সারির সিটে সেই বালিকা। বালিকা উদ্বেগ উৎকন্ঠা সহযোগে প্রতিটি যাত্রীকে একবার যাচাই করে নিচ্ছে যে কে তার পাশে বসতে যাচ্ছে। সব জল্পনা-কল্পনা ভ্রান্ত হয়ে হুজুরই তার পাশের সিটে গিয়ে বসলেন।

মেয়েটি একটি ফুলস্লিভ সামার শার্ট এবং জিনস পরা। তো হুজুর মেয়েটির পোশাক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক প্রথম থেকেই ডাইরেক্ট এ্যাকশনে চলে গেলেন।
হুজুর কোনরকম ভব্যতা ছাড়াই কর্কশ কন্ঠে, কি ঈমান-আমল এসব কিছু পালন করা হয়?
মেয়েটি – জ্বী, স্যরি আমাকে কিছু বলছেন?
হুজুর – মুসলমান নাকি অন্য ধর্মাবলম্বী?
মেয়েটি – জ্বী, মুসলমান।
হুজুর – মুসলমান ঘরের মেয়ে ঈমান-আমল বোঝে না। এইটে কেমন কথা!
মেয়েটি চুপচাপ।

ফ্লাইটের এয়ারকন্ডিশনিংও মনে হয় কাজ করছে না। সব যাত্রী দরদর করে ঘামছে মধ্যপ্রাচ্যের তীব্র গরমে। ততোধীক তীব্র উৎকট ঘামের গন্ধ এয়ারক্রাফটময়। এমনকি কেবিন ক্রুরাও সবাই ঘেমে প্রায় গোসল করে ফেলছেন। যেন পুরো এয়ারক্রাফট হলো হাবিয়া দোজখ। আমার সারিতে দুই সিট পরে এক স্যুট-টাই পরা ভাইকে দেখলাম কেবিনক্রু যখন সবাইকে বার বার করে নিজের সিটে বসতে বলছে। সে উঠে এক দৌড়ে কেবিনের সামনে রাখা দৈনিক হেরাল্ড, গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, মিরর সহ আরো দু’একটি কাগজ খপ করে নিয়ে সিটে বসে পড়লেন। এরপর পত্রিকাগুলোর নাম পড়ে বা শুধু চোখ বুলিয়ে সামনে সিটের পিছনে র্যাকস্যাকে ঢুকিয়ে রাখলেন। এবং তার দশ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পড়লেন। তারপর রাস্তায় অনেকবার জাগলেও কাগজগুলো আর ধরে দেখলেন না। ইংরেজি কাগজগুলো আনার কি মানে আমি আজও ভেবে কোন কূলকিনারা করতে পারলাম না। আর আনবেনই যখন ওখান থেকে দুইটা আরবি কাগজও এনে ঢুকিয়ে রাখতে পারতেন। সেটাইবা কেন করলেন না বুঝলাম না।

আমার পাশের সিটের সহযাত্রী রবিউল ইসলাম। গত আঠারো বছর ধরে বিভিন্নভাবে শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে আছেন। পরিচিত হলাম আমরা একে অন্যের সাথে। রবিউল ভাই এবারই প্রথম কাগজ সাথে নিয়ে দেশে যাচ্ছেন। একদম সহজসরল কেরানীগঞ্জের একজন প্রবাসী শ্রমিক। কাগজসহ দেশে ফেরা যে কত বড় একটা ব্যাপার সেটি আমাকে বুঝিয়ে বললেন। কারণ এর আগে আঠারো বছরে মাত্র ৪/৫ বার দেশে গিয়েছেন। আগের প্রতিবার ছিল কাগজ ছাড়া দেশে ফেরা। মানে অবৈধভাবে থাকার দায়ে কুয়েত পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। হাজত খেঁটেছেন। তারপর এক কাপড়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ব্যাপারটা কত অপমানের এবং কষ্টের সেটি একমাত্র রবিউল ভাইয়ের মতো মানুষরাই বোঝেন। হাতে কোন অর্থকড়ি থাকে না। কোন ব্যাগ না, কিচ্ছু না। প্রবাসের সামান্য সহায়সম্বলটুকুও গোছানোর সুযোগ থাকে না। তখন এয়ারপোর্টে নেমে সহযাত্রীদের কাছে হাতপেতে টাকা চেয়ে বাড়ী পৌছাতে হয়। আবার এই মানুষগুলোই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখে। এমন কি যখন মন্দায় সমগ্র পশ্চিমা দেশগুলোও সংকটে তখনও তারা ঠিকই দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে জীবনপাত করেন। আমার হটাৎ আবার পিছন সিটের কথায় কান আটকে গেল।

