দেশে ফেরার গল্প – শূণ্য

অ.
দাঁতের সাথে আমার শত্রুতা চিরদিনের। আমার জীবনের অনেক সমস্যার মধ্যে দাঁত হলো ছোটবেলা থেকেই অন্যতম একটি মিলিয়ন ডলার সমস্যা। জানুয়ারি মাস থেকে দাঁত বাবাজি বিগড়ানো শুরু করলো। একদিন ঢাকাতে বাসার লোকজনকে টেলিফোনে বলেও বসলাম যে যেদিন দেখবো অবস্থা বেশি খারাপ সেদিন উড়োজাহাজের একটি টিকেট কেটে সোজা দেশের পথে ভোঁ হবো। গত এপ্রিলে ইত্যকার নানা জাগতিক এবং মারফতি কারণ এবং অকারণ মিলিয়ে আমি ভয়াবহ হোমসিক হয়ে পড়লাম। কতদিন এ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে কফির মগ হাতে শূন্য দৃষ্টিতে সামনের ছোট্ট সবুজ বনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভেবেছি – কবে আবার দেশে ফেরার গান গাইবো?!

গত মে মাসের শুক্কুরবার দাঁতের একটি ফিলিং খসে পড়ে অজান্তা-ইলোরার মতো দাঁতের ভিতর একটি গুহা তৈরি হবার পর যখন চিলিক দিয়ে ব্যথা শুরু হলো তখন জিহাদ ভাইয়ের দেয়া বাণী চিরন্তনী আমার জীবনে সত্য হয়ে দাড়ালো – সাবেক প্রেমিকার ব্যথা ভুলে থাকা যায় কিন্তু দাঁতের ব্যথা ভুলে থাকা যায় না। তাই এখানে একদম সময় অপচয় না করে, কোন রকম ডাক্তার কবিরাজ না করে, নানাভাবে তালগাছবাদী যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে দেশে ফেরাই কর্তব্য। বাসায় জানালাম, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমার দন্ত উত্তোলন, সংস্কার, উন্নয়ন এবং সৌন্দর্য্য পরিবর্ধনের কাজ করানো আবশ্যক। পুরো বিষয়টিকে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করে দেশে যাবার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করা হলো। সেইমতো সরকারের ইআরডিতে পরিকল্পনা জানানো হলো এবং পুরো বিষয়টি একনেকে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখে ফিরতি ফোনে সম্মতি জানিয়ে দিল সরকারের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি। যেই কথা সেই কাজ। শুক্রবার বিকালের ভাবনা মঙ্গলবার রাতে ই-টিকেট হাতে পাওয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের রুপকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের নাম লিখিয়ে ফেললাম এক মাসের জন্য।

আ.
যেদিন জাহাজের টিকেট পেলাম হাতে। সেদিন বর্তমানে টরেন্টোবাসী এক বন্ধু তড়িৎবার্তা দিলো যে, তুমি কি বাইচ্যা আছো এবং নিজের ফুসফুস যন্ত্র দিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালাইতেছো?

তাকে বললাম – জীবন ঠেলে ঠেলে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। তবে আমি ঠিক আছি। দেশে যাচ্ছি – দাঁত নিয়ে উপুর্যপরি বিপর্যস্ত।

সে বললো – চমৎকার! আরেকটা স্কার্ফ আসছে আমার জন্য(গামছা)। প্রিটি প্লিজ! আর এয়ারপোর্টে ‘চায়ের সাক্ষাৎকার’ হলেও আমাদের দেখা হওয়া উচিত। আমি গ্রীষ্ম গায়ানাতে কাটাতে জুনের শেষে চলে যাবো। তোমার ফ্লাইট তার আগে হলে দেখা করতেই হবে।

