দেশে ফেরার গল্প – এক

ক.
অটোয়া থেকে আমার দেশে ফেরার বিষয়টি হটাৎ করে ঠিক হওয়াতে গোছগাছ করায় আমার একদম লেজে গোবেরে অবস্থা হয়েছিল। ফ্লাইটের আগের দিন সন্ধা পর্যন্ত কোনকিছু একবিন্দু গোছানো হয়নি। এর মধ্যে ঢাকা থেকে কানাডা সরকারের আমন্ত্রনে আমাদের এক প্রাক্তন সহপাঠিনী ঈশিতা রনি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ন ক্ষুদে আমলা সেদিন অটোয়া পৌছায়। আমার রুমমেট টিপু যাবে ঈশিতার সাথে দেখা করতে ডাউনটাউন অটোয়ার হোটেল লর্ড এলগিনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সেশনের বেশ ক’জনা নানা কারণে বিখ্যাত ছিল। তারমাঝে এই ঈশিতা রনি, নবনীতা চৌধুরিসহ (বর্তমানে বিবিসি বাংলায় কর্মরত) আরো কয়েকজন ছিল অন্যতম। টিপু আমাকে পিড়াপিড়ি করতে লাগলো আমি যেন ওর সাথে যাই। আমি বললাম যে আমার পক্ষে সম্ভব না কারণ আমার কিছুই গোছানো হয়নি। আমি না বলায় টিপু আমাকে প্রস্তাব করলো যে আমি যদি ওর সাথে যাই তাহলে বাসায় ফিরে রাতে আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিবে। এমন প্রস্তাব বদ্ধ উন্মাদও ছাড়তো না, আর আমি তো কোন ছার! যথারীতি রাত দশ-এগারোটা পর্যন্ত আ্ড্ডা সহকারে ঘোরাঘুরি করে বাসায় ফিরে স্যুটকেস, ওয়েট মেশিন সহ সব জিনিসপত্র টিপুর দপ্তরে রেখে বিড়িতে সুখটান দিতে থাকলাম। শেষরাতে দেখলাম অটোমেটিক সব গোছানো হয়ে গেলো।

সকালে আমার রুমমেটরা আমাকে অটোয়া ম্যাকডোনাল্ড কার্টিয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছে দিল। একদম ঢাকার মতো, একজন প্যাসেনঞ্জার সাথে তিনজন তাকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে হাজির। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করে যে তোমার সাথে এরা কারা। বললাম, এরা আমার বন্ধু। বলে যে, তোমার তো সিরাম কপাল! এতোজন তোমাকে বিদায় দিতে এসেছে। এরপর তখন সত্যিকারে বিদায় নেবার পালা। আমার রুমমেটরা বিভিন্ন রকম উপদেশ দিতে লাগলো। অপরিচিত লোক প্লেনে কিছু দিলে যেন না খাই। জানালা দিয়ে যেন হাত বাইরে বের না করি, বাইরে যেন ভালভাবে দেখেটেখে নিয়ে থুথু বা পানের চিপ ফেলি যাতে কারো মাথায় না পড়ে সহ আরো অনেক যাত্রা পথের সদুপদেশ। সব উপদেশ মন দিয়ে শুনে তারপর নিষ্ক্রান্ত হলাম। লম্বা ফ্লাইট, অটোয়া থেকে টরোন্টো, টরোন্টো থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে কুয়েত, শেষমেষ কুয়েত থেকে ঢাকা। সস্তার নানান অবস্থা আরকি। তবে সস্তাভাবে চলাফেরার একটি ভাল দিক হলো মাশাল্লাহ অভিজ্ঞতার অভাব হয় না।