হুজুর আবার – কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
মেয়েটি – জ্বী, ল্যান্ডন।
হুজুর – লন্ডন দ্যাশে কি নামাজ-কালাম পড়া হয় না?
মেয়েটি – জ্বী, হয়। [বালিকা যতোটা সংক্ষিপ্তভাবে সম্ভব উত্তর দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে]
হুজুর – এই মেয়ে, তুমি কি নামাজ পড়ো? [হুজুর রেডি পিক্যাপে ভাববাচ্য থেকে ‘তুমি’তে চলে গেলেন মেয়েটির সাথে]
মেয়েটি – জ্বী, চেষ্টা করি।
হুজুর – চেষ্টা করি মানে কি? ধর্মকর্ম জানো কিছু?
মেয়েটি – জ্বী, মানে সবসময় পাঁচ ওয়াকত পড়া সম্ভব হয় না। আব্বু-আম্মু দেশে থাকতে যতোটুকু শিখিয়েছেন ততোটুকু জানি।
হুজুর – তুমি ওই দ্যাশে কি কর্তেছো?
মেয়েটি – পড়াশুনা করছি।
হুজুর – কোথায়? কি পড়ো তুমি?
মেয়েটি – এলএসইতে একোনোমিকস থার্ড ইয়ার করছি।
হুজুর – পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নামাজ পড়তে সমস্যা কি?
মেয়েটি – জ্বী, স্কুলে থাকলে বা বাসাতে তো আযান বোঝা যায় না ওখানে।
হুজুর – আরে বলো কি? আযানের তো সফটওয়্যার আছে। কম্পুউটারে চালায় দিয়া থুইয়া দিলে অটোমেটিক আযান দিবো। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।

[এরপর হুজুর ইচ্ছাশক্তির উপর আরবিতে কিকি যেন বলে সেগুলোর বাংলা তরজমা করে দিচ্ছিলেন সেগুলি আমার মনে নাই]
মেয়েটি তখন চুপ।

হুজুর আবারো – লন্ডন দ্যাশে কি ভাষায় কথা বলে?
মেয়েটি – জ্বী, ইংরেজি।
হুজুর – বাংলা চলে না?
মেয়েটি – জ্বী, বাঙালিদের ভেতর চলে।
হুজুর – কোরিয়ান, চায়নিজ, আরবি এগুলান চলে না?
মেয়েটি – জ্বী, না।
হুজুর – এই মেয়ে তোমার নামটা কি?
মেয়েটি – জ্বী, শেহরীন। [আমার নামটি মনে নেই। তবে এই ধরণের কিছু একটা যার অর্থ ‘সুন্দর ফুল’]
হুজুর – শেহরীন অর্থ কি?
মেয়েটি – সুন্দর ফুল।
হুজুর – বাহ! তোমার আব্বায় তো তোমার জন্য সুন্দর একটা নাম রাখছে।
হুজুর মোটামুটি মেয়েটিকে যতোভাবে ত্যক্তবিরক্ত করা যায় সারা পথ তার সবরকম উপায় ঝালিয়ে নিলেন। মেয়েটি সারাপথ তার অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিল। হুজুরের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর যথাযথ সম্মানপূর্বক দিয়ে চললো।