বললাম – তথাস্তু।

এই যখন ঠিকঠাক। রকিব টেলিফোনে বলে বসলো, সে আমার সাথে দেখা করতে চায় পিয়ারসন এয়ারপোর্টে। নানাভাবে বলেও যখন বোঝাতে পারলাম না যে, তুই আসিস না। তারপর ভাঙলাম, বন্ধু মানে একজন বান্ধবীর সাক্ষাৎকার আছে। তারসাথে গুরুত্বপূর্ন আলাপসালাপ আছে। ফেরত আসার দিন পিয়ারসনের স্টপওভার তোর জন্য বরাদ্দ করা হলো। রকিব্যা শান্ত হলো। কিন্তু এক চরমোনাই ফন্দি এঁটে বললো – আপনাদের পাপ্পারাজি করবো, যেদিন যাবেন। … এর কোন মানে হয়? এইসব পুলাপানের জন্য আমার জীবনে শান্তির বাপ অনেকদিন হয় মারা গেছেন! যাইহোক, কপাল ভাল ছিল। সেই বন্ধুর যাবার দুদিন আগেঅটোয়াতে কাজ পড়ে যাওয়ায় আগাম সাক্ষাৎকার হয়ে গেল। তাই এয়ারপোর্ট দৃশ্যে রকিবের প্রবেশ শেষ মূহুর্তে ঠিক করা হলো।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! পিয়ারসন এয়ারপোর্টের আমি যেখানে ডমেস্টিক এ্যারাইভালে বসে ছিলাম সেখানে দর্শনার্থী যেতে পারে না এবং আমি সেটি জানতাম না। রকিবের পৌছাতে দেরি হলো এবং আমিও রকিবকে বলে বোঝাতে পারলাম না আমার অবস্থান। তারপর সিকিউরিটি এলাকার ভিতরের অন্য এক পথ দিয়ে আমাকে ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে চলে যেতে হলো। কি আর করা! একই এয়ারপোর্টে বসে দুইজন দুই জায়গায় ফোনালাম চালালাম। সেই থেকে বড় এয়ারপোর্ট আমার দুই চোখের বিষ। কিন্তু তাতে কি আর চিড়া ভিজে? রকিব আমার উপর কিঞ্চিৎ-এর উপর ঝাপসা মাইন্ড খাইলো। ভাই ভাল, ময়না ভাল, ফিরে আসার সময় তোর জন্য রিং চিপস আর কাঠি লজেন্স নিয়া আসবো… এসব ভুংভাং বলে জাহাজে উঠে পড়লাম।

ই.
লন্ডনের হিথ্রোতেও একটি ছোট্ট স্টপওভার। সেখানে যুক্ত হলো লন্ডন প্রবাসী বন্ধু এবং বান্ধবী দম্পতি। সময় অপচয় করে এয়ারপোর্টে বসে থাকা ঠিক নয়, কারণ অপচয়কারী শয়তানের ভাই। তাই হিথ্রোতে সকালবেলা মোটামুটি গল্পগুজব হাহাহিহি করে কাটালাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই বান্ধবীকে একবার ‘পামোশ’ বলার কারণে রেজিস্টারস বিল্ডিং থেকে ব্যানানা বিল্ডিং পর্যন্ত তাড়া খাইছিলাম। তাই এবার আর স্বাস্থ্য দেখে বলতে সাহস পাইলাম না যে তোরা দেশে ফিরতে প্যাসেঞ্জার নাকি কার্গো এয়ারক্রাফট চার্টার করে যাচ্ছিস। বন্ধু এবং বান্ধবীর সাথে এতো দিন পর দেখা হয়েও একমুহূর্তে যেন ফেলা আসা সেইসব দিনে ফিরে গেলাম। সেইটাই! দূর থেকে মনে হয়, সবার সাথে সম্পর্ক কেমন আলগা হয়ে আসছে কিন্তু যখন সত্যি বাস্তবতায় ফিরে যাই সব মূহুর্তে কেমন আগের অবস্থায় চলে যায়।