এয়ার কানাডার ফ্লাইট। বেলা একটায় ফ্লাইট ছাড়বে। নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসলাম। পাশে কে, পাশে কে যপ করে যাচ্ছি। এরমধ্যে ‘নট সো ব্যাড’ টাইপের এক শেতাঙ্গ তন্বী এসে ‘হাই’ বলে পাশে বসলো। অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিক দুইচাইরটা কথা বলার পর আর কথা বেশি এগোলা না। কারণ আগের দিন থেকে ফ্লাইট পর্যন্ত ঘুমটুম ঠিকঠাক না হওয়ায় যা হয়, ফ্লাই করার সাথে সাথেই আমার জন্য ঘুমের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হয়ে উঠলো। ঘুমের আগে একবার দেখলাম সহযাত্রী একটি বই খুলে পড়া শুরু করলো। ঘুমের মাঝে একবার ভাঙ্গলে চোখ খুলে দেখলাম বালিকাও ঘুম। মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিটের ফ্লাইট। কিন্তু কেন যেন একটু বেশি সময় লাগলো, সোয়া ঘন্টার কাঁটা পার করে ফেললো ল্যান্ড করতে।

তো বালিকার সাথে শেষ দশ মিনিট ভালভাবে কথা হলো। বালিকা যাচ্ছে পেরুতে। মাচুপিচুতে গিয়ে থাকবে। কটা দিন যোগব্যায়াম করে কাটাতে চায়। জিজ্ঞেস করলে আমিও জানালাম, যে দেশে যাচ্ছি। বালিকা বললো, বেঙ্গল মানে তোমাদের দেশে তো একসময় বৌদ্ধ ধর্মের খুব প্রসার ছিল। এখন বোধহয় অতোটা নেই। বুঝলাম, বালিকা বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার অংশ কিনা ধরণের প্রশ্ন করে যারা সেই দলের সদস্য না। তার পড়াশুনা ইংরেজি এবং স্প্যানিশ সাহিত্যে। এরপর যদি পড়াশুনা করে তাহলে এ্যানথ্রোপলোজিতে করবে সেটাও আমাকে জানিয়ে দিল। বালিকাকে খুদাপেজ জানিয়ে প্লেন থেকে নামলাম।

খ.
পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলাম। কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী লেস্টার পিয়ারসনের নামে এই বিমানবন্দর। পিয়ারসন প্রথম জীবনে পেশায় ছিলেন টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক এবং পরে একজন কূটনীতিক। আধুনিক ‘পিসকিপিং মিশনের’ ধারণা তারই মস্তিক্স প্রসূত। পিয়ারসন সুয়েজ ক্রাইসিসের সমাধান করে দেন ‘পিস কিপিং’ ধারণার প্রচলন করে। যেজন্য সম্ভবত পিয়ারসনকে নোবেল শান্তি পুরস্কারও প্রদান করা হয়। যাইহোক, ডমেস্টিক লাউঞ্জে বসে রকিব্যারে ফোন করি। পাই না। আবার করি। তাও পাইনা। রকিব তখনো সাবওয়েতে। সেলফোন আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করে না। ল্যাপটপ খুলে বসে গেলাম এয়ারপোর্টের এক স্টারবাকসে (কফিশপ)। ফ্রি ইন্টারনেট! তারপর একসময় রকিবের সাথে কথা হলো। বেচারা থাকে শহরের অপর প্রান্তে স্কারবোরোতে। ওখান থেকে পিয়ারসন এয়ারপোর্ট আসতে যতক্ষন লাগে তার আগে প্লেনে অটোয়া থেকে টরোন্টো পৌছে যাওয়া যায়। শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনা সুতরাং কি আর করা।