জ.
আমার পাশের সিটের সহযাত্রী রবিউল ভাইয়ের এবার বাড়ি ফেরা একদম অন্যরকম। এবার কুয়েত সরকার বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে যারা অবৈধ শ্রমিক তাদের একটি সুযোগ দিয়েছে। তিনি এবার বৈধ কাগজে দেশে ফিরছেন। তিনি একটি নির্মানাধীন বাড়িতে দারোযান ছিলেন। কুয়েতে একটি বাড়ী বানাতে সাধারনত ৪/৫ বছর লেগে যায়। এই লম্বা সময় তিনি সেখানে ছিলেন দারোয়ান হিসেবে। একটিবারের জন্যও দেশে আসেননি। যা রোজগার করেছেন দেশে বাড়িতে তার পরিবারের জন্য পাঠিয়েছেন। দুই সন্তানের একজন অষ্টম শ্রেনীতে এবং অন্যজন তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। একলক্ষ টাকার উপর বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করেছেন। তাকে নিতে এয়ারপোর্টে তার স্ত্রীসন্তানরা আসবেন। তার মালিকও খুব ভাল ছিল। মালিকের স্ত্রী তার পরিবারের জন্য অনেককিছু নিজে কিনেকেটে দিয়েছেন। প্লেন ছাড়ার আগে মালিকের স্ত্রী তাকে একবার ফোনে শেষবারের মতো বিদায় জানালেন এবং কোন সমস্যা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। রবিউল ভাই তার সাথে গড়গড় করে আরবিতে কথা বললেন। আঠারো বছরে ভাষাটা ভালোই রপ্ত করে নিয়েছেন। মালিকের স্ত্রীর সাথে প্লেন ছাড়ার আগে কথা হওয়া একেবারেই অভাবনীয়। কল্পনারও অতীত প্রায়। এমন মালিক পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ মালিকই নাকি পশুর মতো ব্যবহার করে শ্রমিকদের সাথে। জানালেন, দেশে কয়েকমাস থেকে তারপর আবার কুয়েত আসবেন। এই আঠারো বছরে গ্রামে কিছু জমি কিনেছেন। ঘরটা ঠিকঠাক করেছেন। কেরানীগঞ্জ সদরে দুটো দোকান কিনেছেন। নিজের অন্য তিনভাইকে কুয়েত এনেছেন। সীমিত সুযোগে অনেক কিছু করেছেন।

রবিউল ভাই একপর্যায়ে জানালেন যে তিনি গতকাল সারাদিন কম্বল গায়ে শুয়ে কাটিয়েছেন। কেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, মরুর অসহনীয় গরমে সারা শরীর জ্বালাপোড়া করে। কষ্টে স্থির থাকা যায় না দিনের তপ্ত গরমে। যারা এমন প্রত্যন্ত মরুতে নির্মানাধীন প্রকল্পে কাজ করে তাদের জন্য কোন এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ঠান্ডা বাতাস পাবার সুযোগ নেই। ফ্যানের বাতাস তখন কারখানার গরম চুল্লির মতো মনে হয়। মানুষটি এতো সাংঘাতিকভাবে সেসব কষ্টের কথা বলছিলেন যে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমরা, আমি বা আমার মতো যারা, তারা আসলে কত বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। রবিউল ভাই কয়েকবার উঠে এয়ারক্রাফটের ওয়াশ রুমে গেলেন। একবার ফিরে এসে বললেন, জানেন ভাই, এতোবার চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রস্রাব হচ্ছে না। পেশাবের পথে জ্বালাপোড়া। ওখানেও এমন হইতো। বললাম, বেশি করে পানি খান। আর দেশে ফিরে ভাল ডাক্তার দেখান। আমাকে বললেন, ডাক্তার লাগবে না। বাড়ির পুকুরে একটা ডুব দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আজকে গিয়া আখের রস খাবো। কয়টা দিন শুধু পানিতে ডুবায় কাটামু। তাইলে সব ঠিক হইয়া যাইবো।

