ফ্লামেংকো

লেখাটি প্রায় আট/নয় বছর আগের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দেয়ালিকার জন্য। খুঁজে দেখলাম কয়েকটি লেখা চিরদিনের মতো হারিয়ে গিয়েছে। সেজন্য কিছুটা আফসোস হচ্ছে। আজ এই পুরানো লেখাটি পেলাম। ফ্লামেংকো একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সংগীত এবং নৃত্যধারা মাধ্যম – আমি যার কিছুই বুঝি না এবং জানিনা। সম্বলটুকু হলো শুধু নির্বোধ ভাল লাগা। এককালে স্প্যানিশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালিয়েছিলাম। তার লেজ ধরে – হিস্পানি সংস্কৃতির ফ্লামেংকো, ষাড়ের লড়াই, কিছু সিনেমা, গান, চিত্রকর এবং কবি ও কবিতার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। ভাষা শিক্ষার চেষ্টা যথার্থভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সেটিই হবার কথা ছিল। কিন্তু চেষ্টা নামক জিনিসটার একটি মজার দিক হলো – এটি কোন না কোন দিক দিয়ে সামান্যতম হলেও সমৃদ্ধ করে। তা না হলে আমার মতো গন্ডমূর্খের পেট থেকে ফ্লামেংকোর মতো এমন একটি বিষয়ে লেখা বের হতো না। আর অযথা কথা নয়। তাহলে পড়ুন।

ফ্লামেংকো
হিস্পানি লোকজসংস্কৃতির মূল উৎসগুলো গভীরভাবে জিপসী ঐতিহ্যে প্রোথিত। ১৫শ শতকের শেষদিকে স্পেন থেকে ইহুদী ও মুসলমানদের বিতাড়নের পর একমাত্র রোমানিস (Romanis) নামের ক্ষুদ্র যাযাবর জাতিগোষ্ঠি পাকাপাকিভাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয়, এই যাযাবর গোষ্ঠি যারা জিপসী নামে পরিচিত আদতে উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটি নিন্মবর্ণের আদিবাসী জাতি। যারা ১১শ থেকে ১২শ শতকের কোন এক সময়ে “বাইজেনটাইন” (Byzantine) সাম্রাজ্যের এশীয় অঞ্চলের মধ্যদিয়ে বর্তমান ইরান, আরমেনিয়া পাড়ি দিয়ে হিস্পানিক ভূখন্ডে আসে। জিপসীদের আগমনের দ্বিতীয় জোয়ারটির তৈরি হয়েছিল দক্ষিনের সিয়েরালিয়ন, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে। স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে শেষ পর্যন্ত মূলতঃ আন্দালুসিয়াতেই থিতু হয়। আন্দালুসিয়ার তামাটে গাত্রবর্ণ মুর আরবদের রেখে যাওয়া জীবনাচরণ, ভূমি, তৃণভূমি, আকাশ, আলোবাতাস এবং আরব সংস্কৃতির লালিত্য, সেইসাথে সুর ও নৃত্যপিয়াসু জিপসীদের জীবনারচণ এক নিবিড় এবং গভীরতম ভালবাসার মেলবাধনে একাকার হয়ে যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী জিপসী সংস্কৃতি আরব হিস্পানিজ সংস্কৃতির সাথে লীন হয়ে এক নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে।