এক সময় রকিব এসে পৌছালো। সারা এয়ারপোর্টময় খোঁজাখুজি। আমি বসে নানাভাবে বলতে লাগলাম যে আমি কোথায় আছি ডমেস্টিক লাউঞ্জে। রকিব আর সে জায়গা খুঁজে পায় না।পিয়ারসনের সিকিউরিটি বেশি কড়াকড়ি। তাই বাইরের লোক কিছু নিদ্রিষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনির ভিতরের জায়গায় যেতে পারে না। আমি আবার সেটা জানতাম না। আর টার্মিনালটা এতো বড়ো যে কিছু বলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলাম না। কারণ যেটাই ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচনা করি সেইসব স্টোর/কফিশপ এয়ারপোর্টে কিছুদূর পরপর আছে। একসময় ডমেস্টিক থেকে ইন্টারন্যাশন্যাল লাউঞ্জে যাবার সময় হলো। এদিকে রকিব আর আমি হাঁটছি আর ফোনে কথা বলে খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছি একজন অন্যজনকে। শেষে একসময় সিকিউরিটি এরিয়ার পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে আসলাম। তাও রকিব নাই। আমি ভিতরে ঢুকি না। বাইরে দাড়িয়ে থাকি আরো কিছুক্ষন। বেচারা টরোন্টোর আরেক মাথা থেকে আসছে আমার সাথে দেখা করতে। মনটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। একপর্যায়ে সময় ফুরালো। তাই উপায়ন্তর না দেখে বললাম দেশ থেকে ফিরে আসার সময় দেখা হবে। তারপর সাত মাইল লম্বা এক হাঁটা পথ এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ওয়ানের ভিতরেই। সেই পথে হাঁটা শুরু করলাম রকিবকে পিছনে ফেলে।

গ.
টরোন্টোতে তখন পড়ন্ত বিকেল। কাঁচের ভিতর দিয়ে এয়ার কানাডার লন্ডনগামী বোয়িংটি দেখা যাচ্ছে। রকিবের সাথে ফোনে কথা বলে বলে বলে মুখে ফেনা তুলে শেষের দিকে গিয়ে উঠলাম ফ্লাইটে। এবার পাশে বসলো গুজরাটি কানাডিয়ান এক দম্পতি লীলা এবং অরবিন্দ। তিন সিটে তিনজন। লীলা এবং অরবিন্দ খুবই অমায়িক সহযাত্রী। বস্তুতঃ এরাই আমার এযাবৎ জাহাজ যাত্রায় সবথেকে মিশুক সহযাত্রী। লীলা মোটামুটি কানের খৈল নাড়ায়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। লীলাকে দেখে বয়স ঠিকঠাক অনুমান করা যায় না। অরবিন্দের কাঁচাপাকা চুল। অরবিন্দের পরিবার ষাটের দশকে ভাগ্যান্বষনে কানাডায় আসে। আর লীলার বাবা যায় কেনিয়ায় তার পরিবার নিয়ে। কেনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হলে লীলার পরিবার ইংলান্ডে চলে যায়। এখন তারা লীলার ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে লন্ডন যাচ্ছে। লীলা কোনদিন ভারতে যায়নি। অরবিন্দ ভারত যায়নি প্রায় গত ত্রিশ বছর। ওরা থাকে ম্যানিটোবা। অরবিন্দ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এবং লীলা একটি হাসপাতালে ফার্ষ্ট নেশনস হেলথ কাউন্সেলর। কিন্তু দুজনেরই গুজরাটি ভাষায় চমৎকার দখল।

লীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনদিন গুজরাটে না গিয়েও কিভাবে ভাষাটা এতো ভাল জানো?
লীলার পাল্টা প্রশ্ন, আমি ভাল গুজরাটি জানি এটা তুমি কিভাবে বুঝলে?
বললাম, তুমি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করো না তেমন। তাই মনে হলো ভাল জানো হয়তো।
লীলা – আমার মা ইংরেজি জানতো না। তাই গুজরাটি আমাদের না শিখে কোন উপায় ছিল না।