ঝ.
আমি ঘুম, গান শোনা, রবিউল ভাইয়ের সাথে গল্পগুজব করায় অনেকক্ষন হুজুরের প্যাচাল থেকে দূরে ছিলাম। প্লেন তথন ঢাকার কাছাকাছি। এরমধ্যে হুজুর অন্তত গোটা বিশেক বার “ওয়াশরুম টু সিট” করলেন। মেয়েটির সাথে কোন এক অজানা কারণে সিট বদলাবদলিও করে নিলেন। তিনি ইউন্ডো সিটে চলে গেলেন। কিছুক্ষন পরপর গলা খ্যাকারি দেন। কেবিন ক্রুরা খাবার নিয়ে আসলে উনি যতোটা সম্ভব পারেন ঝামেলা করার চেষ্টা করে চলেন। খাবার যে পরিবেশন করা হচ্ছে সেগুলো হালাল কিনা ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন। কেবিন ক্রুরাও হাজার হাজার যাত্রী হ্যান্ডেল করে করে এমন সিদ্ধহস্ত যে এমন দু’চারটা হুজুর হ্যা্ন্ডেল করা হয়তো এক তুড়ির ব্যাপার। তাই হুজুর এদের সাথে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না।

হুজুর মেয়েটিকে অনেক বিষয়ে কথার মাঝে এক পর্যায়ে তিনি যে একজন ব্লগার সে পরিচয় দিয়ে ফেললেন। এটা শোনার সাথে সাথে আমার উৎসুক্য আরো বহুগুন বেড়ে গেল পিছের সিটের কথোপকথনে। মেয়েটিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন – লন্ডনে তোমার কম্পুটার আছে?
মেয়েটি – জ্বী, আছে।
হুজুর – আমি তো কম্পুটারে বলোগ [ব্লগ] লিখি। ইসলামিক বলোগ। আমার বলোগ পইড়া মুসলমান হইছে আমিরিকা, ইউরোপ, লন্ডন, জাপান, কোরিয়া, এশিয়া … মেলা দেশের বহু মানুষ আমার বলোগ পইড়া ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হইছে। তুমি লন্ডন থাইকাই আমার বলোগ পড়তে পারবা।

এই পর্যায়ে হুজুরের ‘বলোগ’ সাইটটার ঠিকানা জানার আমার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যাত্রাপথের শান্তির কথা বিবেচনা করে চেপে গিয়েছিলাম। হুজুর বলোগে নিয়মিত ইসলামিক গল্প লিখেন শুধু এটুকু শুনেই সব কৌতুহল সংবরণ করে নিয়েছিলাম।

ঞ.
প্লেন ঢাকার প্রায় কাছাকাছি। ল্যান্ড করছে। হুজুর মাঝখানের সময়ে খানাপিনা, প্রস্রাব-পায়খানা, ঘুম ইত্যকার জাগতিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মেয়েটি কিছুটা কর্মহীন হয়ে পড়েছিল। প্লেন ল্যান্ড করার আগে দিয়ে হুজুর মেয়েটিকে আবার বললেন – দ্যাশে থাকবা কতদিন?
মেয়েটি – জ্বী, সম্পুর্ন সামার থাকবো।
হুজুর – তাহলে একদিন আসো সময় কইরা আব্বা-আম্মাকে সাথে নিয়া আমার বাড়িতে। কাঁঠাল খাইয়া যাও একদিন। কুমিল্লার দাউদকান্দি আমার বাড়ি। বেশিপথ না তো ঢাকার থাইকা। সকালে যাইয়া আবার বিকালে চইল্লা আসবা।
মেয়েটি – জ্বী, থ্যাংকিউ।
হুজুর – কাঁঠাল খাও না? কাঁঠাল তো খুব মজা! মিষ্টি ফল। দাউদকা্ন্দিতে আমার নিজের গাছের কাঁঠাল খাওয়াবো। কোন এসপ্রে দেয়া না, কিচ্ছু না। কোন ভেজাল নাই।