আন্দালুসিয়া এবং স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলের জিপসী সংস্কৃতির সবথেকে বেশি প্রভাব পড়ার বৈভবময় সময়টি নিঃসন্দেহে ১৯শ শতকের মাঝামাঝি। মোটামুটিভাবে উনিশ শতকেই জিপসী/হিতানো (Gitano) ঐতিহ্যের ফ্লামেংকো আন্দালুসীয় সংস্কৃতিতে পাঁকা আসন তৈরি করে নেয়। যাদের যাযাবর পরিবারে জন্ম হয় কিংবা যারা ভবঘুরে জীবন বেছে নেয় – ‘ফ্লামেংকো’ (Flamenco) পরিচয়কেই মনে করিয়ে দেয় জীবনভর। সম্ভবত জিপসী এবং আন্দালুসীয় সংস্কৃতির মধ্যে সবথেকে বড় বিনিময়টি হলো তাদের স্ব স্ব সংগীতধারা। জিপসীরা স্পানীশ লোকগীতি এবং নৃত্য; সেই সাথে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের অভিযোজন এবং সংরক্ষন করে বিশেষ মেধার পরিচয় দিয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে আন্দালুসীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই চর্চার ফলে সমগ্র স্পেনজুড়ে পেশাদারী জিপসী শিল্পনৈপুণ্যের কদর দারুনভাবে বেড়ে যায়।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক তথ্য থাকবার পরও ফ্লামেংকো চর্চার উৎপত্তি এখনো অস্পষ্ট। ধারণা করা হয়, ১৮শ শতকের শেষদিকে দক্ষিনাঞ্চলের কাদিজ (Cadiz) এবং সেভিল (Seville)-এ ফ্লামেংকোর প্রথম যাত্রা শুরু হয়। স্পষ্টতঃ জিপসী সংগীত রয়ে গিয়েছে ফ্লামেংকো ঐতিহ্যের হৃদয়ে। ফ্লামেংকো শিল্পকর্মের সংগীত ও নৃত্য একই সাথে নাটকীয় এবং হৃদয়গাহী। মূলতঃ বেশিরভাগ ফ্লামেংকো গানই একধরনের লোকজগীতি। এই ঐতিহ্যগত শিল্পটি খাঁটি মৌখিক এবং সরাসরি শেখার মাধ্যমে একটি পরম্পরা তৈরি করে এবং এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বয়ে চলে। এইগানগুলো স্থানীয়ভাবে ‘কোপলাস’ (Coplas) নামে পরিচিত, এর প্রায় ৪০টি ভিন্ন ভিন্ন ধরণ রয়েছে, যেগুলো সাধারনত তিন বা ছয় পক্তির হয়ে থাকে।

ফ্লামেংকো গাইয়েরা যখন গাঢ় আবেগঘন গানগুলো পরিবেশন করে তখন সুরের মাধুর্যপূর্ন কারুকাজে অসম্ভব আবেগ-বিধূত একটি আবহ সৃষ্টি হয়। আর তা যেন কান্নার চেয়েও গভীরতম উপলব্ধি নিয়ে হৃদয়ে ফিরে ফিরে আসে। দুটি প্রধান ভাবগত ধারার ফ্লামেংকো সংগীতে বিশেষ কর্তৃত্ব রয়েছে। প্রথমতঃ ভালবাসার মানুষটির মৃত্যু, বিশেষত একজন ‘মা’ চরিত্র, যিনি জিপসী সংস্কৃতিতে খুবই প্রভাবশালী গুরুত্বপূর্ন চরিত্র। দ্বিতীয়তঃ পরাধীনতা – যা অনেক জিপসীরই নিয়তি হয়ে পড়েছে। এছাড়া, অন্যান্য পরিব্যপ্তময় ভাবধারার মধ্যে রয়েছে – জীবনের সুখানুভূতিগুলোর ক্ষনস্থায়ীত্ব এবং চলমান দূর্ভোগ। ফ্লামেংকো সমালোচক রিকার্ডো মোলিনার ভাষায় –

“… ফ্লামেংকো হলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের অবদমিত আকাঙ্ক্ষার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া”।

ফ্লামেংকোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন চরিত্র অবশ্যই ‘বাইলোরা’ (Bailora) নৃত্যরতা সেই আকর্ষনীয় শ্যামাঙ্গীনী নারী। যার শরীর চমৎকার সাজপোশাকে মোড়ানো, সাথে থাকে সাটিন এবং সিল্কের তৈরি ঝালর। হয়তো কখনো কাঁধের উপর দিয়ে একটা চাদর চাপিয়ে নেয়, আর কারুকার্যময় ফিতা এবং বর্ণিল সুগন্ধী ফুলের সাঁজ। শিল্পীর এই সাজপোশাক দারুন চিত্তচমৎকারী একটি আবহ তৈরি করে। গার্সিয়া লোরকা ফ্লামেংকো নৃত্যরত নারীকে বর্ননা করেছেন এভাবে –