উপমহাদেশের মানুষ কিছু কথাবার্তার পর একটি ব্যাপারে খুব ভালভাবে খোঁজ নেয় তা হলো বিবাহিত কিনা। আমাকে যথারীতি বিবাহ, ভাবভালবাসা, ডেটিং-এর উপর একটি নাতিদীর্ঘ ইন্টারভিউ দিতে হলো লীলার কাছে। অরবিন্দ দেখলাম এইসব বিষয়ে কোন বামহাত চালনা করলো না। কোন আগ্রহ আছে কিনা সেটাও বুঝতে দিল না। ইন্টারভিউ শেষে লীলা আমাকে একরকম শ্লেষের সাথে জানালো, আমরা নাকি ‘কনফিউজড জেনারেশন’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?! তোমার কেন এমন মনে হয়?
লীলা – আমার একটি তোমার বয়সী মেয়ে আছে। টরোন্টোতে থাকে। বিয়ে করেনি। সংসারধর্ম নিয়ে কোন ভাবান্তর হতে দেখি না কখনো। বললেও এড়িয়ে যায়। তুমি কিছু মনে করো না, আমি কথা বলতে বলতে, মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলিয়ে ফেলি। আমি দুঃখিত।

আমি লীলার কথায় তেমন কিছু মনে করি নাই। আমাদের খালা-চাচীরা আরো নির্দয় এসব ব্যাপারে। কিন্তু এবার আমার অবাক হবার পালা লীলার আমার বয়সী সন্তান শুনে।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়স কত?
লীলা – আই এ্যাম ফিফটি সেভেন এন্ড অরবিন্দ ইজ সিকস্টি থ্রি।

আমি মনে করেছিলাম লীলার বয়স হয়তো চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে আর অরবিন্দ পঞ্চাশ-বাহান্নো হয়তো। দেখে বোঝার উপায় নাই যে এদের দুজনার বয়স এতো বেশি। টাস্কি খাইলেওে, যাত্রাপথে আমার নীতি হলো সহযাত্রী সবাই সমান। সবার সাথেই পূর্ন অথোরিটিতে কথা বলা। বয়স জানার পরও ওদের সাথে একই নীতি বজায় রাখা হলো।

সামনের সিটে এক বাঙ্গালি ভদ্রমহিলা এবং তার ছেলে। তারা বাংলায় কথায় বলছে। লীলা এবং অরবিন্দ আন্দাজ করার চেষ্টা করলো এটা কোথাকার ভাষা হতে পারে। শেষে তারা দুইজন উঁকিঝুকি দিয়ে দুই অনুমানে পৌছালো, একজন বললো মারাঠি এবং অন্যজন বললো যে উড়িয়া হতে পারে। তখন বললাম যে, এটা বাংলা। আমিও এই ভাষায় কথা বলি। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কি বলছে নিজেদের ভিতর? আমি অনুবাদ করে দিলাম।

সামনের সিটের মা বলছে – বাবু, এয়ারহোস্টেস মহিলাকে বার বার এটা ওটা চেয়ে বিরক্ত করো না। ও দুই সারির অনেক মানুষকে সার্ভ করছে।
ছেলে – মাম্মা, দিস ইজ হার জব!
মা – হ্যা, জব। কিন্তু সবাই এভাবে বললে ওর অনেক কষ্ট হবে।
ছেলে – ওকে, মাম্মা। আমি এভাবে ভাবিনি। আর বলবো না বেশি প্রয়োজন ছাড়া।

সবশুনে লীলা বললো, হাউ সুইট! লীলা কিছুক্ষন পরপর আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কিন্তু অনেক বকবক করি। তুমি কিছু মনে করছো নাতো। এতো লম্বা পথ! আর আমি ফ্লাইটে তেমন ঘুমাতে পারি না। কথা বলেই সময় পার করি। লীলা কিছুক্ষন যোগব্যায়াম করলো সিটে বসে ইয়োগা মিউজিকের তালে তালে। অরবিন্দ এবং আমি সিনেমা দেখে সে সময়টা পার করলাম।

যাত্রাপথ মোটামুটি লীলা এবং অরবিন্দের সাথে গল্পগুজব করে পার করলাম। আমাকে তারা বিভিন্ন রকম ভারতীয় মাসালা চা খাওয়ালো কয়েকবার করে। বাকি পথের জন্য কিছু এক্সট্রা চায়ের প্যাক সাথে দিয়ে দিল। তারপর একসময় তিনজনই ঘুম পাড়ানি রুহ আফজা পান করে শেষ পথটুকু ঘুমিয়ে কাটালাম। চোখ খুলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে উষার আলো এবং নিচে উজ্জ্বল চমৎকার ল্যান্ডস্কেপের বিস্তৃত লন্ডন শহর। প্লেন ল্যান্ড করছে। বেশ খানিকটা সময় লন্ডনের আকাশে মেঘের ভেতর চক্কর কাটলো প্লেন।