ঈ.
প্রবাস জীবনটা আসলে কিছুটা আজব! আমি দাঁতের ব্যথায় কাতর হয়ে কৃচ্ছতা সাধনের জন্য দেশে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম আর এদিকে কিনা অটোয়াতে বন্ধুবান্ধব আমার দেশে যাওয়া নিয়ে হিংসা করা শুরু করে দিল। একজন বলেও বসলো, আমি নাকি ভাগ্যবান। এইটা শুনে কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম কারণ আমি এতোদিন জানতাম, ভাগ্যবানের বউ মরে, আর দূর্ভাগার মরে গরু। এখন দাঁত নিয়ে একটি তাত্ত্বিক ঝামেলায় পড়ে গেলাম যে এটি বউ না গরু কোন ক্যাটাগরিতে পড়লো। তবে এটি খুব সত্যি যে দেশে ফেরার আগে একটি সাংঘাতিক উত্তেজনা হয়। বুকের ভিতর কি এক যে অজানা অনুভূতি হয়। হবে নাই বা কেন? সব দেশের সব প্রবাসীর শুধু শরীরটুকু থাকে প্রবাসে, কিন্তু মন পড়ে থাকে তার দেশের কোন শহরের ঘিঞ্জি গলির এক চিলতে দালানে, চায়ের টং দোকানে, গাড়িতে ঠাসাঠাসি ব্যস্ত সড়কে কিংবা কোন গন্ড-গ্রামের কুঁড়ে ঘরে, ধানের ক্ষেতে, নদীর তীরের কাঁশবনে। কিংবা তার দেশের গান, গল্প, কবিতায়, টেলিভিশনে, রাজনীতিতে, শরতের চলিষ্ণু মেঘে, পাহাড়ে, সমতলে কিংবা কোন সাগর তীরের বালুকাকনায়, তীব্র নীল ঢেউয়ে। এ বাঁধন কোনদিন ছিন্ন করা যায় না। কেউ পারে না। যে বলে পেরেছে, সে হয়তো মিথ্যে করে বলে। তাই হয়তো আমার বন্ধুরা হিংসা করলো।

চলবে …

১,০১৭ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “দেশে ফেরার গল্প – শূণ্য”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    শূন্যতেই তো ছক্কা মেরে দিলেন রাব্বী ভাই, সামনে না জানি আরো কি আছে! অপেক্ষা থাকলাম...


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)
    রকিব আমার উপর কিঞ্চিৎ-এর উপর ঝাপসা মাইন্ড খাইলো।

    :no: :no: :no: 😮 😮 😮
    আপনে আমারে এমন হালকার উপর ঝাপসা বাঁশ মারলেন; মাইন্ড খাবার অপবাদ তো শত্রুও দিবে না।

    তারপর ভাঙলাম, বন্ধু মানে একজন বান্ধবীর সাক্ষাৎকার আছে। তারসাথে গুরুত্বপূর্ন আলাপসালাপ আছে।

    এই :just: বান্ধবী কিন্তু হান্টসভিলে থাকেন; এইবার জ্ঞানী-গুণীরা যা বুঝিবার বুঝিয়া নিন। আমার ভয়ে উনি তারে টরন্টো থেইকা এক্কারে অটোয়ায় পাক্কা ৪০০ কিমি ভ্রমণ করায়ে নিয়া গেসেন। এরেই বুঝি বলে স্বগ্যো থেকে নেইমে আসা পেরেম। :dreamy: :dreamy: কবে যে বড় হইয়া ড়াব্বী ভাইয়ের পদাংক অনুসরণ করবো :guitar:

    লেখা অতিশয় সুস্বাদু হইছে। আপনে মিয়া বেশি ভালো লেখেন; এমনে হইলে কেমনে চলে। ;;)


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    বস,
    দেশে ফেরার আগের আনন্দটা এক্কেবারে কলেজের ছুটির আগের রাতের মতো না ?


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    পরের পর্ব কৈ? আমারে কইলা টিএসসিতে বইস্যা আড্ডা দিবা........... আর গেলা কিনা শর্মা হাউসে!! আম্মাজান ফাঁস না করলে তো জানতেও পারতাম না!! আবার আসো দেশে.......... 😡 😡 😡


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।