“পূর্নিমার আলোয় বিভোর নারী
যেনবা এক একটি বিমোহিত চাঁদ …”

ফ্লামেংকো নৃত্যে মূল কেন্দ্রীয় চরিত্রটি দ্ব্যর্থকভাবে স্পিরিচুয়াল এবং প্রলুব্ধকর, তাই মনে হয় এটি যেন কামো্দ্রেককারী একটি প্রথা। খ্রীষ্ট ধর্মীয় উৎসবের সময় যেমন কুমারী মূর্তিটিকে সড়ক দিয়ে পরিভ্রমন করানো হয়, ফ্লামেংকো নৃত্যশিল্পীও তেমনি একটি সুন্দর চরিত্র, যা ভালবাসা এবং মাতৃসত্ত্বা, শক্তি এবং নিরাপত্তার প্রতীকি রুপ ধারণ করে। এটি একটি হিস্পানিক এবং হিস্পানিক আমেরিকার সংস্কৃতির পোশাকি অলংকরনের এক অদ্ভুতরকম প্রতিফলন, যা মূলতঃ প্রেম, যৌনময়তা, সহিংসতা, গীতিময়তা এবং নান্দনিক আকাংক্ষায় সন্নিবেশিত ভাব-আবেগের নান্দনিক প্রকাশ।

হিস্পানি সাহিত্যেও ফ্লামেংকো একটি বড় স্থান জুড়ে রয়েছে। যার প্রমান ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সাহিত্য কর্ম। যিনি তার লেখনি শক্তির প্রেরনা পেয়েছিলেন জিপসী সংস্কৃতি থেকে। বিশেষভাবে তাঁর “Romancero Gitano” এবং “Poema del Canto Jondo” এই দুইটি কাব্যগ্রন্থে ফ্লামেংকো ঐতিহ্য সুদূর অতীত থেকে চড়াই-উৎরাই এবং নতুন ধারার মিশেলে এখন এক বিষ্ময়কর স্নিগ্ধ চাঁদের মতো, এবং বর্তমান হিস্পানিক সংস্কৃতির ফ্লামেংকো যেন সেই চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় লালিত এক মোহনীয় পূর্নিমা।

ছবি: ইন্টারনেট
লেখার তথ্য উৎস: দুটি বই। এখন আর নামটাম মনে নাই।

১,৪৭৯ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “ফ্লামেংকো”

  1. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    ভিড্যু দুইটা ভালো লাগছে।
    সবচেয়ে বড় জিনিস হলো নতুন একটি জিনিসের সাথে পরিচিত হলাম এই ব্লগ না পড়লে হয়তো কস্মিৎকালেও যার নাম শোনা হতো কিনা সন্দেহ।
    চমৎকার পোস্টের জন্য রাব্বী ভাইরে ::salute::

    জবাব দিন
  2. আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

    ফ্লেমেঙ্কো মিউজিক অসম্ভব ভালো লাগে, কিন্তু আফসোস- বাজাতে পারি না।

    মূলত: এটার জন্য এক্যুস্টিক গিটার ব্যবহার হয়ে থাকে সবসময়, যেটাকে আমরা 'স্প্যানিশ গিটার' নামে চিনি। আরেকটু ভালভাবে বললে "ক্লাসিকাল গিটার", যেটার তারগুলি নাইলনের হয়। খুব চমৎকার আওয়াজ, পিয়ানো-পিয়ানো শুনায় কখনও কখনও!

    আমাদের সিসিবির ইমোগুলির মধ্যে Mr. :guitar: কে কিন্তু ওরকম একটা ক্লাসিকাল গিটার-ই বাজাতে দেখা যাচ্ছে। 😉

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    নতুন বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ রাব্বী ভাই :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।