ঘ.
প্লেন থেকে নামার মুখে সামনের সিটের ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ বাই এনি চান্স? বললাম, জ্বী, বাংলাদেশী। বললেন, আপনাদের মজার সব কথাবার্তা শুনছিলাম সারাপথ। আপনার সহযাত্রী ভাল পেয়েছিলেন বোধহয়। কথায় কথায় তিনি পরিচিত হলেন। নাম আজরা। আমরা একই পথের পঠিক। পথ শেষের ঠিকানা হলো ঢাকা। ভদ্রমহিলা এ্যডমন্টন থাকেন। সাথে গ্রেড এইটে পড়া ছেলে। ভদ্রমহিলার বাবা এবং মা তিন মাসের ব্যবধানে মারা গিয়েছেন। বাবা মারা গেলে পরে দেশে গিয়েছিলেন জানুয়ারিতে। মা মারা গেলে আর যেতে পারেননি। কয়েকমাস পর এখন যাচ্ছেন মাস ছয়েকের জন্য। দেশে একটি মাত্র ভাই আছে শুধু। আইইউবির প্রথম ব্যাচের প্রথম চার-পাঁচজন ছাত্রের একজন তিনি ছিলেন। বেশ কয়েক বছর ঢাকাতে কয়েকটি আর্ন্তজাতিক সংস্থায় চাকরি করেছেন। এ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাঠ চুকিয়ে পছন্দসই চাকরি খুঁজছেন কানাডায় নিজ পেশাক্ষেত্রে।

লন্ডনে হিথ্রোতে নেমে টার্মিনাল দুই থেকে টার্মিনাল তিনে যেতে হবে, সে আরেক হ্যাপা। বাসে করে এক টার্মিনাল থেকে আরেকটিতে যেতে হয়। বাসে পাশের সিটের জনৈক যাত্রী কথা বলা শুরু করলেন এমনভাবে যেন বহুদিনের পরিচয়। নিউইয়র্ক থেকে আসছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কাহাসে আয়া হো টাইপ প্রশ্ন। বুঝলেও ইংরেজিতে বললাম, কি কও মিয়া কথার আগামাথা কিছুই বুঝি না। তারপর ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক উত্তর দিলাম। আমি বেশি কিছু জিজ্ঞেস করি না। লোকের কথাবার্তার ধরণ তেমন ভাল লাগে নাই। কিন্তু লোকটা খুব গায়ে পড়ে ব্রাদারহুড ফলাতে লাগলো। আমি মনে করেছিলাম ভারতীয় হতে পারে। নিশ্চিত হবার জন্য গন্তব্য কোথায় জিজ্ঞেস করতেই যখন গদগদ হয়ে জানালো লাহোর যাচ্ছে এবং নিউইয়র্কে তার অগনিত বাংলাদেশি বন্ধু তাকে অত্যন্ত খাতিরযত্ন করে চলে। তখন আমি চুড়ান্তভাবে আগ্রহ হারালাম লোকটির সাথে কথা বলার। শুধু পাকিস্থানী ‘ব্রাদার’ ইস্যু না, গায়ে পড়ে যেসব লোক নিজেরে জাহির করে এসব লোক আমি একদম সহ্য করতে পারি না।