এমন সময় প্লেনের চাকাগুলি গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করে এয়ারক্রাফটের পেটের ভেতর থেকে বের হলো। হুজুর চুপ হয়ে গেলেন। রবিউল ভাই জানালার বাইরে তাকিয়ে আমাকে বললেন – দেশে আসা যে কেমন আমার মতো কোনদিন আপনি বুঝবেন না। এই যে নিচের আলোগুলো দেখে আমার বুকের ভিতর কি হচ্ছে আপনারা বুঝবেন না। আমি বললাম – না ভাই, আমি আপনার মত করে হয়তো বুঝতে পারবো না। পাশাপাশি বসলেও আমাদের দুজনের মাঝে বাস্তব জীবনে যোজন যোজন দূরত্ব। আসলেই যে দূরত্ব আমি বা আমাদের সহজে ঘোচাবার নয়। কিছুক্ষন পর প্লেন ল্যান্ড করলো ঢাকার মাটিতে। ড্রাইভার ভাল চালিয়েছেন তাই সবাই জোর হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালেন। আমি প্রথমে তালির আওয়াজে কিছুক্ষুন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসেছিলাম। তারপর আমিও তালি দিয়ে সবার সাথে আনন্দ ভাগ করে নিলাম। এনাউন্সমেন্টে জানানো হলো আমরা সহিসালামতে পৌছেছি। শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে সকলকে স্বাগতম। আগের ফ্লাইটের চাচামিয়া এবং আন্টির বকবকানি এবং হুজুরের শরিয়তি প্যাচালে আমি একদম প্যারানয়েড হয়ে পড়েছিলাম। শাহজালাল এয়ারপোর্ট যে জিয়ার নাম পাল্টে হয়েছে সেটি পত্রিকান্তরে জেনেছিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে হটাৎ মনে হলো – কিরে সিলেট এসে পড়লাম নাকি!?!

এয়ারক্রাফটের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলাম। কেমন যেন কুয়াশায় ভরা ঢাকার রানওয়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ধবধবে সকাল হবে। প্লেন টার্মিনালের কাছে আসলে দূর থেকে দেখলাম ইংরেজি, বাংলা এবং আরবিতে লেখা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। বাংলাদেশের হাতেগোনা মানুষ আরবি ভাষায় বলতে, পড়তে বা ঠিকমতো বুঝতে পারে। আরবি আমাদের দেশের কোন তৃতীয় ভাষাও না। সরকারি কোন দলিল-দস্তাবেজেও এর কোন ব্যবহারিক অস্তিত্ব নেই। সংবিধানে বিসমিল্লাহ আর এয়ারপোর্টের নাম আরবিতে লেখার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে তা আমার মতো হাঁদারামের নিন্মমানের মস্তিক্স বুঝে উঠতে পারে না। এটুকু বুঝি যে, ক্ষমতার রাজনীতিতে এসব কাটমোল্লা ইস্যু ব্যবহার করে খুবই অল্প নিদ্রিষ্ট সংখ্যক মানুষজন ইহজাগতিকভাবেই লাভবান হয়। তবে এতে যদি সত্যি কোন বিশেষ ছওয়াব পাবার ব্যাপার থেকে থাকে তাহলে আমার আর কোন কথা নাই। সেটা তাহলে যৌক্তিক। আমার মতো রবিউল ভাইও দ্বন্ধে পড়ে গিয়েছিলেন ঢাকার বিমানবন্দর নিয়ে। তাকে জানালাম যে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তন করে হয়েছে শাহজালাল বিমান বন্দর। তিনি আঁতকে উঠলেন – কি কন! এইটা ঠিক হয় নাই। এইটা কেন করছে? আরো বিশ বছর শাহজালাল নাম রাইখা দিলেও এইটা আমার কাছে জিয়া ইয়ারপোর্ট। এইটা আমার মন থেকে কোনদিন পাল্টাবে না।

চলবে …

আসেন একটা গান শুনি –

৩,৩৯৩ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “দেশে ফেরার গল্প – দুই”

  1. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    রাব্বী ভাই,
    হুজুরের সাথে সিটটা :just: পরিবর্তন করলে ............... :shy:


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আরো একটা জার্নি হয়ে গেল আপনার সাথে, পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

    Good writing! Quite vivid! মিডেল ইস্ট থেকে ঢাকার গন্তব্যে সবার একই অভিজ্ঞতা। ফ্লাইট এটেনডেনট্ দের, প্রবাসী শ্রমিকদের সাথে দুঃব্যবহার নিয়ে অনেক বার প্রতিবাদ করেছি। লিখতে ইচ্ছে হয়েছে।Best regards,-Aziz


    Smile n live, help let others do!