লন্ডনের হিথ্রোতে আসলে যেটা মনে হয়, তা হলো ভারতের কোন বিমানবন্দর বলে একটা দ্বন্ধ হয়। পুরো বিমানবন্দরময় অসংখ্য উপমহাদেশীয় এমপ্লয়িজ এবং যাত্রী চোখে পড়ে। আর এতো হরেক রকম মানুষ বোধহয় পৃথিবীর আর কোন এয়ারপোর্টে নাই। হিথ্রোতে আরেকটি জিনিস দেখার মতো প্লেন যখন টেইক-অফ করে তখন প্রতি মিনিটে অনেকগুলি ফ্লা্ইট পরপর উড়ে যায়। মনে হয় যে পাখিগুলো সব লাইন দিয়ে দাড়িয়ে আছে উড়াল দেবার জন্য। লন্ডন থেকে এয়ারলাইনস পরিবর্তন হলো। এয়ার কানাডা থেকে কুয়েত এয়ারলাইনস। সাথে পরিবর্তন হলো এয়ারক্রাফটের এবং সেবার মানের উচ্চ থেকে নিন্মক্রম অনুসারে অধঃপতন ঢাকা পর্যন্ত। টার্মিনাল থ্রি-তে হটাৎ দেখা হলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী দম্পতির সাথে। অনেক বছর পর এমন আচমকা অকসাৎ কারো সাথে দেখা হলে ভালই লাগে। চমৎকার সময় কাটলো বেশ কিছুক্ষন। তারপর আমার বন্ধু দম্পতি বিদায় নিল। তাদের অন্য গন্তব্য এবং অন্য ফ্লাইট।

বন্ধু দম্পতি চলে যাবার পর আগের ফ্লাইটে পরিচিত হওয়া আজরা আপার সাথে কথা শুরু হলো। প্রাথমিক পরিচয় শেষ হওয়া এবং পরিচিত আত্মীয়স্বজন বের হবার পর গল্পগুজব কানাডার প্রবাসী বাঙালি জীবন নিয়ে শুরু হলো। প্রবাসে বাঙালি এমন একটি রসে টইটুম্বুর বিষয় যার শাখা-বিষয়ের কোন শেষ নেই। বাঙালি খোদাতালার দুনিয়ায় এমন এক অনন্য অদ্বিতীয় জাতি এবং এমন বৈচিত্রময় তার প্রবাস যাপন যে এ বিষয়ে কথা বলে বিনোদনের কোন শেষ নেই। সুতরাং আমরাও বঞ্চিত হলাম না অপেক্ষারত সময়ে এই অশেষ বিনোদন থেকে।

ঙ.
লন্ডন থেকে কুয়েত যাবার সময় পাশের সিটে কেউ নাই। ফ্লাইটে অসংখ্য ফাঁকা সিট। কুয়েত এয়ারলাইনস খুবই শরিয়ত সম্মত উপায়ে পরিচালিত হয়। ফ্লাইটে হালাল খাবার পরিবেশন করা হয। সকল ধরনের প্রচার আরবিতে হয়, ইংরেজিও থাকা যথাসামান্য। একটু পরপর স্ক্রীনে ভেসে ওঠে কোনদিক ফিরে কখন নামাজ পড়তে হবে। এছাড়া খাবারের মেন্যুতে লেখা আছে, কুয়েত এয়ার লাইনস যাত্রাপথে মদ জাতীয় পানীয় পরিবেশন করে না। এসব দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম, এবার যাত্রাপথের বাকি অংশে কিছু নেকি পরকালের জন্য হাসিল করা যাবে।

আমার পিছের সিটে এক বাংলাদেশি চাচামিয়া এবং বোরকা পরা আন্টি বসা। চাচা মিয়া আসছেন কেন্টাকি থেকে এবং আন্টি আসছে সুদূর নিউজার্সি থেকে। চাচামিয়া এবং আন্টি দুজনই পানসুপারিতে আসক্ত। পানের সূত্রেই সম্ভবত আবিষ্কার করলেন যে তারা বাংলাদেশি। আন্টি জনস্বার্থে চাচামিয়াকে জানালেন প্লেন টেক-অফ করার সময় পান চিবালে নাকি কানে আর কোন চাপ অনুভূত হয় না। চাচামিয়াও সহমত জানালেন যে পান একটি প্রকৃত উপকারী ভেষজ চর্ব্য। চাচামিয়ার বাড়ী চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। আন্টির বাড়ি মহীপাল, ফেনি। তবে আন্টির বাড়ি ফেনি হলেও তারা এখন পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চেটেলট। চাচামিয়ার পুরো পরিবার এবং আন্টির শুধু বড় মেয়ে থাকে জামাইসহ আম্রিকায়। আন্টির মেয়ে ব্যাংকার। চাচামিয়ার ছেলে ইউএস নেভির অফিসার। নেভি অফিসার বলে কিনা জানি না, কিন্তু চাচামিয়া পুরা সময় ছেলে কথা “উনি, উনি” করে বলে গেলেন আন্টিকে।