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ধন্যবাদ আজিজ ভাই। লিখে ফেলুন আপনার অভিজ্ঞতা।

      শ্রমিকরা সাধারণভাবে খুবই নিরীহ। কিন্তু তাদের সবাইকে ঠিকঠাক সিটে বসিয়ে রাখা খুব মুশকিলের কাজ। আবার সব যাত্রী যে ভাল তা কিন্তু নয়। আমার ফ্লাইটেই এক যাত্রী এক মহিলা কেবিন ক্রুর সাথে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে চেষ্টা করেছিল। সেই কেবিন ক্রু সেটা শক্তভাবে মোকাবিলা করেছিল। সমস্যা দুই দিক দিয়েই।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    কি কপাল নিয়া যে আইছো রাব্বী.............. ;;;

    আমি জার্নি করলে কেন জানি ফ্লাইটে একটা বা একাধিক পিচ্চি থাকবেই। আর পুরো সময়টা তারা তারস্বরে চিৎকার করতেই থাকবে! আর যদিও কোনো কারণে কোনো সুন্দরী থাকেও তার আসন থাকবে আমার থেকে কমপক্ষে ১০ সারি সামনে বা পিছনে............ :bash:

    লেখা উপভোগ করছি। মনে হচ্ছে পুরোটা মিলে উপন্যাসই হয়ে যাবে। আগামী বইমেলায় ধরাইবা নাকি 😀


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      উপন্যাস?! বড়জোর একটা ব্লগীয় ট্রাভেল লগ বলা যেতে পারে। 🙂

      কপাল নিয়ে হিংসা করলেন? তাহলে বলি - ফিরতি যাত্রায় হিজ এক্সিলেন্সি পরওয়ারদিগার পুররা ভারসম্য ঠিক করে দিয়েছেন। ঢাকা থেকে কুয়েত পাশের যাত্রী লাগাতার হাঁচি পর হাঁচি দিয়ে গিয়েছে। সার্ক ফোয়ারায় পানি ছাড়লে কিংবা কোন ফলসের পাশে দাড়ালে যেমন পানির মিহি বাষ্পীয় দানার অনুভূতি হয় ঠিক তেমন স্বাদে কুয়েত পর্যন্ত গিয়েছি। না পেরে মুখ কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। কুয়েত থেকে লন্ডন এক চাচামিয়া এবং পুরো কেবিন শ্রীহীন গড়ের মাঠ। লন্ডন থেকে টরোন্টো পাশের দুই সিটে পিচ্চিসহ পরিবার। টরোন্টো থেকে অটোয়া এক দাদুভাইয়ের পাশে :bash:

      আর যদিও কোনো কারণে কোনো সুন্দরী থাকেও তার আসন থাকবে আমার থেকে কমপক্ষে ১০ সারি সামনে বা পিছনে

      লাবলু ভাই, ভাবী বুঝি ইদানিং সিসিবির পাঠক? 😀


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    গান সুন্দর, হুজুর সুন্দর, গোলাপ ফুল সুন্দর, রবিউল সাহেব সুন্দর।
    লেখা ভালো হইছে।
    শেয়ার দিছি।
    এই মুহূর্তে গান শুনতেছি,
    আল্লাহকে যে পাইতে চায়। এই গানটাও সুন্দর।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  6. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আরেকটা কথা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় কুয়েতের লোকজন বিশেষ করে মেয়েরা বেটার।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  7. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    মারহাবা মারহাবা (সত্যি সত্যি আবার কোন হাবারে মাইরা বইসো না)। লেখা ভালা পাইছি। তুমি বলোগ লিখবা বইলাই এতো বাহারী কিছিমের মানুষজন তোমার আশেপাশে বসছে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।