আন্টি আম্রিকায় বসবাস করতে চান, তার যানজটের ঢাকার জীবন একদম ভাল লাগে না। কিন্তু আন্টির হাচপেন্ট আমেরিকাতে থাকা বিশেষ পছন্দ করেন না। এছাড়া আন্টির চার চারটি স্বনামধন্যা কন্যা রয়েছে। যাদের দুজন বর্তমানে প্রাইভেট মেডিকেলে ডাক্তারি অধ্যায়নরতা। ডাক্তারি পড়া কন্যাদ্বয়ের জন্য আম্রিকার ইমিগ্রেশন আবেদন করা হয়েছে। এবং সর্বশেষ খবর হলো, তাদের ভিসা প্রদান করা হয়েছে এবং এবছরের কোন এক সময়ে তারা নিউজার্সি গমন করবেন। (সিসিবি’র আম্রিকা গমনেচ্ছু আবিয়্যাত্তা পোলাপাইনদের অতিসত্ত্বর আন্টির সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা যাচ্ছে!)।

চাচামিয়া এবং আন্টি লন্ডন হতে সারাপথ আম্রিকাতে বাঙালি মুসলমানের হালাল আহার এবং শরিয়তসম্মত জীবনযাপনের ফজিলত এবং কুদরত নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে করতে কুয়েত পর্যন্ত আসলেন। তারা এইমর্মে অনুসিদ্ধান্তে পৌছালেন যে হালাল খাবার না খাওয়া, বেআব্রু চলাফেরা করা এবং ধর্মীয় অনুশাসন ঠিকমতো মেনে না চলার কারণে বাদবাকি আম্রিকানদের সন্তান হাইস্কুলে থাকতেই বখে যায়। তাদের আলোচনায় আড়িপেতে আমিও দুই জাহানের অশেষ নেকি হাসিল করলাম। শেষে না পেরে, আমি মোটামুটি ঢাকা-কক্সবাজার ভলবো গ্রীনলাইন বাসের মতো করে পাশের সীটে পা তুলে তিনসিটের একটা বিছানা বানিয়ে চাচামিয়া এবং আন্টির গল্পগুজব থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করে করে ঘুমানোর চেষ্টা করে চললাম সারাপথ।

চলবে …

৩,৩১১ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “দেশে ফেরার গল্প – এক”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগলো রাব্বী ভাই, আপনার সাথে অটোয়া থেকে টরোন্টো, টরোন্টো থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে কুয়েত, শেষমেষ কুয়েত থেকে ঢাকা বিমান ভ্রমন করে ফেললাম 🙂

    পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম...


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. শিরীন (৯৬-০২)

    :))
    তৌফিকরে বিরাট ঝামেলার মধ্যে ফেলছি আজকাল। বাসায় ফিরতেই প্রথম প্রশ্ন "টিকেট কবে কিনবা? কয় তারিখের টিকেট কিনবা? " বেচারা আর টিকতে না পেরে মনে হয় দেশে যাওয়ার টিকেট কেটেই ফেলবে 😀

    জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    এয়ারপোর্টে রকিব্বার রাথে লাভ-বী ভাইয়ের দেখা না হওয়ায় আমি খুশি হইছি।দেখা হইলেই দুইজন মিল্লা এমুন ভাব করত যেন এইটা একটা সিসিবি গেটটুগেদার x-(

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।